ক্রিস্টোফার কলম্বাস: জীবনী, সৃজনশীলতা, কেরিয়ার, ব্যক্তিগত জীবন

ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যাকে আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারক নামে সবাই জানেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ভুলবশত আমেরিকার ভূখন্ড আবিষ্কার করে ফেলেন। আমেরিকায় ইউরোপিয়দের শাসন প্রতিষ্ঠায় ও আধুনিক সভ্যতার সূচনায় যার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থাবান, একজন ঈশ্বর পূজারী। ভাগ্যচক্রে সামান্য একজন তাঁতী থেকে ‘সাগর-মহাসাগরের নৌ সেনাপতি’ (Admiral of the Ocean Sea) রূপে আবির্ভাব ঘটে তার।

আমেরিকার ভূখণ্ডের আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় একটি বড় অংশ দখল করে সারা দুনিয়া জুড়ে অনেক সম্মান কামিয়েছেন কলম্বাস। ক্রিস্টোফার কলম্বাস; কিন্তু এটিই কি সম্পূর্ণ ইতিহাস? তার এই অর্জনের পেছনে চাপা পড়ে গেছে অসংখ্য নিরপরাধ নারী, শিশু, পুরুষ ও বৃদ্ধের মৃত লাশের আর্তনাদ। চাপা পড়ে গেছে দাসে পরিণত হওয়া অসহায় মানুষগুলোর যন্ত্রণা। চাপা পড়ে গেছে সাজানো গোছানো সংসার আর স্বাভাবিক জীবনযাপন হারানোর বেদনা।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস যে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছেন সেগুলো হচ্ছে আটলান্টিক দাস বাণিজ্য ও আমেরিকায় আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের উপর সংঘটিত গণহত্যা। একজন খুনী ও অত্যাচারী শাসক হিসেবেও তার পরিচয় আছে। আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের জীবনে এটি ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য যে, কলম্বাস ভারতে না পৌঁছে আমেরিকায় পদার্পণ করেন। কী ঘটেছিল তখন? প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে আসা প্রথম ইউরোপিয়ান নন। বেশ কিছু তথ্যমতে, তারও ৫০০ বছর আগে লেইফ এরিকসন নামের আইসল্যান্ডের একজন পরিব্রাজক উত্তর আমেরিকায় পা রাখেন। ১৫ শতকের দিকে স্পেনের আর্থিক অবস্থা অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মতো তেমন উন্নত ছিল না। তাই তারা ভাবলেন, যদি তারা তাদের স্বর্ণের পরিমাণ বাড়াতে পারেন তাহলে হয়তো তাদের অনেক লাভ হবে।

 অন্যদিকে কলম্বাসও অজানা ভূখণ্ডের সন্ধানে গিয়ে অনেক টাকা ও সুনাম কামানোর জন্য অনেক উদগ্রীব ছিলেন। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তখনকার স্পেনের রাজা- রানীকে ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য সাহায্য আবেদন করলেন এবং অনেক স্বর্ণ ও মূল্যবান মসলা সামগ্রী এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রতিদানে স্পেনের শাসক কলম্বাসকে লাভের ১০ শতাংশ ও নতুন আবিষ্কৃত ভূমির গভর্নর পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে রওনা দিলেন এবং ভুলবশত আমেরিকার বাহামাস দ্বীপে পৌঁছালেন। দিনটি ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর, যা কলম্বাস দিবস হিসেবে পালিত হয়। কলম্বাসকে স্বাগত জানাচ্ছে আরাওয়াকদের দল সেখানকার আরাওয়াক গোষ্ঠী তাদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো। নানা রকম আপ্যায়ণ করলো এবং কোনো কিছুর কমতি রাখলো না। এমনকি কলম্বাসের সবচেয়ে বড় জাহাজ ‘সান্তা মারিয়া’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে সেটি মেরামতের কাজেও আরাওয়াকরা সাহায্য করে। স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের এমন অমায়িক, কোমল ও অতিথিপরায়ণ আচরণ দেখে কলম্বাস ভাবলেন, মাত্র ৫০ জন লোক দিয়েই এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আদিবাসীরা তখন অলংকার পরতেন।

More Read  : যারা তসলিমা বিদ্বেষী,

এটি কলম্বাস লক্ষ্য করেন। মনে মনে ভাবলেন, এখানে নিশ্চয়ই অনেক স্বর্ণ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় সেই স্বর্ণ? সেটি খুঁজতে তিনি কয়েকজন ইন্ডিয়ানকে বন্দী বানিয়ে জাহাজ নিয়ে গেলেন। প্রথমে কিউবায়, তারপর হিস্পানিওলাতে (বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান ডিপাবলিক )। কলম্বাস আমেরিকার প্রথম ঘাঁটি বানান হিস্পানিওলাকে। সেখানে দলের ৩৯ জনকে রেখে স্পেনের উদ্দেশ্যে বাকি দুটি জাহাজ নিয়ে রওনা দেন তিনি। যেকোনো মূল্যে স্বর্ণের খোঁজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কলম্বাস তার জাহাজে আরো কয়েকজন ইন্ডিয়ানকে বন্দী করে স্পেনে নিয়ে যান। একটি ঘটনা না বললেই নয় যে, ফেরত আসার পূর্বে স্থানীয় কিছু তাইনোদের সাথে তীর-ধনুক নেয়া নিয়ে কলম্বাসের কথা কাটাকাটি হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তার নির্দেশে দুজন আদিবাসীকে তলোয়ারের আঘাতে মেরে ফেলা হয়। এদিকে স্পেনে ফিরে এসে কলম্বাস অনেক মনোমুগ্ধকর তথ্য দেন রাজা-রানীকে। যার বেশির ভাগই ছিল মিথ্যা। তিনি তাদের জানান, তিনি এশিয়া পৌঁছেছেন ও চীনের একটি দ্বীপে তিনি ঘাঁটি বানিয়েছেন এবং সেখানে অনেক স্বর্ণ ও মসলা সামগ্রী রয়েছে, যার জন্য তার আরো বড় দল প্রয়োজন। এজন্য তিনি ১৭টি জাহাজ ও প্রায় ১,২০০ লোক নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর থেকে শুরু হলো আরাওয়াকদের (যারা তাইনো নামেও পরিচিত) উপর আসল নির্মমতা। আরাওয়াকদের উপর হওয়া নির্মম অত্যাচার;  তিনি ফিরে এসে দেখলেন, তার রেখে যাওয়া লোকেরা সবাই স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। কারণ, তারা স্বর্ণ খুঁজতে গিয়ে নারী ও শিশুদের জোর করে ধরে নিয়ে এসে যৌন নির্যাতন করার চেষ্টা করেছিল। এই যাত্রায় কলম্বাস স্বর্ণের সন্ধান না পেলেও আদিবাসীদের ক্রীতদাস হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কয়েকজন স্প্যানিশ ও পোষা হিংস্র কুকুর মিলে প্রায় ১,৫০০ আরাওয়াক নারী, পুরুষ ও শিশুকে ধরে নিয়ে এসে একসাথে জড়ো করা হয়। সময়টা তখন ১৪৯৫ সাল। সেখান থেকে ৫০০ জনকে বাছাই করে জাহাজে করে দাস হিসেবে কলম্বাস স্পেনে পাঠান, যার মধ্যে পথেই মারা যায় প্রায় ২০০ জন। হিস্পানিওলার একটি প্রদেশে ১৪ বছরের উপরের সব স্থানীয় ইন্ডিয়ানকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা তিন মাস পরপর জমা দেওয়ার আদেশ করেন কলম্বাস। যারা এতে ব্যর্থ হয় তাদের দুই হাত কেটে ফেলা হতো এবং ফলশ্রুতিতে রক্তপাতে তারা মারা যেত। অনেকে সহ্য করতে না পেরে পালানোরও চেষ্টা করতো।

 তাদেরকে হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা হতো। যাদেরকে বন্দী করা হতো তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। এত নির্মমতা সইতে না পেরে আরাওয়াক গোষ্ঠীর লোকরা বিষ পানে গণ-আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে, যাতে স্প্যানিশরা সেসব বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এভাবে নানা উপায়ে প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসী আত্মহত্যা করে। খুন, অঙ্গহানী ও আত্মহত্যার  কারণে মাত্র দুই বছরে হাইতির ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অর্ধেক জনসংখ্যা লাশে পরিণত হয়, যার সবকিছুই ঘটে শুধুমাত্র স্বর্ণ উত্তোলনেকে কেন্দ্র করে। আদিবাসী শিশুদের হত্যা; Image Source: watchingthewheelsdad.net যখন কলম্বাস দেখলেন, এখানে আসলে কোনো স্বর্ণ নেই তখন তিনি আরাওয়াকদের বিভিন্ন জমি দখল করে তাদের দাসে পরিণত করলেন এবং হাজার হাজার ইন্ডিয়ানকে নিষ্ঠুর পরিশ্রম করতে বাধ্য করলেন। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো। যুদ্ধ, অত্যাচার, রাহাজানিতে ছেয়ে গিয়েছিল আদিবাসীদের জীবন। ১৫১৫ সাল নাগাদ ৫০ হাজার ইন্ডিয়ান প্রাণে বেঁচে ছিল। ১৫৫০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র ৫০০ জনে এবং ১৬৫০ সালের হিসাব অনুসারে, দ্বীপটিতে আদি আরাওয়াক গোষ্ঠীর কেউ বেঁচে রইলো না। কলম্বাসের আবির্ভাবের পর ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের সাথে যে অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে তার অনেক তথ্য উঠে এসেছে কলম্বাসের নিজস্ব জার্নাল ও বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে। আরো বিশদ ইতিহাস জানা যায় ফাদার বার্তোলমে দে লাস কাসাস নামক একজন স্প্যানিশ ঐতিহাসিকের লেখা ‘হিস্টোরি অব দ্য ইন্ডিস’ এ। তিনি বেশ কয়েক বছর কলম্বাসের সাথে কাজ করেছিলেন। এমনকি কলম্বাসের ব্যক্তিগত যে জার্নাল ছিল, যেখানে কলম্বাস নিজের হাতে সব ঘটনার বর্ণনা লিখেছেন, সেই জার্নালটিও লাস কাসাসের কাছে পরবর্তীতে প্রদান করা হয়। ফাদার বার্তোলমে একসময় কলম্বাসকে নিজের আদর্শ ভাবতেন। কিন্তু যখন তিনি আস্তে আস্তে দেখলেন, কলম্বাস একটির পর একটি অপরাধ করেই যাচ্ছেন, তখন তিনি কলম্বাসের সঙ্গ ছেড়ে আদিবাসীদের আসল তথ্য তুলে ধরার কাজ শুরু করলেন। তাদের উপর হওয়া নির্মমতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। সেজন্য তাকে ‘ইন্ডিয়ানদের রক্ষাকারী’ বলে অভিহিত করা হয়। তার ভাষ্যমতে, স্প্যানিশরা তাদের ছুরি কিংবা তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করার জন্য ইন্ডিয়ানদেরকে টুকরো টুকরো করে কাটতো। এমনকি একদিন দুটি ছোট্ট আদিবাসী শিশুর হাত থেকে পাখি ছিনিয়ে নিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই সেই শিশু দুটির শিরচ্ছেদ করে তারা। বার্তোলমে দে লাস কাসাস;  একজন স্প্যানিশ ইতিহাসবিদের মতে, ১৫১৬ সালে যেকেউ জাহাজ নিয়ে কোনো রকম মানচিত্র অথবা কম্পাস ছাড়াই বাহামাস থেকে হিস্পানিওলা যাওয়া যেত, কারণ পানিতে মৃত আদিবাসীদের লাশই দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করতো। বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীরা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, দখলদারদের উপর আক্রমণ চালায় এবং অত্যাচারীদের সাথে সংঘর্ষে যায়।

  • Read More : নরমাল ডেলিভারি চান? তাহলে জেনে নিন গর্ভাবস্থায় আপনাকে কি করতে হবে
  •  কিন্তু কখনোই তারা সফল হতে পারেনি। কারণ আদিবাসী ও স্প্যানিশদের মধ্যে অস্ত্রের একটি বিশাল পার্থক্য বিরাজমান ছিল। একপক্ষের কাছে ছিল আধুনিক, অত্যন্ত ফলপ্রসূ হাতিয়ার এবং অন্য পক্ষের কাছে ছিল হাতে বানানো, সামান্য অলাভজনক হাতিয়ার। এতে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা স্প্যানিশদের সাথে পেরে উঠতে পারেনি। তাদেরকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়েও আসেনি। এদিকে কলম্বাসের কর্মকান্ডের জন্য তাকে ও তার ভাইদেরকে যখন গ্রেফতার করে শাস্তির জন্য স্পেনের রাজা-রানীর সামনে হাজির করা হলো, তখন স্বর্ণ ও ক্রীতদাস লাভের অজুহাত দেখিয়ে কলম্বাস ও তার ভাইদেরকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেয়া হয়। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার অপরাধের জন্য কখনো শাস্তিভোগ করেননি। হয়তো সেজন্যই ইতিহাসের পাতায় যুগান্তকারী নায়ক হিসেবে তার পরিচয়। বাহামাস, হিস্পানিওলা ও কিউবার লাখ লাখ আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের উপর করা অত্যাচারের কোনো বিচার হয়নি। উল্টো স্কুলের ইতিহাসের বইগুলোতে তাকে একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাঁকজমক করে কলম্বাস দিবস পালন করা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে গেছে তার কালো অধ্যায়।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস জীবনী

(আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৫১-১৫০৬)

Read More :বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী অধ্যাপক বাংলাদেশি বালক!

ইতালির জেনোয়া শহরে কলম্বাসের জন্ম। সঠিক দিনটি জানা যায় না। তবে অনুমান ১৪৫১ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কোনো এক দিনে জন্ম হয়েছিল কলম্বাসের। বাবা ছিলেন তন্তুবায়। কাপড়ের ব্যবসা ছিল তার। সেই সূত্রেই কলম্বাস জানতে পেরেছিলেন প্রাচ্য দেশের উৎকৃষ্ট পোশাক, নানা মসলা, অফুরন্ত ধনসম্পদের কথা।
সেই ছেলেবেলা থেকেই মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে জাহাজ নিয়ে পাড়ি দেবেন ভারতবর্ষে। জাহাজ বোঝাই করে বয়ে নিয়ে আসবেন হীরা, মণি, মুক্তা-মাণিক্য।
কলম্বাস ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী। কিন্তু অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে ভাগ্য ছিল নিতান্তই প্রতিকূল। তাই অতিকষ্টে জীবন ধারণ করতেন কলম্বাস। কলম্বাসের ভাই তখন লিসবন শহরে বাস করত। ভাইয়ের কাছ থেকে ডাক পেয়ে কলম্বাস লিসবন শহরে গিয়ে বাসা বাঁধলেন। কলম্বাসের বয়স তখন ২৮ বছর।
অল্পদিনের মধ্যেই ছোটখাটো একটা কাজও জুটে গেল। কাজের অবসরে মাঝে মাঝে গির্জায় যেতেন। একদিন সেখানে পরিচয় হলো ফেলিপা মোয়িস দ্য পেরেস্ত্রল্লো নামে এক তরুণীর সাথে। ফেলিপার বাবা বার্তলোমিউ ছিলেন সম্রাট হেনরির নৌবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ অফিসার।
কলম্বাসের জীবনে এই পরিচয় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরিচয় পর্ব অল্পদিনের অনুরাগে পরিণত হলো। তারপর বিবাহ। বিবাহের পর কলম্বাস শ্বশুরের গৃহেই থাকতেন। শ্বশুরের কাছে শুনতেন তার প্রথম যৌবনের সমুদ্র অভিযানের সব রোমাঞ্চকর কাহিনী। অন্য সময় লাইব্রেরি ঘরে বসে পড়তেন দেশ-বিদেশের নানা ভ্রমণ কাহিনী। এই সময়ে একদিন তার হাতে এলো মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের ইতিবৃত্ত। পড়তে পড়তে মনের মধ্যে প্রাচ্য দেশে যাওয়ার স্বপ্ন নতুন করে জেগে উঠল।
এর পেছনে কাজ করেছিল দুটি শক্তি। রোমাঞ্চকর অভিযানের দুরন্ত আকাঙক্ষা, দ্বিতীয় স্বর্ণতৃষ্ণা। তখন মানুষের ধারণা ছিল প্রাচ্য দেশের পথে ঘটে ছড়িয়ে আছে সোনা-রূপা। সে দেশের মানুষের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই। ইচ্ছা করলেই তা জাহাজ বোঝাই করে আনা যায়।
কলম্বাস চিঠি লিখলেন সে যুগের বিখ্যাত ভূগোলবিদ Pagolo Toscanelli কে। Pagolo কলম্বাসের চিঠির জনাবে লিখলেন, তোমার মনের ইচ্ছার কথা জেনে আনন্দিত হলাম। আমার তৈরি সমুদ্রপথের একটা নকশা পাঠালাম। যদিও এই নকশা নির্ভুল নয়, তবুও এই নকশার সাহায্যে প্রাচ্যের পথে পৌঁছতে পারবে। যেখানে ছড়িয়ে আছে অফুরন্ত হীরা, জহরত, সোনা-রূপা, মণি-মুক্তা, মাণিক্য।
এই চিঠি পেয়ে কলম্বাসের মন থেকে সব সংশয় সন্দেহ দূর হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল তার যাত্রার প্রস্তুতি।
কলম্বাসের ইচ্ছার কথা শুনে সকলে অবাস্তব অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিল। অনেকে তাকে উপহাস করল। কেউ কেউ তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও ছাড়ল না। একটি মানুষও এগিয়ে এলো না তার সমর্থনে বা সাহায্যে।
কলম্বাসের অনুরোধে স্পেনের রানি ইসাবেলা সহৃদয় বিবেচনার আশ্বাস দিলেও সম্রাট ফার্দিনান্দ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। ইতিমধ্যে কলম্বাসের স্ত্রী ফেলিপা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সমস্ত চিকিৎসা সত্ত্বেও অসুখ ক্রমশই গুরুতর হয়ে উঠল। দূরপ্রাচ্য অভিযানের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হলো। কিছুদিন পর মারা গেলেন ফেলিপা।

 

  • কলম্বাসের জীবনের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। এবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার অভিযানে। দেশের প্রায় প্রতিটি ধনী সম্ভ্রান্ত মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ান। জাহাজ চাই, নাবিক চাই, অর্থ চাই।
  • কলম্বাসের দাবি ছিল যে দেশ আবিষ্কার হবে তাকে সেই দেশের ভাইসরয় করতে হবে আর রাজস্বের একটা অংশ দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে দু-একজন সম্মতি দিলেও কলম্বাসের দাবির কথা শুনে সকলেই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
কলম্বাসের সাথে এই সময় একদিন পরিচয় হলো ফাদার পিরেজের। ফাদার পিরেজ ছিলেন রাজপরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং রানি ইসাবেলা তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। কলম্বাসের ইচ্ছার কথা ফাদার নিজেই রানি ইসাবেলাকে বললেন। অনুরোধ করলেন যদি তাকে কোনোভাবে সাহায্য করা যায়। ফাদারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না রানি। নতুন দেশ আবিষ্কারের সাথে সাথে বহু মানুষকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার পুণ্য অর্জন করা যাবে।
ফাদার পিরেজ ছাড়াও আরো কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি কলম্বাসের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। কলম্বাসের সব অনুরোধ স্বীকার করে নিলেন সম্রাট। ১৭ এপ্রিল, ১৪৯২ তাদের মধ্য চুক্তি হলো। কলম্বাসকে নতুন দেশের শাসনভার দেয়া হবে আর অর্জিত সম্পদের এক-দশমাংশ অর্থ দেয়া হবে।
সম্রাটের কাছ থেকে অর্থ পেয়ে তিনখানা জাহাজ নির্মাণ করলেন কলম্বাস। সবচেয়ে বড় ১০০ টনের সান্তামারিয়া, পিন্টা ৫০ টন, নিনা ৪০ টন। জাহাজ তৈরির সময় কোনো বিঘ্ন দেখা গেল না। সমস্যা সৃষ্টি হলো নাবিক সংগ্রহের সময়। কলম্বাসের সাহায্যে এগিয়ে এলো পিনজন ভাইরা। তাদের সাথে আরো কিছু বিশিষ্ট লোকের চেষ্টায় সর্বমোট ৮৭ জন নাবিক পাওয়া গেল।
অবশেষে ৩ আগস্ট, ১৪৯২ কলম্বাস তার তিনটি জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিলেন অজানা সমুদ্রে। সেদিন বন্দরে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অধিকাংশই ভেবেছিলেন কেউই আর সেই অজানা দেশ থেকে ফিরে আসবে না।
ভেসে চললেন কলম্বাস। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। দিনের পর দিন অতিক্রান্ত হয়। কোথাও স্থলের দেখা নেই, অধৈর্য হয়ে ওঠে নাবিকরা। সকলকে সান্ত্বনা দেন, উৎসাহ দেন কলম্বাস কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রাখতে পারে না নাবিকরা। সকলে একসাথে বিদ্রোহ করে, জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কলম্বাসের চোখে পড়ে ভাঙা গাছের ডাল। সবুজ পাতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তারা স্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছেন। নাবিকদের কাছে শুধু একটি দিনের প্রার্থনা করেন। দিনটি ছিল ১২ অক্টোবর। একজন নাবিক, নাম রোডারিপো প্রথম দেখলেন স্থলের চিহ্ন। আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠলেন সকলে।
পরদিন কলম্বাস নামলেন বাহমা দ্বীপপুঞ্জের এক অজানা দ্বীপে। পরবর্তীকালে তিনি সেই দ্বীপের নাম রাখেন সান সালভাদর। (বর্তমান নাম ওয়েস্টলিং আইল্যান্ড)। এই দিনটি আজও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় কলম্বাস দিবস হিসেবে উদযাপন হয়।
কলম্বাস ভেবেছিলেন সমুদ্রপথে তিনি এশিয়ায় এসে পৌঁছেছেন। যেখানে অফুরন্ত সোনাদানা ছড়ানো আছে। কিন্তু কোথায় আছে সেই সম্পদ…? দিনের পর দিন চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না ধনসম্পদের কোনো চিহ্ন। কলম্বাস গেলেন কিউবা এবং হিস্পানিওয়ালা দ্বীপে। স্থির করলেন এখানে সাময়িক আস্তানা স্থাপন করে ফিরে যাবেন স্পেনে। এরপর আরো বিরাট সংখ্যক লোক এনে অনুসন্ধান করবেন ধনরত্বের। হিস্পানিওয়ালাতে সাময়িক আস্তানা গড়ে তুললেন। সেখানে ৪২ জন নাবিকের থাকার ব্যবস্থা করে রওনা হলেন স্বদেশভূমির পথে। নতুন দ্বীপে পৌঁছবার প্রমাণস্বরূপ কিছু স্থানীয় আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
শূন্য হাতে ফিরে এলেও দেশে অভূতপূর্ব সম্মান পেলেন কলম্বাস। তার সম্মানে রাজা-রানি বিরাট ভোজের আয়োজন করলেন। স্বয়ং পোপ কলম্বাসকে আশীর্বাদ জানিয়ে ঘোষণা করলেন, নতুন আবিষকৃত সমস্ত দেশ স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হবে।
সম্রাট ফার্দিনান্দ নতুন অভিযানের আয়োজন করলেন। বিরাট নৌবহর, অসংখ্য লোকজন নিয়ে ১৪৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলম্বাস আটলান্টিক পার হয়ে দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযানে যাত্রা করলেন।
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর কলম্বাস গিয়ে পৌঁছলেন হিস্পানিওয়ালাতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন তার সঙ্গী-সাথীদের একজনও আর জীবিত নেই। কিছু মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য মারা গেছে। অবশিষ্ট সকলে স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে মারা পড়েছে।
এই দ্বিতীয় অভিযানের সময় কলম্বাস চারদিকে ব্যাপক অনুসন্ধান করেও কোনো ধনসম্পদের সামান্য মাত্র চিহ্ন খুঁজে পেলেন না। শুধুমাত্র নতুন কিছু দ্বীপ আবিষ্কার করলেন। কোনো অর্থ সম্পদ না পেয়ে জাহাজ ভর্তি করে স্থানীয় আদিবাসীদের দাস হিসেবে বন্দি করে স্পেনে পাঠালেন। তখনো ইউরোপের বুকে দাস ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি। কলম্বাসের এই কাজকে অনেকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করতে পারল না। তাছাড়া আদিবাসীদের বিরাট অংশই নতুন পরিবেশে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যে মারা পড়ল। ইসাবেলা কলম্বাসের এই আচরণকে অন্তর থেকে সমর্থন করতে পারলেন না।
এই সংবাদ কলম্বাসের কাছে পৌঁছতে বিলম্ব হলো না। তিনি আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব করলেন না। আড়াই বছর পর ১৪৯৬ সালের ১১ জুন ফিরে এলেন স্পেনে। কিন্তু প্রথমবারের মতো এবারে কোনো সংবর্ধনা পেলেন না। কিন্তু অজেয় মনোবল কলম্বাসের। নতুন অভিযানের জন্য আবেদন জানালেন কলম্বাস। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিলেন সম্রাট।
১৪৯৮, ৩০ মে তৃতীয়বারের জন্য অভিযান শুরু করলেন কলম্বাস। এবার তার সঙ্গী হলো তার পুত্র এবং ভাই। কলম্বাসের জীবনের সৌভাগ্যের দিন ক্রমশই অস্তমিত হয়ে এসেছিল। হিস্পানিওয়ালার স্থানীয় মানুষরা ইউরোপিয়ানদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত কলম্বাস অত্যাচারী শাসকের মতো কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করলেন। শত শত মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো।
কলম্বাসের সহযোগীরাও তার কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সম্রাটের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তিনি ফ্রান্সিসকো দ্যা বোবদিলা নামে একজন রাজকর্মচারীকে সৈন্যসামান্ত দিয়ে পাঠালেন কলম্বাসের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য। কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধান করে রাজ্য স্থাপনের কোনো অভিযোগ না পেলেও কলম্বাসের বিরুদ্ধে নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ আনা হলো। কারণ কলম্বাস কোনো সম্পদশালী দেশ আবিষ্কার করার পরিবর্তে সম্পদহীন দেশ আবিষ্কার করেছেন। যার জন্য সম্রাটের বিরাট পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে।
এই অভিযোগে প্রথমে বন্দি করা হলো কলম্বাসের ভাই ও পুত্রকে। তারপর কলম্বাসকে। কলম্বাসকে শৃঙ্খলিত করে নিয়ে আসা হলো স্পেনে। তাকে রাখা হলো নির্জন কারাগারে। সেখান থেকেই রানি ইসাবেলাকে চিঠি লিখলেন কলম্বাস।
রানি ইসাবেলা ছিলেন দয়ালু প্রকৃতির। তাছাড়া কলম্বাসের প্রতি বরাবরই ছিল তার সহানুভূতিবোধ। তার চিঠি পড়ে তিনি মার্জনার আদেশ দিলেন। পঞ্চাশ বছরে পা দিলেন তিনি। শরীরে তেমন জোর নেই কিন্তু মনের অদম্য সাহসে ভর দিয়ে চতুর্থ বারের জন্য সমুদ্রযাত্রার আবেদন করলেন। সম্রাট সম্মতি দিলেন, শুধু হিস্পানিওয়ালাতে প্রবেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।
১৫০২ সালের ১৯ মে কলম্বাস শুরু করলেন তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রা। তার ইচ্ছা ছিল আরো পশ্চিমে যাবেন। পথে তুমুল ঝড় উঠল। নিরুপায় কলম্বাস আশ্রয় নিলেন এক অজানা দ্বীপে।
কলম্বাস পৌঁছেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপে। সেখান থেকে ফিরে যান জ্যামাইকা দ্বীপে। ক্রমশই তার দেহ ভেঙে পড়ছিল। অজানা রোগে তার সঙ্গীদের অনেকেই মারা গিয়েছিল। দু বছর পর নিরুৎসাহিত মনে স্পেনে ফিরে এলেন।
এরপর আর মাত্র দু বছর বেঁচে ছিলেন। যদিও অর্থ ছিল কিন্তু মনের শান্তি ছিল না। রাজ অনুগ্রহ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছিলেন। তার আবিষ্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করার ক্ষমতা দেশবাসীর ছিল না।
১৫০৬ সালে ভ্যাসাডোলিড শহরে এক সাধারণ কুটিরে সকলের অগোচরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কলম্বাস। সেখান থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে ডেমিঙ্গোতে সমাধি দেয়া হয়।

Leave a Reply