বৃক্ষরােপণ অভিযান রচনা (৫টি রচনা) | Composition of tree planting campaign

বৃক্ষরােপণ অভিযান রচনা

ভূমিকা: আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার অপরিমেয় অগ্রগতি মানুষকে যেমন অশেষ কল্যাণ দান করেছে তেমনি তার জীবনকে সমূহ বিপদ ও অমঙ্গলের আশঙ্কায় শঙ্কিত করে তুলেছে। বর্তমানকালের উন্নত মানব সভ্যতার প্রস্ফুটিত রঙিন পুষ্পের অভ্যন্তরে দুষ্ট কীটের মতাে প্রকট হয়ে উঠেছে নানাবিধ প্রাণঘাতী মারাত্মক সমস্যা, যা জীবনকে চরম ভীতি ও বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত করছে। বৈজ্ঞানিক সভ্যতার দুরারােগ্য সংক্রামক ব্যাধি এ পরিবেশ দূষণ যে বিষাক্ত কালনাগিনীর মতাে ফণা বিস্তার করে মরণ ছােবল হানতে উদ্যত হয়েছে, তা প্রতিকারের জন্য আজ মানুষ বিশ্বব্যাপী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বৃক্ষরােপণ’ এ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ। দক্ষিণ এশিয়ার বিপুল জনঅধ্যুষিত, দারিদ্র্যপীড়িত, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত পলিমাটি গঠিত বিশ্বের এ বৃহত্তম ব-দ্বীপ, উন্নয়নশীল বাংলাদেশেও এ বৃক্ষরােপণ অভিযান একটি জাতীয় মহাপরিকল্পনা রূপে সম্প্রসারিত হচ্ছে।

বিশ্ববরেণ্য কবি ও নাট্যকার William Shakespear তাঁর কবিতায় বন-বিটপীর ঘন বীথিকায় সহজ সরল, শান্তিময়, উদ্বেগহীন জীবন যাপন করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আমাদের পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের দরদভরা মধুর কণ্ঠের নিমন্ত্রণে “গাছের ছায়ায় লতায়-পাতায় উদাসী বনের বায়” ফিরে যাবার যে আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে, সেই সৌন্দর্যহীন কৃত্রিম সভ্যতার সংকীর্ণ অশান্তিময় পরিবেশে অরণ্যের শ্যামল ছায়াময় ছায়ানীড়কে ফিরে পাবার যে উদগ্রীব বাসনা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে ব্যক্ত করেছিলেন, আজকের বৃক্ষরােপণ অভিযানে আমরা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সেই কালােত্তীর্ণ কবির আত্মবিবেক বাণী আর ক্রন্দন ধ্বনিকেই গভীর আকাঙ্ক্ষায় যে পুনরাবৃত্তি করছি—আজ তা কজন ভাবতে পারছে।

মানুষ ও বৃক্ষ : বসুন্ধরার বুকে প্রথম প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্ভিদের আবির্ভাব হয়েছিল। এরপর এলাে মানুষ। তাই আদিযুগে মানুষ অরণ্যেই বাস করত, বৃক্ষলতাই ছিল মানুষের সাথী। মানব সভ্যতার শুভ উন্মেষ ঘটেছিল অরণ্যের শ্যামল ছায়া শােভিত মিথ রমণীয়তায়, বৃক্ষলতা আচ্ছাদিত স্নেহনীড়ে। প্রকৃতির অবারিত পরিসরে বসবাসকারী মানুষের জীবনের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর যােগান দিয়ে অরণ্যই মানুষের জীবনকে মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমায় বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল। তাই বনাঞ্চলের সাথে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অতি গভীর ও অবিচ্ছেদ্য।

বৃক্ষের প্রয়ােজনীয়তা : বৃক্ষ মানুষের পরম উপকারী বন্ধু। এটি আমাদেরকে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিলিয়ে যেমন উপকার করে, তেমনি এর সৌন্দর্য হৃদয়কে আপুত করে। বৃক্ষ দেশের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। বৃক্ষ আবহাওয়া ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে, বাতাসে জলীয় বাষ্পের ক্ষমতা বাড়িয়ে আবহাওয়াকে শীতল রাখে। প্রচুর বৃষ্টিপাতে বৃক্ষরাজি বিশেষ সহায়ক। কোনাে অঞ্চলের গাছপালা সেখানকার পানিপ্রবাহকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে ভূমিক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। গাছপালা, মূল ভূ-ভাগ ও নতুন সৃষ্ট চরাঞ্চলকে নদীর ভাঙন, বৃষ্টিপাত ও পানিস্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। এটি মাটির স্থিতিশীলতাকে বজায় রাখে। অঞ্চল বিশেষের পানি সংরক্ষণ এবং বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণেও সেই অঞ্চলের গাছপালা অনেক সাহায্য করে। বৃক্ষরাজি ঝড়-ঝঞা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাসগৃহকে রক্ষা করে। জন স্বাস্থ্য রক্ষায় বৃক্ষ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গাছপালা জ্বালানি, গৃহ নির্মাণ ও আসবাবপত্র তৈরির বিপুল চাহিদা মিটিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক ও ব্যবহারিক জীবনে যথেষ্ট উপকার করে। বৃক্ষ আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ। বৃক্ষ আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আবশ্যক। শিশুর দোলনা থেকে মৃত ব্যক্তির খাট পর্যন্ত যাবতীয় কাজকর্মে কাঠ ও বাঁশ একান্ত প্রয়ােজনীয়। নৌকা, গরুর গাড়ি, বাস, ট্রাক, স্টীমার, লঞ, জাহাজ ইত্যাদি তৈরিতে কাঠ প্রয়ােজন। কাগজ, রেয়ন, দিয়াশলাই, প্যাকিং বাক্স ইত্যাদি বহু শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ হয় বন থেকে।

বনের ওপর বর্তমান সভ্যতার প্রভাব : মানবজীবনের এত উপকারী বনাঞ্চল বিনাশে বর্তমান যুগের মানুষ যে ভূমিকা পালন করছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে, জীবনের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ বৃক্ষ নিধনে অধিক তন্সর হয়েছে। কিন্তু যে হারে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে সে অনুপাতে মানুষ বনায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বন্যা, খরা ইত্যাদির প্রকোপ বেড়ে গেছে। পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছর পূর্বের উন্নত সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল সেখানে অপরিমেয়। নিধনের ফলে উক্ত খরা ও বন্যার প্রকোপ। আমাদের চোখের সামনে বর্তমানে ইথিওপিয়ার অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কারণ যে সেখানকার বৃক্ষ সম্পদের ব্যাপক বিনাশ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কথায় বলে “পাগলেও নিজের ভালাে বােঝে।” কিন্তু মানুষ নিজের মঙ্গল না বুঝে বনজ সম্পদ নষ্ট করে খাল কেটে কুমির আনতে ব্ৰতী হয়েছে। ফলে আগামীতে বিশ্ববাসীর অস্তিত্ব যে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে তা সম্যকভাবে সবাই উপলদ্ধি করতে পারছে না। বিশ্বের বনজ সম্পদ ধ্বংস করে, গাছপালা নষ্ট করে মানুষ আজ পৃথিবীতে সৌন্দর্যহীনতা, শুষ্কতা, অনুর্বরতা, বন্যা, খরার শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশের বনের অবস্থা : যে কোনাে দেশের জন্য মূল ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ মােট আয়তনের ১৭ ভাগ। বাংলাদেশের বনভূমি মাত্র ২৫,০০০ বর্গ কিলােমিটার । কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের বনের পরিমাণ প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও তা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগের অভাব যথেষ্ট। অহরহ আমরা কারণে অকারণে আমাদের আশপাশ থেকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলছি। নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের ফলে সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। ফলে প্রয়ােজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে আকস্মিক বন্যা, জলােচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত। জলবায়ু এগিয়ে চলছে চরম ভাবাপন্ন অবস্থার দিকে।

বৃক্ষরােপণ অভিযান : বৃক্ষ নিধনজনিত অনিবার্য পরিণতির হাত থেকে রেহাই পেতে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালিত হয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের এ অভিযানে শিশু, মেহগনি, সেগুন, ইউক্যালিপটাস, ইপিল-ইপিল, আম, জাম, পেয়ারা, জামরুল প্রভৃতি নানা জাতের বৃক্ষের চারা রােপণের জন্য পূর্বেই সরকারি নার্সারি থেকে চারা সরবরাহের জন্য উৎসাহিত করা হয়। আমাদের উচিত এক বৃক্ষ ছেদনের পূর্বে তার বদলে কমপক্ষে চারটি করে চারা রােপণ করা এবং সেগুলাের যত্ন নেওয়া। কারণ বৃক্ষ আছে বলেই পৃথিবীর মানব সমাজ আজও টিকে আছে।

বৃক্ষ রোপনে বেসরকারি উদ্যোগ : বৃক্ষরােপণ একটি জাতীয় কর্ম। এ ব্যাপারটি সরকারের একক প্রচেষ্টায় সাফল্য লাভ করা কঠিন। তাই সরকারের সাথে এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে গ্রামবাসীদের ভূমিকা এতে অধিক প্রয়ােজন। দেশের তরুণরা বৃক্ষরােপণ সমিতি’ গঠন করে সংঘবদ্ধ হয়ে স্বস্ব এলাকার রাস্তার পাশে, বাড়ির আশপাশে ফাঁকা জায়গায় বৃক্ষরােপণ ও তা সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসতে পারে ।

উপসংহার : গাছ লাগান, দেশ বাঁচান’—এ শ্লোগানকে সামনে রেখে আজ আমাদের বৃক্ষ রােপণ অভিযানকে জোরদার করে তুলতে হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে বনের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সবুজ বিপ্লবের সাথে আমাদের বন সংরক্ষণের শ্লোগানকে তুলে ধরতে হবে। আণবিক বােমার আঘাতে বিদীর্ণ শঙ্কাতুর পৃথিবীতে মানুষের জীবনে বনসংরক্ষণের চেতনায় আসবে প্রাণের বন্যা, সৌন্দর্য ও সুষমা। বন সংরক্ষণ ও বৃক্ষ রােপণ করেই আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সুন্দর ও উপযােগী করে রাখতে হবে।

বৃক্ষরােপণ অভিযান রচনা ২

 

ভূমিকা:

বৃক্ষকে বলা হয় পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই পৃথিবী। আর এই পৃথিবীকে সবুজ-শ্যামলা শস্য শ্যামলা করে তুলেছে হাজার হাজার বৃক্ষরাজি।এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে গাছপালার রয়েছে এক অনস্বীকার্য ভূমিকা। তাছাড়া আমাদের জীবনের বেশিরভাগ মৌলিক চাহিদাগুলোই পূরণ করে থাকে গাছপালা। কবির ভাষায়”দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর” – কবির সেই আকুতি আজকের এই যুগে অরণ্যে রোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিনিয়ত মানুষ কেটে সাফ করছে বনজঙ্গল ও জনজীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই জরুরি।

বৃক্ষরোপণ:

গাছপালাকে আমাদের পরম বন্ধু বলা হয়। কারণ গাছপালা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা পানিতে লোহা ভেসে যাওয়ার মতো অসম্ভব। তাই গাছপালা সংরক্ষণে ও পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে আমাদের গাছ লাগাতে হবে এবং গাছপালা লাগাতে জনগণকে সচেতন করতে হবে। গাছপালা লাগানোর এই কর্মসূচিকেই বলা হয় বৃক্ষরোপণ।

বনায়ন:

বন কথাটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সারি সারি ও ঘন বৃক্ষরাজি। কিন্তু আজকাল মানুষ যেভাবে বন জঙ্গল কেটে সাফ করছে সেইভাবে চলতে থাকলে এই বনের দেখা হয়তো আর বেশিদিন পাওয়া যাবে না। তাই এই বনকে উজাড় না করে নতুনভাবে বন তৈরি করার জন্য বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। আর এইভাবে একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি করে গাছ লাগাতে লাগাতে বন তৈরির প্রক্রিয়াই হলো বনায়ন।

বাংলাদেশের বনাঞ্চল:

বাংলাদেশ সবুজ শ্যামল দেশ। এদেশের প্রায় ১৬ ভাগ অঞ্চল জুড়ে আছে বনভূমি।আর বাংলাদেশের এই বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি,শালবন বনভূমি ও স্রোতজ বনভূমি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাসমূহ ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি। তাছাড়া ভাওয়াল ও মধুপুর গড় এর প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লার একটি বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে শালবন। আর দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সমুদ্রের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাজমান সুন্দরবন-ই হচ্ছে স্রোতজ বনভূমি।

বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ:

বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কমপক্ষে ২৫ ভাগ বনভূমির প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের দেশে মাত্র ১৬ ভাগ অঞ্চল বনভূমির অন্তর্গত যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। তাছাড়া সরকারি হিসাব বলছে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯% এবং (FAO) এর মতে এটি ১১.১%। আবার অন্য একটি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। ক্রমাগত এইভাবে বৃক্ষ কমে যাওয়ায় নানান বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটছে আমাদের দেশে। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ এখন বাংলাদেশে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনের ফলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বেড়ে যাচ্ছে গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া।

বনায়ন বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা:

বিশ্বব্যাপী একটি সংস্থা World Research Institute এর মতে বিশ্বের বনভূমির পরিমাণ অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সারা বিশ্ব এখন চরম হুমকির মুখে। গাছপালাকে আমাদের পরম বন্ধু বলা হয়। কারণ, দৈনন্দিন জীবন ও আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি কাজে ও প্রতিটি পদক্ষেপে গাছপালা আমাদের সাহায্য করে থাকে। গাছপালা ব্যতীত এই পৃথিবীতে আমাদের জীবনধারণ অসম্ভব। তাই আমাদের জীবনে গাছপালা বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

জীবন ও পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা:

বৃক্ষ তার ছায়া দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। বড় বৃক্ষ ছায়া দিয়ে পুকুর ও জলাশয়ের পানিকে সহজে বাষ্প হতে দেয় না। গাছের পাতা তার অতিরিক্ত পানি পাতার মাধ্যমে বাষ্পাকারে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয় যা বৃষ্টিপাতে সহায়তা করে। তাছাড়া বৃক্ষ নিজে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেবার মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য জীবের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এভাবে গাছপালা অন্যান্য জীবের নিঃশ্বাসের বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অন্যদিকে গাছপালা মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে ও নদীভাঙ্গন রোধে ভূমিকা পালন করে।

মানব জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা:

মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানুষের খাদ্য যোগানের জন্য বৃক্ষ প্রধান ভূমিকা পালন করে। মানুষ উদ্ভিদের ফল, লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। গাছ মানুষের বেঁচে থাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেন এর একমাত্র উৎস। এই জীবন রক্ষাকারী উপাদান ছাড়া মানুষ এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ তাপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও রান্নার জ্বালানির জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত কাঠ আমরা বৃক্ষ থেকেই পেয়ে থাকি। বৃক্ষ থেকে কাগজের মন্ড, দিয়াশলাইসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়। বনভূমি থেকে মধু ও মোম পাওয়া যায়। জীবন রক্ষাকারী নানান ঔষধ তৈরিতেও উদ্ভিদের দরকার হয়।

বৃক্ষরোপণের স্থান:

বৃক্ষরোপণের স্থান বলতে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। তবে একটি নিয়ম মেনে গাছ লাগালে সেটি উপকারী ও সৌন্দর্যবর্ধক হয়। যেমন রাস্তার দুই পাশে সৌন্দর্যবর্ধক পাতাবাহারের গাছ কিংবা ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে। বাড়ির আঙিনায় নানান শাকসবজির গাছ ও স্কুলের আঙিনায় নানান ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে। নদীর পাশের লাগাতে হবে বড় বড় গাছ । কারণ সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রক্ষা পেতে কাজে লাগে।

গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও:

গাছপালা যে শুধু মানুষ বা অন্যান্য জীবের কাজে লাগে তা কিন্তু নয়। এটি সম্পূর্ণ পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি পৃথিবীতে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখে। যেসব যায়গায় গাছপালা বেশি থাকে সেসব জায়গায় বৃষ্টিপাত বেশি পরিমাণে হয়। গাছপালা নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। মাটির উর্বরতা ঠিক রাখে। তাছাড়া নদী ভাঙন, পানি স্ফীতি ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণেও গাছ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই গাছ লাগানোর মাধ্যমের আমাদের জীবন রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

বৃক্ষরোপণ অভিযান:

আমাদের দেশের বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখার জন্য এদেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ সপ্তাহে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই সময়ে সারাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। সাধারণত প্রতিবছর বর্ষাকালে বৃক্ষরোপণ অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। এসময় সাধারণ জনগণ নিকটস্থ নার্সারি থেকে বিনামূল্যে কিংবা খুবই স্বল্পমূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে। তখন জনগণকে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে সচেতন করা হয়। তাই বলা যায় বৃক্ষরোপণ একটি মহৎ প্রচেষ্টা।

বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করার উপায়:

বৃক্ষ রক্ষা আমাদের জীবন রক্ষারই সামিল। শুধু সরকার নয়, বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করার জন্য জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বন বিভাগ বৃক্ষের চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে তা জনগণের নিকট সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে পারে। গাছ লাগানোর জন্য জনমত তৈরি করবে এবং জনমতে চেতনা সৃষ্টি করবে। এ ব্যাপারে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ আছে। আমরা প্রত্যেকে যদি কমপক্ষে একটি করে চারা গাছ রোপণ করি, তাহলে সহজেই আমাদের এ অভিযান সফল হতে পারে। সুখী ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য সকলকেই এই অভিযানে অংশগ্রহণ করা উচিত।

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও গৃহীত পদক্ষেপ:

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও নানান ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বন অধিদপ্তরকৃত ১৯৮২ সালে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত কমিউনিটি বনায়ন কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।
এরপর ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে প্রায় ৬০ টি জেলার বিভিন্ন থানায় বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়, বনায়ন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হয়, ৮০ হাজার ব্যক্তিকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ছয় কোটি গাছের চারা বিতরণ করা হয়। এ উদ্যোগ গ্রহণ করার পর উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের মধ্যে বনায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সালে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং তা থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্ভব হয়। এভাবেই সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমের বৃক্ষরোপণে নানান কর্মসূচি ও পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

See also  (৫টি রচনা) আমাদের জাতীয় পতাকা রচনা

ধরিত্রী সম্মেলন:

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনে রিও তে পরিবেশ বিষয়ক এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে সারা বিশ্বের ১৭০ টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।  এই সম্মেলনে বৃক্ষ নিধন সম্পর্কে ও পরিবেশে এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়। তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে, বিশ্বে যেভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী একটি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা হিসাব করে দেখেন যে প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় এক একর বনভূমি উজার হয়ে যাচ্ছে। সে সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, একই সাথে বৃক্ষরোপন করতে হবে ও বৃক্ষনিধন কমিয়ে দেশ ও বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।

বন সংরক্ষণ:

বৃক্ষরোপনের উদ্দেশ্যই হলো বনায়ন তৈরি এবং সেই বনভূমিকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে বিশ্বকে রক্ষা করা। তাই শুধু বৃক্ষরোপণের মাধ্যমেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলে চলবে না। আমাদেরকে সেই বৃক্ষকে রক্ষা করার জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে। আজকাল অনেক অসাধু ব্যবসায়ীরা অসাধু উপায়ে গাছপালা নিধন করছে ও পাচার করছে। এইভাবে চলতে থাকলে দেশের বনভূমি অচিরেই উধাও হয়ে যাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেসব অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে অন্যরাও আইনের প্রয়োগ দেখে নিজেরা সচেতন হবে এবং বৃক্ষরোপনে উদ্যোগী হবে। আর এভাবেই বন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

বনায়নের উপায়:

বাংলাদেশে বনায়নের এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সামাজিকভাবে এই বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে জনগণ বৃক্ষরোপনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করতে পারবে। জনগণকে নানান জাতের গাছের বীজ প্রদান করা যেতে পারে যার ফলে সাধারণ জনগণ ও গ্রামবাসীরা নতুন নতুন ও বাহারি জাতের ফল, শস্য, খাদ্য, জ্বালানি পেয়ে গাছ লাগাতে উৎসাহী হবে। তাছাড়া জনগণের মাঝে বিনামুল্যে বীজ সরবরাহ, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও সার সরবরাহের মাধ্যমে জনগনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। জনগনকে বৃক্ষরোপণের উপকারিতা ও বৃক্ষনিধণের অপকারিতা জানিয়ে সচেতন করা যেতে পারে। গ্রাম, মহল্লার সাধারণ জনগনকে প্রশিক্ষন ও বেতন প্রদানের মাধ্যমে এলাকা ও মহল্লার রাস্তার পাশে, মসজিদ-স্কুলের আঙিনায়, নদীর পাড়ে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই কর্মকাণ্ড দেখে সাধারণ জনগনও উৎসাহিত হবে। আর সেসব গাছ থেকে যা আয় হবে তা গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। তাছাড়া বিভিন্ন মিডিয়া যেমনঃ টিভি, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির মাধ্যমেও সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এভাবে বনায়ন করা হলে দেশের অনেক জায়গা আবার বনভূমিতে পরিণত হবে।

বৃক্ষহীনতার অপকারিতা:

বৃক্ষহীন পৃথিবী জীবনবিহীন মানুষের মতো। বৃক্ষ না থাকলে মানুষসহ পৃথিবীর কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারবে না। গাছপালা কমে গেলে বায়ুতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিবে। বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। পানির অভাব দেখা দিবে ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা মরুভূমির ন্যায় হয়ে যাবে। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে ও অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির মতো নানান দুর্যোগ দেখা দিবে। ফলে মানুষসহ অন্যান্য জীবের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।

বৃক্ষের বর্তমান অবস্থা:

বাংলাদেশকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলা হয় একমাত্র বাংলাদেশের সবুজ ফসলের ক্ষেত ও বনভূমির জন্য। একসময় ছিল যখন বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসতো শুধুমাত্র আমাদের দেশের সবুজ বনভূমি দেখতে। কিন্তু মানুষের অসচেতনতার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। আগের দিনের সেই আম, কাঁঠাল, সুপারি ও নারিকেলের বাগান আর তেমন দেখা যায় না। মানুষ গাছপালা কাটছে ঠিকই কিন্তু গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। গাছের বদলে মানুষ এখন গড়ছে বড় বড় ইমারত। গাছপালা থেকে এখন মানুষের নিকট ইমারতের মূল্য বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বর্তমানে এই অবস্থার কারণে পৃথিবী ক্রমেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

বৃক্ষ সংরক্ষণে করণীয়:

বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতির ভিড়ে আজ আমরা বৃক্ষরোপনের কথা ভুলতে বসেছি। কিন্তু বৃক্ষ ছাড়া আমাদের জীবন অচল। তাই বৃক্ষ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। একটি গাছ কাটলে তার বদলে দূটি গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া সারা দেশে কার্যকর করতে হবে। দেশের প্রতিটি মিডিয়ায় বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে অন্তত একটি অনুষ্ঠান প্রতি সপ্তাহে প্রচার করতে হবে। গ্রামের সাধারণ জনগনকে বৃক্ষরোপনের উপকারিতা ও বৃক্ষনিধনের অপকারিতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে গৃহীত আইন সময়মতো কার্যকর করতে হবে। তবেই বৃক্ষ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

উপসংহার:

নিঃসন্দেহে গাছপালা থেকে উপকারী বন্ধু আমাদের দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই শুধু জাকজমকের সাথে বৃক্ষরোপন সপ্তাহ পালন করলেই হবে না, আমাদের সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার
সিম্পোজিয়াম তৈরির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে ও দেশব্যাপী এই কার্যক্রমকে তুলে ধরতে হবে। তবেই দেশ আবার সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে।

বৃক্ষরােপণ অভিযান রচনা ৩

ভূমিকা:

বৃক্ষ প্রকৃতি ও জীবজগতের অপরিহার্য অংশ। একদিকে বৃক্ষ প্রকৃতির শােভাবর্ধক অন্যদিকে প্রাণিকুলের প্রাণ প্রদায়ক। একদিকে সে প্রকৃতিকে দেয় রাণীর সাজ, অন্যদিকে প্রাণিকুলকে দেয় প্রাণধারণের জন্য অক্সিজেন । তাই বৃক্ষ ছাড়া পৃথিবীর বুকে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনাতীত । কিন্তু মানুষের নিষ্ঠুরতা প্রতিনিয়ত কুঠারাঘাত করছে প্রাণপ্রদায়ী বৃক্ষের মূলে। ফলে প্রকৃতির বুকে অরণ্যের যে শােভা তা দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন প্রকৃতিকে করছে বিপন্ন। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হয়ে পড়েছে হুমকির সম্মুখীন। এমতাবস্থায় পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে, দেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সচেতনভাবে বৃক্ষরােপণের বিকল্প নেই ।

পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরােপণ:

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশ্ব পরিবেশের বিপর্যস্ততার কারণ বিশ্বের বনভূমি উজাড় । জীবন ও পরিবেশের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে হবে। পরিবেশকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়ােজন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা। আর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ পালন করে অনিবার্য ভূমিকা। বৃক্ষ বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধকরণ ও শীতলীভবনের অন্যতম অনুঘটক। গাছ তার মূলের সাহায্যে মাটি থেকে পানি আহরণ করে প্রস্বেদন ও বাস্পীভবন প্রক্রিয়ার সাহায্যে আবহাওয়া মণ্ডলকে বিশু রাখে এবং জলীয়বাষ্প তৈরি করে বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বায়ুমণ্ডলকে রাখে শীতল । বৃক্ষ জলীয়বাষ্প তৈরির মাধ্যমে বৃষ্টি ঝরিয়ে ভূমিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তাছাড়া মাটির ক্ষয় রােধ করে নদীর ভাঙন থেকে ভূভাগকে রক্ষা করে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষার ক্ষেত্রেও পালন করে অনন্য ভূমিকা । বৃক্ষ প্রকৃতির বুক থেকে প্রাণিকুলের ত্যাগ করা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেয় জীবনদানকারী অক্সিজেন। ফলে একদিকে বৃক্ষ প্রাণিকুল তথা মানুষকে উপহার দেয় বদ্বাসের উপযুক্ত পরিবেশ। অন্যদিকে, কার্বন ডাই-অক্সাইড-এর আধিক্যের কারণে সৃষ্ট উষ্ণতা থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে । কেননা প্রকৃতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের আধিক্য জন্ম দেবে জলােচ্ছাস, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যার ফলশ্রুতিতে বিলুপ্ত হবে অনেক প্রজাতির জীব, তাই মানুষের অর্থাৎ জীবজগতের বসবাসের উপযােগী ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বৃক্ষের কোনাে বিকল্প নেই।

See also  (৫টি রচনা) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার রচনা

বৃক্ষহীনতার প্রতিক্রিয়া:

বৃক্ষহীনতার প্রতিক্রিয়া যে কী ভয়াবহ তার পরিচয় আজ পৃথিবীব্যাপী স্পষ্ট। আমাদের দেশেও এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৃক্ষহীনতার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে ‘ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া’ অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে কার্বন ডাই- অক্সাইড আটকে পড়া। এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাসের হার অনেক বেড়ে যাবে। এর প্রমাণ ইতােমধ্যে আমাদের দেশে ও বিশ্বের অনেক দেশে পাওয়া যাচ্ছে। আবার ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসায় মানুষ ও জীবজন্তুর নানা রােগ দেখা দেবে। সুপ্রাচীনকাল থেকে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বৃক্ষ। আবার প্রাকৃতিকভাবে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য ও আশ্রয়দাতা হলাে বৃক্ষরাজি। ফলে বৃক্ষহীনতার ফলে জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। এককথায় বিশ্ব পরিবেশের বিপর্যয় ও হুমকি প্রধানত বৃক্ষহীনতারই ফল।

বাংলাদেশে বৃক্ষ নিধন ও তার প্রভাব:

বাংলা প্রকৃতির ঐতিহাময় সবুজ-শ্যামল রূপ আজ মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা ও নির্মমতার আঘাতে বিলীন হতে বসেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য যেকোনাে দেশের মােট জমির অন্তত ২৫ শতাংশ দরকার,সেখানে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ।ওয়ার্ল্ড রিসাের্সেস বনভূমি ইনস্টিটিউটের মতে, মাত্র পাঁচ শতাংশ, যা প্রয়ােজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। উপরন্তু অধিক জনসংখ্যার চাপে তাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশের সর্বত্র বৃক্ষ নিধনের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। কিন্তু বৃক্ষ লাগানােতে যেন সবারই অনীহা। ফলে বনজসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বন উজাড়ের মাধ্যমে ধারণ করেছে কাঙালরূপ। বৃক্ষের ক্রমনিধন বাংলাদেশের আবহাওয়াতে সৃষ্টি করেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশেষত উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়ায় দিনের বেলা দুঃসহ গরম আর রাতে প্রচণ্ড শীত। ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে এখন কেবলই বৈচিত্রতার অভাব, সময়মতাে বৃষ্টির অভাব, অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস, অস্বাভাবিক উষ্ণতা ইত্যাদি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা:

দেশকে, দেশের পরিবেশকে তথা বিশ্ব পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রয়ােজন বনায়ন। আধুনিক সভ্যতার শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বহু জায়গা সম্পূর্ণ বৃক্ষহীন হয়ে পড়েছে। দেশ যেন দিন দিন মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে। রুক্ষ নগরসভ্যতায় বৃক্ষের ছায়াশীতল স্নিগ্ধতা ফিরিয়ে দিতে হলে বৃক্ষরােপণ অপরিহার্য। বৃক্ষ নিধনের ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের যে বিপর্যয় নেমে আসছে তা থেকে রক্ষা পেতে হলে বৃক্ষরােপণ করা প্রয়ােজন। পর্যাপ্ত বনভূমির অভাবে সৃষ্ট অনাবৃষ্টির কারণে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনের পর দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, জীবনােপযােগী পরিবেশের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক গাছ। লাগানাে আজ অবশ্য পালনীয় দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।

বনায়নের উপায়:

বাংলাদেশে রয়েছে বনায়নের  বিপুল সম্ভাবনা। তাই পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরােপণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে । সামাজিকভাবে এ কর্মকাণ্ডে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাঁধ, সড়ক, রেললাইন, খালের পাড়, পুকুর পাড়, খাস পতিত জমি অর্থাৎ যেখানেই খালি জায়গা থাকবে সেখানেই গাছ লাগানাের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য অর্থনৈতিক প্রণােদনা অর্থাৎ অতিরিক্ত আয়ের উৎস প্রদান করতে হবে। গাছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যেন গ্রামবাসী এবং বনায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা থেকে খাদ্য, ফল ও জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারে। প্রয়ােজনে সরকারি ঋণ, ভর্তুকি, অনুদান এবং বিনামূল্যে বীজ ও চারা সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে বৃক্ষরােপণের উপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে। সর্বোপরি, সুপরিকল্পিতভাবে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার আওতায় বৃক্ষরােপণ কর্মসূচি ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করতে হবে।

বৃক্ষরােপণ কর্মসূচি ও গৃহীত পদক্ষেপ:

বহুদিনের অবিবেচনা প্রসূত বৃক্ষ নিধনের ফলে পরিবেশ যে বিপর্যস্ত রূপ ধারণ করেছে তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বৃক্ষরােপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে বন অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮২ সালে উত্তরাঞলের বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত কমিউনিটি বনায়ন কর্মসূচি। ৭ হাজার গ্রামকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। আশির দশকে বৃক্ষরােপণ কর্মসূচির ব্যাপকতা লক্ষণীয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশের ৬১ জেলায় থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৮০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ  দেয়া এবং জনসাধারণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে বৃক্ষমেলার আয়ােজন এবং ১ কোটি ৮ লাখ চারা সরকারি নার্সারি থেকে বিতরণ করা হয়। বৃক্ষরােপণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

আমাদের দেশে প্রতিবছর বনজ সম্পদ রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য বৃক্ষরােপণ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সাধারণত প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে এ অভিযান চালানাে হয়। এ সময় বৃক্ষের প্রয়ােজনীয়তা, চারারােপণ পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয় ।

সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রয়াস:

যেকোনাে কর্মসূচির সফলতা নির্ভর করে জনসাধারণের সচেতন ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ জনমনে এ প্রসঙ্গে সচেতনতার সার করতে হবে। কেননা সাধারণ জনগণ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ভয়াবহতা সম্বন্ধে অবহিত হলেই বৃক্ষরােপণের তাগিদ অনুভব করবে। আর তখনই পরিবেশকে বাঁচানাের এ মহৎ ও বৃহৎ প্রচেষ্টা সফল হবে। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়ােজনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, পথনাটক, পােস্টার ছাপানাে, লিফলেট বিতরণ ও মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

উপসংহার:

গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু । মানবজীবনে গাছের রয়েছে নানামুখী ও ব্যাপক অবদান। তেমনি সুস্থ, সুন্দর, সুবিন্যস্ত পরিবেশের ক্ষেত্রেও রয়েছে এর বিরাট সহায়ক ভূমিকা। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়ােজনীয় আসবাব, খাদ্য, জ্বালানি, আয় ও  কর্মসংস্থান অনেক কিছুর চাহিদা পূরণ করে গাছপালা। বিশেষত গ্রামীণ দরিদ্র জনজীবনে গাছের ভূমিকা যেন আশীর্বাদস্বরূপ । তাই বিপন্ন পরিবেশকে বাঁচাতে এবং সাধারণ জনজীবনকে সমৃদ্ধ করতে বৃক্ষরােপণ কর্মসূচি বর্তমান সময়ের অনিবার্য দাবি। তাই ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। – এ আন্দোলনে শরিক হয়ে বৃক্ষরােপণের বৃহৎ কর্মযজ্ঞে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।

বৃক্ষরােপণ অভিযান রচনা, বৃক্ষরোপণ অনুচ্ছেদ রচনা, বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন রচনা, বৃক্ষরোপণ প্রকল্প pdf, বৃক্ষরোপণ রচনা স্থান, নির্বাচন মুজিববর্ষে বৃক্ষরোপণ রচনা, বৃক্ষরোপণ এর গুরুত্ব বৃক্ষরোপণ রচনা, ৬ষ্ঠ শ্রেণী বৃক্ষরোপণ ছবি

Leave a Reply