ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপর?

বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানি করে থাকে রাশিয়া থেকে। তা ছাড়া এখন তৈরি পোশাক শিল্পের নতুন বাজার হিসাবেও বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে।

কিন্তু ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপর?

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, যার মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য, যার বেশিরভাগটাই খাদ্য পণ্য।

এর আগের বছর রাশিয়ায় বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য, অন্যদিকে আমদানি হয়েছে ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য।

বিশেষ করে গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভুট্টার ২০ শতাংশ আসে এই দুটি দেশ থেকে। আবার তৈরি পোশাক রপ্তানির নতুন বাজার হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকেও।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের প্রভাব এর মধ্যেই পড়তে শুরু করেছে তাদের ব্যবসার ওপর।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গম আমদানিকারক, সিটি গ্রুপের একজন পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে প্রতিবছর আট থেকে দশ লাখ টন গম আমদানি হয়। সেটা বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যান্য যে মালামাল রাশিয়া থেকে আমরা এনে থাকি, এই পরিস্থিতিতে জাহাজগুলোতে সেই মালামাল তোলা যাবে কিনা জানি না।”

”এই যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বাড়ছে, সেটারও একটা প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে পড়বে।”

ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, যুদ্ধের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখন কৃষ্ণসাগরে যেতে চাইছে না। ফলে রপ্তানিকারকরাও চিন্তার মধ্যে পড়েছেন।

ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক।

এই যুদ্ধের প্রভাবে এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম।

সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, গম ইত্যাদি খাদ্য পণ্যের বাইরে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন, দ্রুত সমাধান না হলে এই সংকটের বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরেও। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়ে।

তিনি বলছেন, ”যে কোনো অবরোধ যখন দেয়া হয়, সেটার মাত্রাটা ব্যাপক হলে বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বের জন্যই একটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে যায়। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তো চিন্তার কারণ আছেই, কারণ জ্বালানি তেলের মূল্য এর মধ্যেই বাড়ছে। সেটা বাড়লে যানবাহন, কৃষি-সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ে।”

”প্রভাবটা কতো ব্যাপক হবে, সেটা নির্ভর করবে এই সংকট কতদিন ধরে চলে, তার ওপরে। যদি নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সেটার মাত্রা বাড়তেই থাকবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রশ্ন আসবে। তখন তা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে।”

তিনি বলছেন, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কোন দেশ কার সঙ্গে ব্যবসা করছে, সেটাই যে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। বিশ্বে যদি কোন পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তাহলে সেটা ব্যবহারকারী সব দেশের ওপরেই তার প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই তার সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে রাশিয়ার সহায়তায়।

করোনা ভাইরাস: টিকা নেবার পরও লোকে সংক্রমিত হচ্ছে কেন?

তবে রাশিয়ার ওপরের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এসব প্রকল্পে কোন প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন না বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জামও কেনে বাংলাদেশ।

কূটনীতিকরা বলছেন, বৈশ্বিক একটি পরাশক্তি হিসাবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশ্বের দেশগুলোর ওপর নানাভাবে পড়বে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, সংকট আরও আরও দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের ওপরে কূটনীতিকভাব চাপও তৈরি হতে পারে।

তিনি বলছেন, ”একটা যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করে। সেটা শুধু সেই দুইটা দেশ বা জোটের মধ্যে থাকে না, প্রত্যেকেই অ্যাফেক্টেড হয়।”

তিনি বলছেন, বাংলাদেশের ওপর কি বা কতটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা হয়তো এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর বিরোধে বাংলাদেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য এখনই সতর্ক হতে হবে।

”প্রথমত হলো, আমাদের এক ধরনের নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে হবে। আমরা কোন পক্ষ নেবো না। তবে যুক্তরাষ্ট্র কড়া নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে, সেটা লঙ্ঘন করার উপায় আমাদের নেই। রাশিয়াও সেটা বুঝবে।

”ফলে আমাদের দেখতে হবে, সেই নিষেধাজ্ঞা না ভেঙে, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে, সেটা কীভাবে আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, সেই চেষ্টা করতে হবে।” – তিনি বলছেন।

অর্থনীতিবিদ এবং কূটনীতিকরা বলছেন, খুব তাড়াতাড়ি হয়তো রাশিয়া সংকটের বড় প্রভাব বাংলাদেশে দৃশ্যমান হবে না।

কিন্তু এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বাড়লে বাংলাদেশ কী করবে, বাংলাদেশকে সেই আগাম পরিকল্পনা নিয়ে রাখতে হবে।

Leave a Reply