আমি আবার পলিটিক্যালি কারেক্ট কবে হলাম? চিরকালই আমি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। Taslima Nasrin

আমি আবার পলিটিক্যালি কারেক্ট কবে হলাম? চিরকালই আমি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। সে কারণেই আমার শত্রুর শেষ নেই, সে কারণেই ফতোয়া, মিছিল, হুলিয়া জারি, দেশ থেকে বিতাড়ন, বই ব্যান। অন্য দেশেও একই পরিস্থিতি, গৃহবন্দিত্ব, রাজ্য থেকে বিতাড়ন, দেশত্যাগে বাধ্য করা। সর্বত্র ব্রাত্য আমি।
আমি বেড়াল ভালোবাসি বললে কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠবেই, বলবে, আমি কুকুর ভালোবাসি না। সুতরাং কুকুরপ্রেমীরা এক জোট হয়ে আমার কুৎসা রটাবে।
আমি একবার একটি ঘটনার উল্লেখ করে বললাম, মেয়েরা বাসে বসে ছিল, বাস থামার পর পুরুষেরা বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করে এল, মেয়েরা প্রস্রাব আটকে বাসেই বসে রইলো। অমনি লোকেরা বলতে শুরু করলো, আমি নাকি বলেছি মেয়েরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করুক। একবার লিখলাম, মুসলমান পুরুষেরা চার বিয়ে করতে পারে, ইসলাম ধর্ম পুরুষকে এক সঙ্গে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে, অমনি লোকে বলতে শুরু করলো, আমি নাকি মেয়েদের চার বিয়ের অধিকার চাইছি, অর্থাৎ মেয়েরা যেন চার স্বামী নিয়ে এক সঙ্গে এক ঘরে বাস করতে পারে। আমি যতটুকু ভাবি, তার চেয়ে বেশি ভেবে নেয় কিছু পাঠক। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক আমার বদনাম করা।

মেয়েদের শরীরের কোন অংশ, এবং পুরুষের শরীরের কোন অংশ দেখতে ব্যক্তি আমি পছন্দ করি, তা জানানোর পর কিছু লোক ঘেউ ঘেউ করে উঠেছে, কী পোশাক কাকে মানায়, কাকে মানায় না তা বলাতেও ঘেউ ঘেউ। এর মানে আমি নাকি মেয়ে বা পুরুষ যারা কোন পোশাক পরলে আমার চোখে মানায় না বলেছি, তাদের বডি শেমিং করছি। আমরা তো দিন রাতই বলছি, এ পোশাক ওকে মানাবে, সে পোশাক তাকে মানাবে। মোটাদের জন্য এক ধরণের পোশাক, স্লিমদের জন্য আরেক।
লম্বাদের জন্য এক রকম, বেঁটেদের জন্য আরেক। তরুণীদের জন্য এক রকম, বৃদ্ধাদের জন্য আরেক। আওয়ারগ্লাস বডি হলে এক রকম, না হলে আরেক রকম। এ সব তো পোশাক কোম্পানিগুলোই দেখিয়ে দেয়। ফ্যাশান ম্যাগাজিনগুলো বলে দেয়। আমার ব্যক্তিগত মত, স্তন স্যাগ করলে পুশ আপ পরলে ভালো, বুক খোলা ব্রাহীন ড্রেস না পরাই ভালো। আর স্যাগ না করলে খোলা রেখে চললেও ঠিক আছে। এর নাম বডিশেমিং নয়, এর নাম সত্য কথন। চরম তসলিমাবিদ্বেষীরাও তা জানে।
জানে কিন্তু মুখে উল্টোটা বলবে।
এরা ঘেউ ঘেউ করবেই , বেঁটেকে বেঁটে কেন বললাম, লম্বাকে লম্বা কেন বললাম, মোটাকে মোটা কেন বললাম, স্লিমকে স্লিম কেন বললাম। সুন্দরকে সুন্দর কেন বললাম, তাহলে অসুন্দরদের তো বডি শেমিং করে ফেললাম, সুদর্শনকে সুদর্শন কেন বললাম, তাহলে তো কুদর্শনের বডি শেমিং করে ফেললাম, মোদ্দা কথা সর্বনাশ করে ফেললাম! আমি কাউকে বলিনি তুমি দেখতে বেঁটে তুমি লম্বা আলখাল্লা পরো না, আমি বলিনি, তোমার স্যাগিং স্তন, তুমি ভুলেও স্তন দেখানো ড্রেস পরো না। যার যে পোশাক পরার ইচ্ছে, সে পোশাক সে পরবে। আমার কোনটা ভালো লাগছে, কোনটা ভালো লাগছে না, তা আমি বলবো।
এতে এত ঘেউ ঘেউ এর কী আছে? ওয়েট, যদি বলিই তোমাকে এই পোশাকে মানাচ্ছে না, যদি উপদেশই দিই এটা পরো না, ওটা পরো, তাতে এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? আমি তো দিন রাত মেয়েদের উপদেশ দিচ্ছি , হিজাব বোরখা পরো না, ওসব তোমার জন্য ঠিক নয়। আমার উপদেশ কজন মেয়েই বা শুনছে! কিন্তু আমি তো সারা জীবনই এই উপদেশ দিয়ে যাবো, আমার এই মত আমি প্রকাশ করবোই, যতই আমাকে ‘চয়েজ’বাদীরা গালি দিক।
নারীর অনেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে অনেকে মনে করে নারীর ”লজ্জাস্থান”। লজ্জাস্থান নিয়ে কথা বলাটাই তাদের কাছে স্পর্ধা বলে মনে হয়েছে। সুতরাং আমার স্পর্ধা তারা মানবে কেন? তা না মানুক, আমার তো স্পর্ধা দেখাতে জুড়ি নেই।
সত্য কথন, বা ভিন্নমত কোনওকালেই সমাজের অধিকাংশ কূপমণ্ডুক সহ্য করতে পারেনি। আজ হঠাৎ কী ঘটে গেল যে সহ্য করবে? আমি আশাও করি না। বিরুদ্ধ স্রোতে আমি জীবন ভর চলেছি। অতীতে চলেছি, আজও চলছি, যতদিন বাঁচি চলবো। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই।

Leave a Reply