কখনো সবাইকে খুশি করতে যাবেন না। সবাইকে খুশি করতে যায় বোকা,ব্যক্তিত্ত্বহীন মানুষেরা। খেয়াল করে দেখবেন, অনেক সময় কাউকে ভালো লাগার জন্য কোনো কারণ লাগে না। অকারনেই আপনার ভালো লাগে, আপন লাগে। আবার কোনো কারণ ছাড়াই কোনো কোনো মানুষকে আপনার ভালো লাগবেনা। তাদের ভালো কথা শুনলেও বিরক্ত লাগবে।
আপনার বন্ধু যত ড্রেস পরে,সব ড্রেস কি আপনার পছন্দ হয়? নিশ্চয়ই না। এজন্যই তো শপিং এ এত ধরনের, ডিজাইনের পোশাক রাখা হয়। পৃথিবীতে এত বিচিত্র , এত মডেলের মানুষ। প্রত্যেকটা মানুষের পছন্দ -অপছন্দ, রুচিবোধে পার্থক্য আছে।
আপনি যতই ভালো কাজ করুন না কেনো, কখনো ভেবে বসবেন না যে সবাই আপনাকে বাহবা দেবে! আপনার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে! শুধু তাদের সন্তুষ্টির কথা মাথায় রাখবেন,যাদের সন্তুষ্টি থাকা না থাকায় আপনার আসে যায়। আপনার জীবনের সাথে যারা মিশে আছে। সবাইকে সন্তুষ্ট করার অভ্যাস থেকে বের হতে পারলে অনেক উটকো ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবেন। একটাই তো জীবন।
“Life is too busy to wear boring dress “
©এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
২৬-০৬-২০২১
জন্মের পরই ছেলে মারা যাবে এই অন্ধবিশ্বাসে তাঁর মা তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাসির কাছে। সেই থেকেই তাঁর নাম হয় ক্ষুদিরাম।
১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মেদিনীপুর জেলার মোহবনী গ্রামে জন্মেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। তিন কন্যার পর তিনি ছিলেন চতুর্থ সন্তান। আগেই দুই পুত্র জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিলেন বলে তাঁর মা লক্ষীপ্রিয় দেবী ক্ষুদিরামও দ্রুত মারা যাবেন বলে ভয় পেয়েছিলেন। সেই কারণেই নিজের দিদির কাছে বিক্রী করে দিয়েছিলেন পুত্রকে। তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া।
ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তিনি তার মাকে হারান। এক বছর পর তার পিতার মৃত্যু হয়। তখন তার বড়ো দিদি অপরূপা তাকে দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই তিনি স্বাধীনতা ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েন।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিহারের মুজফ্ফরপুরে ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে বোমা ছুড়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন অত্যাচারী ব্রিটিশ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবকে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত যে গাড়িটিতে তাঁরা বোমা ছুড়েছিলেন তাতে ছিলেন না কিংসফোর্ড। বদলে দুই ইংরেজ মহিলার মৃত্যু হয়।
প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। অল্প বয়সী ক্ষুদিরামকে বিচারক কর্নডফ প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে তো?
স্বাধীনতার আকাঙ্খায় এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক। ফাসির রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ কয়েকটা দিনে কারাগারে বসে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে চেয়েছিলেন। ১০ আগস্ট আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহরব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’
ফাঁসি হওয়ার সময় ক্ষুদিরামের বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস এবং ১১ দিন, যেটা তাকে ভারতের কনিষ্ঠতম ভারতের বিপ্লবী অভিধায় অভিষিক্ত করেছিল।
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, ফাঁসি হয়েছিল শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর। বাংলা তথা ভারত হারিয়েছিল এক আদ্যন্ত নির্ভীক সন্তানকে। স্বাধীনতার স্বপ্নে যিনি মৃত্যুভয়কেও বশ করেছিলেন। এমনকি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁর শেষ কথা চমকে দিয়েছিল উপস্থিত সকলকে। ফাঁসির আগেও ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা ছিল- দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ারই চেষ্টা করা! তিনি বলেছিলেন, তিনি বোমা বানাতে জানেন। ব্রিটিশদের অনুমতি পেলে সেই বিদ্যা ভারতের অন্যান্য যুবকদের শিখিয়ে যেতে চান।
ফাঁসির মঞ্চে এসেও যে প্রশান্তি ছিল তাঁর মনে, তা সবচেয়ে বিস্ময়কর। ১৯০৮ সালের ১১ অাগস্ট জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল দুটি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল। তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ-ফাঁস।
ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে শহীদ ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’ এটাই ছিল বীর শহীদের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ জেলার সহ উপস্থিত সকলে। ফাঁসির আগে কী করে কারোর মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে?
প্রতিকার অসম্ভব জেনেও অন্যায়ের প্রতিবিধানের চেষ্টা করবার ঐকান্তিক প্রবৃত্তি ও সৎসাহস ক্ষুদিরাম চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মৃত্যুর শত বছর পরেও এই উপমহাদেশের মানুষের মনে যিনি আজও অমর। অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।
© হারুন-অর-রশীদ।
(Source:Asianet news Bangla/Amartya lahiri)
পরাজিত মানিক
মৃত সন্তান জন্ম দেয়ায় মানিকের স্ত্রী ডলির অনুভূতি : “বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।”
বড় একটি ভাই ছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের। যখন শুনেছেন ভাই গল্প লেখে, রাজনীতি করে, টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। মৃত্যুর আগে যখন চরম অর্থকষ্টে দিন যায় , বড়ভাইয়ের কাছে টাকা ধার চাওয়াতে উত্তর পেয়েছেন, “আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, আমি কাউকে টাকা ধার দিই না।”
তবু সাহিত্য দিয়ে পেট চালানোর জেদ ছাড়েননি একরোখা মানিক। একবার পূর্বাশা পত্রিকায় চাকরির আবেদন করলেন। যখন শুনেছেন বন্ধুও একই পদে প্রত্যাশী, সম্পাদককে লিখলেন, “আমি অবগত আছি পরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাহার সম্পর্কে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন।’’
সরকারি চাকরিও ছেড়ে দেন, ভালো লাগেনি বলে৷ আদতে মার্কস-ফ্রয়েডের বিষম ভূত চেপেছিল তাঁর মাথায়। মধ্যবিত্তের যুদ্ধ লিখতে গিয়ে নিজের জীবনের সাথেই মহাযুদ্ধ করা হয়ে গেছে গোটা জীবনে।
অথচ গণিতে বিএসসি তুখোড় ছাত্র প্রবোধ কুমারের সাহিত্যিক হওয়ার কথা ছিল না। একবার ক্যান্টিনে এসে এক বন্ধু বলল, ” পত্রিকায় লেখা দিয়েছি, ছাপায়নি। নামী কেউ না হলে ছাপায় না। ” তর্কাতর্কি করতে গিয়ে লেখা ছাপানোর চ্যালেঞ্জে নামলেন। সেই চ্যালেঞ্জই বাংলা সাহিত্যকে পাইয়ে দিল চালচুলোহীন মৃগীরোগী এক সাহিত্যিককে।
পদ্মানদীর মাঝি লিখেছিলেন জীবনের মোটামুটি ৬ ঘন্টার অভিজ্ঞতা থেকে, তখন তিনি কিশোর। একবার বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছেন, অনেক খুঁজে পাওয়া গেল নদীপারের জেলেদের নৌকায়। তাদের কাছে দুবেলা ভাত খেয়ে গল্প করে কাটিয়েছিলেন মানিক।
“প্রাগৈতিহাসিক” গল্পের শেষ লাইন কটা নিজেকেই উৎসর্গ করেছিলেন কি তিনি?
শেষবেলা যখন শয্যাশায়ী, তখন বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া না দেবার দায়ে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। সে মামলা লড়ে ওঠার আগেই, বাড়ি ভাড়া না দিয়ে ৩ ডিসেম্বর মানিক ফেরত যান ওপারে।
সুভাষ মুখার্জি তাঁর স্ত্রী কে বলেছিলেন, “একটা টেলিফোন তো করবেন , বৌদি। ” ডলি ম্লান হাসিতে উত্তর দেন,ফোন করলেও যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।”
মরার পর শত শত দেশনেতা এসে পায়ে মাথা ঠুকেছেন, হাজার হাজার মানুষ ফুলের তোড়া নিয়ে শব দেখতে এসেছেন। অথচ মৃত্যুর আগের দিনও ছিল কা কারোর খোঁজ। বিস্ময়কর হলেও, জীবনে একটাও পুরষ্কার -সম্মাননা পাননি আমাদের পদ্মানদীর মাঝি!
মরে গিয়ে প্রথমবার বেঁচে গেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। আজকে ৩ ডিসেম্বর। প্রজন্মের অনেক “স্যার” লেখক এসেছে, আরো আসবে। কিন্তু এমন মৃগীরোগী ছন্নছাড়া জেদী মানিক একটাই, কেবল একটাই।
আপনাকে ভালোবাসি, মানিক।
©শাফায়াত স্বচ্ছ
আমার স্টুডেন্টের একটা বছর আজ নষ্ট হয়ে গেলো।
ইন্টারের ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার এক্সাম ছিলো আজ। কেন্দ্র পড়েছে ঢাকার এক সরকারী কলেজে। স্টুডেন্ট গাজীপুর থেকে ভোর ছটায় রওনা হয়েছে, পরীক্ষা শুরু হবে দশটায়। প্রয়োজনেরও প্রায় তিনগুন সময় ছিলো হাতে। ছয়টা পয়ত্রিশে ও বোর্ডবাজার জ্যামে পড়ে। সেখানে কিছুক্ষন জ্যামে বসে থেকে থেকে যখন বুঝলো এই জ্যাম কয়েক কিলোমিটার লম্বা, সহজে ছুটবার নয়; তখন বাস থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করলো। দৌড়ে আর হেটে ছেলেটা বোর্ডবাজার থেকে টঙ্গী স্টেশন রোড- বিশাল এই দূরত্ব পার হলো প্রায় দুই ঘন্টায়। গত দুদিনের বৃষ্টিতে গাজীপুরের খানা-খন্দে ভরা নিকৃষ্ট রাস্তায় পানি জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে। দুটো ট্রাক উল্টে পড়ে আছে রাস্তায়, সেজন্য মাইলের পর মাইল লম্বা বাস ট্রাকের লাইন।
পথিমধ্যে ও পাঠাও উবারের মোটরসাইকেলও খুজেছে। এই বৃষ্টি আর জ্যামে রাস্তায় কিছুই নেই। যে দু একটা বাইক পেলো সেগুলোও যেতে চাচ্ছে না জায়গায় জায়গায় হাটু অব্দি পানি জমে যাবার কারনে।
ছেলেটার মন অনেক নরম, হার্ট খুব পোক্ত না। অল্পতে প্যানিক করে। পরীক্ষার বাকি আর মাত্র দু ঘন্টা, এখনো গাজীপুর পেরোয় নি। ও অস্থির হয়ে পড়লো। আতঙ্কে কি করবে কিছু বুঝতে পারছিলো না বেচারা। এতো দূর দৌড়ে এসে পা আর কোনোমতেই চলে না। জ্যাম একটু নড়তেই একটা বাসে চড়ে বসলো। স্টেশন রোড থেকে সেই বাসে এয়ারপোর্ট আসতে আসতে সাড়ে নয়টা। পরীক্ষার বাকি আর মাত্র ত্রিশ মিনিট। ওর তখন পাগল পাগল অবস্থা।
ওর দিশেহারা কান্না কান্না চেহারা দেখে বাসের সবাই আদ্র হয়ে গেলো। এক মহিলা যাত্রী চিৎকার করে ড্রাইভারকে বলেই বসলো, আপনি ছেলেটার এই অবস্থা স্বত্ত্বেও জায়গায় জায়গায় থেমে লোক উঠাচ্ছেন কেনো? আপনার টাকা আমি দিবো, আপনি দ্রুত যান।”
কিছুক্ষন পর কজন বললো, “তুমি তো কেন্দ্রে সময় মতো পৌছুতে পারবা না, একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাও”।
সিএনজি পেলে তো হতোই। সারা রাস্তা খালি। কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে এসে একটা সিএনজি দেখা গেলো। ড্রাইভার নিজে থেকেই বাস সাইড করে সিএনজির সামনে দাড় করালো। কপাল এমন খারাপ, ড্রাইভার যাবে না ওদিকে। পরে বাসের সব যাত্রীরা নেমে সবাই মিলে সিএনজি ড্রাইভারকে অনুরোধ করলে সে রাজি হয়।
আমার স্টুডেন্ট ড্রাইভারকে কাদো গলায় বললো যত দ্রুত পারেন কেন্দ্রে নিয়ে যান চাচা। ড্রাইভারও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে চিৎকার, চেচামেচি করে সামনের গাড়ি সরিয়ে এগিয়ে যেতে। সেসময় সিএনজি ড্রাইভারের ফোন থেকে ও বাসায় কলে করে জানায় এ পরিস্থিতির কথা। আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম, ফোনকলে ওর আম্মুর কান্নাকাটি শুনে কি করে উঠবো বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ফোন করে কিছু একটা উপায় বাতলে দেবো সেই উপায়ও নেই। ফোন নিয়ে যায়নি সাথে করে।
শেষমেশ কেন্দ্রে যখন পৌছুলো তখন ঘড়িতে বাজে দশটা চল্লিশ। অলরেডি চল্লিশ মিনিট লেইট। বৃষ্টিভেজা শরীরে হন্তদন্ত হয়ে হলে ঢুকে গার্ডে থাকা টিচার, হল সুপারদের কনভিন্স করতে করতে আরো দশ পনেরো মিনিট। ও যখন হাতে খাতা পেলো তখন বাকি আর চল্লিশ মিনিট। গার্ডে থাকা ম্যাডাম বললে, আগে সৃজনশীল দাও, তারপর শেষে নির্ব্যাক্তিক প্রশ্ন দিবো।
ওর প্রিপারেশন খুব ভালো ছিলো। পাচটা অধ্যায়ের মধ্যে চল তড়িৎ, ভৌত আলোক বিজ্ঞান আর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অধ্যায় তিনটা একেবারে ঝাঝড়া করে গেছিলো। আর প্রশ্নও এসেছিলো আজ সহজ। প্রায় সবগুলো সৃজনশীলই কমন পড়েছে।
ওর সময় হাতে চল্লিশ মিনিট। মাত্র আধ ঘন্টায় দুইটা সৃজনশীল লিখে শেষ করে ফেললো। ওর কথা অনুযায়ী দুইটাতে বিশে বিশ পাবার কথা। বাকি আছে দশ মিনিট। ও দাড়িয়ে ম্যাডামের কাছে নৈর্ব্যক্তিক চাইলো।
ম্যাডাম এসে নরম গলায় বললো, “তোমার মন খারাপ হবে তাই বলি নি। তোমাকে MCQ প্রশ্ন দিতে না করেছে হল সুপার দেরির জন্য”।
ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নৈর্ব্যক্তিক না দাগাতে পারলে শিওর ফেইল আসবে। এতোক্ষন পরে এ আবার কি কথা! ও কান্নাকাটা শুরু করে দিলো। গার্ডের ম্যাম আন্তরিক ছিলেন। উনি প্রিন্সিপলকে ডেকে আনলেন। প্রিন্সিপল জেলা মেজিস্ট্রেটকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে বলা হলো কোনোভাবেই নৈর্ব্যক্তিক দাগাতে না দিতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এক রূমে বসে মহামান্য মেজিস্ট্রেট মহোদয় তিনটা ঘন্টা আতঙ্কে আর টেনশনে পর্যদুস্ত কাক ভেজা, কান্নারত একটা ছেলের জীবনের ডিসিশন নিয়ে নিলেন এক সেকেন্ড দেরি না করে।
সাধারনত দেরি করে হলে ঢুকলে আশঙ্কা করা হয় পরিক্ষার্থী সামহাউ নৈর্ব্যক্তিকের এন্সার জেনে এসে হলে ঢুকেছে। এই আশঙ্কা অমূলক তা না। বাট আমার স্টুডেন্টটা কতোটা ভালো স্টুডেন্ট, কতোটা শুদ্ধতম মানুষ আমি জানি। পরীক্ষার খাতায় কাটাকাটি হলে যে ছেলে আতঙ্কে পড়ে যায়, অংক না মিললে প্যানিক এটাক হয় সে ছেলে এসবে জড়িত হবার প্রশ্ন কতোবড় অলীক চিন্তা আমি জানি। যাহোক, এসব গার্ডের টিচার কিংবা প্রিন্সিপালদের জানার কথা নয়। কিন্তু চোখের সামনে একটা ছেলে ভেজা জামাকাপড় গায়ে এই বয়েসে এতোগুলো মানুষের সামনে দাড়িয়ে অসহায় কান্না করছে, ওর চোখের দিকে তাকালেই তো ভাই বোঝার কথা সে দু নম্বরি করতে দেরি করেছে নাকি রাস্তার জ্যামের ঘটনা সত্য! এটুক কমনসেন্স, বোধ তো একটা প্রিন্সিপলের থাকার কথা। সারাজীবন ছাত্র চড়িয়ে পেট চালানো লোকের তো মূহুর্তেই বোঝার কথা কোন ছাত্রটা অভিনয় করছে আর কোনটা অসহায় কান্না করছে।
এবং বুঝেছে তারা অবশ্যই।
আসল ব্যাপার হলো, দে জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। তারা চাইলেই ছেলেটাকে দশ মিনিটের জন্য MCQ প্রশ্নটা দিতে পারতো। ও ইভেন কাদতে কাদতে বলেছিলো এন্সার শীটটা অন্তত দিতে, ও প্রশ্ন না দেখে আন্দাজে কতগুলা দাগায় দিলেও যদি চারটা(পাশ মার্ক) নৈর্ব্যক্তিক হয়!
প্রিন্সিপল দায়সারা জবাব দিয়েছিলো, “আরে সৃজনশীল তো ভালো দিছো, পাশ করে যাবা সমস্যা নাই”। অথচ সবাই ভালো করেই জানে সৃজনশীল আর নৈর্ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা পাশমার্ক উঠাতে হয়। এমন রেকলেস দায়সারা নিচুমানের মিথ্যে সান্তনা একটা কলেজের প্রিন্সিপল কিভাবে দিতে পারে?
সন্দেহপূর্ণ কেইসে আইনের একটা ফান্ডামেন্টাল নিয়ম হলো, একটা দোষী কোন শাস্তি না পাক সমস্যা নেই, একটা নিরপরাধ যেনো কোনোভাবেই শাস্তি না পায়।
স্যারেরা যদি মনে করেনও ছেলেটা দু নম্বরি করতে গিয়ে দেরি করেছে, এতো কাকুতি মিনতি কি ওর নিরপরাধ হবার এক পার্সেন্ট সম্ভাবনাও জাগায় নি? একবারও মাথায় আনেনি ছেলেটা যদি সত্যই জ্যামের ভাগ্যে পড়ে দেরি করে থাকে তাহলে কতো বড় ইনজাস্টিস আমরা করছি?
আগেই বলেছি তারা আসলে কেয়ারই করে না। সরকারী কলেজের শিক্ষক। হাজার হাজার ছেলের মাঝে একটা দুইটা ফেইল করলে তাদের কিছুই আসে যায় না। হয়তো হরমামেশাই তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এসব কোন মাথাব্যাথাই না।
এই ছেলের বাসায় আজ কান্নার রোল। মা বাবা সবার বুক ভেঙে গেছে এই ঘটনায়। ছেলেটা খাওয়া দাওয়া করছে না, চুপচাপ বসে আছে। পরের পরীক্ষাগুলো কেমন দেবে খোদাই জানে। ভালো স্টুডেন্টদের একটা বাজে পরীক্ষাই পরেরগুলোর মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর ও বেচারা অলরেডি জেনে বসে আছে ওর আর পাশই আসছে না এইচ এস সি তে।
সেসময় ছোট্ট একটু মহানুভবতা যদি প্রিন্সিপল দেখাতো, একটু গুরুত্ব যদি দিতো, ছেলেটার চোখের পানিকে একটু যদি কনসিডার করতো তাহলে একটা ফ্যামিলির আজকের দিনটা এমন নরক হওয়া লাগতো না।
রুলস আর রুলস- এটা কোনো যৌক্তিক কথাই নয়। এক্সেপশন কেইস সবসময় থাকবে। নিয়মের ব্যতিক্রমও তখন কর্তাব্যক্তিদের দেখাতে হবে। সবকিছুর উর্ধ্বে হলো বিপদে আপদে মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, সহমর্মিতা, ইন্সট্যান্ট সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। এসবকে কবর দিয়ে শুধু নিয়ম আউড়ে গেলে তাকে কতোটুকু অনুভূতিগ্রাহ্য মানুষ বলা যায়?
এদেশের রাস্তা ঘাটের প্রতি দোষ দিয়ে আর কি লাভ। জন্মই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ এদেশে। সেখানে রাস্তায় জ্যামের দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলা শুধুই বাতুলতা। এদেশে থাকলে, এদেশে বাচলে এমন বিপদে বারবার, বারংবার পড়তে হবে। এটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র আশা এটুকই- যখন নষ্ট রাজনীতি আর দুর্নিতিগ্রস্থ এই দেশের সিস্টেমের কবলে আটকে যাবো, তখন আশেপাশের মানুষগুলো যেনো একটু মমতা, একটু মানবতা দেখিয়ে অসহায়ের হাতটা ধরে। অসহায় বিপদে যদি সেটাও না পাওয়া যায় তাহলে বিশ কোটি মানুষের দেশ এটা- শুধু সাধারন জ্ঞানের প্রশ্ন হয়েই থাকবে।
এই ছেলেটার কপালে সেই মানবিকতাটুকুও জুটলো না। একজন জাতির মেরুদন্ড রুলস এন্ড রেগুলেশনের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছেলেটার একটা বছর নষ্ট করে দিলো। খুব নিয়মনিষ্ঠ হওয়া হইলো, আইনের মান্য করা হইলো। শুধু মানবিকটাই হওয়া হইলো না।
শুধু উচ্চশিক্ষিত হলে, রুচিশীল হলেই মানুষের প্রতি মানুষের মমতাবোধ জাগ্রত হয়না। বাস ভর্তি যাত্রী, ড্রাইভাররা যে মমতা ছেলেটার প্রতি দেখিয়েছে তার সিকিভাগ যদি প্রিন্সিপাল কিংবা মেজিস্ট্রেট দেখাতো তাহলে ছেলেটার জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হতো না।