যেভাবে মানুষ অন্য প্রাণীর দুধ খেতে শিখলো

বিবর্তনের প্রথম দিকে মানুষের অন্য প্রাণীর দুধ হজম করতে পারতো না। কিন্তু এখন অনেক জনগোষ্ঠীই গরু, উট, বা ছাগলের দুধ খায়।

কিভাবে মানুষের শরীরে অন্য প্রাণীর দুধ হজম করার ক্ষমতা তৈরি হলো?

ইদানীং বাজারে প্রাণীর দুধের নানা ‘প্রতিযোগী’ এসে গেছে। যেমন সয়া দুধ, আমন্ড বাদামের দুধ – এগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে।

যারা ‘ভেগান’ – তাদের জন্য, অথবা যাদের দুধে এ্যালার্জি আছে – তাদের জন্য এই বিকল্পগুলো বেশ সুবিধাজনক।

কিন্তু এগুলো এখনো জনপ্রিয়তার দিক থেকে প্রাণীজ দুধের কাছাকাছি আসতে পারে নি।

বিবিসির মাইকেল মার্শাল এক রিপোর্টে লিখছেন, প্রাণীজ দুধের সাথে মানুষের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের পুরোনো। এর ইতিহাসও অতি বিচিত্র উত্থান-পতনে ভরা।

মানুষ হয়ে অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা কি একটা ‘আজব’ ব্যাপার?

১২ বছরে বুক ফুঁড়েছিল ব্রিটিশদের গুলি, সহবাগের টুইটে ফের চর্চায় ‘দেশের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ’

দুধ খাওয়াটা মানুষের কাছে এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে কেউ যদি বলে – এটা একটা আজব কাজ – তাহলে এ কথা যে বলবে তাকেই বরং আপনার একটা উদ্ভট লোক বলে বনে হবে।

কারণ আমরা কখনো এভাবে চিন্তা করি না।

একটি গরু বা অন্য কোন প্রাণীর দেহে দুধ তৈরি হয় – তার বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু মানুষ কি করছে? তারা গরুটার বাঁট টিপে টিপে সেই দুধ বের করে নিয়ে নিজেরা খাচ্ছে। এটা কি একটা আজব ব্যাপার নয়?

কিন্তু এমন সংস্কৃতিও আছে, যেখানে প্রাণীর দুধ খাবার কথা অনেকেরই প্রায় অজানা।

এই সেদিন, ২০০০ সালে চীনে একটা প্রচারাভিযান শুরু হয়েছিল যাতে লোকে স্বাস্থ্যগত কারণেই আরো বেশি করে দুধ এবং দুধজাত খাবার খায়।

এই প্রচারাভিযানটিকে চীনের বয়স্ক লোকদের দিক থেকে গভীর সন্দেহের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। দুধ থেকে যে পনির তৈরি হয় তা এখনও চীনের অনেক মানুষকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে।

বলা হয়, মানব প্রজাতির ইতিহাস মোটামুটি তিন লক্ষ বছরের। সে তুলনায় দুধ খাবার ইতিহাসকে প্রায় ‘নতুন’ বলা যায়।

মোটামুটি ১০ হাজার বছর আগেও মানুষ দুধ প্রায় খেতোই না।

খেলেও তা ছিল খুবই বিরল। প্রথম যে মানুষেরা দুধ খেতে শুরু করে তারা ছিল পশ্চিম ইউরোপের কৃষক ও পশুচারণকারী জনগোষ্ঠীর লোক । এরাই ছিল প্রথম মানুষ যারা গরু বা অন্য পশুদের পোষ মানিয়ে গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করেছিল।

বর্তমানে উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্য আরো অনেক জায়গায় দুধ পান করাটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।

মানুষের জন্য অন্য প্রাণীর দুধ খাওয়াটা যে ‘অস্বাভাবিক’ তার একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আছে।
‘বৈজ্ঞানিক যুক্তি’

দুধের মধ্যে আছে এক বিশেষ ধরণের শর্করা – যাকে বলে ল্যাকটোজ। ফল বা অন্যান্য মিষ্টি খাবারে যে শর্করা থাকে তার চেয়ে এটা অনেক আলাদা। আমরা যখন শিশু ছিলাম, আমাদের শরীর এক বিশেষ ধরণের এনজাইম তৈরি করতো যাকে বলে ল্যাকটেজ – যার কাজ ছিল আমাদের মায়ের দুধ হজম করতে সহায়তা করা। কিন্তু শিশু যখন মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয় – তখন অনেকের দেহেই সেই ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।

এই ল্যাকটেজ ছাড়া দুধ ঠিকমত হজম হয় না। তাই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি বেশি দুধ খায় তাহলে তার পেটে গ্যাস হওয়া, পেটে ব্যথা, খিঁচুনি অথবা ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন গরু, কুকুর বা বিড়ালের মধ্যেও দেখা যায় যে তারা পূর্ণবয়স্ক হলে তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে অনেকেই দুধ খেয়ে হজম করতে পারেন, কারণ তাদের দেহে ল্যাকটেজ তৈরি বন্ধ হয় না। মানুষের ক্ষেত্রে এটা কিভাবে ঘটলো?

দুধ হজম করার ‘ল্যাকটেজ’ এনজাইম কারো দেহে সারাজীবন থাকে, কারো থাকে না

প্রথম যে প্রাপ্তবয়স্ক ইউরোপিয়ানরা দুধ খেয়েছিল – তাদের হয়তো প্রচুর গ্যাস হতো।

কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই তাদের মধ্যে একটা বিবর্তন ঘটেছিল। তারা মায়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেও তাদের দেহে ল্যাকটেজ উৎপাদন অব্যাহত রয়ে গেল, দেখা গেল তারা দুধ খেলেও কোন বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে না।

এর কারণ হিসেবে ডিএনএ’র একটি অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে – যা ল্যাকটেজ জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রবণতাকে বলে ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স এবং এর বিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন প্যারিসের ‘মিউজিয়াম অব হিউম্যানকাইন্ড’-এর অধ্যাপক লোরে সেগুরেল। তিনি বলছেন, “ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রথম ল্যাকটেজ পার্সিস্টেন্স দেখা যায় এখন থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। আর মধ্য ইউরোপে এটা প্রথম দেখা যায় ৩ হাজার বছর আগে।”

বর্তমানে অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ প্রবণতা অর্থাৎ ‘দুধ হজম করার ক্ষমতা’ খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। উত্তর ইউরোপে এখন ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে।

আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।

কিন্তু এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে যাদের দেহে ল্যাকটেজের অব্যাহত উপস্থিতি অনেক বিরল। আফ্রিকানদের অনেকের মধ্যেই এটা নেই। এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও এটা সাধারণত দেখা যায় না।
কেন এমন হয়, তা এখনো এক ধাঁধাঁ

বৈজ্ঞানিকরা বলছেন: কোন কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কি কারণে দুধ খাবার অভ্যাস গড়ে উঠেছে এবং তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হচ্ছে – এটার কোন সূত্র বের করা খুবই কঠিন।

মি. সেগুরেল বলছেন, “দুধ খাওয়াটা ‘উপকারী’ হয়ে উঠেছে কেন, বা অন্য অনেক রকম খাদ্যের উৎস থাকলেও একেবারে অন্য রকম একটি খাদ্য এই দুধই কেন এতটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে – এটা বলা কঠিন।”

কেউ হয়তো বলতে পারেন, দুধ পান করার ফলে মানুষ নতুন একটি পুষ্টিদায়ক খাবারের সন্ধান পেয়েছে, তাদের অনাহারে থাকার ঝুঁকি কমেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এ যুক্তি খুব বেশি খাটে না।

যেসব লোক দুধ খেয়ে হজম করতে পারে না, তারাও অল্প পরিমাণ দুধজাতীয় খাবার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই খেতে পারে। তা ছাড়া দুধ থেকে যে মাখন, দই, ক্রিম এবং পনির তৈরি হয় – এর সবগুলোতেই ল্যাকটোজের পরিমাণ অনেক কমে যায়। চেডার এবং পারমিজিয়ানো নামে যে বিশেষ ধরণের পনির আছে তাতে মাত্র ১০ শতাংশ বা তারও কম ল্যাকটোজ থাকে।

“ঘন ক্রিম এবং মাখনে ল্যাকটোজের পরিমাণ সবচেয়ে কম” – বলছেন সেগুরেল। জানা যায়, চিজ বা পনির তৈরির কৌশল মানুষ বেশ দ্রুতই উদ্ভাবন করেছিল।

Leave a Reply