আমার প্রিয় কবি রচনা
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রিয় কবি
বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালের ২৪ মে জন্মগ্রহণ করা ছেলেটিই যে একসময় বাংলাসাহিত্যের সেরা কবি হয়ে উঠবে সেদিন কেউ কল্পনাই করতে পারে নি। বাবা-মা এই ছেলেটির নাম রেখেছিলো দুখু মিঞা, যার পোশাকী নাম আমাদের সবার পরিচিত প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম। কবির পূর্বপুরুষগণ ছিলেন পাটনার অধিবাসী, সেখান থেকেই এসেছিলেন চুরুলিয়ায়। চুরুলিয়া এখন বিখ্যাত কাজী নজরুল ইসলামের জন্যই।
মাত্র আট বছর বয়সে বালক নজরুল বাবাকে হারান। এ আর এমন কী বয়স! তবুও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দশ বছর বয়সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিলো তাঁকে।
১৯০৯ সালে মক্তব থেকে প্রাইমারি পরীক্ষা পাশ করার পর বন্ধ হয়ে যায় তাঁর লেখাপড়া। মক্তবের এক মৌলভী সাহেবের কাছে নজরুল আরবী-ফারসি মিশ্রিত বাংলা ভাষা শেখেন এবং সেই শেখা থেকেই শুরু করেন কবিতা-ছড়া-পালা-গান ইত্যাদি লেখা। এর পাশাপাশি অর্থকষ্ট দূর করার জন্য মক্তবের ছেলেদের পড়াতেন, মাজারে খাদেমগিরি এবং গ্রামে মোলস্নাগিরি করতেন। এই যত্সামান্য আয় দিয়েই শুরু হয় তার কর্মজীবন। কিন্তু এই আয়ে যে সংসার চলে না? তাই শুরু করেন ‘লেটো’ দলের পালা-গান লেখার কাজ। মক্তবে মৌলভী সাহেবের কাছে যা শিখেছিলেন সেটাই ছিলো তাঁর পুঁজি। ‘লেটো’র গান অতো পরিশীলিত ছিলো না, গ্রামের মানুষদের জন্য তার প্রয়োজনও পড়তো না। ফলে, অল্প সময়েই নজরুলের খ্যাতি গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এসব লিখে আনন্দও পেতেন বেশ। এই লেখালেখির সূত্রেই আরবী-ফারসী-বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মে এবং নানান দেশি-বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে কবিতা-গান লেখার শুরুটা সহজ হয়ে যায়।
তিনি তাঁর ছোটবেলার কোনো কবি-সাহিত্যিকের সান্নিধ্য লাভ করেন নি, তিনি যা লিখছেন তা কিছু হচ্ছে কি না, তা তাকে কেউ কখনও বুঝিয়েও বলেন নি। তিনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যা মনে আসতো তা-ই লিখে ফেলতেন। এই অল্প বয়সেই তিনি কয়েকশ’ মারফতী, পাঁচালি, ব্যঙ্গ, বঙ্গ-মারফতি ইত্যাদি গান এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাটিকা লিখে ফেলেছিলেন। সেগুলোর হয়তো সাহিত্যমূল্য ছিলো না, কিন্তু কবির পরবর্তী সাহিত্য-সংগীত জীবনে এগুলোই ছিলো তাঁর দাঁড়িয়ে যাবার ভিত্তি। তাঁর পরবর্তী জীবনে লেখা ‘সেতু-বন্ধ’ অথবা ‘শকুনি বধ’ নাটকগুলো তাঁর বালকবেলার লেখা নাটক-নাটিকারই উন্নততর পরিমার্জনা বা সংস্করণ বলে নজরুল-গবেষকগণ মনে করেন।
‘লেটো’র দল ছেড়ে ছন্নছাড়া নজরুল আবার ভর্তি হয়েছিলেন মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়বার জন্য কিন্তু আর্থিক অনটনে পড়তে পারেন নি। পরে আসানসোলে গিয়ে রুটির দোকানে কাজ নিয়েছিলেন, দোকানে জোগালি ও বাবুর্চির কাজের পাশাপাশি কিশোর নজরুল সবাইকে গান গেয়ে শোনাতেন।
তাঁর নিজের লেখা ও সুর করা সেইসব গান শুনে সবাই মুগ্ধ হতো। আসানসোলে কর্মরত এক পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নজরুলের প্রতি মায়া জন্মে যাওয়ায় তাকে নিয়ে গিয়ে নিজ বাড়িতে কাজে লাগান এবং পরে তাকে তার বাড়ি ময়মনসিংহের দরিরামপুরে নিয়ে গিয়ে হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। সপ্তম শ্রেণী পাশ করে অষ্টম শ্রেণীতে উঠলেও দরিরামপুর নজরুলকে আটকে রাখতে পারে নি। তিনি যে ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুল, তাই ফিরে যান বর্ধমানে। সেখানে রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুলে অষ্টম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন, কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা আর দেয়া হয় নি, তিনি যোগ দেন সেনাদলে। যুদ্ধ করবেন, ১৯১৭ সাল, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া এই পর্যন্তই হয়েছিলো এই বিখ্যাত কবির। নজরুলের আলোচকদের মতে, ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত করাচীতে সেনাদলে থাকার সময়ই তাঁর পরবর্তী জীবনের ভিত্তিমূলের সন্ধান পাওয়া যায়। এই তিন বছরে ‘উন্মেষ ঘটে তাঁর বিদ্রোহী সত্তার এবং এখান থেকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রারম্ভকাল সূচিত হয়।
তাঁদের মতে, করাচীর সেনানিবাস থেকেই তিনি প্রকৃত সাহিত্য-সাধনা শুরু করেন এবং পত্র-পত্রিকায় হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে।
এই হচ্ছে মোটামুটিভাবে কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব-কৈশোরের কথা। করাচি থেকে ফিরে এসে ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত আমরা যে কাজী নজরুল ইসলামকে পাই সেই নজরুলই এক বিস্ময়কর মানুষ আমাদের কাছে। তাঁর সকল সৃষ্টি এই তেইশ বছর কালেই। প্রথম দশ বছর তিনি প্রধানতঃ সংগীতের জন্য নিবেদিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি বাকশক্তিরহিত হয়ে যান এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪২ সালের পর তিনি আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন নি। দেশ-বিদেশের বহু চিকিত্সক তাঁর চিকিত্সা করলেও তিনি আর সুস্থতা ফিরে পান নি।
মাত্র তেইশ বছরের বিস্ময়কর সৃষ্টি কর্মসমূহ আমাদের সত্যিই অবাক করে দেয়।
বাংলা সাহিত্য-সংগীতে এমন বহুবর্ণিল সৃষ্টি একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই সাধন করতে পেরেছেন। একুশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর, এর মধ্যে চারটি তাঁর অসুস্থ হবার পরে প্রকাশিত। কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে তিনটি, যেখানে কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের কবিতাও রয়েছে। ছোটদের কবিতার বই লিখেছেন ১৩টি, উপন্যাস ৩টি, গল্পগ্রন্থ ৪টি, নাটক ৩টি, ছোটদের নাটক একটি, প্রবন্ধগ্রন্থ ৫টি, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন ২টি। ভাবা যায়, একজন কবি এতো কিছু লিখতে পারেন! ১৯২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রায় ৫০টি কবিতা ও গান প্রকাশিত হয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আগমনকে সুনিশ্চিত করেছিলো।
১৯৩০ থেকে ১৯৪২ সময়কালে নজরুল বেশিরভাগ সময় তাঁর সংগীত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
বিভিন্ন ভাব-রস ও সুরের হাজার হাজার গান এতো অল্প সময়ের মধ্যে রচনা করেছেন এমন নজির বিশ্বের সংগীতের ইতিহাসে নেই। এই বিশাল মানুষটিকে জানতে হলে তাঁর বিশাল সৃষ্টিকে আমাদের পড়তে হবে, জানতে হবে। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং একজন প্রকৃত মানবপ্রেমিক। তিনি ইসলামী গান যেমন লিখেছেন, কবিতা যেমন রচনা করেছেন, তেমনি শ্যামাসংগীতও রচনা করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় হিন্দু ও মুসলিম পুরাণকে ব্যবহার করেছেন, সংস্কৃত শব্দকে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেন নি। তাঁর এই চিন্তাভাবনার জন্য অনেকের প্রিয় যেমন হয়েছেন, তেমনি অনেকের কাছেও ছিলেন অপ্রিয়। কিন্তু সেইসব অপ্রিয় মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর করুণা করা ছাড়া উপায় ছিলো না। কেননা, নজরুল জানতেন, বাঙালি সম্প্রদায় এক বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তিনি তারই উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন উত্সর্গ করে গেছেন। নজরুল এতো বড়ো কবি ও শিল্পী যে তাঁকে পরিমাপ করবার জন্য আমাদের প্রতিনিয়তই ফিরে যেতে হবে তাঁর কবিতা ও সুরের কাছে।
আমাদের সৌভাগ্য ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে ১২ ভাদ্র তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার শাহবাগে তাঁর সমাধি রয়েছে।
আমার প্রিয় কবি রচনা ২
ভূমিকা:
আবহমান গ্রামবাংলার অকৃত্রিম রূপকার কবি জসীমউদ্দীন। বাংলা সাহিত্যে তিনি পল্লিকবি’ হিসেবে খ্যাত। তিনিই আমার প্রিয় কবি। তার কবিতা পল্লিপ্রকৃতি আর পল্লিজীবনেরই অনাড়ম্বর সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কবিতায় মেঠো সুরের যে আলাপন তা মুগ্ধ করে সবাইকে মুগ্ধ করেছে আমাকেও। তার কবিতায় পল্লি রাখালের যে বাঁশির সুর তা যেন আমারই। প্রাণের সুরকে রূপ দিয়েছে। নগরজীবনের ব্যস্ততায় জসীমউদ্দীনের কবিতা এক অনাবিল প্রশান্তির পরশ।
কেন প্রিয় কবি:
কবিতা পাঠ ও কবিতা আবৃত্তি সবসময়ই আমার প্রিয় বিষয়। তাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ
প্রমুখ কবির কবিতা পড়া হয়েছে অনেক। নাগরিক জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানা ভাবনা প্রকাশেই তারা তৎপর ছিলেন। কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতায় পল্পির শ্যামল স্বর্ণশ্রী, শ্যামল দূর্বা, তরুছায়া, পল্লিবালার ঘরকন্না অপূর্ব মাধুর্য নিয়ে ধরা পড়েছে। তাই হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত পল্লিগ্রাম আমি খুঁজে পাই একমাত্র জসীমউদ্দীনের কবিতায়। আমার কাছে তাই তিনি প্রিয় কবি হিসেবে সমুজ্জ্বল।
জন্ম ও শিক্ষা:
জসীমউদদীনের জন্ম ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি । পিতা মৌলভি আনসার উদ্দীন ছিলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। মা ছিলেন সরলা স্নেহময়ী পল্লিরমণী । জসীমউদ্দীনের পিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং স্বাভাবিক কবিত্বশক্তিও তার ছিল । উত্তরাধিকার সূত্রে জসীমউদ্দীন এসব পৈতৃক গুণের অধিকারী ছিলেন। শৈশবে পিতামাতার তত্ত্বাবধানে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় । ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে তিনি ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২৯ সালের বিএ পাস করেন। ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এমএ পাস করেন।
কর্মজীবন:
স্কুলের ছাত্রাবস্থায় জসীমউদ্দীনের কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিনি দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পল্লিগীতি সংগ্রাহক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত সংগ্রাহকের কাজ করেন। পরবর্তীতে এমএ পাস করার পর ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৪৪ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কবি সরকারের প্রচার বিভাগে কার্যরত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে কবি পরলােকগমন করেন ।
কাব্যচর্চা:
বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় জসীমউদ্দীনের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে । নগরভিত্তিক শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে মানবমন যখন নির্মল শান্তির অন্বেষণে অস্থির, তখনই কবিতায় ভিন্ন স্বাদ নিয়ে হাজির হন জসীমউদ্দীন। যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে তিনি পল্লিনির্ভর কাব্য রচনা করে এক নবআন্দোলনের জন্ম দেন । পল্লির জীবন, পল্লির প্রকৃতি যেন স্বরূপেই তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে। কলেজের ছাত্রাবস্থায় পল্লিবৃদ্ধের বেদনাতুর হৃদয়কে অবলম্বন করে রচিত ‘কবর’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পল্লিবৃদ্ধের স্বজন হারানাের ব্যথা ছুয়ে যায় সবার অন্তর। জসীমউদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’, এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’ ও ‘পল্লিজননী’ স্থান পেয়েছে। রােগাক্রান্ত ছেলের মুক্তি কামনায় দুঃখিনী মায়ের হৃদয়ের যে আকুলতা কবি এঁকেছেন তা চিরকালের স্নেহময়ী পল্লিমায়েরই প্রতিরূপ । কবির ভাষায়—
‘নামাজের ঘরে মােমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে আমার ভালাে কোরে দাও, কাদে জননীর প্রাণ।
ভালাে করে দাও আল্লাহ রছুল! ভালাে করে দাও পীর!
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।’
জসীমউদ্দীনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নকশীকাঁথার মাঠ’। এতে এক পল্লিকিশাের ও পল্লিকিশােরীর বেদনামধুর প্রেমকাহিনি অপূর্ব কাব্যিক রূপ পেয়েছে। গ্রন্থটি ইংরেজিতে ‘Field of the embroidered (Quilt’ নামে অনূদিত হয়ে জসীমউদ্দীনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী করেছে | জসীমউদ্দীনের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে- ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘সকিনা’, ‘বালুচর, ধানক্ষেত’, ‘রূপবতী’ ও ‘মাটির কান্না, শিশুদের জন্য তিনি হাসু’ ও ‘এক পয়সার বাঁশি’ নামে দুটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। পল্লিজীবন ও পল্লিপ্রকৃতিকে ভালােবেসে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি বাংলার বিপুল লােকসাহিত্য সম্পদকে সার্থকতার সাথে তাঁর কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন ।
কাব্যিক বৈশিষ্ট্য:
জসীমউদদীনের কবিতায় গ্রামবাংলার মানুষের ছবি উঠে এসেছে গভীর মমতায়, আন্তরিকতায় ও
নিরবচ্ছিন্নতায় । গ্রামীণ জীবনকে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে জসীমউদ্দীন প্রকৃতি ও মানুষকে একই সরলরেখায় এনেছেন, যা দিয়ে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক অবস্থানকে চিহ্নিত করেছেন। ফলে দুঃখ, দারিদ্র্য, বঞনা ও বিড়ম্বনা নিয়ে গ্রামের মানুষের যে বিবর্ণ জীবন তা ধরা পড়েছে স্পষ্টভাবে। তিনি আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের চাহিদা ও রুচিকে মূল্য দিয়ে প্রকরণগত দিক থেকে পল্লিকবিতাকে আধুনিক শৈল্পিক পরিচর্যায় সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। তাই তাঁর কবিতার মেঠোসুর মুগ্ধ করে সবাইকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ জসীমউদ্দীনের মূল্যায়ন করে বলেছেন- ‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের।’
গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক গতিই জসীমউদ্দীনের কবিতাকে গতিশীল করেছে। গ্রামের মানুষের সহজ-সরল অনুভূতি ও প্রেম ভালােবাসার সুখ-দুঃখ-বেদনায় বিজড়িত জীবনের ভেতর বাহির তিনি চিত্রিত করেছেন তাঁর কবিতায়। একজন চিত্রশিল্পীর দৃষ্টি ও যােগ্যতা নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। ফলে তার গ্রামীণ জীবনের কবিতা হয়ে উঠেছে –
‘কাচা ধানের পাতার মতাে কচি মুখের মায়া
লাল মােরগের পাখার মতাে ওড়ে তাহার শাড়ি
শুকনাে চেলা কাঠের মতাে শুকনাে মাঠে ঢেলা।’
তবে জসীমউদদীনের কবিতা মূলত পল্পিনির্ভর হলেও নাগরিক জীবনের ভাবনাও তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়। এ ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় তার বালুচর’, ‘রূপবতী’, ‘মাটির কান্না’, ‘জলের লেখন’, ‘হলুদ বরণী’ ইত্যাদি কাব্যে।
উপসংহার:
পল্লিপ্রকৃতির সকল অভিজ্ঞতার প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া কবি জসীমউদ্দীন। গ্রামকে তিনি দেখেছেন অখণ্ড রূপে। গ্রাম ছিল তার কাছে পরিপূর্ণ এক বিশ্ব। তিনিই প্রথম কবি যিনি গ্রামীণ উপকরণই শুধু নয় গ্রামের মানুষের ভাব, ভাষা, কল্পনা প্রবণতা, মেজাজ তথা অন্তর্গত ভঙ্গিকে কাব্যে ধারণ করতে পেরেছিলেন। তাই একমাত্র তাঁর কবিতায় আমি খুঁজে পাই আমার স্বপ্নময় গ্রামের অকৃত্রিম ছবি । নগর সভ্যতার যান্ত্রিকতার বিপরীতে জসীমউদ্দীনের পল্লিবাসীর ভালােবাসার আকর্ষণ বােধ আমাকে মুগ্ধ করে। তাই তিনিই আমার প্রিয় কবি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক পল্লিকবি’ হিসেবে কবি জসীমউদ্দীন অমর থাকবেন চিরদিন।
আমার প্রিয় কবি রচনা ৩
ভুমিকা : আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম দেশে-বিদেশে বিদ্রোহী কবি, বুলবুল কবি বলে পরিচিত। তাঁর কাব্যে পরাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মানব মর্যাদা ও সৌন্দর্যচেতনা সমন্বিত হয়েছে।
জন্ম : কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন।
কেন তিনি আমার প্রিয় : নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা আমাকে মুগ্ধ ও আকর্ষণ করে। “বল বীর চির উন্নত মম শির’ একথা বলেই তাঁর ‘বিদ্রোহী’ নামক প্রসিদ্ধ কবিতা আরম্ভ। এ কথা কয়টি উচ্চারণ করার সাথে সাথে পাঠক ও শ্রোতা মাত্র যেন অন্য জগতে নীত হয়। আবার দুনিয়ায় অবিচার ও জুলুমবাজির প্রবাহ চলছে। মানুষের পরাধীনতা ও গােলামীর জিঞ্জির আজও ছিন্ন হয়নি। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মক্ষেত্রের অবিচার-অনাচার আজ আকাশপর্শী হয়ে উঠেছে। মূর্তিমান অন্যায় ও অকল্যাণ জগদ্দল পাষাণের মত মানুষের বুকে চেপে আছে। মজলুম মানুষের কান্নার জলে আজ আকাশ-বাতাস আবিল হয়ে ওঠেছে। তার বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ না করে থাকতে পারে না। যতদিন পৃথিবীর বুক হতে পাপ-তাপ দূর না হবে, ততদিন কোন সমাজ-সচেতন মানুষ শান্ত হতে পারে না। তাই কবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাকেও বলতে ইচ্ছা হয়
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রােল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”
নজরুল ইসলামের বিদ্রোহের সুর তার প্রথম দিকের কাব্য রচনার প্রায় সবগুলােতেই অল্প-বিস্তর রয়েছে। তাঁর ‘অগ্নিবীণা, ‘ভাঙ্গার গান’ প্রভৃতি গ্রন্থে এর পরিচয় পাই। আগুনের মত উজ্জ্বল ও প্রােজ্জ্বল এসব বইয়ের কবিতাগুলােতে ভাবের সাথে। ভাষার সংগতি ও মিল অনবদ্য। মানুষের কবি নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাকে কাব্য ও গানে রূপ দান করেছেন। তাঁর রচিত দেশাত্মবােধক গান আজ ভারত উপমহাদেশের মানুষের মুখে মুখে, সভায় সভায় , আসরে আসরে গীত হয়।
ইসলামী ভাবধারা : নজরুল ইসলামের আর একটি বড় দান হল এই যে, তিনি ইসলামী ভাবধারাকে তাঁর কাব্য প্রথম সুন্দরভাবে রূপ দান করেছেন। তাঁর ‘জিঞ্জির’-এর বিভিন্ন কবিতায় এর অনবদ্য পরিচয় মিলে। তাঁর রচিত গজলেও ইসলামী ভাবধারার সুষ্ঠু প্রয়ােগ দেখতে পাই। এসব কারণেই নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার পাঠকদের মন জয় করেছেন। আর এজন্যই তাঁর কবিতা আমার খুব ভাল লাগে।
মৃত্যু : ইংরেজি ১৯৪৫ সালের দিকে কবি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ১৯৭২ সালে কবিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং নাগিরিকত্ব দেয়া হয়। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে (১২ই ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) তিনি ঢাকায় শেষ নিস্বাশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাকে সমাহিত করা হয়।
উপসংহার : কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় শক্তি সাহস এবং চরিত্রের বাস্তব প্রতিমর্তি। আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধিতে তার বহু অবদান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাঁর নামে ঢাকায় নজরুল ইনস্টিটিউট স্থাপন হয়েছে। আমাদের উচিত তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা।
আজকে আমরা আপনাদের আমার প্রিয় কবি রচনা দিয়েছি আশা করি আপনাদের অনেক উপকার হয়েছে।
রচনা আমার প্রিয় বিষয়, আমার প্রিয় বই পথের পাঁচালী, আমার প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান রচনা, তোমার প্রিয় বই সম্পর্কে জানিয়ে বন্ধুর নিকট পত্র, প্রিয় লেখক প্রিয় বই, আমার পড়া একটি বইয়ের গল্প রচনা class 6, আমার প্রিয় উপন্যাস