ভগবান শ্রী রজনীশ, অশো বা আচার্য রজনীশ নামে পরিচিত, আসল নাম চন্দ্র মোহন জৈন (১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩১ – ১৯ জানুয়ারী ১৯৯০) গুগলের মতে ভারতীয় পাবলিক স্পিকার, রহস্যবাদী আধ্যাতিক গুরু, অনেকের মতে যৌনতার দীক্ষাগুরু, কেউ কেউ মানেন ধর্মগুরু হিসেবেও। নিজেকে নিজে পরিচয় দিতেন ভগবান হিসেবে। অবশ্য ভগবান হিসেবে নিজেকে দাবী করা প্রথম মানুষ যে রজনীশ তা নয়। কিন্তু নিজেকে ভগবান দাবী করা এই কথিত সন্ন্যাসীর জীবন ছিল বৈচিত্রময় এবং রহস্যে ঘেরা।
জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে একের পর এক বিতর্কের। অগাধ ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন অশো। বিশ্বাস করতেন মানুষের সৃষ্টি সবচেয়ে বড় মিথ্যার নাম ঈশ্বর এবং অবাধ যৌনতার মাধ্যমেই শান্তি আনা সম্ভব পৃথিবীতে। তিনি তার শিষ্যদের ধ্যানের শিক্ষা দিতেন এবং সেই সঙ্গে তার আশ্রমে ছিল অবাধে যৌনাচারের সুযোগ। কখনো কখনো ধ্যানে মগ্ন না হতে পারলে মানসিক প্রশান্তি আনার জন্য ড্রাগ গ্রহনের পরামর্শও দিয়েছেন রজনীশ।
“সম্ভোগ সে সমাধি” অর্থাৎ যৌনমিলনের দ্বারাই সমাধিস্থ বা ধ্যানস্থ হওয়া সম্ভব। তার মতে যৌনমিলনই মোক্ষলাভের মোক্ষম পথ। এই উক্তি দিয়েই একসময় সারা বিশ্বের কাছে জনপ্রিয় এবং প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে ওঠেন স্বঘোষিত ভগবান শ্রী রজনীশ। ভারতের মধ্য প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী রজনীশ ছোট থেকেই ছিলেন দর্শন শাস্ত্র আগ্রহী। পরবর্তীতে দর্শন শাস্ত্রেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন ডিএন জৈন কলেজ এবং সাগার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মধ্য প্রদেশের রাইপুরের সংস্কৃত কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন এর পরপরই। শিক্ষকতা করার সময় থেকেই ১৯৭০ সালে মুম্বাইতে তিনি তার নতুন ধরনের এই উদ্ভট চিন্তাভাবনার প্রচার করেন। সেই থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মুম্বাইতেই বিভিন্ন জায়গাতে তার দর্শন প্রচার করতেন বক্তব্য দিয়ে। তার প্রচারিত নতুন ভাবনাগুলো সবাই উদ্ভট বলেই মনে করতো। তবুও বিশাল সংখ্যক মানুষ ভক্ত বনে গিয়েছিলেন অশোর।
ভক্তদের নিয়ে অবাধ যৌনাচার, ধ্যান এবং মাদকের আশ্রম রজনীশপুরম তৈরি করেন মুম্বাই তে। এর পরের সাত বছর নিজস্ব মতবাদ প্রচারের জায়গা হিসেবে বেছে নেন ভারতের আরেক বিখ্যাত শহর পুনেকে। পুনেতেও একইভাবে শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে গড়ে তোলেন রজনীশপুরমের আরেকটি শাখা। এই আশ্রম আর অবাধ যৌনতার দর্শন নিয়ে ভারত থেকে ছড়িয়ে যান সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত। এভবেই দিনে দিনে বাড়ছিল ভগবান শ্রী রজনীশের আশ্রমের পরিধি সাথে ইউরোপ-আমেরিকান অনুগামীর সংখ্যা। এ সময় থেকেই তার বক্তৃতায় দার্শনিক ব্যাখ্যার বদলে ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে ‘নোংরা’ চুটকি। এসব কিছুকেই পুঁজি করে ততদিনে স্বঘোষিত ভগবান জি দেশ ছাড়িয়ে পাড়ী জমালেন মার্কিন মূলুকে। মূলত পেছনের বিতর্ক সাথে নিয়ে বড় বিতর্ক আর শান্তির বাণীর মধ্যে স্লো পয়জনের মত অশান্তির টক্সিসিটি ছড়িয়ে আলোচিত হয়েছেন জীবনের এই পর্যায়েই।
মার্কিন মুলুকে ততদিনে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করতে শুরু করেছেন রজনীশ। আগের দফায় পুনে থেকে একদল মানুষ সাক্ষাৎ করে গিয়ে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে এই প্রতিপত্তি গড়তে সাহায্য করেছেন। তবে ভীত কিন্তু তখনও মজবুত হয়নি। আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েই ওরেগনের একটি নির্জন জায়গায় একটি খামার কেনার পরিকল্পনা করেন। একটি আশ্রম গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই জায়গা ক্রয় করেন অশো। কিন্তু এই কাজের জন্য মার্কিন সরকারের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। টাকার বিনিময়ে সেই কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন একজন মার্কিন নাগরিক। তখনো ঐ ব্যক্তির কোনো ধারণাই ছিল না যে স্বঘোষিত ভগবান রাজনীশের হাজার হাজার ভক্ত রয়েছে। পরে ভক্তরা যখন ওরেগনের নির্মানাধীন আশ্রমে দলে দলে এসে ভীড় জমাতে থাকলো তখন তিনি বিষয়টা উপলব্ধি করেন। এ পর্যায়ে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, “কীভাবে রজনীশ এত সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন যে ভারত থেকে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমিয়ে একটি খামার কিনে ফেললেন?” সে প্রশ্নের উত্তরও রজনীশ এবং তার ভক্তকূলের মধ্যেই আছে। প্রথাবিরুদ্ধ উদ্ভট দর্শনের অবতারনা করে রজনীশ ভারত এবং মার্কিন মুলুকে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে খুব ভালো মত পৌছাতে না পারলেও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষদের ভক্ত এবং শিষ্য হিসেবে পেয়েছেন বরাবরই। সুখের সন্ধান পেতেই আসতেন অশোর আশ্রমে। কেউ কেউ সর্বস্বও বিসর্জন দিয়েছেন রজনীশের দর্শন প্রচারে। পৃথিবীর শীর্ষ ধনীরা তার শিষ্য-ভক্ত। যখন তাকে প্রশ্ন করা হতো, তার ভক্তরা ধনী কেন? তার সপাট উত্তর, “সব মহাপুরুষ গরীবদের উদ্ধারের জন্য এসেছেন, আমি না হয় ধনীদের উদ্ধারের জন্যই রইলাম।”
এভাবেই অনেক ধনী শুরু থেকেই সর্বস্ব বিসজর্ন দিয়ে আসছেন। আমেরিকার ওরেগনের এই নতুন আশ্রমেও তার ব্যতিক্রম না। যৌনমুক্তির জোয়ারে ভাসতে থাকলো গোটা আমেরিকা। আন্দোলনের নাম দেয়া হলো ‘নয়া সন্ন্যাস’। বাধাহীন যৌনতাই মুক্তির একমাত্র পথ, রজনীশের এই তত্ত্বে ভারতের পর এবার গা ভাসিয়ে দিলো আমেরিকার ধনীদের দল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো অশো নানান ভাবে বিভ্রান্ত করতে শুরু করেছিলেন তার ভক্তদের, বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ে সাংঘর্ষিক মতবাদ দিয়ে। ভারতে যা সম্ভব হয়নি অশো তার ষোলো কলা পূর্ণ করেছেন ওরেগনের এই আশ্রমে। প্রতিদিন সফট মিউজিকের সাথে খুব নিরবে অশো নব্বই মিনিটে ব্যাখ্যা করতেন তার দর্শন এবং যৌনতার মশলা মাখানো অদ্ভুত সব তত্ত্ব যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘তান্ত্রিক যৌনতা’। তিনি গভীর দৃষ্টি দিয়ে ভক্তর চোখের দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে যখন কোনও ভক্তের কপাল স্পর্শ করতেন, সেই ভক্তের শরীরে নাকি পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে ভর করতো দাবি করেছেন তার অনেক ভক্ত। আশ্রমে অন্তর্বাস ছাড়া ঢিলেঢালা পোশাকে প্রবেশ এর নিয়ম ছিলো কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে যৌনতায় নিষেধ ছিল না। এভাবে চেনা অচেনা অসংখ্য মানুষ অবাধে মিলিত হতেন আশ্রমে। মূলত সেই জন্যই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন রজনীশ আমেরিকাতে। এমনই নিত্য নৈমিত্তিক আজগুবি কার্যক্রমে এগিয়ে চলতে থাকে আশ্রমের কার্যক্রম।
স্বঘোষিত ভগবান, রাজনীশ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে ১৯৮১ সালে পাড়ি জমায় আমেরিকায়। সেখানে নিজের নামে শহর গড়ে তুলে এবং সমালোচনার ঝড় তুলে পাঁচ বছরের মধ্যেই আবার সব শেষ হয়ে যায়। রাজনীশের বেশ ভালো সংখ্যক অনুসারী ছিল, যাদের বেশিরভাগ আমেরিকার বাইরে ও শহরাঞ্চল থেকে এসেছিল। আমেরিকায় পৌঁছানো মাত্রই রাজনীশ ওরিগনে বিশাল এক অঞ্চল কিনে নেয় এবং তার অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলে রাজনীশপুরাম নামে একটি শহর। নিজের নামে শহর গড়ে তোলার প্রায় তিন বছর পর্যন্ত রাজনীশ জনগণের সাথে কথা বলেননি।
মা আনন্দ শীলা ছিলেন এই আধ্যাত্মিক গুরুর একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী যিনি এই পুরো শহরটি পরিচালনা করতেন। সে সময় বিশাল এই শহরের মাসিক পরিচালনা ব্যয় ছিল ২.৫ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় একা হাতেই সামলাতেন শীলা। স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও নিয়মের তোয়াক্কা করতো না রাজনীশপুরামের বাসিন্দারা; সমস্যার শুরু এখান থেকেই। রাজনীশ জাগতিক সুখে বিশ্বাসী ছিলেন, অবাধ যৌনাচারের প্রচার করতেন এবং এই আধ্যাত্মিক গুরুর ৯৩টি রোলস রয়েস ছিল।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকার পরও, খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি রাজনীশের অবজ্ঞা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। তাদের ক্রমাগত উগ্র ও অসহনশীল আচরণ স্থানীয়দের চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। বলতে গেলে, এটি ছিল প্রথাগত ও অ-প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার একটি দ্বন্দ্ব। ১৯৮৫ সালের দিকে আমেরিকায় প্রথম জৈব-রাসায়নিক আক্রমণের জন্যে দায়ী করা হয় মা শীলা আনন্দসহ রাজনীশপুরামের কিছু নেতাকে, যারা একটি রেস্টুরেন্টের খাদ্যে বিষক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিল এবং এই ঘটনায় প্রায় ৭৫০ জন আক্রান্ত হয়। এরপর শীলাসহ অভিযুক্তরা পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে যায় এবং রাজনীশপুরামের কার্যক্রম প্রায় থেমে যায়। ১৯৯১ সালে রাজনীশ মারা গেলেও তার মতবাদ এখনো জীবিত।