তসলিমা নাসরিন -এর অন্তহীন যাত্রা
নালন্দার মেয়ে আমি। হিলসায় বাড়ি। বাবা ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিস্ট গাইড। শুনেছি প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তৈরি ওই বিশ্ববিদ্যালয়। তখনই ছিল ২০০০ শিক্ষক, ১০,০০০ ছাত্র। বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যলায় দেখিয়েছে, বৌদ্ধ বিহার দেখিয়েছে। দেখিয়ে দেখিয়ে ইতিহাস বলেছে। বাবা যখন ইতিহাস বলে, কেবল শুনতেই ইচ্ছে করে। আমি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। মাধ্যমিক দেওয়ার পর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হয় আমারই ইস্কুলের রঞ্জন মাস্টারের সঙ্গে। নালন্দাতেই শ্বশুর বাড়ি। বছর তিনেক সংসার করার পর একদিন মাস্টারের আর আমাকে পছন্দ হয় না। অন্য কোনও ছাত্রীকে মনে ধরেছে। হবেই বা না কেন, ছেলে ছেলে করে অস্থির মাস্টার মশাই। আর আমি কিনা দিয়েছি এক মেয়েকে জন্ম। আমাকে তালাক দিয়ে যে ছাত্রীকে মনে ধরেছে, রঞ্জন মাস্টার তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। আমি অগত্যা বাপের বাড়ি। সঙ্গে ভাবনা, দেড় বছর বয়সী কন্যা। আমার বাবার সংসার ঝলমল করে উঠলো আমাদের উপস্থিতিতে। মা’র আর আমার বেলা কাটে ভাবনার সেবা যত্নে, রান্নাবান্নায়, সংসারের নানা খুঁটিনাটিতে। বাবা পড়ে থাকে গাইডের কাজে। বাবাকে নিজেই একদিন বলি, ‘বিদেয় করেছিলে, কিন্তু তোমার সংসারে আমাকে আবার ফিরতে হলো, তোমার ওপর বোঝা হলাম। শুধু আমি নই, আমার মেয়েও’। বাবা হেসে বলেছে,’ এ কি শুধু আমার বাড়ি, এ তো তোরও বাড়ি, জন্ম থেকে তো এখানেই বড় হয়েছিস। বছর তিনেক ছিলি না বলে পর হয়ে গেলাম আমরা?’ আমাকে জন্ম দেওয়ার পর মা আরও তিনটে সন্তান জন্ম দিয়েছিল, তিনটেই পুত্র সন্তান, আশ্চর্য, ঠিক তিন বা চার মাস বয়সে গা-পুড়ে- যাওয়া জ্বরে ভুগে তিন পুত্রই মারা গেছে। পাড়ার ডাক্তার ডেকে কোনও কাজ হয়নি। কেন জ্বর হচ্ছে, কেন মরে যাচ্ছে এসব প্রশ্ন করলে ডাক্তার সিলিংয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে ভগবানকে দেখিয়েছে।
বাবা মা, ভাবনা আর আমি— আমাদের সুখ শান্তির সংসার দিব্যি চলছিল। আমরা ধনী নই, আমাদের অভাব আছে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, অভাববোধ নেই। আমরা শাক ভাত খেয়েও হাসি আনন্দে দিন কাটাতে পারি। বাবা ৬ মাস গাইডের কাজ করে, ৬ মাস নালন্দার একটি লাইব্রেরিতে কাজ করে। দুটো কাজে যা আয় রোজগার হয়, তা আমাদের খেয়ে পরে চমৎকার চলে যায়। তাছাড়া নিজেদের বাড়ি, নিজেদের সবজি বাগান! মাঝে মধ্যে পরবে অনুষ্ঠানে স্বজনদের বাড়ি বেড়ানোও হয় আমাদের। ট্রেনে করে চলে যাই পাটনা, বেগুসারাই, রাঁচি। বাবা একদিন বললেন, তুই তো কলেজে পড়তে পারিস। তাই তো, আমি তো কলেজে পড়তেই পারি। উদাসিন মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলে একদিন না একদিন তো পাশ করে বেরোবো, কোথাও ভালো একখানা চাকরিও তো করতে পারবো। মাও চায় কলেজে পড়ি আমি। কেবল কাকা মামাদের কেউ কেউ বাড়ি এসে বলে যায়, ভালো ছেলে দেখে আমাকে ফের বিয়ে দিতে। সন্তানসহ মেয়ের জন্য আর যে ছেলেই জুটুক, ভালো ছেলে যে জুটবে না, সে আমি জানি। ওরাও নিশ্চয়ই জানে। কোনও বিয়ের পিঁড়িতে না বসে একদিন কলেজে ভর্তি হলাম।
দ্বিতীয় বর্ষে যখন আমি, তখনই একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বাবার বুকে ব্যথা হচ্ছে, তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়েও বাবাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বাবা মারা গেল। মৃত বাবাকে দেখতে এলো বটে মামা কাকারা, কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে সংসার কেমন চলছে, খেতে পরতে পারছি কিনা, তার খোঁজ নিতে পরে আর কেউ আসেনি। জমানো টাকা ফুরিয়ে গেলে কাকা মামাদের কাছে ধার চেয়েছে মা, সবাই নিজেদের নানা ঝামেলার কথা বলে মাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সবজি বাগানের সবজি না হয় রান্না করা যায়, কিন্তু ভাত তো ফুটোতে হবে, পেটে তো কিছু দিতে হবে, আর ভাবনার খরচও তো দিন দিন বাড়ছে।
বছর পার হলে দূই কাকা এসে বলা নেই কওয়া নেই একদিন বাড়ি ছাড়তে বললো আমাদের, বললো বাড়ি নাকি আমার বাবা দুই ভাইকে লিখে দিয়েছে। লিখে দেওয়ার দলিলও দেখালো, বাড়ির দলিলও দেখালো। বাড়ির দলিল মা আলমারি থেকে বের করে আনলো। ওটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল এক কাকা, বললো, এ পুরোনো দলিল, আর তার হাতের দলিলটা মা’র মুখের সামনে নাচিয়ে বললো, এটা নতুন দলিল। কাকাদের ব্যবহার এত অদ্ভুত যে ওদের আমার কাকা বলে মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল কাকাদের মুখোশ পরে দু’টো খুনী আমাদের হেনস্থা করছে। চলে যাওয়ার আগে দুটো কপি রেখে গেল তাদের জাল দলিলের। আর এমনই মহানুভব যে একদিন দু’দিন নয়, রীতিমত এক সপ্তাহ সময় দিয়ে গেছে বাড়ি ছাড়ার। মা ছুটে গেল মামাদের কাছে। মামারা দু’দিন কাকাদের বাড়ি গিয়ে ঝগড়া করে এসেছে। এরপর কে জানে কেন হঠাৎই মামারা চুপ হয়ে যায়। কাকাদের সঙ্গে লড়াইয়ে যাবে না জানিয়ে দিয়েছে, তারাও বলতে চাইলো ওই দলিল যে জাল তার তো কোনও প্রমাণ নেই।
আমার বাবার সইটা নাকি আসল সই। আমি আর মা যতই বলি, কই বাবা তো বলেনি এই বাড়ি কাকাদের লিখে দিয়েছে বাবা, তাছাড়া কাকারা তো আগে এমন দাবি করেনি, আচমকা কোত্থেকে উদয় হলো দলিল? মামারা দলিল কোত্থেকে উদয় হয়েছে জানে না, তবে বললো, তারা জানে যে, আমার বিয়েতে কাকাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ধার নিয়েছিল বাবা, আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর টাকা যে সময়ের মধ্যে ফেরত দেবে বলে বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিল সেই সময়ের মধ্যে পারেনি ফেরত দিতে, বাড়িটাই অগত্যা লিখে দিতে হয়েছে। যেহেতু আমিই একমাত্র সন্তান, আর আমারও বিয়ে হয়ে গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জামাইয়ের ভোগ করার চেয়ে নাকি ভাইয়ের সম্পত্তি ভাইদের ভোগ করাই উচিত। এসব কথা আমি বিশ্বাস করিনি, মা’ও করেনি। আমরা থানায় গিয়েছিলাম অভিযোগ করতে, পুলিশকে আমাদের বাড়ির আসল দলিল দেখিয়েছি। পুলিশ হেসে বললো, কাকারা নাকি আগেই তাদের বাবার দলিল দেখিয়েছে, ওতে লেখা আছে বাবা বাড়িটি বিক্রি করেছে কাকাদের কাছে। আমরা থানার পুলিশদের যতই বলি এ মিথ্যে, যতই বলি ওদের দলিল জাল দলিল, পুলিশ হেসে মাথা নাড়ে। বলে, একেবারেই জাল নয় দলিল। আমি সেদিন হঠাৎ পুলিশের মুখের ওপর বলেছি আমার বাবার সই যে জাল নয়, তা আপনি কী করে জানেন, আমার বাবার সই তো কোনওদিন দেখেননি! লোকটি আবারও হাসলো, বলল, উকিলের সই সীল সব আছে, উকিলের সামনে বসেই ওরা সই করেছে।
অগত্যা মামার বাড়িতে আপাতত আমাদের আশ্রয় জোটে। প্রথম প্রথম আদর আপ্যায়ন জুটলেও ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে সব। আমরা যে বাড়তি বোঝা তা কি আমরা জানি না! মামার বাড়ির কাজ মা অনেকটা একা হাতেই সারে, যেন অন্তত মা’কে কাজের প্রয়োজনেও রাখে ওরা। দুঃখ-শোককে গা ঝেড়ে তো এক সময় বিদেয় করতেই হয়। মা’কে বলে দিই আমি চাকরি করবো। মা তো অবাক, বলে ইস্কুল পাশ করে ভালো চাকরি পাওয়া যায় না, কলেজটা পাশ হোক। কলেজ পাশের দেরি অনেক। আসলে ভালো চাকরির আশা এখন আর করি না, যেন তেন কিছু হলেই একখানা কুড়েঘর হলেও ভাড়া নিয়ে তিন কন্যা বাস করবো।
মা, আমি, ভাবনা, — আমরা তো কারো না কারো কন্যাই। অনাকাংক্ষিত কন্যা।
আমি কলেজ বন্ধ করে দিয়ে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজি। বাবার যে বন্ধুরা গাইডের চাকরি করে, তারা আর যে লাইব্রেরিতে বাবা কাজ করতো, সেই লাইব্রেরির লোকেরা আমার মা আর আমার অসহায়ত্বের খবর শোনে, আমাকে কোনও একটা চাকরি যোগাড় করে দেবে বলে কথা দেয়, শেষ পর্যন্ত জানিয়ে দেয় তারা কিছুই করতে পারছে না, কোথাও চাকরি নেই, চারদিকে অভাব, পুরুষেরাই চাকরি পাচ্ছে না। পুরুষেরা চাকরি পাচ্ছে না, সুতরাং মেয়ে মানুষের চাকরি পাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না– সরাসরিই বলে। হিলসায় চাকরি নেই, অন্তত আমার জন্য নেই। মামারা কাপড়ের দোকানের ব্যবসা চালায়, সেখানেও আমার কোনও চাকরির সুযোগ নেই।
অগত্যা পাড়ার যারা দিল্লি মুম্বই চলে গেছে চাকরির জন্য, তাদের খোঁজ করি। ওরা চাকরি করে দিব্যি সংসারে টাকা পাঠাচ্ছে। পরিবার নিয়ে ভিন শহরে পাড়ি দিয়েছে চেনা কয়েকজন। খোঁজ করতে করতে আমার পুতুল খেলার বান্ধবী গরিমার সন্ধান পেয়ে যাই, কথাও হয় তার সঙ্গে ফোনে। থাকে মুম্বই শহরের ধারাবিতে। গার্মেন্টসে চাকরি করে। বিহারের আরও দুটো মেয়েও তার সঙ্গে থাকে, তারাও গার্মেন্টসে। গরিমা নিজেই আমাকে বললো আমি যেন মুম্বই চলে যাই, আমাকে ও গার্মেন্টসে ঢুকিয়ে দেবে, ওই তিন কন্যার কুঠুরিতে আমিও যোগ দিতে পারবো। বেতন যা জোটে, তা দিয়ে মুম্বইয়ের খরচ চালিয়ে হিলসায় পাঠানো যাবে। কয়েকদিন গরিমার সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি কলেজ বন্ধ করে মুম্বইয়ের টিকিট কাটি।
গরিমার সহযোগিতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটে, আমার চাকরি হয়, উপার্জনের টাকা আমার হাতে আসে, মুম্বইয়ের থাকা খাওয়ার খরচ করেও মা আর মেয়ের জন্য হিলসায় হুন্ডি করে দিব্যি টাকাও পাঠাতে পারি। সেই টাকা দিয়ে মামার বাড়ির কাছেই মা একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছে। সে যেমনই ঘর হোক, তারপরও তো নিজের ঘর। অন্যের দালান- ঘরে বাস করার চেয়ে নিজের মাটির ঘরে বাস করায় আরাম বেশি। মা’রও অনেকদিন পর আরাম হয়েছে। ভাবনা বড় হচ্ছে মা’র কাছেই। আমাকে একটু একটু করে ভুলেই যেত, যদি না প্রতিদিন ভিডিও কল না হতো আমাদের। একখানা পুরোনো স্মার্ট ফোন মা’কে দিয়েছে মামা, ভালো যে দিয়েছে, তা না হলে আমাকেই পাঠাতে হতো। ফোন থাকায় আমি মা আর মেয়ের সঙ্গে , যেন কাছে ব্সে আছি, এমন ভাবে গল্প করতে পারি। মনেই হয় না যে হাজার মাইলের দূরত্ব মাঝখানে। সারাদিন ব্যস্ততার পর যেটুকু সময় জোটে, তা আমি সযত্নে রেখে দিই। শিবানী আমার খাটিয়ায় শোয়। আমার চেয়ে বয়স কম ওর। এখনও বিয়ে হয়নি। ফোন থেকে ভাবনার ছবি বের করে ও প্রায়ই অপলক তাকিয়ে থাকে, তারও নাকি এমন একটা ফুটফুটে বাচ্চার শখ।
করোনা আসার পর যখন লকডাউন শুরু হলো, কারখানা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল, আমাদের সপ্তাহের টাকা দিয়ে দেওয়া হলো, আরও একটি সপ্তাহের টাকা অগ্রীম দেওয়া হলো, কিন্তু সেই টাকা তো ফুরোতে দেরি নেই, এরপর আমরা খাবো কী, ঘর ভাড়া দেবো কী করে! এই লকডাউন শেষ হবে কবে, কারখানা খুলবে কবে, তা কেউ জানে না। কারখানার মালিকেরা জানিয়ে দিয়েছে, তারাও নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারবে না। ব্যস, আর কোনও দায়িত্ব তারা নেয়নি। এই চরম দুর্যোগে তাদের কি উচিত ছিল না শ্রমিকদের দেখভাল করা! এই প্রশ্নটিই বা কে করে!
মড়ক লেগেছে মড়ক লেগেছে বলে ট্রেন বাস ধরতে মানুষ দৌড়োচ্ছে, বাড়ি যাবে, গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে কেউ না কেউ আছে তাদের, ক্ষেতও কিছু আছে, না খেয়ে মরতে হবে না। কিন্তু ট্রেনে বাসে যখন আর জায়গা নেই, যখন ট্রেন -বাসের টিকিট কেনারও টাকা নেই হাতে, তখন কিছু লোক সিদ্ধান্ত নেয়, তারা হেঁটেই যাবে। হেঁটে? শিক্ষিত বাবার মেয়ে আমি। নিজেও কলেজে গিয়েছি। হেঁটে কতদূর যাবে? যতদূর গেলে বাহন মিলবে। যেতে হবে কাছের কোনও স্টেশনে, সেখানে ট্রেন না পেলে পরের স্টেশনে। আর তা যদি না হয়, যেতে হবে হেঁটে। মুম্বই থেকে বিহার কত কিলোমিটার দূর, তা নেট থেকে বের করে ফেলি। বিহারের কোনও অঞ্চলে যেতে ১৫০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ১৭০০। গরিমা আর ঘরের বাকি সঙ্গী শীলা আর শিবানীকে বোঝাই, এত দূর হাঁটা কারো পক্ষে সম্ভব নয়, আমাদের বরং আর ক’টা দিন অপেক্ষা করা উচিত। ট্রেনের টিকিট একদিন তো মিলবেই। কিন্তু, তারা অন্ধকারে অন্ধের মতো বসে থাকে। যেন পথই তাদের আলো দেবে। ধারাবি থেকে দূর দূরান্তের মানুষ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
পেটে খাবার নেই, হাতে পয়সা নেই, চাকরি আছে কী নেই কেউ জানে না, চারদিকে গভীর একটা হাহাকার শুরু হলো। বাড়ি চলো বাড়ি চলো। যেতে যত দিনই লাগুক, বড় জোর, পাঁচ দিন, ছ’দিন , তারপর তো না খেয়ে অন্তত মরতে হবে না। সুতরাং তৈরী হও। তৈরী না হয় হলাম, কিন্তু যেখানে যাবো, সেখানে কী করছে? স্বস্তি নাকি আরও দ্বিগুণ কোনও অস্বস্তি! গরিমাদের না হয় বাড়ি চলে যেতে পারলেই থাকা খাওয়ার অভাব হবে না, কিন্তু আমার কী হবে! হিলসার ঘর-ভাড়াই বা কোত্থেকে দেবো, খাবোই বা কী! মা মেয়েকে নিয়ে তো উপোস করে মরতে হবে। আমার বেলায় রোজগার না থাকলে হিলসাতেও যা, ধারাবিতেও তা। আমি উদাস বসে থাকি। গরিমা আমাদের ভাড়া-ঘরটি ছেড়ে দিয়ে, শত শত লোক পায়ে হেঁটে যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই যেতে থাকে। ঘরের বাকি দুই মেয়ে শীলা আর শিবানীও। আমি একা কোথায় পড়ে থাকবো! পিঠের ব্যাগে জরুরি কিছু জিনিস নিয়ে আমিও কাফেলায় যোগ দিলাম। হিলসার বাড়ি আমার সমস্যা ঘোচাবে না। কিন্তু ধারাবির সমস্যাই বা আমি কী করে ঘোচাবে! কপর্দকশূন্য আমাকে কে ঘর দেবে, কে দু’বেলা খেতে দেবে? অনিশ্চয়তা সর্বত্র। পায়ে পায়ে অনিশ্চয়তা। ওকে নিয়েই পা বাড়াই। আমার ছোটবেলার পুতুল খেলার সঙ্গী গরিমাকেই এই বড়বেলার অন্তহীন যাত্রার সঙ্গী করি ।
গরমে ঘামতে ঘামতে ক্ষিধেয় তেষ্টায় আমরা হাঁটি। এই যাত্রা অদ্ভুত যাত্রা। কোনওদিন রাজপথে হাঁটিনি এভাবে। সঙ্গে নাম-না-জানা অসংখ্যা মানুষ। সবাই ওরা আমাদের মতো শ্রমিক। সবাই বস্তি। সবারই ধার দেনা। সবারই আধপেট। আমাদের পুঁটলিতে আছে শুকনো রুটি আর চিঁড়ে গুড়। রাত ৩টেয় হাঁটতে শুরু করি, সকাল ১০টায় এসে জিরোতে বসি কোথাও। আবার রওনা হই বিকেলে, রাত ১১টা ১২টায় জিরোই। আমাদের দিন রাত একাকার হয়ে যায়। ভেবেছিলাম পথে ট্রাক বা বাস পেলে উঠে পড়বো। পেয়ে যাই, কিন্তু পুরুষগুলো আমাদের কনুইয়ের গুঁতোয় সরিয়ে দিয়ে নিজেরা উঠে যায়। আমাদের পা-ই অগত্যা আমাদের সহায় ।
গরিমা, শীলা, শিবানী আর আমি, হনহন করে হেঁটে যেতে থাকি। মুম্বইয়ে ট্রেন নেই বলে আওরঙ্গাবাদে এসে ট্রেনের খোঁজ করি। ট্রেন ভর্তি করে শ্রমিকেরা চলে যাচ্ছে উত্তরে, দক্ষিণে। আমাদের জন্য কোনও ট্রেনই থামছে না। টিকিটও নেই কাউন্টারে। অগত্যা রেলের লাইন ধরে হাঁটতে থাকি আমরা, আমাদের মতো আরও অনেকে। পথে , রাজপথে, রেলের লাইনে, অলিতে গলিতে, কোথাও আমরা একা নই। সবখানেই আমাদের মতো আরও অনেককে পেয়ে যাই। আরও অনেকের মতো আমরাও রাত ১২টার দিকে বিশ্রাম নিই রেল লাইনের ধারে। একসময় শিবানী আর আমি রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ি, এর আগে আমি এভাবে কখনও শুইনি। কী রকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। স্বাধীনতা টগবগ করে শরীরে। আজ একা থাকলে রেল লাইনে শোয়ার সাহস হতো না, কে খুন করে বা ধর্ষণ করে রেখে যেত, কোনও ঠিক নেই। দল নিয়ে ঘুরলে এক রকম শক্তি সাহস থাকে, স্বস্তিও । একসময় মশার কামড় খেয়ে আমি উঠে পড়ি, কাছাকাছিই চাদর পেতে গরিমা আর শীলা শুয়েছে। ওদের সঙ্গে শোবো বলে ঠিক করি। শিবানীকে টেনেও ওঠানো গেল না লাইন থেকে। আরও অনেকের মতো সেও লাইনের ওপরই শোবে। আমি বলি, ‘শিবানী উঠে আয় , ট্রেন চলে আসবে। ’ শিবানী বললো, ‘লকডাউনের কারণে ট্রেন চলবে না আজ থেকে, স্টেশনের লোকেরা বলেছে।‘আবারও আহ্লাদি গলায় বললো, ‘দিদি, ও দিদি, তুমি থাকো সঙ্গে। তুমি না থাকলে ভয় করবে আমার’।
শিবানীকে ধারাবিতেই প্রথম দেখেছি, অথচ মনে হয় ওকে যেন অনেক কাল চিনি। মনে হয় ওর সঙ্গে আমার শৈশব থেকেই আত্মীয়তা। কণ্ঠস্বরে ওর কত রাতের যে না-ঘুমোনো ঘুম! প্রায় কুড়ি পঁচিশ জনের মতো শুয়ে আছে লাইনে, দীর্ঘ পথ হেঁটে পরিশ্রান্ত। লাইনে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেমে এসেছে। অধিকাংশই মধ্য প্রদেশের দিকে যাবে। আমরা যাবো বিহারের দিকে। গরিমার পাশে যখন শুই, গরিমা বিড়বিড় করে বলতে থাকে, কাল সকালেই নতুন রাস্তা ধরতে হবে।কোন রাস্তা, তা ইউপি বিহারের যাত্রীরাই বলবে। আমাদের কাজ শুধু অনুসরণ করা।
ভালো করে সকালের আলো ফোটার আগেই বিকট চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় আমার, ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে রেলের লাইন, ছিটকে পড়ে আছে মানুষের টুকরো টুকরো শরীর। গরিমা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। আমি স্তব্ধ পড়ে থাকি যেখানে ছিলাম সেখানে, আলুথালু চাদরের ওপর। কাটা মুণ্ডুগুলো ছিটকে পড়ে আছে এদিক ওদিক। শীলা আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদে। কতক্ষণ ওভাবে বাকরুদ্ধ পড়ে থাকি জানিনা, এক সময় গরিমা এসে বলে, এবার ওঠ, পুলিশ সবাইকে সরে যেতে বলছে।
কিন্তু শিবানী?
শিবানী নেই।
শিবানী হয়তো ট্রেনের শব্দ পেয়ে লাইন থেকে সরে গিয়েছিল, হয়তো আছে কোথাও। অপেক্ষা তো করতে হবে ওর জন্য।
কোনো লাভ নেই।
একটা মানুষকে ছেড়ে চলে যাবো? ও কোথাও ঘুমিয়ে আছে হয়তো। আশে পাশে একটু দেখি।
না। দরকার নেই।
ও তো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোয়। শিবানীটা পারেও ঘুমোতে।
গরিমা আমাকে থামিয়ে বলে ট্রেনে কাটা একটি হাত সে পড়ে থাকতে দেখেছে, হাতটি শিবানীর। হাতে মেলা থেকে কেনা তার ঘড়িটি ছিল।
আমরা যে শিবানীর শরীরটা কাঁধে করে নিয়ে তার মা বাবার কাছে সৎকারের জন্য পৌঁছে দেব, তাও সম্ভব নয়। অতগুলো মানুষের হাড় মাংস সব মিলে মিশে শত পিণ্ড হয়ে আছে। গরিমা হাঁটতে হাঁটতে বললো, মোট ১৬ জন কাটা পড়েছে ভোরের ট্রেনে। থেতলে গেছে সবাই, কাউকে আর আলাদা করে চেনা যায়নি। আমরা খুব দ্রুত হাঁটতে থাকি। যেন দ্রুত হাঁটলেই বাড়ি পোঁছোতে পারবো সন্ধ্যের মধ্যেই, যেন দ্রুত হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে পারবো। মাথায় শিবানীর স্মৃতি যন্ত্রণা দিতে থাকে, আমার গা কাঁপতে থাকে, তবু হাঁটতে থাকি। আজ আমিও তো ওই রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম। আজ আমিও হতে পারতাম থেতলে যাওয়া রক্ত মাংসের পিণ্ড। হাঁটছি চুপচাপ। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যে পেছনে শিবানী পড়ে নেই, পেছনে পড়ে আছি আমি। আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি। নিজেকে চেষ্টা করছি জড়ো করতে, পারছি না।
কেউ সাইকেল চালিয়ে মুম্বই থেকে উত্তরপ্রদেশ যাচ্ছে, কেউ ইলেকট্রিক রিক্সা চালিয়ে। ট্রাক বাস আমাদের নেয় না, গাড়ি অটো কিছুই আমাদের জন্য থামে না। একবার এক গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে এক লোক জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী? আমি বলি, আমার নাম নেই। বাড়ি কোথায়? আমার বাড়ি নেই। ঠিকানা কী? ঠিকানা নেই। লোকটি, জানিনা, হয়তো সাংবাদিক, অথবা কোনও ত্রাণ নিয়ে এসেছে। গরিমা বলে, কথা যদি বলিস কারও সঙ্গে , হাঁটতে হাঁটতে বলবি, থামবি না কারও জন্য। আমার নাম ঠিকানা নেই, এই তথ্যটি দিয়ে আমার আনন্দ হয়। পরদিনও আরও একটি গাড়ি গরিমার গায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে তোমার নাম কী? গরিমাও আমার মতো উত্তর দেয়, নাম নেই। বাড়ি কোথায়? বাড়ি নেই। গাড়ি চলে যায়। কী লাভ নাম বলে? কী লাভ ঠিকানা বলে? আমরা তো ভাসমান। নাম ঠিকানাহীন ভাসমান মানুষ। এটিই আমাদের আসল পরিচয়।
বিশ্রামের সময়ে আমাদের পকেটে যেটুকুই টাকা ছিল, খরচ হতে থাকে। পেটে কিছু না দিতে পারলে হাঁটতে কষ্ট হয়। কখনও কখনও কোনও দোকানী খাবার দেয়, টাকা সামান্য নেয় অথবা নেয় না। জল তেষ্টা পেলে জলও খেতে দেয়। মেয়াদ চলে যাওয়া ঠাণ্ডা পানীয়ও একজন বের করে দিল। প্রাণ ভরে খেয়ে নিই। এই দুঃসময়ে মেয়াদ নিয়ে ভাবলে চলে না।
১৭০০ কিলোমিটার হাঁটবো, এমন দুঃস্বপ্ন আমরা দেখিনি। পাশ দিয়ে যে গাড়িগুলো যায়, আমাদের চোখ চলে যায় ওসবের ভেতরে, কোনও জায়গা আছে কি না দেখি। কোনও সহৃদয় যদি খানিকটা এগিয়ে দিতে চায়, তিনটে আসন খালি না থাকলে আমরা উঠিনা। গরিমা আমাকে দু’বার ঠেলেছে আর বলেছে , তোর জুতো বার বার ছিঁড়ে যাচ্ছে, তুই যা। আমি যাইনি। গরিমা আর শীলাও আলাদা হয়নি। ওদেরও তো জুতো ছিঁড়ছে, ওদেরও তো আমার মতো পায়ে ফোসকা পড়েছে।
আমরা যেন সমুদ্রের তলায় সাঁতার কাটছি, কেউ কারো হাত ছাড়ছি না। শিবানী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর হতদরিদ্র আমাদের তিনটি প্রাণীর আর কিছু চাই না, এই বন্ধন টুকুই চাই। পাশে থাকার জন্য মৌখিক বা লিখিত প্রতিশ্রুতির দরকার পড়ে নি। শিবানীর জন্য আমাদের দীর্ঘশ্বাসই নিঃশব্দে নির্মাণ করেছে এই প্রতিশ্রুতি। শিবানীর বাড়ি ছিল রাঁচিতে। অক্টোবরে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বলেছিল বিয়ের পর আর সে মুম্বইয়ে কাজ করবে না। বরের সঙ্গে রাঁচিতে থাকবে।রাশি রাশি স্বপ্ন ছিল । মুম্বইয়ে বেশ কয়েক বছর কাজ করে কম খেয়ে কম প’রে টাকা জমিয়েছে। টাকাগুলো কে জানে কার হাতে যাবে এখন!
প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার হাঁটার পর জব্বল্পুর এসে আমরা ট্রেন পেয়ে যাই। লকডাউনে ট্রেন সত্যিই বন্ধ। তবে শ্রমিকদের পারাপারের জন্য স্পেশাল ট্রেন চলছে। জব্বলপুর থেকে পাটনায় ট্রেন বদলে নালন্দার দিকে যাই। পাটনা থেকে গয়ার লাইনে চলে যায় শীলা। বিদেয় নেওয়ার সময় শীলা বড় বিষণ্ণ ছিল। জানিনা কিছু বলতে চেয়েছিল কিনা। আমি আর গরিমা হিলসায় নামি। আমরা কেউ আর কারো কাছে জানতে চাই না আমরা আবার কখনও মুম্বইয়ে ফিরে যাবো কিনা। যে শহর আমাদের ক’দিন আশ্রয় দিতে পারেনি, ক’দিন খেতে দিতে পারেনি, সে শহরে আর নয়। আমার মতো কি গরিমাও ভাবছে এমন?
বাড়ি ফিরে আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। শিবানীর জন্য চোখের জল ফেলা বাকি ছিল আমার। এই চোখের জল শিবানীর জন্য, এই চোখের জল আমার জন্য, গরিমা আর শীলার জন্য, রেলের লাইনে থেতলে যাওয়া যাত্রীদের জন্য, ট্রাকের ধাক্কায়, আর দামি গাড়ির আঘাতে মরে যাওয়া যাত্রীদের জন্য, পথের মধ্যে অনাহারে পড়ে থাকা যাত্রীদের জন্য, আর আমাদের অন্তহীন যাত্রার শত শত নাম ধামহীন যাত্রীর জন্য। আমার চোখের জলে মায়ের কাঁধ ভিজে যায়। ভাবনা ঘুমিয়ে থাকে।