আমাজনের অরণ্য। নামটা শুনলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ঘন ও দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় ব্ল্যাক প্যান্থার আর জাগুয়ারের দল। জলাভূমিতে গিজগিজ করে কুমির আর গ্রিন অ্যানাকোন্ডা। নদীর জলে মৃত্যুদূত হয়ে ওঁৎ পাতে ইলেকট্রিক ইল আর পিরানহা মাছ। গাছের ডালপালায় জাল পেতে রাখে বিষাক্ত ট্যারেন্টুলা মাকড়সা।
দক্ষিণ আমেরিকার ৯ টি দেশের, ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশ্বের এই বৃহত্তম রেনফরেস্ট। বুক চিরে অ্যানাকোন্ডার মতই এঁকেবেঁকে এগিয়েছে আমাজন নদী। অরণ্যটির প্রায় ৬০% রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকি ২৭% রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানাতে।
আজ থেকে পাঁচ কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ বছর আগে, ইয়োসিন ( Eocene) যুগে আমাজন অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। একদম বিরল জাতের প্রাণী, উদ্ভিদ ও পতঙ্গদের বাসভূমি এই আমাজন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রজাতিই আমাজন ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
আমাজনের গভীরে বাস করে প্রায় ১১৩ টি আদিম উপজাতি
আমাজনের গভীরে এমন অনেক উপজাতি আছে যাদের কথা পৃথিবী জানে না। যারা সভ্য সমাজ থেকে হাজার হাজার বছর ধরে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে আছে। আমাজনের আদিম জনজাতিদের নিয়ে কাজ করে ব্রাজিলের একটি সরকারি সংস্থা। নাম তার FUNAI (Fundação Nacional do Índio)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এই ২০১৯ সালেও আমাজন অরণ্যের বিপদসংকুল স্থানে বাস করে প্রায় ১১৩ টি আদিম উপজাতি গোষ্ঠী। যাদের সঙ্গে তথাকথিত সভ্য জগতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
এই সমস্ত উপজাতিরা, বাইরের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় না। তাদের সঙ্গে জোর করে যোগাযোগ করতে গেলে, পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর। তাদের ডেরার কাছাকাছি গেলেই বিষাক্ত তির বা ব্লো-পাইপ থেকে ছুটে আসা শলাকা বিঁধে নিশ্চিত মৃত্যু।
এই ১১৩ টি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে, এখনও পর্যন্ত মাত্র ২৭ টি উপজাতির ছবি তোলা গেছে। বাকি ৮৬ টি উপজাতি গোষ্ঠীর উপস্থিতি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা গেলেও, দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভেতরে থাকার কারণে তাদের ছবি তোলা যায়নি।
সুড়ঙ্গ-মানব
এ হেন ভয়ঙ্কর ও দুর্ভেদ্য আমাজন অরণ্যের কেন্দ্রস্থলে বাস করে একজন মানুষ। সম্পূর্ণ একা। মাঝে মাঝে তাকে গভীর জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। আবার কয়েক বছরের জন্য গভীর জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে নিজের ইচ্ছাতেই সে হারিয়ে যায়।
মানুষটির ছবি প্রথম তোলা হয় ১৯৯৬ সালে। গবেষকরা ব্রাজিলের রোন্দোনিয়া প্রদেশের জঙ্গলে তাকে এক ঝলক দেখতে পান । ২০১৯ সালে আবার দেখা গেল সেই নিঃসঙ্গ উপজাতীয় মানুষটিকে। রহস্যময় মানুষটির নাম দেওয়া হয়েছে সুড়ঙ্গ-মানব।
মানুষটির বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। মনে করা হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স্ক মানুষটি আমাজনের মত দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ২৪ বছর ধরে একা বাস করছে। সম্প্রতি তাকে আবার দেখতে পাওয়া গেছে। তাই ভীষণ খুশি FUNAI সংস্থার কর্মীরা। সুড়ঙ্গ-মানব তাহলে বেঁচে আছে।
কেন একা একা থাকে সুড়ঙ্গ-মানব!
একদিন তার দল ছিল। আজ নেই। তাই সে একা। গবেষকরা বিশ্বাস করেন বিংশ-শতাব্দীর শেষ ভাগে আমাজনের জমিতে সভ্যতার চরম থাবাটি পড়ে। জঙ্গলের ভেতর কৃষি জমির সন্ধানে, কাঠ ও অন্যান্য সম্পদের লোভে পালে পালে ঢুকে পড়ে সভ্য জগতের মানুষরা।
জঙ্গলের ভেতরে থাকা উপজাতিদের থেকে কৃষি জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অনেক আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। কিছু উপজাতি, আমাজনের আরও গভীরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হিংস্র বন্যপ্রাণী ও সাপের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই শুরু করে।
১৯৯৫ সালে শেষবারের মতো লোভী কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আক্রমণ করে আদিম জনজাতিদের। সেই সময় এই রহস্যময় সুড়ঙ্গ-মানবের উপজাতি দলটি আক্রমণের মুখে পড়েছিল। আদিম জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত দলটি ছোট হয়ে গিয়েছিল আগেই। মাত্র ৬ জন ছিল শেষ দলটিতে। পাঁচজনই মারা পড়ে, ভাগ্যবলে বেঁচে যায় সুড়ঙ্গ-মানব। সেই আদিম উপজাতির দলের শেষ প্রতিনিধি।
১৯৯৫ সাল থেকে ২৪ বছর ধরে একা ভয়াল ভয়ঙ্কর আমাজন অরণ্যে একা বেঁচে আসছে মানুষটি। কখনও তাকে জঙ্গলের বাইরে আসতে দেখেনি কেউ। বছরের পর বছর জঙ্গলে পড়ে থেকেও ফটোগ্রাফাররা তার একটির বেশি ছবি তুলতে পারেনি। আর তুলেছে একটি ভিডিও। ভিডিও থেকেই ছবি বের করে গবেষণা চালাচ্ছেন গবেষকরা।
কী ভাবে থাকে সুড়ঙ্গ-মানব!
আমাজনের কেন্দ্রস্থলে, প্রায় একশো কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সকলের অলক্ষে ঘুরে বেড়ায় সুড়ঙ্গ-মানব। মানুষটিকে আবিষ্কার করার পর FUNAI তার গতিবিধির দিকে নজর রেখে চলেছে। সংস্থাটি কড়া নিয়ম করেছে, কেউ সুড়ঙ্গ-মানবের সাথে কথা বলতে বা যোগাযোগ করতে পারবেন না। তাই সুড়ঙ্গ-মানবকে নিয়ে গবেষণা করা অত্যন্ত কঠিন।
এই কড়া নিষেধাজ্ঞার জন্য, কেউ জানে না মানুষটির নাম। তার গোষ্ঠীর নাম। কিন্তু একটা জিনিস জানা গেছে, মানুষটি আমাজন অরণ্যের ভিতর সুড়ঙ্গ কেটে রেখেছে। সুড়ঙ্গ-মানব জীবিত আছে কিনা জানতে রহস্যময় এলাকাটিতে গিয়েছিলেন FUNAI সংস্থাটির কিছু কর্মী। তাঁরা দেখেছেন বিরাট এলাকা জুড়ে কয়েকশো গভীর গর্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গবেষকরা মনে করছেন গর্তগুলি পশু ধরার ফাঁদ।
মানুষটি খাদ্যের জন্য আদিম পদ্ধতিতে পশু শিকার করে চলেছে। অনেক গর্ত সুড়ঙ্গের মত অনেক দূরে চলে গেছে। বিপদের হাত থেকে বাঁচতে ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বসবাস করার জন্য, সুড়ঙ্গ-মানব সম্ভবত সেই সুড়ঙ্গগুলি বানিয়ে নিয়েছে।
সারাদিন কী করে কাটায় সুড়ঙ্গ-মানব!
FUNAI সংস্থাটির কর্মীরা দেখেছেন, মানুষটি সারাদিন, জঙ্গলের ভিতর প্রচুর পরিশ্রম করে। আমাজনের একেবারে কেন্দ্রস্থলে আদিম পদ্ধতিতে নিজের প্রিয় সবজি নিজেই চাষ করে। একটা ছোট্ট ঘাসে ছাওয়া কুঁড়ে ঘরও আছে তার। ঘরটির চারদিকে ভুট্টা, পেঁপে গাছের চাষ করেছে সুড়ঙ্গ-মানব।
বড় বড় গাছে শিম্পাঞ্জীর দক্ষতায় তরতরিয়ে ওঠে সে। পরনে বস্ত্র বলতে, এক চিলতে পশুর ছাল। FUNAI জানিয়েছে, কঠিন ও ভয়ঙ্কর পরিবেশে আদিম মানবের মতোই মানিয়ে নিয়েছে সুড়ঙ্গ-মানব। সংস্থার কর্মীরা ঘাসের কুঁড়েটির সামনে অসংখ্য হাতে তৈরি আদিম যন্ত্রপাতিও দেখতে পেয়েছেন। মানুষটির স্বাধীনতা ও তার বিচরণ এলাকা সুরক্ষিত রাখার জন্য FUNAI তার জন্য সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
ক’দিন সুরক্ষিত রাখা যাবে সুড়ঙ্গ-মানবকে!
সুড়ঙ্গ-মানবের দিকে এখন সারা বিশ্বের নজর পড়েছে। সুড়ঙ্গ-মানবের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই চিন্তিত FUNAI সংস্থাটি।আদিম উপজাতিদের বাঁচাতে ১৯৯০ এর দশকে ‘তানারা ইন্ডিজেনাস রিজার্ভ’ নামে আমাজনের কোর এলাকাকে সংরক্ষিত করলেও, প্রতি মুহূর্তে সেখানে হানা দিচ্ছে বাইরের মানুষ।
সুড়ঙ্গ-মানবের ছবি তুলতে পারলেই এখন কোটিপতি হওয়ার সুযোগ। সেই ভয়ও পাচ্ছে সংস্থাটি। একুশ শতকে এসেও হেলায় সভ্যতার আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাজনের অন্ধকারকে বেছে নিয়েছে সুড়ঙ্গ-মানব। ২০০০০ বছর আগে যে ভাবে বাঁচত তার পুর্বপুরুষ, ২০১৯ সালে সে ভাবেই বাঁচছে সুড়ঙ্গ-মানব।
সুড়ঙ্গ-মানব ভয় পায় না জাগুয়ার কিংবা অ্যানাকোন্ডাকে। তার ভয় সভ্য জগতের মানুষকে। যারা, তার বাবা-মা-ভাই-বোন-স্ত্রী এমনকী দুধের শিশুদেরও মেরে ফেলেছে। যে জমাট ব্যথা বুকে নিয়ে আমাজনের গভীরে ঘুরে বেড়ায় সুড়ঙ্গ-মানব,তা কোনও দিন সভ্য জগত জানতে পারবে না। এক বুক হতাশা আর অভিমান নিয়ে, আমাজন অরণ্যের জমাট অন্ধকারেই চিরতরে হারিয়ে যাবে নিঃসঙ্গ সুড়ঙ্গ-মানব।
আমাজন অরণ্যের গভীরে একা থাকে রহস্যময় সুড়ঙ্গ-মানব। ফের দেখা মিলল তার