সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনী Bankim Chandra Chattopadhyay Biography In Bengali

একবার বঙ্কিমচন্দ্র স্ত্রীকে নিয়ে ট্রেনে করে যাচ্ছেন। এক যুবক অনেকক্ষণ ধরে তার স্ত্রীকে দেখার চেষ্টা করছিল। বিষয়টা বুঝতে পেরে বঙ্কিমচন্দ্র ছেলেটিকে ডেকে বললেন, ‘কী করা হয়?’

ছেলেটি বলে ‘ত্রিশ টাকা রোজগারে একটি চাকরি করে।’

হেসে বঙ্কিম বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরি করি সঙ্গে বইও লিখি। হাজার দুয়েক রোজগার। সবই আমার স্ত্রীর চরণে দিই। তবুও মন পাইনে ভাই। ত্রিশ টাকায় সে মন কী তুমি পাবে?’

কথাটি শুনে ছেলেটি কামরা থেকেই নেমে যায়।

বাংলা সাহিত্যের সাহিত্য সম্রাট, উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজকের এইদিনে(২৬ জুন ১৮৩৮) জন্মগ্রহণ করেন।

কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর, দেবী চৌধুরানী সহ তার রচিত আরো অনেক উপন্যাস ও রচনা বাংলা সাহিত্যকে করেছে আরো সমৃদ্ধ।

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

সাহিত্য সম্রাটের অজানা গল্প-

বঙ্কিচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ সালের ২৬শে জুন।১৩ আষাঢ় ১২৪৫।

কাঁঠালপাড়া গ্রাম, নৈহাটি, কলকাতা।

তাঁর কর্মজীবনে শুরু যশোর – ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে।যোগদানের তারিখ: ১৮৫৮, ৭ আগস্ট। এ বাদেও তিনি

খুলনা – ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর (যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ নভেম্বর )

বিজেপির রাষ্ট্রপতি প্রার্থী কে এই দ্রৌপদী

ও ঝিনাইদহ – ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ( ১৮৮৫, ১ জুলাই ) ছিলেন।

খুলনায় থাকার সময় “Rajmohans Wife” ১৮৬৪ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস। এটি ১৮৬৪ সালে ‘Indian Field’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৫৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৮ সালে বিএ পরীক্ষা প্রবর্তিত হলে ১৩ জন এই পরীক্ষা দেন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন মাত্র দু’জন – যার একজন বঙ্কিম।

১৮৫৮ সালের ২৩ আগস্ট তিনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ পান। যশোর শহরে এসে তিনি এই পদে যোগ দেন।

অভিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা ছিল যশোর। ১৭৮১ সালে মিঃ টিলম্যান হেংকেলকে কালেক্টর হিসাবে নিয়োগের মাধ্যমে যশোরের জেলা প্রশাসনের কাজ শুরু হয়। তখন জেলা সদর কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল যশোর শহরের মুড়লীতে। মুড়লী ছিল এক সময় সমতট রাজ্যের রাজধানী। এখানে বৌদ্ধ মঠও ছিল। মুড়লী থেকে নতুন কালেক্টর ভবনে প্রশাসনের সমস্ত কর্মকর্তারা চলে আসেন ১৮০১ সালে। ওটিই ছিল যশোরের প্রথম কালেক্টর ভবন। নির্মিত হয় ১৮০১ সালে। উল্লেখ্য বর্তমানের কালেক্টরেট ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। পুরানো কালেক্টরেট যেখানে স্থাপিত হয় তার নাম ছিল সাহেবগঞ্জ – নতুন নাম কসবা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কালেক্টর ভবনে এসেই ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন। এই ভবনেরই একটি কক্ষে ছিল তাঁর কার্যালয়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন, তখন যশোর ছিল আধা গ্রাম। ম্যালেরিয়া রোগে ভরা- দুষিত জল আর অস্বাস্থ্যকর জায়গাটির কথা তিনি শুনেছিলেন কলকাতায় বসেই। তবুও তাঁর প্রথম কর্মস্থলের অপ্রিয় শহরটিকে একদিন ভালবেসে ছিলেন।

সে সময় যশোরের সাথে কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্গম। রেল লাইন বসেনি- নৌকা পথে যশোরে আসতে ব্যয় হতো তিন থেকে চার দিন। যদিও কলকাতা থেকে যশোরের দুরত্ব মাত্র ১শ’ ১০ কিলোমিটার। ভাগীরথী, আপার ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ ও লোয়ার ভৈরব দিয়ে যশোরে আসতে হতো। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নৌকা ছাড়াও ব্যবহার করতেন পালকী। যশোর থেকে তখন কলকাতা পর্যন্ত যশোরের কালীপোদ্দারের একক ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে একটি কাঁচা সড়ক। আজ আজকের প্রখ্যাত যশোর রোড নামে পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারনত কলকাতা থেকে যশোরে যাতায়াত করতেন পালকীতে।

যশোর শহরের চারপাশে তখন ঘনজঙ্গল। ম্যালেরিয়ায় হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর শহর জন মানবহীন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল পত্রে জানা যায়-প্রথম প্রথম যশোর শহর বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে অসহ্য ঠেকত। তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ভয়ে ভীত থাকতেন। কিছু দিন পর এই শহর তাঁর ভাল লেগে যায়।

যশোর থাকাকালীন ম্যালেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে মানুষজনকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতেও তিনি সচেস্ট হন।

এখানে তার পরিচয় ঘটে ‘নীলদপর্ন’ নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সাথে। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন যশোর ডিভিশনের পোষ্ট অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। ‘প্রভাকর’ ও ‘সাধুরঞ্জন’ পত্রিকা সূত্রে একে অপরের পরিচিত ছিলেন। যশোরে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হয়।

১৮৫৪ সালে যশোরে স্থাপিত হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরির সাথে খেলাধুলার ব্যবস্থাও ছিল। তাঁরা এই লাইব্রেরিতে যেতেন নিয়মিত।

১৮৪৯ সালে তাঁর বিয়ে হয়। স্ত্রীর নাম ছিল মোহিনী দেবী। স্ত্রীর বয়স যখন পনের আর বঙ্কিমের বয়স বাইশ,তখন তিনি তাকে যশোরে কর্মস্থলে নিয়ে আসেন। যশোরে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েক দিন রোগ ভোগের পর মারা যান তাঁর স্ত্রী। বঙ্কিমের দাম্পত্য জীবন যশোরে শুরু হয় এবং তা ছিল মাত্র এক বছরের। এই বিয়োগযন্ত্রণায় তিনি লিখেছিলেন –

‘মনে করি কাঁদিব না রব অন্ধকারে

আপনি নয়ন তবু ঝরে ধারে ধারে

গোপনে কাঁদিব প্রাণ সকলি আঁধার

জীবন একই স্রোতে চলিবে আমার।’

১৮৬০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্কিম চন্দ্র যশোরে ছিলেন। এ সময় সর্বত্র নীলকরদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। এ সংক্রান্ত ঘটনার বিভিন্ন তদন্তে তিনি কৃষকদের আনুকুল্য দেখাতেন। এ জন্য নীলকররা তাঁকে প্রাণহানির হুমকিও দিয়েছিল। যশোর থেকে বদলী হয়ে যান মেদিনীপুর জেলার নাগোয়াতে। সেখান থেকে পুনরায় আবার তাঁকে যশোরে বদলী করা হয়। যশোরে কয়েকদিন থাকার পর তাঁকে পাঠানো হয় খুলনাতে।

খুলনায় থাকাকালীন ১৮৬১সালের শেষ দিকে মোরেলগঞ্জের বারুইখালিতে নীলকরদের সাথে কৃষকদের সংঘর্ষ হয়। তাতে কৃষক নেতা রহিমুল্লাহ সহ ১৭জন নিহত হন। এই মামলার তদন্তে বঙ্কিমচন্দ্র নীলকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন- তাদের দায়ী করেন । যা তাঁকে ইংরেজদের কাছে অপ্রিয় করে তোলে।

কিন্তু প্রথম বাঙ্গালী আমলা হিসেবে তিনি ঐ সময়ে স্থানীয় মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার কাঁঠালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।

 

বঙ্কিমচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তার পিতা মেদিনীপুরের Deputy Collector ছিলেন । জন্মের পর হতে ৬ বছর পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠলপাড়াতেই কাটান । এ সময় পাঠশালায় গুরুমহাশয় তাকে বাড়িতে এসে পড়াতেন । তার নিয়মমাফিক বিদ্যালয় জীবন পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে একটি ইংরেজি School তে আরম্ভ হয় । এগারাে বছরে তিনি Hoogly College প্রবেশ করেন । ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই কলকাতার Presidency College তে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে Kolkata University তে B. A. পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে বঙ্কিমচন্দ্র বি . এ . পরীক্ষায় বসেন এবং উত্তীর্ণ হন । এরপর বঙ্কিমচন্দ্র সরকারি চাকুরি পান, Deputy Magistrate পদ এবং বিশেষ যােগ্যতার সঙ্গে কাজ করেন ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । এরপর অবসর গ্রহণ করেন । ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তার রচিত ‘ দুর্গেশনন্দিনী ’ উপন্যাস সাহিত্যজগতের রুচিতে যুগান্তর আনে ।

 

ছাত্রাবস্থাতেই তার সাহিত্য সাধনা , আরম্ভ হয় । ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদিত সংবাদ ‘প্রভাকর’ মাসিকপত্রে তার লেখা প্রকাশিত হয় । কিছু কিছু রচনা এডুকেশন গেজেটেও প্রকাশিত হয় । খুলনায় অবস্থানকালে তিনি রাজমােহন’স ওয়াইফ নামে উপন্যাস রচনা করেন । তাঁর কপালকুণ্ডলা ( ১৮৬৬ ) , মৃণালিনী ( ১৮৬৯ ) , যুগলাঙ্গুরীয় ( ১৮৭৪ ) , চন্দ্রশেখর ( ১৮৭৫ ) , রাজসিংহ ( ১৮৮২ ) ও সীতারাম ( ১৮৮৭ ) প্রকাশিত হয় । স্বদেশবাসীদের মনে দেশপ্রেম জাগানাের উদ্দেশ্যে তিনি আনন্দমঠ ( ১৮৮২ ) , দেবী চৌধুরানী ( ১৮৮৪ ) এবং সীতারাম ( ১৮৮৭ ) প্রকাশ করেন । তার বিষবৃক্ষ ( ১৮৭৩ ) , কৃষ্ণকান্তের উইল ( ১৮৭৮ ) এবং রজনী ( ১৮৭৭ ) আধুনিক পারিবারিক উপন্যাসের উৎসস্থল । মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পরনারীর সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এগুলােতে পরিস্ফুট হয়েছে । তার ইন্দিরা ( ১৮৭৩ ) ও রাধারাণী ( ১৮৭৬ ) বড় গল্পের মতাে ইংরেজি নভেলেট – এর পর্যায়ভুক্ত । তাঁর প্রবন্ধগুলাের মধ্যে লােকরহস্য ( ১৮৭৪ ) , বিজ্ঞান রহস্য ( ১৮৭৫ ) , কমলাকান্তের দপ্তর ( ১৮৭৫ ) , বিবিধ সমালােচনা ( ১৮৭৬ ) , সাম্য ( ১৮৭৯ ) , প্রবন্ধ পুস্তক ( ১৮৭৯ ) , ধর্মতত্ত্ব ( ১৮৮৮ ) , শ্রীমদ্ভগবদগীতা ( ১৮৮৪-১৮৮৮ ) উল্লেখযােগ্য ।

 

তিনি ‘ আনন্দমঠ উপন্যাসে বন্দেমাতরম সঙ্গীত রচনা করে দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ গান রচনা করেন । স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ বন্দেমাতরম ’ রবীন্দ্রনাথের জনগণমন অধিনায়ক ’ সঙ্গীতের সঙ্গে গণপরিষদে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয় । ভাষায় সাধু এবং চলিত এই দুই রীতির সমন্বয় সাধনে শক্তিশালী । করেছেন । বিভিন্ন সময়ে বহু ছদ্মনামে । ইনি লেখেছেন শ্রী অষ্টমাবতার চট্টোপাধ্যায় , ভীষ্মদেব খােসনবীশ । ‘ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র হলেন । বাংলা উপখ্যানের । তাঁর সম্পর্কে যত কথাই লেখা যাক — মনে হবে কমই বলা হল । তার ‘ আনন্দমঠ উপন্যাসে , যে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সম্রাজ্ঞী বিদ্রোহর কথা তুলে ধরা হয় তা ছিল সে যুগের বিপ্লবীদের কাছে ‘ গীতা’র মতাে । বঙ্কিমচন্দ্র -শরৎচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ — উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাসাহিত্যের নবজাগরণে বঙ্কিমই ছিলেন প্রথম এবং অগ্রগণ্য সাহিত্যিক । আজ তাকে স্মরণ করে , তার অক্ষয় অমর সাহিত্যকীর্তি । অনুধাবন করে এগিয়ে চলার দিন ।

 

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র তার কলকাতার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

Leave a Reply