গল্প : যতদূর চোখ যায় | পর্ব : এক মো. ইয়াছিন

বেড়াতে এসে বিয়ে হলে গেল নিতুর। এখন সে বাসরঘরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে, সেই মানুষটাকে এখনও চোখের দেখা দেখেনি সে। শুধু নাম শুনেছে জাফর।
এরই মধ্যে নিতুর শাশুড়ি-মা দুই গেলাস গরম দুধ নিয়ে এসেছেন। আস্তে করে নিতুর কাছে বসে বলেছেন, “শুনো মা, মেয়েদের জীবনে স্বামী হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া অন্যতম একটি নেয়ামত। আমাদের উচিৎ সেই নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করা। স্বামীর ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে তার মঙ্গল কামনা করা। স্বামীকে ভালোবাসা। কোনো অবস্থায় তাকে কষ্ট না দেওয়া। আশা করি তোমার স্বামী কষ্ট পাবে এমন কোনো কাজ তুমি করবে না।”

কথাগুলো বলে তিনি বেরিয়ে গেছেন। ভ্যাপসা গরমে নিতুর গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। মাথার উপর ঝড়ের বেগে ফ্যান ঘুরলেও কাজ হচ্ছে না৷ পরনের ভারী শাড়ি আর গহনার ফলে আরো বেশি গরম লাগছে তার। নিতু আস্তে করে নেমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে এসে ভারী শাড়ির আঁচল গা থেকে নামিয়ে রাখল। এবার একটু শান্তি লাগছে। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। জাফর এলেই দরজা খুলে দিতে হবে।
নিতু পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশ বছরে পা দিয়েছে মাত্র। এখনই ঘর-সংসার করার ইচ্ছে ছিল না তার। ব্যাপারটা সবাই জানতেন। আর জানতেন বলেই বাবা-মা আজ বেড়ানোর কথা বলে নিতুর বিয়ে দিয়ে দিলেন। যদিও নিতু খুব কান্নাকাটি করেছে। এতে লাভ হয়নি। কারণ তার বিয়ে অনেক আগেই ঠিক করা হয়েছিল। তখন তার বয়স মাত্র এক মাস। থাক সেসব কথা। নিতু কোনোদিন ভাবতেও পারেনি যে, এতকাল আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতির জন্য বাবা তার জীবনের এমন বারোটা বাজিয়ে দেবেন। জানলে সে কোনোদিনই বাবার মিষ্টি কথায় ধেইধেই করে এখানে চলে আসত না।
বাবা যখন বেশি বেশি কেনাকাটা করছিলেন আর সব আবদার এক কথায় মেনে নিচ্ছিলেন তখনই বোঝা উচিৎ ছিল। কিন্তু নিতু আস্ত একটা বুদ্ধু। বুদ্ধু না হলে কেউ এমন পাতা ফাঁদে পা দেয়? চেনা নেই, জানা নেই, দেখা অবধি হয়নি কোনোদিন। এমন মানুষের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার! এখন যদি লোকটা খুব বেশি খাটো হয়? যদি কাকের মতো কালো হয়? কিংবা যদি লোকটার ইয়া বড়ো একটা ভুঁড়ি থাকে? তখন কী হবে?
চিন্তায় আরো বেশি ঘামতে শুরু করেছে নিতু। এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে পুরো শাড়িটাই আলগা করে রাখল সে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে এত গরম পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে নিতু এত পরিমাণ ঘামা মোটেও স্বাভাবিক হতে পারে না। এমন সময় সে একেবারেই ঘামেনি এমনটা নয়। কদাচিৎ ঘেমেছে। তবে আজ তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর কারণ কী? অতিরিক্ত চিন্তা? মানুষ কোনোকিছু নিয়ে বেশি বেশি ভাবলে এভাবে ঘামে কি?
কী জানি! নিতুর আপাতত ওই একটাই ভাবনা। যার সাথে তার বিয়ে হলো, সেই লোকটা কেমন হবে? দেখতে ভালো হবে তো? তার আচরণ মার্জিত হবে তো? আচ্ছা, ওরা এমন আড়ালে আড়ালে বিয়েটা সেরে ফেলল কেন? বিয়ের আগে একটিবারও কেন জাফরকে সামনে আনা হলো না? কী কারণে শাশুড়ি-মা এতসব কথা শিখিয়ে গেলেন?
“ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?” বিড়বিড় করে বলে উঠল নিতু। এখন কেমন যেন একটু হাঁসফাঁস লাগছে তার। বিয়েটা সত্যিই হয়েছে তো? জাফর নামের কোনো মানুষ সত্যি সত্যি আছে তো? না কি নেই? থাকলে এত রাত অবধি বাইরে কেন? ঘরে নতুন বউ রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারবে না নিশ্চয়ই! তা হলে?
নিতুর খুব খিদে পেয়েছে। সেই কখন খাওয়া হয়েছিল মনে নেই। এখানে আসার পর থেকেই তো বিয়ের তোড়জোড় শুরু। সবাই খাবার পেলেও নিতুর কপালে কিছু জোটেনি। খিদের পেট চোঁ-চোঁ করছে। আর ভালো লাগছে না। নিতু অতিশয় ক্লান্ত চোখদু’টো একবার বন্ধ করে আবার খুলতেই টেবিলের উপর রাখা দুধের গেলাস চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে যেন পেটের খিদে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটি লোভী হাত বাড়িয়ে দিলো গেলাসটার দিকে। এক চুমুকে পুরোটা দুধ শেষ করে গেলাস রাখতে গিয়ে অপরটিতে নজর পড়ল তার। সেটা জাফরের জন্য বরাদ্দ জেনেও তার লোভ হলো। এক গেলাসে পেট ভরেনি। এ-ঘরে পানিও নেই যে খেয়ে তৃপ্তি মেটাবে। সুতরাং বাকি দুধটুকুও সাবাড় করল সে। তারপর লম্বা হাই তুলে ঘড়ির দিকে তাকাল।
দূরের দেয়ালে ডিম্বাকৃতির অ্যানালগ সিস্টেমের ঘড়ি ঝুলছে। একটা সতেরো মিনিট। নিতুর বিরক্ত লাগল খুব। এ কেমন মানুষকে বিয়ে করেছে সে? ঘরে নতুন বউ রেখে এত রাত অবধি বাইরে বসে আছে! ধুর! এদিকে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে তার। ঘুমিয়ে পড়ার পর এসে ডাকাডাকি করলে দরজা খুলে দেবে না সে। কিছুতেই না। এই তার এক সিদ্ধান্ত। সে বড়জোর আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে যদি জাফর না আসে, তা হলে আজ রাতে আর নিতুকে পাবে না। তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দিলেও না।
শাড়ি ছাড়াও ভারী লাগছিল। নিতু সব গয়না খুলে রেখে আলমারিতে হামলা চালিয়ে কয়েকটি টি-শার্ট, জিন্স, ফতুয়া আর লুঙ্গি ব্যতীত কিছুই পেল না। সালোয়ার-কামিজ জাতীয় কিছু পেলে ভালো হত। কিন্তু তা যখন পাওয়া যায়নি, তখন গোল গলার গেঞ্জি আর জিন্স দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হলো।
জিন্স এবং গেঞ্জি দু’টোই খুব আঁটোসাঁটো হয়ে গায়ের সাথে মিশে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে চেপে ধরে আছে। এই আরেক ঝামেলা। কিন্তু কিছু করারও নেই। এগুলো খুলে ফেলতে চাইলে আবারো ভারী শাড়ি গায়ে পেঁচাতে হবে। যা ভাবতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে।
দশ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার আগেই দরজায় আওয়াজ হলো৷ “কে?” জিজ্ঞেস করতেই দরজার ওপাশ থেকে একটা মিহি পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এল, “আমি জাফর।”
এতক্ষণে নবাব আসার সময় হয়েছে! এই ভেবে মুখ বাঁকিয়ে দরজা খুলল নিতু। তার সামনে এক অসাধারণ পুরুষ দাঁড়িয়ে। অসাধারণ এইজন্য যে, আজ অবধি কোনো ছেলেকে পাত্তা না দেওয়া নিতু আজ হা করে তাকিয়ে আছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এতটাই সুদর্শন যে মাহতা মনে মনে বলে উঠল, “এতদিন তুই কই ছিলি চাঁদু?” কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। একটু আগে তার গা থেকে ঘাম ঝড়ছিল। এখন কিছুটা সময়ের ব্যবধানে ঘামের নোনাজল শুভ্র শীতল পরশ দিচ্ছে গায়ে। জাফরের পরনে একটা কালো পাঞ্জাবি। চোখে কালো সানগ্লাস। মাথায় পরিপাটি কালো কুচকুচে চুল। মুখভরতি কালো কালো দাড়ি। আর গায়ের রং দিনের মতো উজ্জ্বল। নিতুও ততটা ফরসা নয়, যতটা জাফর। তা হলে লোকটা এতদিন সামনে আসেনি কেন?
“আমার হাতটা ধরুন।” বলে ডান হাত এগিয়ে দিলো জাফর। নিতু আলতো করে দু’হাত দিয়ে জাফরের হাত ধরল। তারা দু’জনে একসঙ্গে বিছানা পর্যন্ত গেল৷ এতদূর পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু জাফর যখন বলল, “শাড়িতে আপনাকে বেশ মানিয়েছে।” তখন নিতু বিচলিত হয়ে পড়ল৷ বলল, “আমি তো আপনার গেঞ্জি পরে আছি।”
“ওহ!” বলে চুপ করল জাফর৷ নিতু উসখুস করছিল। জাফর কি মজা করে বলেছে কথাটা? তার কি হাসা উচিৎ ছিল? এবার?
নিতু ইতস্তত করে বলল, “আপনি তো জানেন, আমার পরনে শাড়ি নেই। তবুও কেন এমনটা বললেন? ফান করে কি?”
জাফর বিনীত হাসল, “না, ফান করে নয়। আসলে আমি দেখতে পাই না তো, তাই।”
এইবার নিতু আঁতকে উঠার পালা। এবং সে উঠল-ও। জাফর দেখতে পায় না মানে? এজন্যই কি এমন আড়ালে আড়ালে বিয়েটা সেরে ফেলা হয়েছে? এক মুহূর্তে নিতুর ভেতর শুকিয়ে গেছে৷ বুক কাঁপতে শুরু করেছে। সে ভীষণ বিচলিত হয়ে বলল, “আ-আপনি দেখতে পান না মানে?”
জাফর খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, “মানে আমি অন্ধ।” বলে চোখের সানগ্লাস খুলে টেবিলের উপর রাখল। নিতু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সত্যিই কি তার স্বামী অন্ধ? সারাজীবন অন্ধ লোকের ঘর করবে সে?
চলবে
গল্প : যতদূর চোখ যায় | পর্ব : এক
মো. ইয়াছিন
Source: নীলাভ্র আর নীলাম্বরীর গল্প fbpage

Leave a Reply