ভারতের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনাকারী কে এই বিপিন রাওয়াত | প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিপিন রাওয়াতের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা

তামিলনাড়ুতে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৪ জনকে বহনকারী সামরিক হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াত নিহত হয়েছেন। বুধবার দুপুরে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

২০১৯ সালে দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) বা প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং এর আগে ভারতের ১০ লাখ সেনার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রায় ৬৩ বছর বয়সী একজন কঠোর সৈনিক এবং একজন অনুপ্রেরণাদায়ক কমান্ডার হিসেবে তার খ্যাতি ছিল, যিনি কখনও কখনও রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।

জেনারেল রাওয়াত ১৯৫৮ সালের ১৬ মার্চ ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডে এক গঢ়ওয়ালি রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং তার মা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদের কন্যা।

 

সামরিক প্রশিক্ষণের সময় সেরা ছাত্র হিসেবে জেনারেল রাওয়াত ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ এবং ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে ‘সোর্ড অফ অনার’ পুরষ্কার পান। এছাড়াও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কমান্ড এবং ক্যানসাসের ফোর্ট লিভেনওয়ার্থে জেনারেল স্টাফ কলেজের সঙ্গেও একটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন।

তিনি ১৯৭৮ সালে তার বাবার সামরিক ইউনিট ১১ গোর্খা রাইফেলস-এ যোগদান করেন। এর পরে, তিনি সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ-উচ্চতায় যুদ্ধ এবং বিদ্রোহ বিরোধী অভিযানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তিনি।

তিনি একজন সুসজ্জিত অফিসার ছিলেন যিনি প্রায়শই দেশের অশান্ত অঞ্চলের ইউনিটগুলোকে নেতৃত্ব দিতেন। দীর্ঘ কর্মজীবনের বড় অংশ জম্মু ও কাশ্মীরে কাটিয়েছেন রাওয়াত।

১৯৮০-র দশকে চীনের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনার সময় ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল হিসেবে জেনারেল রাওয়াত তার ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

২০১৫ সালে যখন তিনি ৩ কর্পসের দায়িত্বে ছিলেন, জেনারেল রাওয়াত ভিন দেশের মাটিতে ভারতের প্রথম আনুষ্ঠানিক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শুরু করেছিলেন। সেসময় তিনি ভারতীয় সেনাদের উপর অতর্কিত হামলার জবাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নাগা বিদ্রোহীদের আক্রমণ করার জন্য একটি প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়ন পাঠান।

একই বছর, তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য নাগাল্যান্ডে একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান।

২০১৬ সালে তিনি ভারতের ২৭তম ভারতীয় সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার থেকে সিনিয়র দুই অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

পরের বছর ভারত একটি আন্তর্জাতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। ভারত শাসিত কাশ্মীরে একজন বিক্ষোভকারীকে সেনাবাহিনীর জিপের সামনে বেঁধে রেখে ঘুরিয়েছিল এক সেনা অফিসার। জেনারেল বিপিন রাওয়াত এই কাজের জন্য তাকে একটি পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

জেনারেল রাওয়াত এই কাণ্ডকে ‘নোংরা যুদ্ধে’ ওই অফিসারের একটি অভিনব ‘উদ্ভাবন’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘লোকে আমাদের দিকে ঢিল ছুড়ছে, মানুষ আমাদের দিকে পেট্রোল বোমা ছুড়ছে। আমার লোকেরা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমরা কী করব, আমি কি বলব, শুধু অপেক্ষা করুন এবং মারা যান? আমি একটি জাতীয় পতাকা সহ একটি সুন্দর কফিন নিয়ে আসব এবং তোমার মরদেহ সম্মানের সঙ্গে তোমার বাড়ি পাঠাব। সেনাপ্রধান হিসাবে আমি কি তাদের শুধু একথাই বলব? কিন্তু আমাকে তো আমার সৈন্যদের মনোবলও বজায় রাখতে হবে যারা সেখানে যুদ্ধ করছে’।

কাশ্মীরে বিক্ষোকারীদের পাথরে সেনাদের আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিপিন বলেছিলেন, ‘পাথরের বদলে ওরা যদি গুলি ছুড়ত, আমাদের পক্ষে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হত।’

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্থলসেনা প্রধানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল রাওয়াতের। তাঁর এক দিন আগে দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে নিযুক্ত করে মোদী সরকার।

২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় উন্নত করার জন্য সিডিএস-এর পদ সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীর জন্য অর্থায়নের উপরও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল।

এই দায়িত্ব গ্রহণের সময় জেনারেল রাওয়াত ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে তার কথিত ঘনিষ্ঠতার জন্য সমালোচনার শিকার হন। তবে তিনি বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তার সমালোচকরা বলেছেন যে, তার কিছু বক্তব্য ভারতের সামরিক বাহিনীর ‘অরাজনৈতিক’ ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গেছে।

তিনি একবার আসামে মুসলিম-অধ্যুষিত অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট পার্টির উত্থানকে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। যার ফলে সংখ্যালঘু নেতারা তাকে বিজেপির ‘তোতাপাখি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

বিপিনের আগে ভারতের দুই প্রাক্তন সেনাপ্রধান কে এম কারিয়াপ্পা এবং শ্যাম মানেকশকে অবসরের পর আলঙ্কারিক ভাবে ফিল্ড মার্শাল পদে উত্তীর্ণ করা হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনার সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব পাননি তারা।

মোদী সরকার সেনা বিধি সংশোধন করে বিপিন রাওয়াতকেই প্রথম ভারতের তিন বাহিনীর ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজর’-এর দায়িত্ব দিয়েছিল। জল্পনা ছিল, অবসরের আগে রাওয়তকেও পাঁচতারা ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হতে পারে। জীবদ্দশায় সেই সুযোগ পেলেন না রাওয়ত।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জেনারেল বিপিন রাওয়াত ভারতের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন।

জেনারেল রাওয়াতের নেতৃত্বে ভারতের সামরিক একীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু তিন বাহিনীর জন্য সমন্বিত থিয়েটার কমান্ড এখনও গঠিত হয়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘জেনারেল বিপিন রাওয়াত একজন অসাধারণ সৈনিক ছিলেন। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করতে বিশাল অবদান রেখেছেন। কৌশলগত বিষয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি এবং দৃষ্টিকোণ ছিল ব্যতিক্রমী। তার পরলোক গমন আমাকে গভীরভাবে শোকাহত করেছে। ওম শান্তি’।

বিপিন রাওয়াত

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বিপিন রাওয়াতের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা

তামিলনাড়ুতে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৪ জনকে বহনকারী সামরিক হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াত নিহত হয়েছেন। তার স্ত্রীসহ মোট ১৩ জন নিহত হয়েছেন। বুধবারের দুর্ঘটনার এমনই বিবরণ দিচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

কৃষ্ণস্বামী নামে কুন্নুরের এক বাসিন্দা বলছেন, ‘প্রথমে একটা কানফাটানো আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলাম, হেলিকপ্টারটি প্রচণ্ড গতিতে প্রথমে একটি গাছে ধাক্কা মারল। তার পরই দেখতে পেলাম একটা আগুনের গোলা। পরমুহূর্তেই সেটা সজোরে আরও একটি গাছে ধাক্কা মারল। দেখলাম, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ওই কপ্টারটি থেকে দু’তিন জন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের গোটা শরীরই পুড়ে গিয়েছে তত ক্ষণে।’

কৃষ্ণস্বামী আরো বলছেন, ‘এর পর আমি লোকজনকে ডেকে আনি। আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করি। দমকল এবং পুলিশকেও খবর দেয়া হয়।’

 

বুধবার বেলা ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে তামিলনাড়ুর কুন্নুরে চা বাগানে ভেঙ্গে পড়ে ওই কপ্টারটি। তাতে ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অর্থাৎ সেনা সর্বাধিনায়ক বিপিন রাওয়াত। ছিলেন তার স্ত্রী মধুলিকাও। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা দেখে হকচকিত প্রত্যক্ষদর্শীরা।

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক নিহত হয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রধান বিপিন রাওয়াত।

তামিলনাড়ুর কুন্নুরের গভীর জঙ্গলে স্থানীয় সময় বুধবার বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে  দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিপিন রাওয়াতকে বহনকারী সেনা হেলিকপ্টারটি। ওই দুর্ঘটনায় বিপিন রাওয়াত আর স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াতসহ ১৩ জন আরোহী নিহত হয়েছেন। ওই হেলিকপ্টারের একমাত্র জীবিত আরোহী গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিংহ তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটনের সেনা হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।

বিপিন রাওয়াত স্বাধীন ভারতের সামরিক ইতিহাসে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার সর্বাধিনায়ক হওয়ার কৃতিত্বের অধিকারী। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি এই পদে নিযুক্ত হন তিনি।

১৯৫৮ সালের ১৬ মার্চ উত্তরাখণ্ডের পৌড়ীর এক গঢ়ওয়ালি রাজপুত পরিবারের জন্ম বিপিনের। তার পরিবারে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইতিহাস পুরুষানুক্রমিক। বাবা লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়ত ছিলেন ভারতীয় সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল। সেই রীতি মেনেই সেনায় যোগদান করেন রাওয়াত।

তার স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াত  মধ্যপ্রদেশের প্রয়াত রাজনীতিবিদ ছিলেন মৃগেন্দ্র সিংয়ের মেয়ে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন তিনি।

স্বামী সেনার সর্বাধিনায়ক হওয়ায় মধুলিকা ছিলেন ‘ডিফেন্স ওয়াইভস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’এর সঙ্গে যুক্ত।

মধুলিকা রাওয়াত ভারতের অন্যতম বড় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আর্মি ওয়াইভস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

মৃত সেনা সদস্যদের স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে নিয়মিত দেখা যেত মধুলিকাকে।

মৃত সেনা সদস্যদের স্ত্রীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে এই সংগঠন বিউটিশিয়ান কোর্স চালায়। এ ছাড়াও কেক ও চকোলেট বানানো শেখানো হয়। সেই সব কাজে যুক্ত ছিলেন মধুলিকা।

বিপিন ও মধুলিকা দম্পতির দুই মেয়ে রয়েছে।

বিপিন রাওয়াত,হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে ভারতের প্রতিরক্ষাপ্রধান বিপিন রাওয়াত,বিপিন রাওয়াতের পরিবার সম্পর্কে যা জানা গেল,Bipin Rawat: প্রয়াত চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত,কপ্টার দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক বিপিন রাওয়াত প্রয়াত

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।

Leave a Reply