‘বঙ্গাল কে শের’। অমলজ্যোতি ঘোষকে এ-নামটা দেন বড়ে গোলাম আলি। তখন অমলজ্যোতি ঘোষ পান্নালাল ঘোষ নামেই খ্যাত। পান্নালাল ঘোষ সেই মানুষ, যিনি ভারতের রাগ সঙ্গীতে যে বাঁশি বাজানো যায় – তা দেখান। ওঁর বাঁশিপ্রাপ্তি নিয়ে বাংলায় বহু মিথ প্রচলিত। কেউ বলেন, জন্মস্থান বরিশালের নদীতে একটা বাঁশি পান তিনি। কেউ বলেন, কোনো এক সাধু শ্মশানে বাঁশি আর শঙ্খ পছন্দ করতে বললে তিনি বাঁশিই পছন্দ করেন। সেখানেই নাকি ভবিষ্যৎ লেখা হয় এই মর্মে যে, তিনি বিরাট শিল্পী হবেন। সে যাই হোক, বাঁশিটা তিনি শেষজীবন অবধি বয়ে বেড়ালেন। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের আসর থেকে নৌশাদের মুঘল-এ–আজম অবধি।
ছোটো থেকে কী কী শিখলেন পান্নালাল – কণ্ঠসঙ্গীত, সেতার, পাখোয়াজ,তবলা, বাঁশি, বক্সিং, জিমন্যাস্টিক। স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে তৎকালীন হুজুরদের রক্তচক্ষুর ফলে সতেরো বছর বয়েসে এলেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে চাকরি নিলেন একবার একটা টিউবয়েলের কোম্পানিতে, কখনো একটা প্রেসে। তখনও সিনেমার মুখে বোল ফোটেনি। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে কনসার্ট বাজানোর চল ছিল স্টেজের পেছনে। পান্নালাল বাঁশি বাজাবার কাজ পেলেন। তখনো তাঁর স্বমহিমায় আসার বেশ খানিকটা দেরি আছে। তিনি অনুভব করলেন, শুধু সঙ্গত করে পেট ভরলেও মন ভরছে না। তিনি রাগ সঙ্গীত বাজানোর তালিম শুরু করলেন – তিনবছর টানা চললও। ইতোমধ্যে তাঁর বাবা অক্ষয়কুমার ঘোষ, যিনি কিনা সেনিয়াঘরের সেতারি ও পান্নালালের সেতারের গুরুও বটে – তিনি চলে গেলেন।
অন্যদিকে, এর মধ্যেই পান্নালাল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশলেন। শুধু যে মিশলেন তাই নয়, ব্যায়াম শেখানোর বিনিময়ে শিখলেন ধনুর্বিদ্যা। আর পেলেন সাধারণের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা বাঁশি, যার আওয়াজের গভীরতা ওঁকে ভীষণ টাচ করে। ডায়মন্ডহারবার থেকে বাঁশ জোগাড় করে একজন খেলনাওয়ালার সঙ্গে মিলে বাঁশি বানালেন নিজের মতো করে, যার দৈর্ঘ্য বত্রিশ ইঞ্চি।
এবার আমাদের ১৯৩৪ সালের দিকে একবার ফিরে তাকাতে হবে। সে-বছর অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথ। সে-প্রতিযোগিতায় নিয়ম ছিল যে প্রথম হবে, সে পরের বছর অনুষ্ঠান করার ডাক পাবে। পান্নালাল প্রথম হলেন। অনেকের মধ্যে ছিলেন বিচারক হিসেবে বাবা আলাউদ্দিন। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে ১৯৪৬ সালে একদিন সরাসরি শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। আলাউদ্দিন প্রাথমিক অনিচ্ছের পর দেড় বছর শেখালেন পান্নালাল ঘোষকে।
পঁয়ত্রিশ বছরের পান্নালাল ততদিনে বোম্বে গিয়ে কাজও করেছেন। বাঁশির জনপ্রিয়তা দেখে ওঁর ছাত্রই ওঁকে বোম্বে যাওয়ার জন্যে বলেন। বিবাহও করেন প্রখ্যাত সুরকার, যিনি কিনা পান্নালালের বাল্যবন্ধু ও সুরসঙ্গী, অনিল বিশ্বাসের বোন শিল্পী পারুল বিশ্বাসকে।
পান্নালাল ঘোষ সম্পর্কে একটা গুজব ওঠে যে, দুটো আঙুলের মধ্যেকার যে গ্যাপ, সেটা নাকি অপারেশান করে বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। যদিও সেটা ভিত্তিহীন। পান্নালাল ঘোষ যেখানে মেধার পরিচয় দিলেন সেটা হল, পান্নালাল ওঁর উদ্ভাবন দিয়ে যে বাঁশিটা বানালেন, সেটাতে একটা এক্সটা ছিদ্র জুড়ে দিলেন। শোনা যায়, তাতে বেহাগ, ইমন, বাগেশ্রীর মতো রাগের ক্ষেত্রে মীড়ের জায়গাটা আরো একটু স্বচ্ছন্দ হয়েছিল। তিনি পরবর্তীতে ছয় তারের তানপুরাও প্রচলন করেন। যদিও অনেকে এ-ব্যাপারে ওঁকে কৃতিত্ব দিয়ে কুণ্ঠা করেন।
এতকিছুর মধ্যে ১৯৩৮ সাল নাগাদ তাঁর ইউরোপ ট্যুর হয়ে গেছে। যা সে সময়ের নিরিখে বিরাট ও বিরল। পান্নালাল ঘোষের জীবন দেখলে একটা কথা বোঝা যায়, তিনি একটা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, বাঁশিকে সম্বল করে। নিয়মিত চর্চা করে, পথ তৈরি করে, পথ বদল করে একটা শেপ দিতে চেয়েছিলেন হয়তো বাঁশিকে। হয়তো বাঁশি না পেলে তাঁর বাবার শেখানো যন্ত্র সেতারের মধ্যে তাঁকে পেত শ্রোতারা। তাতে একজন রবিশঙ্কর, একজন বিলায়েত খানের পাশে হয়তো তিনি স্বমেধায় বসতেন। কিন্তু বাঁশিটাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রসার করে পান্নালাল দেখালেন যে, বাঁশিতেও রাগসঙ্গীত বাজানো যায়। যার ফলে পরে আমরা দেখলাম ওঁর ছাত্র বা ছাত্র নন এমন অনেকেই বাঁশিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। শোনা যায়, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ওঁর কাছে শিখতে চেয়েছিলেন—পারেননি, উনি যে-কোনো কারণেই হোক শেখাননি।
পান্নালাল ঘোষ হয়তো থিতু হতে পারেননি কোথাও। সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এটা বিরল নয়। প্রবল খ্যাতি অথচ আর্থিক দুর্দশায় গেলেন বোম্বে, সিনেমায় কাজও করলেন কিছু, কিন্তু মনে হল যেন সুরে বাজছে না। চলে এলেন। ১৯৫৬ সাল নাগাদ আকাশবাণীতে বেশ কিছু অর্কেস্ট্রা উপহার দিলেন – কলিঙ্গবিজয়, ঋতুরাজ। ভারতবর্ষের আর্কাইভের চেষ্টা নির্লিপ্তিতে মেডেল পেতে পারে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রেকর্ডিং-এ পান্নাবাবুকে এও শুনতে হয়েছে ওঁর থেকে, এত সুরে উনি বাজান কেন! লতা মঙ্গেশকর কবি সাহির লুধিয়ানভির কবিতায় গাইতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। রাধাকান্ত নন্দী মান্না দে’র একটা বিশেষ গানে বাজাতে গিয়ে মাঝপথে থামিয়ে বলেন, ‘আর গায়েন না,মান্নাদা।’ লতা মঙ্গেশকর, রাধাকান্ত নন্দীরা ওরকম বলেই থাকেন। আমাদের অত মাথা না ঘামালেও চলে।
২০১১ সালে ঘটা করে বাংলাদেশে পান্নালালের শতবর্ষ পালিত হয়। এখানে কী হয়েছে জানা নেই। পান্নালাল ঘোষ বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৮ বছর। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার একটা অনন্য মত আছে। উনি বলছেন, পান্নালালবাবুই দেখালেন, প্রচণ্ড পরিশ্রম করলে সরোদ–সেতারের মতো জনপ্রিয় হতে পারে বাঁশিও। তাঁর এও মত যে, লোকে নতুন কিছু দেখলে নিন্দে করে। পান্নালালের রাগসঙ্গীত বাঁশিতে বাজানো নিয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
তবু পান্নালাল হাল ছাড়েননি। প্রথাগত রাগ চর্চার বাইরেও নিজে রাগ সৃষ্টি করলেন – নূপুরধ্বনি, দীপাবলি। এমনও দিন গেছে, পান্নালালের দারিদ্র্যের খবর পেয়ে ভারতের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী বালাসাহেব বিশ্বনাথ কেসকার নিজে কলকাতায় এসে তাঁকে চাকরি দিয়ে দিল্লি নিয়ে যান। পান্নালাল ঘোষের ছাত্র ছিলেন দেবেন্দ্র মুরুদেশ্বর(যিনি ওঁর জামাইও বটে), গৌর গোস্বামী, ভি জি কার্নাড, মুকুল রায়, ফকিরচন্দ্র সামন্ত সহ বহু মানুষ। শুধু গায়কী অঙ্গই নয়, তন্ত্রকারী অঙ্গেও সমান দক্ষতা ছিল ওঁর।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে সময় উনি প্রয়াত হচ্ছেন, সে সময় বাংলা-হিন্দি গানের সত্যিকারের স্বর্ণযুগ। বাংলায় সিনেমা ও বেসিক গানের পাশে তৈরি হচ্ছে রম্যগীতি। যেখানে সুর দিচ্ছেন-বাজাচ্ছেন ভি বালসারা, অলোকনাথ দে, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, নিখিল ঘোষ। এই নিখিলবাবু পান্নালালেরই ভাই। সে সময়ে চলে ওঁর চলে যাওয়া ‘দেশের ক্ষতি, জাতির ক্ষতি’ গোছের বিরাট শব্দবন্ধ প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। তবে বহু মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষতি। সুরের ক্ষতি। বাঁশির শরীরে যে গভীরতা আনা যায়, পান্নালাল ঘোষ দেখিয়ে গেলেন।
পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ এর ১০৯তম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামী ০২ আগস্ট শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশেষ মিলনায়তনে স্মারক বক্তৃতা ও ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। স্মারক বত্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক মোঃ আলী নকী। যন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ওস্তাদ মূর্তজা কবির মুরাদ (বাঁশি), মাহমুদুল হাসান (বেহালা) এবং নিশীথ দে (সেতার)। তবলায় সঙ্গত করবেন স্বরুপ হাসান, সুপান্থ মজুমদার এবং প্রশান্ত কুমার।
উত্তরপর্বের এ আয়োজন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ভারতীয় উপমহাদেশে বাঁশির বিবর্তন ও বিকাশে পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ (১৯১১ – ১৯৬০) এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম। পান্নালাল ঘোষ জন্ম নিয়েছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) বরিশালে, কীর্তনখোলা নদীর পারে। ডাকনাম অমলজ্যোতি ঘোষ। পিতামহ হরকুমার ঘোষ প্রখ্যাত ধ্রুপদী ও পিতা অক্ষয় কুমার ঘোষ ছিলেন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক, মা সুকুমারী ছিলেন সুগায়িকা।
চৌদ্দ বছর বয়সে পান্নালাল বাঁশি শিখতে শুরু করেন। কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। সে সূত্রে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৯২৬ সালে বরিশাল থেকে চলে যান কলকাতায়। ওখানে প্রথমে তিনি যুক্ত হন নিউ থিয়েটার্স-এর সঙ্গে। সংগীতের প্রাথমিক তালিম পিতার কাছে নিলেও নাড়া বেঁধে রাগসংগীতে পদ্ধতিগত তালিম নেন অমৃতসরের ওস্তাদ খুশী মোহাম্মদ খানের কাছে। গুরুর মৃত্যুর পর সংগীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর কাছেও পান্নালাল দীর্ঘদিন তালিম নেন এবং তাঁরই উৎসাহে সৃষ্টি করেন নানা রাগ; নূপুরধ্বনি, চন্দ্রমৌলি, দীপাবলি, কুমারী। ফৈয়াজ খান ও ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মতো কণ্ঠশিল্পীদের অনুরোধে পান্নালাল তাঁদের খেয়ালের সঙ্গে বাঁশিতে সঙ্গত করেছেন। পান্নালাল ঘোষের সহধর্মিণী পারুল ঘোষ। পান্নালালের ছোট ভাই নিখিল ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত তবলাবাদক।
১৯৫৬ সালে আকাশবাণী দিল্পী কেন্দ্রে সংগীত নির্দেশক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তারও আগে, ১৯৪০ সালে সংগীতের বৃহত্তর অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যাশায় গিয়েছিলেন বোম্বে; যুক্ত হয়েছিলেন সেখানকার চলচ্চিত্র অঙ্গনে। স্নেহবন্ধন (১৯৪০) তাঁর সংগীত পরিচালনায় প্রথম ছবি। আনজান (১৯৪১), বসন্ত্ (১৯৪২), দুহাই (১৯৪৩), নন্দকিশোর (১৯৫১), বসন্ত বাহার (১৯৫৬), মুঘল-এ-আজম (১৯৬০) প্রভৃতি বিখ্যাত ছবির গান ও আবহসংগীতে মিশে আছে তাঁর বাঁশির কারুকাজ। আঁধিয়া (১৯৫২) ছবির আবহসংগীতে তিনি কাজ করেন ওস্তাদ আলী আকবর খান ও পন্ডিত রবিশঙ্কর-এর সঙ্গে যৌথভাবে। মুঘল-এ-আজম (১৯৬০) ছবিতে মধুবালার ওপর চিত্রায়িত লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘মোহে পনঘাটপে নন্দলাল’ গানের সঙ্গে বাঁশি বাজানোর জন্য নওশাদ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পান্নালাল ঘোষকে। শঙ্কর-জয়কিশেনের সংগীত পরিচালনায় বসন্ত বাহার (১৯৫৬) ছবিতে একই শিল্পীর গাওয়া গাওয়া ‘নৈন মিলে চৈন কাঁহা’ গানেও রয়ে গেছে পান্নালালের ফুঁ-য়ের জাদুর নমুনা। যেটা তাঁর মূল বাজানো রেকর্ডে বহু রাগে রঞ্জিত পান্নালাল ঘোষের সুরসম্ভার অক্ষয় হয়ে আছে।
সানি লিওনের জীবনী | Sunny Lenoe Biography
বাঁশির যে আধুনিক রূপটি আমরা দেখি, সেটি পান্নালাল ঘোষের উদ্ভাবন। ৩২ ইঞ্চি আকৃতির সাত ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশির প্রথম প্রচলন তিনিই করেছিলেন। আগেকার বাঁশিতে দু’একটি স্বর বাজানো বেশ অসুবিধাজনক ছিল। সপ্তম ছিদ্রটি উদ্ভাবন করে পান্নালাল সেই সমস্যার সমাধান করেন। তিনিই বাঁশিকে উন্নীত করেছিলেন সেতার, সরোদ, সানাই, সারেঙ্গীর পর্যায়ে যা এককভাবে ধ্রুপদী সংগীতের গৌরবে বাজতে পারে মূল যন্ত্র হিসেবে। কণ্ঠ সংগীতের গায়কীকে তিনি তাঁর বাঁশিতে ধারণ করেছিলেন। এটা তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রই অনন্য। তবু বাঁশিকে আলাদা স্থান দিতেই হয়। বাঁশি শুনলেই কেন মন উচাটন হয়ে ওঠে, এ প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই। তাই, ভাবতে প্রলুব্ধ হই, কিবোর্ড এসে অন্য সব বাদ্যযন্ত্রের স্থান যতই দখল করুক; যমুনা আর উজানে না-ই বা বইল, ডাকাত-স্বভাবের এই বাঁশির আবেদন থেকেই যাবে; সুরপিয়াসী মানুষের অন্তরে তেমনই থাকবে পান্নালাল ঘোষের নাম।
আজ ২৪ জুলাই সঙ্গীত জগতের একটি বিশেষ দিন। কেননা এই দিনে জন্ম নিয়েছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী সুরকার পান্নালাল ঘোষ (Pannalal Ghosh) যিনি বাংলার বাঁশের বাঁশিকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই বাঙালি বংশীবাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য ছিলেন এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বাঁশিকে একটি অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি অমলজ্যোতি ঘোষ নামেও পরিচিত ছিলেন।
যেভাবে শুরু: পান্নালাল ঘোষ ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই বরিশাল শহরের এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা হরকুমার ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী এবং অক্ষয়কুমার ঘোষ ছিলেন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক। তাই পরিবারের সাংস্কৃতি পরিমণ্ডল পান্নালালকে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
পান্নালালের সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবা অক্ষয়কুমারের নিকট। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে পান্নালাল বাঁশি শিখতে শুরু করেন। বাঁশির পাশাপাশি তিনি সেতার বাজানোও শিখেছিলেন। তবে বাঁশির প্রতিই তার মনোযোগ বেশি ছিল।
তার বাঁশির প্রতি অনুরাগ নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, তার বাড়ি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে হওয়ায় তিনি বাঁশির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন. খুব ছোটবেলায় নদীর জল থেকে তিনি ছোট্ট একটা বাঁশি উদ্ধার করেন। পরে এক সাধু নাকি তার হাতে ওই বাঁশি দেখে বলেছিলেন, ‘তুই কখনও বাঁশি ছাড়িস না, ওটাই তোর যন্ত্র।’
তো ছোটবেলায় সেই যে এক টুকরো বাঁশের বাশি হাতে নিলেন সেটা আর নামাতে পারলেন না। বরং এই বাংলার বাঁশের বাঁশিকে তিনি বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করে আদায় করে নিয়েছেন বিশেষ সম্মান। রাগসঙ্গীতে বাঁশির সম্ভবনার পথটি তার হাত ধরেই উন্মুক্ত হয়েছিল।
বরিশাল থেকে কলকাতায়: বাাঁশিপ্রেমী পান্নালাল রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। জানা যায়, ৪৭য়ে দেশভাগের আগেই পুলিশের ভয়ে তিনি বরিশাল থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। যোগ দেন স্বদেশী আন্দোলনে। কলকাতায় কিছুদিন ব্যায়ামাগারে মুষ্টিযুদ্ধের প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। পরে কলকাতার বিখ্যাত নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন। সেখানে অমৃতসরের প্রসিদ্ধ হারমোনিয়ামবাদক খুশি আহমদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি তার কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন।
খিদিরপুরে তখন বড় বড় বাঁশবাগান ছিল। সেখান থেকে বাঁশ কেটে এনে বাঁশের বাঁশি তৈরি করতে শুরু করেন পান্নালাল। কেননা পশ্চিবঙ্গে যে বাঁশির চল তার আগে ছিল তাতে সব রাগ বাজানো যেত না। পান্নালাল বাঁশের বাঁশিতে দু’একটি ফুটো এমনভাবে বানিয়ে দেন যাতে সেই অসুবিধেগুলো ঘুচে যায়। এইভাবে পৃথিবীর প্রথম বাঁশ থেকে তৈরি পুরোদস্তুর কন্সার্ট ফ্লুট জন্ম নেয়।
১৯৩৮ সালে ‘সরই কলা নৃত্য’ দলের সঙ্গে পান্নালাল বিদেশ ভ্রমণে যান। বিদেশ থেকে ফিরে তিনি সঙ্গীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী এবং ১৯৪৭ সালে বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের দিকে তিনি সঙ্গীতজীবনের উন্নতির জন্য মুম্বাই চলে আসেন এবং বিভিন্ন ছবিতে সুরকার হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। মুম্বাই গমনের প্রথম বছরই ‘স্নেহ বন্ধন’ছবির মাধ্যমে তার সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে অভিষেক ঘটে। এই ছবির দুই জনপ্রিয় গানে “Aabroo Ke Kamaanon Mein” এবং “Sneh Bandhan Mein Bandhe Hue” কণ্ঠ দেন কাহ্ন মাস্তান এবং বিব্বু।
পান্নালাল ঘোষ যৌথভাবে ওস্তাদ আলী আকবর খান ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর -এর সাথে “Aandhiyan” (১৯৫২) সিনেমার নেপথ্যে কাজ করেন। তিনি সে যুগে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত পরিচালক অনিল বিশ্বাসের সাথেও কাজ করেছেন। তিনিই প্রথম সাত গর্তের বাঁশির প্রচলন শুরু করেন। তবে মশলাদার সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালকের কাজ খুব বেশি পছন্দ ছিল না। তার তাই মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে ফের কলকাতায় চলে আসেন।
কিন্তু কলকাতায় ফিরে নিদারুন অর্থ কষ্টে পড়েন পান্নালাল। সারা দুনিয়ায় যন্ত্র সঙ্গীতে খ্যাতি অর্জনকারী এই মহানশিল্পীর কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঠাঁই হয়নি। তাই পাঁচের দশকে সপরিবারে প্রায় না খেয়ে মরার উপক্রম হয়োছিল পান্নালালের। এ খবর শুনে ভারতের তৎকালীন তথ্য-বেতার মন্ত্রী বি ভি কেশকর কলকাতায় বাঁশির কারিগরের ডেরায় ছুটে আসেন। তখন তার এমনই অবস্থা যে অতিথির সামনে এক কাপ চা তুলে দেবেন সে অবস্থাও ছিল না তার স্ত্রীর। একই সঙ্গে পান্নালালকে কেশকর সাহেবের জাতীয় অর্কেস্ট্রা দলের পরিচালক করে দেন। ফলে পাশের বাড়ি থেকে চা চেয়ে এনে মন্ত্রীকে আপ্যায়ন করেন। মন্ত্রী তখন তাকে আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্রের সঙ্গীত নির্দেশক হিসেবে কাজ নেন। তিনি দীর্ঘদিন এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।
যন্ত্রসঙ্গীতে পান্নালালের অবদান: তিনি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রসমূহের যথেষ্ট সংস্কার সাধন করে খ্যাতি অর্জন করেন। খেয়াল অঙ্গের বাদনে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি বিভিন্ন সপ্তকের জন্য তিনটি বাঁশি ব্যবহার করতেন। তার একাধিক গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে।
আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে পান্নালাল ঘোষালের এক একটি সেশন ছিল হিন্দুস্তান সঙ্গীতের শ্রোতা ও শিল্পীদের কাছে এক একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
পান্নালাল একজন মহান যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। রাগসঙ্গীতে বাঁশির সমূহ সম্ভাবনার পথ তিনিই উন্মুক্ত করেন। রাগসঙ্গীতের গভীর আবেগ প্রকাশে তার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। মানুষের যেকোন কণ্ঠস্বরকে তিনি অনায়াসে বাঁশিতে রূপায়িত করতে পারতেন। পান্নালাল কলকাতার নিউ থিয়েটার্স-এর বৃন্দবাদনে বাঁশি বাজাতেন। তার শিষ্যদের মধ্যে বংশীবাদক গৌর গোস্বামীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্রের সঙ্গীত নির্দেশক থাকাকালীন সময়ে অসামান্য কিছু অর্কেস্ট্রাল কাজ করেছিলেন পান্নালাল। স্বরলিপিতে বাঁধা এসব সুর স্বদেশী সিম্ফনি নামে পরিচিত। আকাশবাণীর অখিল ভারতীয় কার্ক্রমে পান্নালাল ঘোষের বাঁশের বাঁশিতে বাজানো দরবারি কানাড়া সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সবার একটাই কথা-‘মানুষ কী করে বাজাতে পারে অমন মধুর সুর।’
পান্নালাল ঘোষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কলকাতার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন লিখেছেন, তার (পান্নালাল রায়) নাম করলেই বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়,চোখ বুজে হাতদুটি কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানাতেন সঙ্গীতাচার্যকে। সারাজীবন সুধীন্দ্রনাথ কতোবার যে বলে উঠেছেন, ‘ভেবে দ্যাখ্, খোদ পান্না ঘোষ যেচে বাঁশি বাজিয়ে দিলে রে! ও তো মানুষ না রে, দেবতা। যেচে,গায়ে পড়ে বাজিয়ে দিলে! জীবনে এটাও ঘটে গেল।’
প্রসঙ্গত, করীর সুমনের বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একজন গায়ক ছিলেন। তিনি আকাশবাণীতে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। বিখ্যাত সুরকার পান্নালালের তিনি কাছ থেকে দেখেছেন।
১৯৬০ সালের ২০ এপ্রিল দিল্লিতে মারা যান পান্নালাল। আজ তার ১০৯তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন সুরের জাদুকর পান্নালাল।
ঋণ- সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
তাঁতঘর পত্রিকা