বোকো হারাম: আফ্রিকার নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থানপর্ব

বোকো হারাম পৃথিবীর বর্বরতম সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কয়েক বছরের মাঝেই সশস্ত্র হামলা, সংঘাত আর নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে ছাড়িয়ে গেছে পৃথিবীর অন্য সকল সন্ত্রাসী সংগঠনকে। দুই দশকে নাইজেরিয়াভিত্তিক এই সন্ত্রাসী সংগঠনের হামলায় প্রায় এক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যাদের বড় একটা অংশ নারী আর শিশু। দুই দশকে বোকো হারাম পশ্চিমা কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে পুড়িয়ে দিয়েছে চৌদ্দশর বেশি স্কুল, পুড়িয়ে দিয়েছে প্রায় ২,২৯৫ জন শিক্ষককে। বোকো হারামের সন্ত্রাসী হামলাগুলোর কারণে হাজার হাজার নাইজেরিয়ান শিশু এতিম হয়েছে, হাজার হাজার নারী হয়েছেন বিধবা। গত দুই দশকে বোকো হারাম নাইজেরিয়ার অর্থনীতিতে প্রায় ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতিসাধন করেছে।

বোকো হারামের প্রতিষ্ঠা

সালাফি ধর্মগুরু মোহাম্মদ ইউসুফের হাত ধরে ২০০২ সালে বোকো হারাম প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও এই গ্রুপের অস্বিত্ব আর অপ্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ছিল নব্বইয়ের দশক থেকেই। মোহাম্মদ ইউসুফ ব্যক্তিগতভাবে সৌদি আরবে পড়াশোনা করেছেন। বৈশ্বিক সালাফি আন্দোলনের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নাইজেরিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় বোকো হারাম। আরবি এই গ্রুপের আসল নাম ‘জামাতুল আহলিস সুন্না লিদদাওয়াতি ওয়াল সুন্নাহ’। এই নামেই সদস্যরা পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। আরবি এই নামের অর্থ হচ্ছে ‘রাসুল (স.) এর শিক্ষা ও জিহাদের প্রতি প্রতিশ্রুত ব্যক্তিরা’। পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি পাওয়া বোকো হারাম নামটি এসেছে স্থানীয় হুসা ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘পশ্চিমা শিক্ষা নিষিদ্ধ’।

বোকো হারাম
বোকো হারামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ; Image Source: Cuitan Dokter.

প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম এক দশক শান্তিপূর্ণ উপায়েই নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বোকো হারাম। ২০০৩ সালে সীমান্ত পুলিশের সাথে দুইশো বোকো হারাম সদস্যের সাথে সংঘাতের ঘটনা ছাড়া মোহাম্মদ ইউসুফের জীবদ্দশায় আর কোনো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২০০৯ সালে সরকারি বাহিনী বোকো হারামের উপর নির্বিচারে দমন-পীড়ন শুরু করে, প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ নিহত হন পুলিশি হেফাজতে। এর পাশাপাশি প্রায় আটশো বোকো হারাম সদস্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন, আহত হন আরো কয়েকশো সদস্য। মোহাম্মদ ইউসুফের উত্তরসূরী হিসেবে মনোনীত হন তার প্রধান সহযোগী আবুবকর শেকাও। তার নেতৃত্বেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে বোকো হারাম।

কেন ঘটেছে বোকো হারামের উত্থান?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কলিয়ার আর হফলারের গবেষণা দাবি করছে, রাজনৈতিক বিপ্লব, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত আর গৃহযুদ্ধ নিখাদ সুযোগ ব্যয়ের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে পারে। যেসব দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য সহজে অর্থের যোগান পাওয়া যায়, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে, রয়েছে অর্থনৈতিক সুযোগ, সেসব দেশে জঙ্গিবাদ বিকাশের সম্ভাবনা বেশি। অনেক সময়ই সশস্ত্র সংঘাতের শুরু হয় অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে, সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির ভিন্নতার কারণে, সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু হতে পারে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মূল্যবোধের পার্থক্যের কারণেও। নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ বিকাশের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই রয়েছে, রয়েছে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর অর্থনৈতিক কারণ। নাইজেরিয়াতে রাজনৈতিক অধিকারের সীমাবদ্ধতা আছে। নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমিত, রয়েছে গভীর সামাজিক বিভাজন।

ধর্মীয় পরিচয়

পৃথিবীজুড়ে চলা সালাফি জিহাদী আন্দোলনগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শুরু হয় বোকো হারামের কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর নাইজেরিয়াতেই। উত্তর নাইজেরিয়া বহু সালাফি ধর্মগুরুর আবাসস্থল, নাইজেরিয়ার এই অংশের মাইদুগুরি শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় বোকো হারাম। প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ ছিলেন নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সালাফি ধর্মগুরু আবুবকর ঘুমির ছাত্র। পৃথিবীজুড়ে চলা অন্যান্য সালাফি আন্দোলনগুলোর মতো বোকো হারামের সদস্যরাও ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো অনুসরণ করার কথা বলে, যেগুলো রাসুল (স.) নিজের জীবনাদর্শের মাধ্যমে রেখে গেছেন। এর পাশাপাশি বোকো হারাম দাবি করে, নাইজেরিয়ার অবৈধ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার তাদের আছে, নাইজেরিয়াতে প্রয়োজন আছে শরিয়াহ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার। পাশাপাশি, বোকো হারাম ইসলামের অন্যান্য ধারার উপর সালাফি মতবাদ চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।

বোকো হারাম
বোকো হারামের যোদ্ধারা; Image Source: European Eye on Radicalization.

মোহাম্মদ ইউসুফ যখন বোকো হারাম প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি মুসলিম পরিচয়টি ব্যবহার করেন, ইসলামিক শাসনের যুক্তি তুলে ধরেন নাইজেরিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার বিপরীতে। বোকো হারাম নাইজেরিয়াকে তুলে ধরে একটি ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রকাঠামো হিসেবে, নিজেদের তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ভিক্টিম হিসেবে। বোকো হারামের দর্শনে নাইজেরিয়াতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলমানদের প্রতি অন্যায্য আচরণ করছে, রাষ্ট্র আক্রমণ করছে মুসলিমদের উপর, ইসলামের উপর।

সন্তান অল্প বয়সে প্রেম করছে? যা করবেন আপনি

অর্থনৈতিক সুযোগ ও সম্ভাবনা

অধিকাংশ সময়েই নৈতিক মূল্যবোধ আর জাতিগত পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা থেকে শুরু হওয়া সশস্ত্র সংঘাত অর্থনৈতিক চরিত্র ধারণ করে। সশস্ত্র সংঘাতের এই পরিক্রমা দেখা গেছে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে, কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থী শক্তিগুলোর ক্ষেত্রে, এমনকি ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংকটেও।

বোকো হারাম উত্তর নাইজেরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলো থেকে খাজনা আদায় করে, অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যাংকে ডাকাতি করে, মুক্তিপণ আদায় করে অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবানদের অপহরণ করে। তারা অর্থের যোগান পেয়েছে আল-কায়েদার কাছ থেকে, আইএসের উত্থানের পর অর্থের প্রবাহ এসেছে তাদের দিক থেকেও।

যৌক্তিক পছন্দ তত্ত্বানুযায়ী, একজন মানুষ সবসময়ই চায় তার কাছে থাকা তথ্যের উপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায় করে নিতে, নিজেকে অন্যদের চেয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখতে। যৌক্তিক পছন্দ তত্ত্ব অযোক্তিক সিদ্ধান্তগুলোকে ব্যাখ্যা করতে না পারলে একজন যৌক্তিক অ্যাক্টর কীভাবে সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করে, সন্তুষ্টি অর্জন করে স্বার্থ আদায়ের মাধ্যমে, সেটি ব্যাখ্যা করে। বোকো হারামের উত্থানকেও যৌক্তিক পছন্দ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

বোকো হারাম
নাইজেরিয়ায় তেলের খনিসমূহ; Image Source: Stratfor.

ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বোকো হারামের অস্ত্র তুলে নেওয়ার পেছনেও কারণ রয়েছে। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও নাইজেরিয়াতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বসবাস করে, রয়েছে তীব্র আয়বৈষম্য। অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি পাঁচজন নাইজেরিয়ানের মধ্যে তিনজন দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে, দৈনিক আয় করে ১ ডলারের কম। নাইজেরিয়ার দরিদ্র অর্ধ কোটি মানুষের সম্পদের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার, সর্বোচ্চ ধনী পাঁচজন ব্যক্তির মোট সম্পদের পরিমাণও ৩০ বিলিয়ন ডলার। নাইজেরিয়ার ৬০ শতাংশ মানুষ নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না, পায় না ন্যূনতম কোনো নাগরিক সুবিধা। অথচ, স্বাধীনতার পরে কেবলমাত্র তেল রাজস্ব থেকেই প্রায় শত বিলিয়ন ডলার আয় করেছে নাইজেরিয়া। সামষ্টিকভাবে, এমন একটি সমাজে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক ঘটনা না।

বোকো হারামের অর্থ আয়ের বহুমুখী উৎস রয়েছে। খাজনা আদায় আর বৈশ্বিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে অর্থের প্রবাহ ছাড়াও তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে তেলের উৎস। নিয়মিত তারা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করে, করে ব্যাংক ডাকাতি। কয়েক বছরেই নাইজেরিয়া আর ক্যামেরুনের সরকারের কাছ থেকে এরা কেবলমাত্র মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করেছে দশ মিলিয়ন ডলার। একজন সাধারণ নাইজেরিয়ান আয় করেন ১ ডলারের কাছাকাছি, একজন নাইজেরিয়ান সৈনিকের বেতন দৈনিক ৩ ডলার, সেখানে একজন বোকো হারামের সন্ত্রাসী দৈনিক আয় করেন ৩০ ডলারের মতো। যেকোনো ব্যক্তির জন্যই এই অর্থের প্রবাহ ঈর্ষণীয়।

বোকো হারাম
মুক্তিপণ আদায় বোকো হারামের অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস; Image Source: BBC.

নাইজেরিয়ার ব্যর্থ রাষ্ট্রকাঠামো

রাষ্ট্র হিসেবে নাইজেরিয়া বরাবরই দুর্বল; দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের অধীনে উত্তর নাইজেরিয়াতে রাষ্ট্রের কার্যক্রমও অত্যন্ত সীমিত। উত্তর নাইজেরিয়ার মোট শিশুর ১০ শতাংশেরও কম বয়স অনুযায়ী টিকাগুলো পায়, শিক্ষার হারও সেখানে ২০ শতাংশের নিচে। সেখানকার বর্ন, ইয়োব, বাউচি, সকতের মতো প্রদেশগুলোর রাষ্ট্র প্রায় অনুপস্থিত, নাগরিকরা নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে না। এসব জায়গায় ভিক্টিম হওয়ার চেয়ে বোকো হারামের মতো সংগঠনের সদস্য হওয়া নাগরিকদের জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো পছন্দ হিসেবে উঠে আসে।

রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নাগরিকেরা যখন বৈধ উপায়ে প্রতিবাদ করতে পারেন না, রাষ্ট্র অর্থনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেয় না, তখন রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের প্রতিবাদে সশস্ত্র উপায় খুঁজে নেয় নাগরিকেরা। প্রথমে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়, পরবর্তীতে হামলা চালায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোতে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় এই ধরনের প্রবণতা বেশি দেখা যায় ব্যক্তির মধ্যে, সশস্ত্র পন্থা বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় রাষ্ট্রে স্কেপগটিং আর হেইট ক্রাইমের ঘটনা ঘটলেও।

ভি এস নাইপল : জীবন ও সাহিত্য V.S. Naipaul Books Biography

তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তেল রাজস্বের ব্যবহার কেন্দ্র করে, তেল বিক্রি করে উপার্জিত অর্থের ৯০ শতাংশই ব্যয় হয়েছে দক্ষিণ নাইজেরিয়ার উন্নয়নে। অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে খ্রিষ্টানপ্রধান দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে বেশি; সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন এই অঞ্চলে রয়েছে তুলনামূলকভাবে ভালো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার সুবিধা, রয়েছে তুলনামূলক বেশি রাজনৈতিক সুবিধা।

অন্যদিকে, মুসলিমপ্রধান উত্তর নাইজেরিয়াতে ১১ কোটি মানুষ বসবাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রবাহও এই অঞ্চলে আসে কম। রাজনৈতিক সুবিধা কম থাকায়, উত্তর নাইজেরিয়াতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের কর্তৃত্বমূলক প্রবাহও আসে না, রাজনৈতিক এলিটরাও এই অঞ্চলের প্রতি সহানুভূতিশীল নন। ফলে, মুসলিমপ্রধান উত্তর নাইজেরিয়াতে বোকো হারামের কর্মকাণ্ডের একধরনের বৈধতা তৈরি হয়েছে, নাগরিকদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে সমর্থকশ্রেণী।

Source: roar.media

Leave a Reply