ছিলেন কমেডিয়ান। এক টিভি সিরিজে অভিনয় করলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সেই সিরিজ তাকে এমন জনপ্রিয়তা এনে দিল, যা পুঁজি করে ভোটের লড়াইয়ে চমক দেখিয়ে হয়ে গেলেন সত্যিকারের প্রেসিডেন্ট। সেই ভলোদিমির জেলেনস্কি এখন চলে এসেছেন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে জেলেনস্কির ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এমন গুঞ্জন উড়িয়ে দিতে শুক্রবার রাতে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে কিয়েভের রাস্তায় হাঁটারও ভিডিওও ছেড়েছেন তিনি; যুক্তরাষ্ট্র তাকে দেশ ছেড়ে যেতে বললেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেই খবর এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে।
রাশিয়ার হামলার মধ্যে সহকর্মীদের নিয়ে কিয়েভের পথে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ইউক্রেইন সঙ্কট ঘিরে পুরো বিশ্বের চোখ এখন যে ক’জনের ওপর নিবদ্ধ তার অন্যতম জেলেনস্কির জন্ম ১৯৭৮ সালে, তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় থাকা ইউক্রেইনের ক্রিভি রি’তে। ওই অঞ্চলের অনেকের মতো তিনিও বড় হয়েছেন রুশভাষী হিসেবে, পরবর্তীকালে অবশ্য ইউক্রেইনীয় এবং ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
ব্রিটানিক ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে আইনে স্নাতক করার পর খুব দ্রুত আইন পেশা চর্চার সনদ পেলেও তার ঝোঁক ছিল অন্যদিকে- অভিনয়। ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তার দল কভারতাল ৯৫ ‘ক্লাব অব দ্য ফানি অ্যান্ড ইনভেনটিভ পিপল’ নামের টিভি অনুষ্ঠানের ফাইনালে ঠাঁই করে নিয়েছিল; এ জনপ্রিয় কমেডি প্রতিযোগিতাটি কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটসজুড়ে প্রচারিতও হত।
জেলেনস্কি ২০০৩ সালে স্টুডিও কভারতাল নামে একটি প্রোডকশন কোম্পানি দাঁড় করান, আট বছর পর তিনি টিভি চ্যানেল ইন্টার টিভি জেনারেল প্রডিউসার হন। সেখানে থাকেন এক বছর; এরপর তিনি ও কভারতাল ৯৫ ইউক্রেইন নেটওয়ার্ক ১+১ এর সঙ্গে অনুষ্ঠান বানানো নিয়ে যৌথ চুক্তি করে।
এই নেটওয়ার্কেই ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রচার শুরু হয় সিরিজ ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’। জেলেনস্কি সেখানে অভিনয় করেন ‘ভাসিলি গোলোবোরদকো’ নামের এক শিক্ষকের চরিত্রে, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন।
অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে জয়ী হন ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ওই সিরিজের শেষ পর্বে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ‘ভাসিলি গোলোবোরদকো’কে ইউক্রেইনের জনগণের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, “আজ, আমি শুরু করব দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই শব্দগুলো দিয়ে, যা আমি গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করছি। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেইন ঐক্যবদ্ধ হল, এটাই আমাদের জয়।”
সিরিজটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার উপর ভর করে ক্ষমতায় গেলে ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানোর অঙ্গীকারে কভারতাল ২০১৮ সালে ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামে রাজনৈতিক দলই খুলে বসে। আর সিরিজ শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই জেলেনস্কি আবির্ভূত হন সত্যিকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ক্ষমতাসীন পেত্রো পোরোশেঙ্কো, যিনি জেলেনস্কিকে ‘নবিশ রাজনীতিক’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনীতিতে জেলেনস্কির সাফল্যের পেছনে ২০১৪ সালে ইউক্রেইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাতে শুরু হওয়া গণআন্দোলন ও পরবর্তী অস্থিরতা বেশ ভূমিকা রেখেছিল।
২০১৯ সালের মধ্যেই দেশটির রাজনৈতিক অভিজাতরা এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে তা এক অভিনেতা ও রাজনীতিতে তুলনামূলক নবীন একজনকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদে আসীন করতে সহায়ক হয়ে উঠেছিল।
স্থপতি ও চিত্রনাট্যকার স্ত্রীকে নিয়ে জেলেনস্কির অনলাইন প্রচারও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন বিবাদের শুরু থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি তথ্য একনজরে
স্ত্রী ওলেনা জেনেলস্কির সঙ্গে ভলোদিমির জেলেনস্কি।
তবে তিনি যে কেবল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েই বাজিমাত করেছেন, তা নয়। তার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাসে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যে লড়াই ছিল, তার ইতি টানাও।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট আর পরে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের দড়ি টানাটানিতে পড়ে মস্কোর সঙ্গে জেলেনস্কি প্রশাসনের সম্পর্কের তিক্ততা বাড়তে শুরু করে।
কিয়েভ নেটোতে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ বাড়ানো শুরু করলে রাশিয়া তার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এর এক পর্যায়ে ইউক্রেইন সীমান্তে জড়ো করে লাখো সেনা।
শুধু ইউক্রেইনের নেটো জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়টিই নয়, পূর্ব ইউরোপে নেটোর সম্প্রসারণ নিয়ে মস্কোর উদ্বেগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে দরকষাকষিতে নামে রাশিয়া। শেষপর্যন্ত কোনো পক্ষ ছাড় না দিলে উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করে।
এক পর্যায়ে রাশিয়া দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউক্রেইনে সর্বাত্মক আক্রমণে নামে।
ভোলোদিমির জেলেনস্কি জীবনী – Volodymyr Zelensky Biography in Bangla
ভলোদিমির জেলেনস্কি এখন বড় সঙ্কটে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার শুরুর দিকে অন্য একটি চাপও মোকাবেলা করতে হয়েছিল জেলেনস্কিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জো বাইডেনকে ঘায়েল করতে জেলনস্কির শরণ নিতে চাইছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
ইউক্রেইনকে বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দিতে চাপ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। জেলেনস্কি তাতে টলেননি, উল্টো এই ইস্যুতে ট্রাম্প প্রথমবার অভিশংসিত হন।
এর পরপরই করোনাভাইরাসের দাপট; সেটা শেষ হতে না হতে রুশ আগ্রাসন। সব মিলিয়ে দুই সন্তানের পিতা জেলেনস্কিকে তার স্বল্পতম রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে অনেকগুলো চড়াই-উৎরাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই পর্যায়ে তিনি এখন ইউক্রেইনের যুদ্ধদিনের নেতাও।
এখন আলোচনা চলছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। রুশ বাহিনী ইতোমধ্যেই কিয়েভে পৌঁছে গেছে; ইউক্রেইনীয় বাহিনী লড়াই চালিয়ে গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই শহরটির পতন হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রও আশঙ্কা করছে। পুতিন এরই মধ্যে ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীকে জেলেনস্কিকে উৎখাতে আহ্বান জানিয়েছে। সবমিলিয়ে জেলেনস্কির সামনে ঘোর বিপদের শঙ্কা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সম্পর্কে ১০টি তথ্য
প্যারিস সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভলোদিমির জেলেনস্কি এক হলেও তাদের সম্পর্ক ছিল শীতল।
এক ভাষণে নিজেও তেমনটাই বলেছেন তিনি, “রুশ বাহিনী আমাকে তাদের এক নম্বর টার্গেট বানিয়েছে। দুই নম্বর আমার পরিবার।”
তবে কিয়েভের দখল বজায় রাখতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন জেলেনস্কি। আর আলোচনার সম্ভাবনাও যে একদমই শেষ হয়ে গেছে তাও নয়।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পুতিনকে ফোন করার পর রাশিয়া বেলারুশে ইউক্রেইনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছে। ইউক্রেইন সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেনও।
আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন খোদ জেলেনস্কিও। শুক্রবার তিনি পুতিনের উদ্দেশে বলেছেন, “ইউক্রেইনজুড়ে যুদ্ধ চলছে। চলুন আলোচনার টেবিলে বসি এবং মানুষের মৃত্যু থামাই।”
আমাকে বন্দি করার পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া হয়েছে: জেলেনস্কি
কিয়েভেই আছি, ভিডিও দিয়ে জানালেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট
আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করবো: জেলেনস্কি
‘দেশ ছাড়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান জেলেনস্কির’
আমাদের একাই লড়তে হচ্ছে: জেলেনস্কি