আসিফ মহিউদ্দিন একজন স্বঘোষিত নাস্তিক। সে কমিউনিজমে বিশ্বাসী। শাহবাগে প্রথম সমাবেশে সে একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেয়। একটি ছবিতে দেখা যায় এ ধরনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ইসলামবিদ্বেষী বৃহৎ দলের বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওইদিন তাকে পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
আসিফ মহিউদ্দীন (জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪) একজন বাংলাদেশী নাস্তিক্যবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ কর্মী, ধর্মীয় সমালোচক এবং নারীবাদী।[৩] ২০১২ সালে তিনি ডয়চে ভেলে থেকে দ্য ববস-বেস্ট অফ অনলাইন এক্টিভিজম পুরস্কার লাভ করেন, যেখানে বলা হয়, “আসিফের ব্লগ ছিল বাংলাদেশের সবথেকে বেশি পঠিত ওয়েব পাতাগুলোর মধ্যে একটি, এবং এটি বাংলাদেশের ” জন-বিরোধী রাজনীতি” এর ক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদের কঠোর সমালোচনার জন্য পরিচিত ছিল।[৪] ২০১৩ সালের ১৫ই জানুয়ারিতে তিনি ইসলামী চরমপন্থীদের দ্বারা গুপ্তহত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন ও বেঁচে যান।[৫] কয়েক মাস পরে তিনি ইসলাম ও ইসলামের নবীমুহাম্মদকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করার কারণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনবার কারারুদ্ধ হন।[৬] অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের জন্য আসিফ মহিউদ্দীনকে কারামুক্ত করা হয়, তারপর ২০১৪ সালে নিজ দেশ ত্যাগ করে তিনি জার্মানিতে চলে যান এবং এখন পর্যন্ত তিনি জার্মানিতেই অবস্থান করছেন। ২০১৫ সালে তিনি সাংবাদিকতার জন্য অ্যানা পলিটকফস্কায়া পুরস্কার লাভ করেন।
আসিফ মহিউদ্দীন ঢাকার একটি মুসলিম পরিবারে একজন মধ্যম পদমর্যাদার সরকারী চাকুরিজীবীর সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন ও পালিত হন।[৩] তিনি বিদ্যালয় থেকে এসে মসজিদে ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করতেন, সেই ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমি অনেক হাস্যকর বিষয় শিখেছি – যেমন আমি স্বর্গে কুমারী লাভ করব, বা চিরকালের জন্য নরকে চূড়ান্ত শাস্তি ভোগ করব”।[৩] তার পিতামাতার দুঃখের জন্য তিনি তাকে শেখানো ধর্মীয় রীতি নিয়ে বারবার প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন।
তার এই গুরুতর প্রশ্নগুলো এবং শিক্ষকদের প্রশ্নের ভক্তিহীন উত্তরের জন্য তাকে প্রায়ই অনেক মার খেতে হয়েছে।[৮] ১৩ বছর বয়সে তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক বলে ঘোষণা করেছিলেন।[৩] আসিফ মহিউদ্দীন বিজ্ঞান সম্পর্কে পড়তে শুরু করেন এবং ১৬ বছর বয়স (২০০০ সাল) থেকে তিনি ঢাকার সংবাদপত্রগুলোতে ইসলামবাদীদের অবৈজ্ঞানিক দাবিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন।[৩] একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় কুরআনে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাকে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সংগতি আনার এবং যেভাবেই হোক যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারা একে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে এমন একটি প্রবন্ধ পড়ার পর তার এই কাজ শুরু হয়। আসিফ মহিউদ্দীন এর প্রতিক্রিয়ায় একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, নবী মুহাম্মাদের বোরাকে করে স্বর্গে উড়ে যাওয়া বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। এটি এবং ঢাকার বাংলা সংবাদপত্রগুলোতে তার অন্যান্য সমালোচনামূলক ও ব্যাজস্তুতিপূর্ণ প্রবন্ধ মুক্তমনা ও ধর্মীয় সমালোচক হিসেবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
এর ফলে তিনি অন্যান্য সমমনা অনলাইন সক্রিয় কর্মীদেরও সংস্পর্শে আসেন।[৮][৯] মহাবিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে তার উপর মারধর অব্যাহত ছিল। মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তিনি নিজেকে পুলিস সহিংসতা, নারী অধিকার, এবং উন্নততর গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হতে শুরু করেন।[৮] ২০০৬ সালে তিনি ব্লগিং শুরু করেন।[৮] ২০০৮ সালে তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন।[৩] ২০১০ সালে তিনি ঢাকায় বাংলাদেশী মুক্তমনা, নাস্তিক্যবাদী, অজ্ঞেয়বাদী ও অন্যান্য অবিশ্বাসীদের নিয়ে প্রথম সম্মেলনের আয়োজন করেন, যেখানে ৩৪ জন উপস্থিত হয়েছিলেন।[১০]
হামলা ও কারাগারে প্রেরণ আসিফ মহিউদ্দীন পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা, গৃহ নির্যাতন এবং ইসলামে ধর্মত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন,[১১] যার ফলে মৌলবাদীরা তাকে হত্যার জন্য আহ্বান জানায়। ২০১৩ সালে আল-কায়েদার নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির দ্বারা অনুপ্রাণিত চারজন যুবক আসিফ মহিউদ্দীনের উপর তার বাসার বাইরে হামলা করে এবং ছুড়িকাঘাত করে।[১২][১৩] এক মাস পর, বাংলাদেশী ব্লগার এবং অনলাইন এক্টিভিস্টগণ ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরু করেন, যার ফলে হেফাজতে ইসলাম সহ ইসলামী সংগঠনগুলো পালটা মিছিল বের করে এবং তারা ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষকে একত্রিত করে।
তারা দেশে ঈশ্বরনিন্দা আইনের দাবি করেন, এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরকে হুমকি দেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ব্লগারদের শিরোশ্ছেদের জন্য পুরস্কার জারি করা হয়।[১৪] ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশী সরকার আসিফ মহিউদ্দীন সহ অন্যান্য ব্লগারদেরকে কারারুদ্ধ করেন, এবং অনেক ওয়েবসাইটকে ব্লক করে দেয়।[১৫][১৬][১৭] আসিফ মহিউদ্দিন আমেরিকার নাস্তিক সম্মেলন ২০১৫-এ বক্তব্য রাখছেন (ইংরেজিতে)। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে গণ ব্লগিং সাইট সামহোয়্যার ইন ব্লগে আসিফ মহিউদ্দীনের ব্লগকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বন্ধ করে দেয়। একে ২০১৩ বেঙ্গলি ব্লগ ব্ল্যাকআউটের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা হয়। এপ্রিল মাসে, মহিউদ্দিনকে আরও তিনজন ব্লগারের সাথে[১৮] “ঈশ্বরনিন্দামূলক” পোস্টের জন্য গ্রেফতার করা হয়।
[১৯] স্বাধীন ব্লগগুলোতে এরকম কঠোর ব্যবস্থা এবং দৈনিক আমার দেশ সংবাদপত্রকে বন্ধ করে দেয়াকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ[২০] এবং আইএইচইউ (হিউম্যানিস্টস ইন্টারন্যাশনাল) কঠোর সমালোচনা করে।.[২১][২২] ব্লগারদের গ্রেফতারের অল্পসময় পরে, প্রধানত বাঙালি ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত নাস্তিক ও মুক্তমনাদের একটি স্বাধীন ওয়েবসাইট মুক্তমনা থেকে বিবৃতি দেয়া হয় যার শিরোনাম ছিল, “‘Bangladesh government squishing freedom of speech by arresting and harassing young bloggers inside the country” (বাংলায়: দেশের অভ্যন্তরে তরুণ ব্লগারদের গ্রেফতার ও হয়রানির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের দ্বারা বাকস্বাধীনতার দমন)। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও একটি বিবৃতি দান করে যার শিরোনাম ছিল “Bangladesh: writers at risk of torture” (বাংলা্য: “বাংলাদেশ: নির্যাতনের ঝুঁকিতে লেখক”)।
[২৩] সেন্টার ফর ইনকোয়ারি (সিএফআই), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট জন কেরিকে “বাংলাদেশ সরকারকে ধর্মের সমালোচনাকারী নাস্তিক ব্লগারদেরকে গ্রেফতার করার নীতিটি প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে” অনুরোধ করে। তারা ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এর এম্বাসেডর-এট-লার্জ সুজান জনসন কুককে একটি পত্র পাঠায় যেখানে লেখা হয়, “এই পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য তাদের পক্ষে যা করা সম্ভব তা যেন তারা করে”। ফ্রি সোসাইটি ইনস্টিটিউট অফ সাউথ আফ্রিকা, রিপোটারস উইদাউট বর্ডারস, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস, গ্লোবাল ভয়েস এডভোকেসি, এবং অন্যান্য কয়েকটি সংস্থাও বাংলাদেশী ব্লগারদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে এবং বিভিন্ন বিদেশী কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে বাংলাদেশেকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারকে গ্রেফতারকৃত ব্লগারদেরকে মুক্ত করতে চাপ দেওয়ার জন্য ২৫ এপ্রিল এবং ২ মে, ২০১৩ এ বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কয়েকটি মানবতাবাদী সংগঠন (যেমন সিএফইউ, সিএফআই-কানাডা, ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান এথিস্টস, সেকুলার কোয়ালিশন ফর আমেরিকা, এবং মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রিথিংকর্স সহ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশ শহরে অংশ নেয়।[২৪] সালমান রুশদি, তসলিমা নাসরিন, হেমন্ত মেহতা, মরিয়ম নামাজী, পিজি মায়ারস, অভিজিৎ রায়, আনু মুহাম্মদ, অজয় রায়, কাইয়ুম চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ অনেক লেখক, কর্মী এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী গ্রেফতারকৃত ব্লগারদের প্রতি তাদের সংহতি প্রকাশ করেন।[২৪] গ্রেফতারকৃত ব্লগারদের মধ্যে তিনজনকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়,[২৫] তবে আসিফ মহিউদ্দীনের জামিনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং তাকে ২ জুন, ২০১৩ তারিখে জেলখানায় পাঠানো হয়।[২৬] তিন মাস পর তিনি মুক্তি লাভ করেন, কিন্তু তখনও তিনি অভিযুক্ত ছিলেন। এখন তিনি বার্লিন, জার্মানিতে বসবাস করেন।[২৭][২৮]
২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে আসিফ মহিউদ্দীন জার্মানিতে বসবাস করেন, প্রাথমিকভাবে তিনি হামবুর্গ ভিত্তিক স্টিফটুং ফুর পলিটিশ ভারফলগটে (ফাউন্ডেশন ফর দ্য পলিটিকালি রিপ্রেসড বা রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিতদের জন্য সংগঠন) থেকে বৃত্তি পেতেন,[৫] এবং পরবর্তীতে তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালেরও সমর্থন লাভ করেন। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ডয়চে ভেলের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, তিনি জার্মানিতে সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করেন না।
মাত্র কয়েক দিন আগে কোন একজন জার্মানিতে গিয়ে তাকে হত্যা করার ডাক দিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট করেন। সেই পোস্টে ১২০০ জন পছন্দ করেছিল এবং সেটি অনেকবার শেয়ার করা হয়েছিল।[২৯] এমনকি জার্মানিতে বসবাসকারী কিছু মুসলমান বা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে জার্মানিতে আসা অভিবাসীদের কাছেও তার দৃষ্টিভঙ্গি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।[৮] এক বছরের বৃত্তি পাওয়ার পর, আসিফ মহিউদ্দীন পরিকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন না করে জার্মানিতে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে তিনি ইসলামবাদীদের ‘এক নম্বর শত্রুতে” পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন।[২৯] আসিফ মহিউদ্দীন তার ইন্টারনেট কার্যক্রম পরিবর্তন করেনি। তার পুরানো ব্লগ বন্ধ হয়ে যাবার কারণে, তিনি ফেইসবুকে এবং অন্যান্য অনলাইন চ্যানেলে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। ২৯ জুন, ২০১৫ তারিখে তিনি টেনিসির মেমফিসে আমেরিকান এথিস্টস-এর জাতীয় সম্মেলন সহ বিভিন্ন সম্মেলন ও অনুষ্ঠানে তিনি বক্তা হিসেবে জড়িত।[৯]
রাষ্ট্রবিরোধী মামলা[উৎস সম্পাদনা]
২০২০ সালের ৫ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে “আই এম বাংলাদেশি” (I am Bangladeshi) নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারী করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির’ অভিযোগে র্যাব-৩ এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো আবু বকর সিদ্দিক কর্তৃক ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যাতে পেজটি চালানোর দায়ে ছয়জনকে আসামি করা হয় এবং হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথনের জেরে আসিফ মহিউদ্দীন সহ আরও ৫ জনকে আসামী করা হয়।
Source of wikipedia