র‍্যাগ ডের নামে হচ্ছেটা কী!

র‍্যাগ ডের নামে হচ্ছেটা কী!

বিদ্যাপীঠে ১০ বছর কাটানোর পর শেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেন সবাই। একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে স্কুলের শেষ দিনটি উদযাপনের নাম ছিল ‘বিদায় অনুষ্ঠান’ বা ‘ফেয়ার ওয়েল’। তবে সময়ের আবর্তনে এখন তা হয়ে উঠেছে ‘র‌্যাগ ডে’। যেটাকে উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর বলছে অনেকে।

সাদা টি শার্ট গায়ে চলছে উদ্দাম নাচ, হচ্ছে ডিজে পার্টি, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ মেতেছেন রং খেলায়, আবার কেউ বন্ধুদের টি-শার্টে লিখছে অশ্লীল সব বার্তা। যেসব শব্দ সীমা ছাড়াচ্ছে অশ্লীলতার। এভাবেই এখন উদযাপিত হয় স্কুলজীবনের শেষ দিন! যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘র‌্যাগ ডে’।

র‌্যাগ ডে উদযাপনের ভিডিওতে দেখা গেছে উচ্ছৃঙ্খলতা আর অনৈতিকতার বিভিন্ন দৃশ্য। স্কুল ছাড়ার আগে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাজীবনে ব্যবহৃত বেঞ্চ ও টেবিল। নষ্ট করা হচ্ছে দেওয়াল কিংবা টয়লেট। বাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে ফ্যানের পাখা। সেগুলো আবার মোবাইল ফোনে ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে টিকটকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুধু স্কুল নয়, ‘র‌্যাগ ডে’ নামের এমন কালো থাবা ছড়িয়ে পড়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও।

 

যে স্কুলটায় শৈশব-কৈশোর কাটল, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জীবনের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিল, বিদায়বেলায় সেই স্কুলের সঙ্গেই কেন এমন নিষ্ঠুর আচরণ?

 

শিক্ষার্থীরা বলেন, টি-শার্টে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় সেগুলো আসলে ব্যবহার করার মতো না। স্কুলের চেয়ার বা বেঞ্চ ভাঙা এগুলো র‍্যাগডে বা আনন্দের মধ্যে পড়ে না। স্কুল থেকে খারাপ বদনাম নিয়ে যাওয়া তো উচিত না। আগের যে বিদায় অনুষ্ঠানটা করা হতো এখন আর সেটা করে হচ্ছে না তার পরিবর্তে র‍্যাগ ডে পালন করা হচ্ছে।

 

বলা হয়, নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শেখার আঁতুড়ঘর হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, শিক্ষার পাশাপাশি শিশুর মন-মানসিকতার মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে এ তীর্থস্থানে। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণে শিক্ষকদের নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, স্কুল প্রাঙ্গণেই হচ্ছে ডিজে পার্টি বা অনৈতিক কাজ। এসব পার্টির অনেক ভিডিওতে শিক্ষকদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে।

উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল জহুরা বেগম বলেন, এটা একটা অপসংস্কৃতি। যে প্রতিষ্ঠানই হোক এটি অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করব কোন প্রতিষ্ঠান এগুলো করছে, তারা যেন এগুলোকে বের করে আনেন এবং সেসব শিক্ষক যারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

 

আরও পড়ুন: ফাইজারের টিকা কিশোর-কিশোরীদের শতভাগ সুরক্ষার দাবি

 

একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হতো। নাম ছিল ‘বিদায় অনুষ্ঠান’। সেদিন শিক্ষকদের কাছে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে চোখের জলে বিদায় নিতেন শিক্ষার্থীরা। অতীতের সেই শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন অভিভাবক। স্কুলজীবনের সেই ‘বিদায় অনুষ্ঠান’ আর বর্তমানের ‘র‌্যাগ ডে’ কী চোখে দেখছেন তারা?

 

অভিভাবক মো. তৌহিদুল আলম বলেন, বিদায় অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা চলে আসত তখন দেখা যেত হৃদয় ভরাক্রান্ত মন নিয়েই কিন্তু এ অনুষ্ঠানটি করতাম। র‍্যাগ ডের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা চিন্তাই করতাম না। আমাদের পরিকল্পনা থাকত যে সে একটা দোয়ার মাহফিল হবে জুনিয়র ছাত্ররা যারা আছে তারা আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানটি খুব সুন্দরভাবে আয়োজন করত।

 

তিনি আরও বলেন, আমি অভিভাবক হিসেবে বলব আমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হোক এবং আনন্দ করুক। র‍্যাগডে নামক যে প্রহসনমূলক যে অনুষ্ঠান হচ্ছে এ অনুষ্ঠান গুলো বন্ধ হোক।

 

শিক্ষার্থীদের এমন আচরণকে মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবেই দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এখনই সময় প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

 

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, কে কি মনে করল সেটা তারা মনে করে না। সে কারণে এ উচ্ছৃঙ্খলাটা দেখা যায়। এটা কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সব সমাজে দেখা যাবে না। এটা কিন্তু তারাই করে যাদের বেড়ে ওঠাটা সুন্দর হয়নি, যাদের মধ্যে মূল্যবোধের সংকট আছে। এটা রোধ করার উপায় হলো আমাদের বাংলাদেশে এখন প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের চর্চা থাকা উচিত।

যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীর নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে দেয়, বিদায় বেলায় সেই স্কুলের সঙ্গেই র‌্যাগ ডের নামে এখন চলছে উচ্ছৃঙ্খলতার চর্চা। স্কুলের শেষদিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম জড়াচ্ছে অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায়। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, আসলেই কী প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে তারা?

 

Leave a Reply