গল্পঃ “বন্ধন” লেখক: বাঁধন আহমেদ।

সুমুকে যখন বিয়ে করি তখন সুমুর বয়স চৌদ্দ আর আমার সাতাশ। মায়ের জোরাজুরিতে অর্ধেক বয়সের মেয়ের সাথে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাবার গত হওয়ার পর মা সংসারের হাল ধরলেন। বাবার ঋণের বোঝা মায়ের কাঁধে পড়লো। চাচা, মামারা ক্রমশ দুরে সরে গেল। মা তার বিয়ের সময়ের সমস্ত গহনা বিক্রি করে পাওনাদারদের মুখে ছুড়ে মারলেন। ঋণের দুই-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট রইল।
আমি তখন সবেমাত্র উনিশ। মা বললেন, যাই হোক কেন পড়াশোনাটা ছাড়বি না। মা ভীষণ শক্ত মনের মানুষ। চারপাশের মানুষের কটু কথা হজম করে মা আমাদের আগলে রাখলেন।
উর্মির তখন বয়স আট, পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য। বেশ চঞ্চল স্বভাবের। সে আবার আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। ভাইয়া, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা কিনে দিতে হবে। তার বায়নার ইয়ত্তা ছিল না।
.
পাওনাদারদের উপদ্রবে আমার পড়াশোনায় মন বসলো না। ইন্টারের রেজাল্ট নেহাৎ পাশ করলাম। আর আমি আহামরি মেধাবীও ছিলাম না।
মা কে একদিন বললাম, ‘পাওনাদারের অপমান আর যে সহ্য হয় না, মা। এই ভিটেমাটি বিক্রি করে দুরে কোথাও চলে যায়।’ আমার কথা শুনে মা আড়ালে চোখের পানি ঝরালেন। সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, ‘মা, বাবার শেষ স্মৃতিটুকু হারাতে চান না।’

মা সেই সময়ের মেট্রিক পাশ। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করলেন। যে যা খুশি হয়ে দিতেন, তাই নিতেন। আমিও পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করলাম। এভাবেই অভাব অনটনের মাঝে দিন এগোতে থাকলো।
কোন রকম পড়াশোনাটা শেষ করলাম। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করেও চাকরি জুটছিল না। আমার মধ্যম সারির স্টুডেন্টের চাকরি পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। দিন দিন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। মা তখন কাঁধে হাত রেখে বলতো, ‘আমার ছেলে একদিন অনেক বড় চাকরি পাবে। বেশি চিন্তা করিস না।’
ততদিনে অনেক বেলা গড়িয়েছে। পঁচিশ বছর বয়সে তেইশশো টাকা বেতনে একটা কোম্পানি চাকরি জুটলো। মা এ বাড়ি, ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে সবাইকে রসগোল্লা বিলিয়ে বেড়ালেন। পাড়ার সবার মুখে মুখে আমার প্রশংসায় বেকারদের কান পঁচে যাবার উপক্রম হলো।
.
পনের বছর বয়সেই মা উর্মির বিয়ের বন্দোবস্ত করলেন। পাত্র কামিল পাস, মসজিদে ইমামতির করেন। আমি মা কে বললাম, ‘খুকি,আরেকটু বড় হোক। মেট্রিক পাস করুক। তারপর না হয়, বিয়ে দিও।’
মা আমার কথার পাত্তা দিলেন না। বললেন, ‘এমন পাত্র সবসময় পাওয়া যায় না। মেয়েদের যতদ্রুত বিয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল।’
সেদিন মায়ের কথার উপর আর কথা বলি নি। মা সন্তানের জন্য যেটা ভাল মনে করছেন, তার চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে?
.
এক ছুটির দিনে দুপুরবেলা মা থেকে ডেকে ছাই রঙা পাঞ্জাবিখানা হাতে ধরিয়ে বললেন, মেহেরপুর যেতে হবে।
হঠাৎ মেহেরপুর কেন? কি হয়েছে, মা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা বললেন, তোর এত কিছু জানতে হবে না। আমার সাথে চল। তিন ঘন্টার রাস্তা, দ্রুত রেডি হয়ে নে।
কি হতে চলেছে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। চাকরি পাবার পর মা যে যখন তখন আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবেন, সে আগে থেকে ঠিক করা ছিল।
বাসে যাবার সময় মা কে বলেছিলাম, এই সামান্য বেতনে বউ, সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
মা চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তিনজনের সংসার দেদারসে চলে যাবে।
পথিমধ্যে উর্মিকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পর পৌছলাম পাত্রীর বাড়িতে। ঐ বাড়িতে কেমন একটা গমগমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সবাই অতি ব্যস্ত। আমাদের এক কক্ষে বসার বন্দোবস্ত করলো। রুমের পরিপাটী দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এটাই পাত্রীর রুম।
পাত্রীর মা, আমার মায়ের বান্ধবী। বহুদিন পর বান্ধবীকে পেয়ে মা আমাকে ভুলে গেলেন। ঐ পরিবারের সাথে মা আর উর্মি একদম মিশে গেলেন। আমি নিরীহ প্রাণীর মত বসে রইলাম।
মিনিট পনের পর, সদ্য শাড়ী পরিহিতা এক কিশোরী নাস্তার প্লেট হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো। নাস্তার প্লেটটা রেখে আমার দিকে শরবতের গ্লাসটা দিয়ে অপটু হাতের অনভ্যস্ততায় শাড়ীর ঘোমটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইহার ফাঁকে আমি তাকে এক নজর দেখে নিলাম। গোলগাল, মিষ্টি চেহারা। তবে মেয়েটার কৈশোর রেশ এখনো কাটে নি। এই মেয়ে একেবারেই বিবাহের অনুপোযুক্ত। বাচ্চা মেয়ের সাথে কি আর বলবো, আমি তাকে যেতে বললাম।
মেয়েটা বের হতেই উর্মি এসেই মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, আমার ভাইজানের বউ পছন্দ হয়েছে তো?
কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ বললাম, এত ছোট মেয়ে কেউ বিয়ে করে? এই বিয়ে আমি করবো না।
তুই না বললেই তো হবে না। মা সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখছে, উর্মি জবাব দিল।
কিছুক্ষণ পর মা আসলো। মাকে ফিসফিসিয়ে বললাম, মেয়ের বয়স একেবারেই কম। এই মেয়েকে বিয়ে করবো না। মেয়ের বয়স আটারো কিংবা কুঁড়ি হলে ঠিক হত।
মা চোখ কটমট করে বললেন, ‘এই মেয়ের সাথে এখনই বিয়ে করতে হবে।’ আমি ওমন কাটা জবাবে আর একটি টু শব্দও করার সাহস করি নি। মেয়ে দেখতে এসে বিয়ে করতে হবে এটা আমি কল্পনাতেই ভাবি নি।
.
অতঃপর বিয়ে পড়ানো হল।
প্রায় অর্ধেক বয়সের মেয়ের সাথে তাহার কক্ষেই তথাকথিত বাসর রাত কাটাতে বাধ্য হলাম। যেখানে আমি পুরুষ হয়েও প্রতিবাদ করতে পারলাম না, সেখানে মেয়ের অবস্থানটা ভাবা অনভিপ্রেত। প্রথম রাতে দুজন হরেক রকম গল্প করে পার করে দিলাম। তার কি কি পছন্দ অপছন্দ সবকিছুই জেনে নিলাম।
পরদিন ফিরলাম চিরচেনা পৈতিক ঠিকানায়।
.
আমার মা ছিলেন একবারেই অন্যরকম। আর দশটা শাশুড়ির মত বউয়ের উপর ছড়ি ঘোরাতেন না। সুমু ঘুম থেকে দেরিতে উঠতো, কখনো গল্পের বইয়ের পাতায় ডুবে থাকতো, আবার কখনও পাড়ার সমবয়সী মেয়েদের সাথে খোঁশগল্পে মেতে থাকতো। চৌদ্দ বছরের সুমুর উপর মা খুব বেশি নির্ভর করতেন না। মা তাকে উদার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
সুমুর সাথে আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছিল। আর হবেই না কেন? সাতাশ বছরের ছেলেটি বাসায় থাকলে পনের বছরের ছেলের মত আচরণ করতো। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সেই ছোট্ট মেয়েটি শাড়ী সামলাতে হিমশিম খেতো। আমিই তাকে শাড়ী পরা শিখিয়েছিলাম। অফিস থেকে ফেরার পথে বাদাম কিংবা ছোলাবুট নয়ত চকলেট কিংবা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আসতাম।
পিরিয়ডের ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া সুমুর পেটে গরম কাপড়ের ছ্যাঁকা দিতেই সুমু গুটিশুটি হয়ে আমার কাছে নিজেকে সঁপে দিত। মা দরজার আড়াল থেকে কেবল মিটিমিটি হাসতেন। মায়ের সাথে তখনও সুমুর কিঞ্চিৎ দূরত্ব রয়ে গিয়েছিল, সেটা কেবল লজ্জার নয় কিছুটা সম্মানেরও।
সময় গড়াতে শিমুল তুলোর কোলবালিশটা আমাদের মাঝ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।সুমুর সাথে খুনসুটিতে আমার প্রতিটা দিন দিব্যি কেটে যাচ্ছিল।
.
একদিন অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরি হল। তাড়াহুড়ো করে সুমুর জন্য কিছু নেয়া হল না। বাসায় ফিরে দেখি, সুমু সেজেগুজে বসে আছে। কিন্তু মন খারাপ। মন খারাপ হলে, সুমু চুপ করে থাকে, কথা বলে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার সুমুর কি হয়েছে?
সুমু জবাব দিল না।
-আমার সুমু কি আমার সাথে কথা বলবে না?
-না।
-তুমি কেন রাগ করেছো তা আমি জানি।
সুমু অবাক বিস্ময়ে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো।
-কেন বলেন তো?
-তা তো বলবো না।
রাগান্বিত দৃষ্টিতে বললো, বলেন বলছি।
-না বলবো না। আমার বউয়ের মুখ থেকে শুনবো।
-আমি বলবো না।
-আমার বউটা শাড়ী পড়ে সেজেগুজে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। নিশ্চয়ই আমার সাথে কোথাও ঘুরতে যাবে।
-জি না।
-তাহলে?
-আপনি বাবা হবেন।
-কি? বাবা হবার মত এমন কিছু আমি করি নি।
আমার এমন কথা শুনে সুমুর কয়েক প্রস্থ কিলঘুষিতে সে আমার বাহুডোর আবদ্ধ হয়ে পড়লো। আমি তখন আর কিছুই বলতে পারি নি, কেবল সুমুর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন দুজনের চোখে নেমেছিল খুঁশির বৃষ্টি।
.
সুমু আমার কাছে কখনো মুখ ফুটে কিছু চাইতো না। বরং তার কি প্রয়োজন, আমি বুঝে ফেলতাম। সুমু কি জিজ্ঞেস করতাম, তোমার কি প্রয়োজন আমাকে বলো না কেন?
জবাবে সুমু বলতো, ‘আমি যদি বলে দেই, তাহলে আপনি আমার দিকে তাঁকাতেই ভুলে যাবেন।’
সংসারে কি লাগবে, না লাগবে, মা হিসেব করে রাখতো। মা কখনই সুমুকে করার জন্য কিছু বলতো না। তবে সুমু নিজ আগ্রহে মায়ের কাজে ভাগ বসাতো।
যে মেয়েটা কিছুদিন আগে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতো, সেই মেয়েটা অনাগত সন্তানের জন্য জামা কাপড় বানানো, কাঁথা সেলাই, এটা সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
.
পরের গল্পটুকু সুখকর নয়।
প্রেগনেন্সির সময় সুমুর শরীরে ভাগ বসালো নানান রকম জটিলতা। এ হাসপাতাস থেকে ও হাসপাতাল ছুটোছুটি।
আমার পেরেশানি দেখে সুমু বলতো, ‘আমার রোগ আর ভাল হবে না। আপনি আমায় বাসায় নিয়ে যান। আমার এখানে দম বদ্ধ হয়ে আসে।’
সুমুর হাত দুটো ধরে চোখের কোণের অশ্রু লুকিয়ে বলি, আমার সুমুর কিচ্ছু হবে না।
শেষবার যখন সুমুর সাথে কথা হয় তখন সুমু আমার হাতটি ধরে বলেছিল, ‘আমি বাঁচতে চাই। আমাকে ছেড়ে যাইয়েন না।’
আমি সুমুর কথা রাখতে পারি নি।১৪/১২/২০০১ অ্যাকটোপিক প্রেগন্যান্সির কারণে সুমু ছয় মাসের গর্ভাবস্থায় না ফেরার দেশের চলে যায়। সুমুর পরপরই মাও আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়।
সেইসব স্মৃতি আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। উর্মি আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য বারবার বলেছিল, কিন্তু ঐ চৌদ্দ বছরের কিশোরীর আসত্তি এই জীবনে আর কাটবে না।
জীবন বোধহয় এমনই, প্রিয় জিনিসগুলো বেশিদিন কাছে থাকে না।
.
গল্পঃ “বন্ধন”
লেখক: বাঁধন আহমেদ।
Source: নীলাভ্র আর নীলাম্বরীর গল্প fbpage

Leave a Reply