Deprecated: Function WP_Dependencies->add_data() was called with an argument that is deprecated since version 6.9.0! IE conditional comments are ignored by all supported browsers. in /home/amadersa/public_html/wp-includes/functions.php on line 6131
স্কয়ার বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ার পথে

স্কয়ার বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ার পথে

চার বন্ধুর মাত্র ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে স্কয়ারের জন্ম। সেই স্কয়ারের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ বর্তমানে ১১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও কারখানা করছে গ্রুপটি। ওষুধ দিয়ে শুরু করলেও ব্যবসা এখন আটটি খাতে বিস্তৃত

স্কয়ারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী অনিতা চৌধুরী (মাঝে) এবং তাঁদের চার ছেলেমেয়ে (বাঁ থেকে) অঞ্জন চৌধুরী, রত্না পাত্র, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল এস চৌধুরী। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি স্যামসন এইচ চৌধুরীর পরলোকগমনের পর তাঁর সন্তানেরাই স্কয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবিটি স্কয়ার গ্রুপের সৌজন্যে।

বাষট্টি বছর আগে পাবনার আতাইকুলায় জন্ম। শুরুতে সাধারণ সর্দি–কাশির সিরাপ বানিয়ে হাতেখড়ি। সেই স্কয়ার আজ দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহু আগেই নিজেদের পণ্য ভিনদেশে নিয়ে গেছে তারা। এখন আরেক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হতে চায় স্কয়ার গ্রুপ।

চার বন্ধুর হাত ধরে ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু করলেও স্কয়ারের মূল কান্ডারি হচ্ছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তাঁর প্রয়াণের পর সন্তানেরাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্যতম পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানকে। নতুন করে যুক্ত হয়েছেন নাতি–নাতনিরা। স্কয়ারকে বহুজাতিক কোম্পানি করার উদ্যোগটি তাঁরাই নিয়েছেন। সে জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় গড়ে উঠছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কারখানা। চলতি বছরই কারখানাটির কার্যক্রম শুরু হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা।

স্কয়ার হাসপাতালের সেবা অনবদ্য, করোনাজয়ীদের অভিমত

মাত্র ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে স্কয়ারের জন্ম। সেই স্কয়ারের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ বর্তমানে ১১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ওষুধ দিয়ে শুরু করলেও স্কয়ার গ্রুপের ব্যবসা বর্তমানে আটটি খাতে বিস্তৃত—স্বাস্থ্যসেবা; ভোগ্যপণ্য; বস্ত্র; মিডিয়া, টিভি ও তথ্যপ্রযুক্তি; নিরাপত্তা সেবা; ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স; হেলিকপ্টার ও কৃষিপণ্য। তাদের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০। কর্মী বাহিনী ৫৫ হাজারের বেশি।

স্কয়ারের শূন্য থেকে শীর্ষে পৌঁছার দীর্ঘ যাত্রা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গত সপ্তাহে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দুই কর্ণধার তপন চৌধুরী ও অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে। তপন চৌধুরী বর্তমানে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অঞ্জন চৌধুরী স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন, স্কয়ার বাংলাদেশি বহুজাতিক কোম্পানি হবে। বিশ্বের মানুষ এটিকে বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে চিনবে। সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

স্যামসন এইচ চৌধুরী

স্বপ্নদ্রষ্টা স্যামসন এইচ চৌধুরী
১৯৫২ সালে ডাক বিভাগের চাকরি ছেড়ে বাবার হোসেন ফার্মেসিতে বসতে শুরু করেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। বছর চারেক পর বাবার কাছ থেকে টাকা ধার করে আতাইকুলাতেই ইসন্সস (ইয়াকুব অ্যান্ড সন্স) নামে ছোট ওষুধ কোম্পানি করেন তিনি। সেটিকে বড় করতে তিন বন্ধুকে সঙ্গে নেন। কাজী হারুনূর রশীদ, পি কে সাহা ও রাধাবিন্দ রায়কে নিয়ে ১৯৫৮ সালে স্কয়ার নামে ওষুধ কোম্পানি করেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তখন তাঁদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টাকা।

চারজনের সমান বিনিয়োগ বলে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় স্কয়ার। ১৯৭১ সালে রাধাবিনোদ রায় নিজের মালিকানার অংশ ছেড়ে দেন। হারুনূর রশিদ ও পি. কে. সাহার মালিকানার অংশ এখনো রয়ে গেছে। চার বন্ধু মিলে কোম্পানিটি গড়ে তুললেও নেতৃত্বে ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। শুরুতে পাবনায় নিজ বাড়ির কাছেই কোম্পানির কারখানা করা হয়। শুরুতে স্কয়ার ফার্মা সিরাপজাতীয় ওষুধ তৈরি করত। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে কোম্পানির পরিসরও বড় হতে থাকে।

পাবনায় স্কয়ারের কারখানা

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে এসে বহুজাতিক কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় স্কয়ার। ওই সময় দেশের ওষুধের বাজারে একচেটিয়া প্রভাব ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। জনসনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এ দেশে কোম্পানিটির ওষুধ উৎপাদন শুরু করে স্কয়ার। তাতে ওষুধের বাজারে শক্ত ভিত তৈরি হয় স্কয়ারের। ১৯৮২ সালে এসে এরশাদ সরকারের সময় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিগুলোর চুক্তি ও সনদ বাতিল করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি দেশের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ বা এসেনশিয়াল ড্রাগসের একটি তালিকা তৈরি করে। তত দিনে বিদেশি কোম্পানি জনসনের জন্য ওষুধ তৈরি করতে গিয়ে স্কয়ারের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। সেই সক্ষমতা দিয়েই ১৯৮৩–৮৪ সালের দিকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি শুরু করে স্কয়ার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্কয়ারের ওষুধ

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত স্কয়ার ফার্মা ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে ১০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ৯০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। সে সময় ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের বা ফেসভ্যালুর এ শেয়ারের জন্য অধিমূল্য বা প্রিমিয়াম নেওয়া হয় ৮০০ টাকা। সেই ৯০ কোটি টাকার মধ্যে ৫০ কোটি দিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গড়ে তোলা হয় স্কয়ার ফার্মার বিশাল কারখানা। বাকি ৪০ কোটি টাকায় তৈরি হয় স্কয়ার টেক্সটাইল।

গত ২০১৭–১৮ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কয়ার ফার্মার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৭৮২ কোটি টাকার। ২০১৮–১৯ অর্থবছরের মুনাফার পর প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। কোম্পানি তাদের সম্পদমূল্যের হিসাব করেছে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করা হলে কোম্পানিটির সম্পদমূল্য ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অথচ ১৯৫৮ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে কোম্পানিটি। সেই ২০ হাজার টাকার কোম্পানি এখন পরিণত হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার কোম্পানিতে।

বর্তমানে বিশ্বের ৪২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে স্কয়ার। এগুলোর মধ্যে এশিয়ার ১৯টি দেশ, আফ্রিকার ১৩টি, ওশেনিয়া অঞ্চলের ৩টি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ৬টি এবং যুক্তরাজ্যের বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করা হয়। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর স্কয়ার ১৪৫ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি করেছে। এই আয় তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নজর এখন বিদেশে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় কারখানা তৈরি করছে কোম্পানিটি। এ বছরের শেষে কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু করতে চায় স্কয়ার ফার্মা। এর মাধ্যমে কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার ছয়টি দেশের ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বা সাড়ে ২৫ হাজার েকাটি টাকার ওষুধের বাজার ধরতে চায় তারা।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, কেনিয়ায় কারখানা করতে প্রাথমিকভাবে ১ েকাটি ২০ লাখ ডলার বা ১০০ কোটি টাকার মূলধন বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া কারখানা নির্মাণে ঋণ নেওয়া হয়েছে আরও ৮০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে কেনিয়ায় কারখানায় মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ২ কোটি ডলার বা ১৭০ কোটি টাকা।

কারখানার ভেতরে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান মাহমুদ

যুদ্ধের সময় কারখানা বন্ধ
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে পাবনায় স্কয়ারের কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপত্তার খাতিরে গ্রামের দিকে চলে যায় স্যামসন এইচ চৌধুরীর পরিবার। তখন কয়েকজন পাঠান নিরাপত্তাকর্মী কৌশল করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে কারখানাটি নিজেদের বলে দাবি করে। তাদের কৌশলের কারণেই কারখানার কোনো ক্ষতি হয়নি।

সেই গল্প বললেন তপন চৌধুরী, ‘পাবনা শহরে ঢোকার আগে আমার দাদুবাড়ি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকসেনারা। শহরে আমাদের বাড়িটিও গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দিল তারা। আমরা প্রত্যন্ত এলাকার দিকে চলে গেলাম। আমার বড় ও ছোট ভাই ভারত চলে গেল। বোন ও বাবা–মাকে নিয়ে দেশে রয়ে গেলাম।’ তিনি বলেন, ‘পাঠান নিরাপত্তারক্ষীদের সর্দার ছিলেন মোল্লা খান। তাঁর নাতিরা বর্তমানে কারখানায় কাজ করছেন। সেই মোল্লা খান আমাদের ১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে পাবনায় নিয়ে আসেন। কারখানার উৎপাদনও শুরু হয়।’

অবশ্য স্বাধীনতাযুদ্ধের আগেও একবার স্কয়ারের কারখানা বন্ধ হয়েছিল। আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তান আর্মির সহায়তায় স্কয়ারের কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেয় সরকার। তখন অভিযোগ ছিল, কারখানার ভেতরে রাষ্ট্রবিরোধী কাজকর্ম হচ্ছে। তখন কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। পরে তিনি সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হন, কারখানায় অনৈতিক কাজ হয় না। তখন কারখানা খুলে দেয় সরকার।

অবিশ্বাস ভাঙা বড় চ্যালেঞ্জ
বগুড়ার খঞ্জনপুর বোর্ডিং স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তপন চৌধুরী। তারপর পাবনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। পরে পড়াশোনা করতে চলে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন, তবে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ১৯৭৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। তপন চৌধুরী বললেন, ‘বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন ছোট ভাই অঞ্জন চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে। সে বলল, “আমি যদি না যাই, তাহলে তাকেই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশে ফিরে যেতে হবে।” পরে বাধ্য হয়ে ফিরলাম।’

অবশ্য ছোটবেলা থেকেই স্কয়ারের ওষুধের কারখানায় যাতায়াত ছিল তপন চৌধুরীর। বললেন, ‘ওষুধের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বাবাকে প্রায়ই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে থাকতে হতো। ফলে বাবাকে আমরা খুব বেশি সময় পেতাম না। মায়ের কাছেই আমরা বড় হয়েছি। তবে বাবা যখন বাড়ি থাকতেন, তখন তাঁর সঙ্গে কারখানায় যেতাম। একটু যখন বড় হলাম, তখন স্কুল ছুটির পর একা একাই কারখানায় চলে যেতাম। অনেকক্ষণ কাজ করতাম।’ দেশে ফিরে স্কয়ার ফার্মার বিপণন বিভাগের দায়িত্ব নিলেন তপন চৌধুরী। শুরুতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফার্মেসিতে গিয়েছেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে মিশেছেন। তপন চৌধুরী বললেন, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান ওষুধ বানাবে, তখন দেশের অনেক মানুষই বিশ্বাস করতে চাইতেন না। মানুষের এই অবিশ্বাস ভাঙার কাজটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।

কারখানার ভেতরে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ছবি: হাসান মাহমুদ

জুঁই দিয়ে টয়লেট্রিজের যাত্রা
বর্তমানে একাধিক ব্র্যান্ডের নামে টুথপেস্ট থেকে শুরু করে লোশন, শ্যাম্পু, সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, ডিটারজেন্ট, ডায়াপার ইত্যাদি তৈরি করছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। তবে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে জুঁই নারকেল তেল তৈরির মাধ্যমে, ১৯৮৮ সালে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বর্তমান েচয়ারম্যান স্যামুয়েল এস চৌধুরীর বড় মেয়ের নাম জুঁই। সেটিকে নারকেল তেলের ব্র্যান্ডের নাম হিসেবে বেছে নেন স্যামসন এইচ চৌধুরী।

ওষুধের ব্যবসা থেকে টয়লেট্রিজে আসার কারণ হিসেবে তপন চৌধুরী বললেন, ‘বাবার মাথায় বহু জিনিস ঘুরত। কোনো পণ্য তাঁর মনে ধরলে সেটি তৈরি করার চেষ্টা করতেন। সেই চিন্তা থেকেই টয়লেট্রিজ ও পরে ফুড ও বেভারেজ কারখানা করেন বাবা। নারকেল তেল দিয়ে টয়লেট্রিজ শুরুর কারণ হচ্ছে, তখন নারকেল তেল ছিল মেয়েদের বড় দুর্বলতা। সে সময়কার মেয়েরা বিশ্বাস করতেন, নারকেল তেল মাথায় দিলে চুল কালো ও ঘন হয়। যদিও বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। যাহোক, নারীদের দুর্বলতার কারণেই খাঁটি নারকেল তেল তৈরি করা শুরু করলেন বাবা। সেই জুঁই ব্র্যান্ডের তেল বাজারে বিক্রি শুরু হলো।’

বস্ত্রকল ও হাসপাতালে হাতেখড়ি
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন স্পিনিং মিল করার সিদ্ধান্ত নেয় স্কয়ার। পুঁজিবাজারে স্কয়ার ফার্মার শেয়ার ছেড়ে ৯০ কোটি টাকা তোলে তারা। তার মধ্যে ৫০ কোটি টাকা দিয়ে কালিয়াকৈরে স্কয়ার ফার্মার নতুন কারখানা স্থাপন ও বাকি ৪০ কোটি টাকা দিয়ে স্পিনিং মিল করা হয়। বর্তমানে গাজীপুর, ময়মনসিংহের ভালুকা ও হবিগঞ্জে স্কয়ারের বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে। দুই যুগের ব্যবধানে স্কয়ার বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ বস্ত্রকল।

তপন চৌধুরী বলেন, ‘শেয়ারবাজার থেকে টাকা ওঠানোর আগে বাবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যাঁরা স্কয়ার ফার্মার শেয়ার কিনবেন, তাঁদের টেক্সটাইলসের শেয়ার বিনা মূল্যে দেবেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি আটকে দেয় সরকার। তখন বাবা উচ্চ আদালতে মামলা করেন। অবশেষে স্কয়ার টেক্সটাইলসের শেয়ার বিনা মূল্যে দেওয়ার পথ পরিষ্কার হয়।’

পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালের জায়গায় হোটেল ও শপিং মল করার পরিকল্পনা ছিল। সে জন্য থাইল্যান্ডের সেন্ট্রালের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেই রাস্তায় হাঁটেনি স্কয়ার। থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের নকশাকারী প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিদের দিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের নকশা করা হয়। স্কয়ার হাসপাতাল বর্তমানে লাভজনক প্রতিষ্ঠান। তবে সেই মুনাফা উদ্যোক্তারা নেন না। পুনর্বিনিয়োগ করেন। নিজেরাও হাসপাতালটি থেকে পয়সা দিয়ে চিকিৎসা নেন। শুরু থেকেই এই নিয়মে চলছে বলে জানালেন তপন চৌধুরী।

তপন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে তখন বেসরকারি খাতে ভালো মানের হাসপাতাল ছিল না। মানুষজন উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যেত। তো দেশের মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবাকে যখন বললাম, তখন তিনি বেশ উৎসাহ দিলেন। সহযোগিতাও করলেন।’

মূল কেন্দ্রবিন্দু মা
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। স্যামুয়েল এস চৌধুরী, অঞ্জন চৌধুরী ও রত্না পাত্র বারিধারায় থাকেন। তাঁদের মা অনিতা চৌধুরীও সেখানেই থাকেন। আর তপন চৌধুরী থাকেন ইন্দিরা রোডে তাঁদের পুরোনো বাড়িতে।

তপন চৌধুরী বলেন, ‘মা আমাদের পরিবারের কমান্ড ইন চিফ। প্রতিদিন দেখা না হলেও দিনে অন্তত দুবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। প্রতি শুক্রবার বারিধারায় চলে যাই। মায়ের সঙ্গে গল্প করি। সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করি। বয়স হলেও মা সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। দুপুরে মা রান্না করে বাসা থেকে এখনো আমার জন্য খাবার পাঠান।

স্যামসন এইচ চৌধুরীর গড়ে তোলা স্কয়ার বেশ ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছেন তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তারপরও বাবার শূন্যতা অনুভব করেন তাঁরা। তপন চৌধুরী বলেন, ‘যখন বাবার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেল, তখন সবাই তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু আমরা যখন কঠিন সমস্যায় পড়ে যেতাম, তখন বাবাকে বললে ২–৫ মিনিটের মধ্যে সমাধান করে দিতেন। আসলে দীর্ঘদিন ব্যবসা করার কারণে সবকিছুই ছিল বাবার নখদর্পণে। আমি সরকারের উচ্চপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছি। তারপরও যেখানে গিয়েছি, সেখানেই বাবার পরিচয়ে পরিচিত হয়েছি।’

আমরা শূন্য থেকে আজকের এই অবস্থানে এসেছি। সে জন্য লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। রাতারাতি এই সাফল্য আসেনি। দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন ও আস্থা দিয়ে বিশ্বাস করায় স্কয়ার আজকের উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই জিনিসটি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরে দিয়ে যেতে চাই।
তপন চৌধুরী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস

একনজরে
স্কয়ার গ্রুপ
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৫৮ সাল
প্রতিষ্ঠাতা: স্যামসন এইচ চৌধুরী
প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা: ২০
মোট কর্মী: ৫৫,৬০৩ (এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত)
বার্ষিক লেনদেন: ১১,১৬০ কোটি টাকা (২০১৮-১৯ অর্থবছর)
রপ্তানি গন্তব্য: ৫০-এর বেশি
দেশ রপ্তানি আয়: ২,৮৭১ কোটি টাকা
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি: ২টি (স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্কয়ার টেক্সটাইলস)
কোন খাতে ব্যবসা: স্বাস্থ্যসেবা; ভোগ্যপণ্য; বস্ত্র; মিডিয়া, টিভি ও তথ্যপ্রযুক্তি; নিরাপত্তা সেবা; ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স; হেলিকপ্টার ও কৃষিপণ্য।
স্কয়ারের যত প্রতিষ্ঠান:
১. স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস,
২. স্কয়ার টেক্সটাইলস,
৩. স্কয়ার ফ্যাশনস,
৪. স্কয়ার ইয়ার্ন,
৫. স্কয়ার হেস্ককন,
৬. স্কয়ার হসপিটাল,
৭. স্কয়ার টয়লেট্রিজ,
৮. স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ,
৯. স্কয়ার সিকিউরিটিজ ম্যানেজমেন্ট,
১০. ফার্মা প্যাকেজেস,
১১. মিডিয়াকম,
১২. স্কয়ার এয়ার,
১৩. স্কয়ার ইনফরমেটিকস,
১৪. এজেস সার্ভিস,
১৫. স্কয়ার ফ্যাশন ইয়ার্ন,
১৬. মাছরাঙা কমিউনিকেশনস,
১৭. স্কয়ার অ্যাগ্রো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রসেসিং,
১৮. সাবাজপুর টি কোম্পানি,
১৯. স্কয়ার ডেনিম এবং
২০. স্কয়ার অ্যাপারেলস।


শ্রমিকের অংশীদারত্ব আমাদের বড় শক্তি: অঞ্জন চৌধুরী

সুনাম ও প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শ্রমিকদের অংশীদারত্ব স্কয়ারের আজকের অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন অঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, স্কয়ারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে এটি চাকরির চেয়ে বাড়তি কিছু। গাড়িচালক থেকে শুরু করে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই এ প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করেন। নানা দুর্যোগে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় তাই শ্রমিকেরা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের হাত থেকে আমাদের কারখানাটি বাঁচিয়েছিলেন সে সময় কারখানায় কর্মরত একজন দারোয়ান। যিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পাঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও উনি আমাদের ছেড়ে যেতে রাজি হননি। আমাদের সঙ্গেই থেকে গেছেন এ দেশে। উনি মারা যাওয়ার পর ওনার ছেলে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখন করছেন তাঁর নাতি। এভাবে অনেক অনেক কর্মীর পরিবার বংশপরম্পরায় স্কয়ারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। আমরাও মালিক-শ্রমিক ভেদাভেদ ভুলে এক পরিবারের সদস্য হিসেবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই ভালো থাকলে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হিসেবে আমরাও ভালো থাকব।

সততা, নিয়মানুবর্তিতা, মানুষের প্রতি সম্মান—এসব স্কয়ারের অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র বলে জানান অঞ্জন চৌধুরী। এ কারণে দেশে-বিদেশে মানুষ স্কয়ার গ্রুপকে সমীহ করে। তিনি বলেন, ‘বাবা এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে আমাদের মধ্যে এমন কিছু মূল্যবোধ তৈরি করে দিয়ে গেছেন, যেগুলো আমরা প্রতিনিয়ত অনুসরণ করে চলেছি। এ কারণে ব্যবসার অনৈতিক কোনো পথে আমরা কখনো পা বাড়াইনি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার, দেশের মানুষ, শ্রমিক—কাউকে না ঠকিয়ে এবং অসৎ পন্থা অবলম্বন না করেও ব্যবসায় উন্নতি করা সম্ভব। তারই দৃষ্টান্ত স্কয়ার গ্রুপ। এ গর্ব ও মূল্যবোধ আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও বপন করে দিয়ে যেতে চাই।’

বর্তমানে অঞ্জন চৌধুরী এ শিল্প গ্রুপের অধীনে থাকা স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু করা স্কয়ারের ব্যবসার সঙ্গে অঞ্জন চৌধুরী যুক্ত হন ১৯৯১ সালে। শুরুতেই তিনি দায়িত্ব পান স্কয়ার টয়লেট্রিজের। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের মধ্যে ছিল জুঁই নারকেল তেল আর মেরিল শ্যাম্পু। অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর আমার দায়িত্ব ছিল স্কয়ারের নিজস্ব পরিচিতির বাইরে আলাদা ব্র্যান্ড হিসেবে “মেরিল”কে পরিচিত করা। সেটি করতে গিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে ছোট ছোট দোকানে মেরিলকে পরিচিত করেছি। এমনও হয়েছে যখন মেরিলের কথা বলতাম, দোকানদারেরা কথাই বলতে চাইত না। যখন বলতাম, এটি স্কয়ারের কোম্পানি, তখন তাঁরা কিছুটা নমনীয় হতেন। স্কয়ারের সুনামের কারণে এখনো অনেক ব্যবসা করতে গিয়ে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। স্কয়ারের সুনামের সঙ্গে বাবার (প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী) নামটিও এ দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। এখনো কোথাও গেলে আমাদের লোকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করে স্যামসন এইচ চৌধুরীর ছেলে হিসেবে। তাই আমরা কোনো কাজ করার আগে স্কয়ার ও বাবার সুনামের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’

ব্যতিক্রমী ৩ নজির

গোপনে আবেদন প্রত্যাহার
২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি স্কয়ারের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তপন চৌধুরী উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার বেশ আগে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিল স্কয়ার গ্রুপ। সেই আবেদন পড়ে ছিল বিদ্যুৎ-জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে।

তপন চৌধুরী উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান বিদ্যুৎ-জ্বালানি মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের। এরই মধ্যে একদিন ছেলেকে (তপন চৌধুরী) না জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ–সচিবের সঙ্গে দেখা করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আবেদনটি প্রত্যাহার করে নেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী। ছেলেকে না জানিয়ে আবেদন প্রত্যাহারের বিষয়টি তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদকে অবহিত করেন। কারণ, স্যামসন এইচ চৌধুরী মনে করেছিলেন, ছেলে যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, সেই মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন নিলে তাতে স্বার্থের সংঘাত হতে পারে। নানা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার বেশ কিছুদিন পর এ ঘটনা প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন তপন চৌধুরী। এরপর স্কয়ার গ্রুপ আর কখনো বিদ্যুতের ব্যবসায়ও আগ্রহী হয়নি। তপন চৌধুরী বলেন, ‘উপদেষ্টা হওয়ার পর বাবা আমাকে কখনো দিনের বেলায় ফোনও করতেন না, আমার সঙ্গে ব্যবসায়িক কোনো আলাপও করতেন না। বাসায় ফিরলে পারিবারিক কথাবার্তাই হতো তাঁর সঙ্গে। বাবা ছিলেন মূল্যবোধের বিষয়ে একেবারে আপসহীন।’

বিনা পয়সায় শেয়ার
১৯৯৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। ওই সময় কোম্পানিটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে ১০ লাখ শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে ৯০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। যার মধ্যে ৫০ কোটি টাকায় গাজীপুরে গড়ে তোলা হয় স্কয়ার ফার্মার বিশাল কারখানা। আর বাকি ৪০ কোটি টাকায় গড়ে তোলা হয় বস্ত্র খাতের কোম্পানি স্কয়ার টেক্সটাইল। স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, আইপিও ছাড়ার সময় কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন, স্কয়ার ফার্মার শেয়ার যাঁরা পাবেন, পরবর্তীকালে তাঁদের বিনা পয়সায় স্কয়ার টেক্সটাইলের শেয়ারও দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এক কোম্পানির শেয়ারের সঙ্গে অন্য কোম্পানির শেয়ার দেওয়ার আইনি বিধান তখন ছিল না। তাই অনেকেই তখন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরীকে পরামর্শ দিলেন বিনিয়োগকারীদের বিনা পয়সায় শেয়ার না দেওয়ার। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কিছুতেই বরখেলাপ করতে রাজি হননি তিনি। তাই আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালতে মামলা করে সেই মামলায় জিতে স্কয়ার ফার্মার শেয়ারধারীদের বিনা পয়সায় স্কয়ার টেক্সটাইলের শেয়ার দেওয়া হয়।

২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ
২০১৯ সালজুড়ে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন ঘটতে থাকলে তাতে স্কয়ার ফার্মারও শেয়ারের দাম অনেক নিচে নেমে যায়। কোম্পানির আর্থিক ভিত্তির সঙ্গে তা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তাই প্রতিষ্ঠানটির চার উদ্যোক্তা পরিচালক মিলে বাজার থেকে ১২ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন। তাতে তাঁদের ব্যয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মার পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আমাদের কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল বা মৌলভিত্তি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানি। তাতে আমাদের মনে হয়েছে, কোম্পানিটির শেয়ারের দাম এত নিচে নামার কোনো কারণ নেই। আমরা আমাদের কোম্পানি নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাই দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় আমরা শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

স্কয়ার একটি আস্থার নাম – অঞ্জন চৌধুরী

বাবা ব্যবসা শুরু করেন ১৯৫৮ সালে। দাদার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। তখন তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস। এরপর তা স্কয়ার ফার্মা লিমিটেড হয়। গত শতকের আশির দশকে আমাদের ব্যবসার প্রসার ঘটে। শুধু ওষুধ নয়, তখন স্কয়ার থেকে নানামুখী ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাবা আমাকে দেশে ফিরে আসার জন্য বললেন। কারণ, বাবাকে ব্যবসার অনেক দিকে নজর দিতে হয়। তত দিনে আমিও পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছি।

ব্যবসা জীবনের শুরুতেই আমাকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। ওষুধ নিয়ে স্কয়ার তখন সারা দেশে পরিচিত নাম। কিন্তু মেরিল নামটি নতুন। একটি মাত্র পণ্য জুঁই নারিকেল তেল নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। দেশে ফেরার পর বাবা (প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, স্কয়ার গ্রুপ) আমাকে এর দায়িত্ব দেন।

গোড়াতেই আমার কাজ হলো, মেরিল নামটি যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা। ওই সময় মাসের ২৫ দিনই ঢাকার বাইরে থেকেছি। দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে যাইনি। সেখানে বিভিন্ন মার্কেটে আর দোকানগুলোতে যেতাম। এখন একজন বিক্রয় প্রতিনিধি যেভাবে সবার কাছে যান, তখন আমিও তেমনিভাবে গিয়েছি। বারবার কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, ‘আপনারা কারা? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নাম তো শুনিনি। কী দেবেন? বাকি কত দেবেন?’

আমি সবাইকে বলেছি, আমাদের বাকির কোনো ব্যাপার নেই। শুনে কেউ কেউ বলেছেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আপনি যান।’ আমি কিন্তু চলে আসিনি। বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিছুক্ষণ পর কেউ আবার দোকানে ডেকে নিয়ে বসতে দিয়েছেন, চা দিয়েছেন, কথা বলেছেন। এটা আমার জন্য একটা শিক্ষা। তা হলো, ধৈর্য থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।‘মেরিল’ নামটা ক্রমেই পরিচিত হতে লাগল। আমাদের পণ্য বাড়ছে। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। সেখান থেকে হলো স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড।

এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ে। খোলা বাজারে প্রচুর ভেজাল মসলা পাওয়া যেত। আমাদের বাড়ি ছিল মফস্বল শহরে। এর একটা বাড়তি সুবিধা হলো, সেখানে খাঁটি জিনিসটা আমাদের হাতের নাগালে। সেই ভাবনা থেকে মনে হলো, আমরা তো ভালো মানের মসলা বাজারে দিতে পারি। এভাবে পাবনায় স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গেই স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড শুরু করি।

তবে যখন যুদ্ধ শুরু হল তখন একটা সময়ে এসব দিকে আমার মোটেও আগ্রহ ছিল না। ১৯৭১ সালে আমি ১৭ বছরের তরুণ। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে পড়তাম। তখন ফিরে যাই পাবনায়, আমাদের বাড়িতে। কিন্ত সেই সময়ে হাত-পা গুটিয়ে কি বসে থাকা যায়! আমিও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বন্ধুরা মিলে চলে যাই ভারতে। যোগ দিই মুজিব বাহিনীতে। দেরাদুনের চকরাতা আর্মি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো প্রশিক্ষণ নিই। একসময় দেশ স্বাধীন হলো। এখন আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।

ওই সময় দেশের তরুণদের একটা অংশ চলে যায় রাশিয়ায়। বাবা আমাকে নিয়ে তেমনি কিছু ভেবেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় ট্রাই-স্টেট কলেজের বিদেশি শিক্ষার্থীদের উপদেষ্টা ছিলেন একজন বাঙালি প্রকৌশলী, বাবার বন্ধু। তাঁর মাধ্যমে বাবা সেখানে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সাত দিনের মধ্যেই চলে যাই। এই কলেজটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। পড়াশোনা করেছি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। এরপর আমাদের ব্যবসা-সংক্রান্ত কিছু দিক ওখানে দেখাশোনা করেছি। রিয়েল এস্টেট আর গার্মেন্টস ব্যবসা। কিন্তু তখন মন পড়ে থাকত দেশে। প্রায় প্রতিবছরই বড়দিনের ছুটিতে দেশে আসতাম। পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতাম।

আমরা কিন্তু সোনার চামচ কিংবা রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বাবার অনেক কঠিন সময় গেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের দূরত্ব ছিল ১২ মাইল। সন্ধ্যার পর আর বাস পাওয়া যেত না। পাবনায় একটা মিশন আছে। যেদিন অফিসের কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে যেত, সেদিন রাতে বাবা ওই মিশনের বারান্দায় ঘুমিয়েছেন। এমন একসময় ছিল, আমার বড় ভাইয়ের জন্য দুধ কেনার টাকা পর্যন্ত ছিল না। ছোটকালে আমার কয়টা শার্ট ছিল, কোন জামার রং কেমন ছিল, তা এখনো মনে আছে। একটা বেল্ট ছিল। দুই-তিনটা খেলনা ছিল। মনে থাকার কারণ, এইটুকুই ছিল আমার জন্য বিশেষ কিছু। তবে আমরা কখনো কিছুর অভাব বোধ করিনি।

স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড থেকে নানা দিকে ব্যবসার প্রসার হতে থাকে। একটি পণ্য নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের শুরু, তা ডালপালা ছড়ায়। নিজেদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়েই নতুন অভিজ্ঞতা হয় আমার। দেখি নির্মাতাদের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো কাজ পাওয়া যায় না। পণ্য বিপণনের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের একটা যোগসূত্র তো আছেই। এখানে এর ব্যাঘাত ঘটছিল। ফলে ক্ষোভ থেকেই একসময় নিজেই বিজ্ঞাপনী সংস্থা গড়ে তুলি, নাম মিডিয়াকম। তখন আবার দেখি চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সেই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় মাছরাঙা। এখান থেকে বিজ্ঞাপনচিত্র আর টিভি নাটক তৈরি করতে শুরু করি। চলচ্চিত্রের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হই। এ পর্যন্ত লালসালু, শঙ্খনাদ, আয়না, লালন, মনপুরা ছবিগুলো প্রযোজনা করেছি। মনপুরার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এভাবে গণ্যমাধ্যমেও কাজের শুরু আমাদের।

বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমতি পায় একুশে টিভি। এর লাইসেন্স পান এ এস মাহমুদ। তিনি ছিলেন বাবার বন্ধু। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা এই টিভি চ্যানেলের পরিচালক হলাম। পরে নানা কারণে আমরা এটি ছেড়ে দিই। পরে আমাকে এনটিভির শেয়ার দেওয়া হয়। মাছরাঙার নামে টিভির লাইসেন্স পাওয়ার পর আমি ওই শেয়ার বিক্রি করে দিই। মাছরাঙা টিভিকে ঢেলে সাজাই। অনুষ্ঠানগুলো এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করি, যাতে তা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখতে পারে। এখানে আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, ইতিবাচক বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মাছরাঙা টেলিভিশন এবং রেডিও দিনরাত-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কাজ করছি এখন।

ছোটবেলা থেকে আমি খেলাধুলা ভালোবাসতাম। ফুটবল, ক্রিকেট আর শীতের সময়ে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ১৯৯১ সালে দেশে ফেরার পর আমাকে পাবনার জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন সরাসরি খেলার উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। পরিচিতজনদের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবাহনীর সঙ্গে। পরে আবাহনী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হয়। আর আমি হই এর পরিচালক। পাশাপাশি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাকে যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এখন কাজ করছি। পাবনা রাইফেল ক্লাবের সঙ্গে আমি অনেক বছর ধরেই জড়িত আছি। আমরা পাবনা এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছি।
আর কিছু সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছি আমি। অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করছি। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্বরত আছি অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন কোম্পানি ওনার্স সংগঠনটির।

বাংলাদেশের তরুণ শিল্পীদের সহযোগিতা করার জন্য ‘সোসাইটি ফর প্রমোশন ফর বাংলাদেশ আর্ট’ প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে। এখন এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যুক্ত আছি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর পান্থপথে একটা জায়গা কেনেন বাবা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সেখানে একটা হাসপাতাল করার, স্কয়ার হাসপাতাল। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। এখন আমরা এ দেশেই সবাইকে বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বাবা ছিলেন আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাবা খুব নিয়ম মেনে চলেন। তাঁর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সরলতা; সবকিছুই ছিল অনুকরণীয়। সময়ের কাজ তিনি সময়ে করতেন। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি। প্রতিবছর বাবা শ্রমিকসংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতেন। নিয়ম মেনে নয়, এটাই ঐতিহ্য। প্রত্যাশার চেয়ে তিনি বেশি দিয়ে এসেছেন সব সময়। তিনি তাদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করতেন, মনে হতো যেন নিজের পরিবারের মধ্যে বসে আলোচনা করছেন। বাবার কাছ থেকে এভাবেই শিক্ষা পেয়েছি।

সবার আস্থা আমাদের শক্তি। এত বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সবার মাঝে যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে যেন তা আরও সুদৃঢ় হয়, সেই চেষ্টা আমার অব্যাহত আছে।

(অনুলিখন)
অঞ্জন চৌধুরী, পরিচালক, স্কয়ার গ্রুপ

Leave a Reply