ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি

ডাইনি অভিযোগে হত্যা: এখনও চলছে

১০ আগস্ট বিশ্ব ডাইনি হত্যাবিরোধী দিবস৷ ইউরোপে তিনশ বছরে অন্তত ৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো৷ হত্যা করা হয়েছিল ৬০ হাজার৷ তবে আফ্রিকাসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে উইচ হান্ট বা ডাইনি নিধন এখনও চলছে৷

গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনা ৩৫টি। সিআইডি-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে এ ভাবে ৪৬ জন মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়।

প্রতিদিন গড়ে তিন জন। গত ২২ বছরে এক হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে ঝাড়খণ্ডে। ২০২২ সালে আজ অবধি পাঁচজন এই কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত হয়েছেন। চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ঝাড়খণ্ড পুলিশের রিপোর্টে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এই রিপোর্ট বলছে, ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় এক হাজার জনের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এখনো রাজ্যে রাজ্যে ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন বা মারধরের অভিযোগ উঠে আসে খবরের শিরোনামে। এই কুসংস্কারে সবচেয়ে এগিয়ে ঝাড়খণ্ড। ২০০০ সালে বিহার থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয় ঝাড়খণ্ডকে। তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ২৪ জন এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন।

গত ২ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলার লুকিয়া গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে মারধর করেন স্থানীয়রা। মৃত্যু হয় তার। মাকে রক্ষা করতে ছুটে যান অজয় ও সঞ্জয় ওঁরাও নামে দুই ছেলে। রক্ষা পাননি তারাও। তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে নির্মম প্রহার। দুই ভাই গুরুতর আহত হন। এখন অজয়ের চোখটাই নষ্ট হওয়ার পথে। এই ঘটনায় পুলিশ যে অভিযোগ দায়ের করে সেখানে মূল অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং পঞ্চায়েত প্রধান। সব মিলিয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ।

২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি। খুনতি জেলার অদকি থানার তিরলা গ্রামে এক যুগলকে পিটিয়ে খুন করেন প্রতিবেশীরা। অভিযোগ, তারা ‘কালাজাদু’ জানতেন। যদিও পাঁচদিন পর এই খবর প্রকাশ্যে আসে।

১২ জানুয়ারি। আবারো ডাইনি সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। থেতাই থানার অন্তর্গত কুড়পানি গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযুক্তের বয়ান অনুযায়ী, ঝড়িয়ো নামে এক প্রতিবেশীর ‘কুনজর’-এ অকালে মারা যান তার স্ত্রী। এখনও রাঁচির এক হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ওই মহিলা।

২৭ জানুয়ারি। ডাইনি সন্দেহে আবারও একটি খুনের ঘটনা ঝাড়খণ্ডে। খুনের বীভৎসতা চমকে দেওয়ার মতো। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মহিলাকে খুনের পর গাড়িতে তার দেহ লুকিয়ে রাখেন অভিযুক্তরা। তার পর গাড়িটিকে খুনতি থানা এলাকার একটি নির্জন জঙ্গলে ফেলে রাখেন চার অভিযুক্ত। আর এই খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পেশায় নার্স! পুলিশি জেরায় সালোমি মিজ নামে ওই নার্স জানান হঠাৎ তার ছেলের মৃত্যু হয়। নার্সের ঘোর সন্দেহ, নোরা লকড়া নামে তার ভাড়াটে ডাকিনী বিদ্যা করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন!

২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। গুমলা জেলায় পাঁচজনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে আট জনের বিরুদ্ধে। সেখানেও কারণ সেই এক-ডাইনি অপবাদ। তার আগের দু’মাসে তিনজন এই কুসংস্কারের বলি হন। ঝাড়খণ্ড পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি সন্দেহে খুনের ঘটনা ৩৫টি। সিআইডি-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে ডাইনি সন্দেহে ৪৬ জন মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়। ২০১৬ সালে ৩৯, ২০১৭ সালে ৪২, ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ২৭ এবং ২০২০ সালে ২৮ জন এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন। ২০২১ সালের পুরো তালিকা এখনও আসেনি। তবে পুলিশের খাতায় এমন ২৪টি খুনের মামলা রুজু হয়েছে। গত সাত বছরে ঝাড়খণ্ডে ২৩০ জনের মৃত্যুর কারণ হল ডাইনি অপবাদ। গত ২২ বছরে সংখ্যাটা এক হাজারের বেশি!

ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি

‘ডাইনি নিধন’: তিনশ’ বছর পূর্বে ইউরোপীয় পৈশাচিক পুরুষতন্ত্রের বলি ৬০ হাজার নারী

১৫৫৬ সালে তিনজন প্রোটেস্টেন্ট নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে৷ এর মধ্যে একজন নারী জ্বলন্ত অবস্থায় এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন৷ সেসময় নারীটিকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পরে আবারও তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়৷ বর্তমানে সেই তিন নারী ‘গুয়ের্নসের শহীদ’ হিসেবে খ্যাত।

‘উইচ হান্ট’ বা ডাইনি নিধনের শুরু হয় সে মধ্যযুগ থেকে, কিংবা তারও আগে। ইউরোপে ডাইনি-নিধনের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫১-এ। এরপর ১৪ শতক থেকে বাড়তে থাকা এ ব্যাধি প্রশমিত হয় ১৮ শতকের শেষভাগে। আর ততদিনে ঝরে গেছে হাজারো প্রাণ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন উগ্র দুর্বৃত্তদের আক্রোশের শিকার এ মানুষগুলোর সিংহভাগই নারী। রয়েছে পুরুষ আর শিশুও। এরপর ইউরোপ এই বর্বরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে, এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে  উইচ হান্ট বা ডাইনি নিধন নামে এখনও চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১-এ রোমে মহামারি দেখা দিলে একসঙ্গে ১৭০ জন মহিলাকে ‘ডাইনি’ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার প্রায় দুই সহস্রাব্দ পরে, ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে রোম, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে এবং মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ মিলিয়ে মোট পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে অনুরূপ কারণে হত্যা করা হয়।

ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি

পঞ্চদশ শতকের বিপ্লবী ও সুযোদ্ধা মাত্র উনিশ বছর বয়সী জোন অব আর্ককেও ডাইনি অপবাদ দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ফরাসি এই বীর যোদ্ধা ১৪২৯ সালে ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন৷ তার কারণে ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের শতবর্ষের যুদ্ধের অবসান ঘটে৷ ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর জোয়ান অফ আর্ককে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে আটক করা হয়৷ ইংরেজ যাজকের অধীনে তার বিচার শুরু হয় এবং তাকে ডাইনি অ্যাখ্যা দিয়ে ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে পুড়িয়ে মারা হয়৷

তবে এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে তিনশ বছরে অন্তত ৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। আর হত্যা করা হয়েছিল ৬০ হাজার মানুষকে; যার প্রায় অধিকাংশই নারী।

প্রাথমিক মধ্যযুগে গির্জা সরাসরি ডাইনি বিচারে যেত না। যদিও এসব বিচার গির্জার আদর্শ থেকেই এসেছে। ৭৮৫ সালে চার্চ অব প্যাডেরবর্ন ডাকিনীবিদ্যা নিষিদ্ধ করে। পোপ জন (XXII) ডাকিনীবিদ্যা দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে ১৩২০ সালে। তদন্তকারী আদালত এ বিচারে জড়িত হয় ১৫ শতকে।

প্রাথমিক আধুনিক ইউরোপে ডাইনি বিচার শুরু হয় ভালোভাবেই। ১৫ শতকে ও ১৬ শতকে প্রাথমিক ডাইনি বিচার শুরু হয়। তারপর মানুষের ডাইনি ভীতি কমে গেলে বিচার কমে যায়। পরে আবার ১৭ শতকে এটা তুমুলভাবে শুরু হয়। খ্রিস্টান সমাজ ও সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করত ডাকিনীবিদ্যা নগ্ননৃত্য, অরজি সেক্স ও মানুষের মাংস খাওয়া নিয়ে পালিত শয়তানী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে ভালভাবে জড়িত।

জার্মানিতে ডাইনি শিকার শুরু হয় অনেক আগে। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানীতে ডাইনি শিকারের সফল বছর ছিল ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ সাল। জার্মানিতে ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মানুষকে ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ তবে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই নারী৷

ডাইনিদের বিরুদ্ধে বিচার হত আশ্চর্য এক ‘বৈধ’ আইনি পদ্ধতিতে৷ একজন নারী ডাইনি কিনা তা বিচার করা হত নিষ্ঠুরতম এক পরীক্ষার মাধ্যমে৷ এটাকে বলা হত ‘সাঁতার পরীক্ষা’৷ অভিযুক্তকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়া হত৷ যারা ডুবে যেতো তারা নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হত৷ আর যারা বাঁধন খুলে সাঁতরে উঠে আসতো তাদের ডাইনি বলা হত, কারণ ধারণা করা হত, তারা শয়তানের সাহায্যে এটা করতে পেরেছে৷

প্রমথ চৌধুরী এর জীবনী ও সাহিত্যকর্ম

অভিযুক্ত প্রত্যেককে তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হত৷ বলা বাহুল্য এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া ছিলো নির্যাতনের মাধ্যমে দোষ স্বীকারে বাধ্য করা৷ ১৪৮৬ সালে ডোমিনিকান সন্ন্যাসী হাইনরিশ ক্রেমার ‘হ্যামার অফ হুইচেস’ নামে এক বই প্রকাশ করেন৷ এই বইটিতে ডাইনিদের নির্যাতনের কত ধরনের প্রক্রিয়া হতে পারে তার বর্ণনা এবং আইনি প্রক্রিয়ার পূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে৷ সপ্তদশ শতাব্দীর পর এটি ছাপানো বন্ধ হয়ে যায়৷

১৫৫০ সালে ইংলিশ চ্যানেলের দ্বীপ গুয়ের্নসে অনেক ডাইনির বিচার হয়৷ সেসময় প্রোটেস্টেন্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলছিল৷ ১৫৫৬ সালে তিনজন প্রোটেস্টেন্ট নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে৷ এর মধ্যে একজন নারী জ্বলন্ত অবস্থায় এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন৷ সেসময় নারীটিকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পরে আবারও তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়৷ বর্তমানে সেই তিন নারী ‘গুয়ের্নসের শহীদ’ হিসেবে খ্যাত।

মূলত ডাইনি শব্দের ইংরেজি উইচ শব্দটি এসেছে উইকা থেকে। এর অর্থ হল যিনি নিগূঢ় জ্ঞান অর্জন করেছেন। পেগান ধর্মের উপাসক নারী পুরুষদের উইকা বলা হত। পেগান ধর্মের এই জ্ঞানী উপাসকদের কাজ-কারবার খ্রিস্টান জগত সহ্য করতে পারত না।

ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি
Occultist. (File Photo: IANS)

উইকানরা বিশ্বাস করতেন যে, গুহ্য জ্ঞান বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। এরা জাদু মন্ত্র করে মানুষের রোগ-বালাই সারিয়ে তুলত। এই তন্ত্রমন্ত্রই খ্রিস্টানদের কাছে কুসংস্কার ছিল। তাই ইউরোপের মানুষ উইকান নারীদের ভয় পেতে লাগল। চার্চ  ভাবতে লাগল যে, শয়তানের কাছ থেকে এরা গুপ্ত বিদ্যা রপ্ত করেছে। এমনকি এদের ভেষজ লতাপাতার জ্ঞানও চার্চের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করত কেবল প্রার্থনায়। উইকানদের ম্যাজিক এবং প্রকৃতি উপাসনাকে চার্চ সন্দেহের চোখে দেখত।

১৫৬৪ সাল্ব স্কটিশ উইচক্র্যাফট অ্যাক্ট জারি করা হয়। এই আইনে চিকিৎসার জন্য যারা উইকানদের কাছে যাবে ধর্মের কাছে তারা উইকানদের সমান অপরাধী। পঞ্চদশ শতক থেকে চার্চের সিদ্ধান্তে উইকান নরনারীদের ডাইনি   আখ্যায়িত করে তাদের হত্যা করা শুরু হয়। সন্দেহজনক উইকান নারীকে  অভিযুক্ত করে তার বিচার হত এবং বিচারক মৃত্যুদণ্ড হিসেবে পুড়িয়ে মারার আদেশ দিত। এছাড়া ডাইনি নিধনে ব্যবহৃত হত আরেকটি যন্ত্র। এটি একটি তীক্ষ্ম যন্ত্র  যা তার বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হত।

উইকান নরনারীরা ছিল ইউরোপের প্রাচীন পেগান সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পেগানদের উপাসনা পদ্ধতি ছিল খ্রিস্টান ধর্ম বিরোধী। ডাইনি হত্যার পেছনে এটি অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ ছিল না।

গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত শত্রুতা, বয়স্কা একাকিনীকে সরিয়ে তার সম্পত্তি দখলের গোপন অভিপ্রায়, ডাইনি অপবাদ দিয়ে অর্থ আদায়ের লোভ, অজানা রোগ, মড়ক বা ফসল না হওয়ার দায় কারোর উপর চাপিয়ে দিয়ে মানসিক শান্তি লাভ কিংবা মানসিক রোগ জাতীয় অদ্ভূত আচরণকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা- এসবই ছিল ডাইনি হত্যার পশ্চাদে কারণ।

নারীবাদী তাত্ত্বিকরা অবশ্য মনে করেন, উইকান নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল কারণ তারা পারিবারিক গন্ডিবদ্ধ  জীবন থেকে সরে এসেছিল। তাই পুরুষতেন্ত্রর কর্তারা তাদের শেষ করে দেবার চক্রান্ত করেছিল।

ডাইনি নিধনের বর্বরতার শিকার নারীদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ছিলেন কিছুটা স্বাধীনচেতা স্বভাবের, প্রতিবাদী কিংবা ঝগড়াটে। তাই বিশেষজ্ঞরা ডাইনি নিধনকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি দিক হিসেবেও দেখছেন। নারীকে সবসময় দুর্বল ভাবা এবং অবদমিত করে রাখার মানসিকতাই তাদের গলার স্বর উঁচু হতে দেয় না। ব্যতিক্রম হলে পুরুষের অহমে আঘাত করে যা ডাইনি নিধনের তথ্য উপাত্তে প্রমাণিত হয়।

নির্যাতনের পর বেঁচে যাওয়া অনেক নারী বলেছেন যে তাদেরকে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় নানাবিধ কারণে। গ্রামে কোনো নবজাতকের মৃত্যু, মহামারীর আগমন, গৃহপালিত পশু মৃত্যু, এমনকি আবহাওয়া খারাপ হলেও অনেক সময় এই চিহ্নিত ‘ডাইনি’দের দোষী করা হয়। তবে ঘটনার গভীরে গেলে আরো ভয়ানক তথ্য মেলে।

অনেক নারীকেই ডাইনি আখ্যা দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়মিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রামের প্রভাবশালী শ্রেণী। আবার অনেক নারীকে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যই দেয়া হয় এরকম অমূলক পরিচিতি। ডাইনি হিসেবে হত্যা করা নারীদের বেশির ভাগই বিধবা, বয়োঃবৃদ্ধ কিংবা পরিবার ছেড়ে একাকী বাস করা নারী।

নৃতাত্ত্বিকবিদ মার্ভিন হ্যারিস অবশ্য ডাইনি নিধনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে এই বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ক্ষমতাভোগী চার্চ ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যে কৃষক বিদ্রোহের আবহাওয়া ১৩ শতক থেকে ঘনিয়ে উঠেছিল সেই দিক থেকে মানুষের মূল লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেবার চক্রান্ত ছিল এই ডাইনি নিধন।

ধারণা করা হতো, অষ্টাদশ শতকেই বিশ্বে ডাইনি নিধনের বর্বরতা সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু ৩৬টি দেশে এখনো ডাইনি শিকার অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ক্যাথলিক মিশনারি সোসাইটি মিসিও৷ জার্মান ইতিহাসবিদ ভল্ফগাং বেহরিঙ্গেরের মতে, ওই তিনশ বছরে ডাইনি সন্দেহে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা চেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে আধুনিক সভ্য যুগে৷ বিশেষ করে আফ্রিকায়৷

ভারতের অন্যতম মহান মুক্তিযোদ্ধা তিরোট সিং। তিনি ইউ তিরোট সিং সিয়েম নামেও বিশেষ পরিচিত

 

১৯৯৯ সালে বিবিসির প্রতিবেদনে দেখা যায় যে কঙ্গোতে শিশুদের ডাইনি সন্দেহ করে হচ্ছে ও তাঞ্জানিয়াতে ডাইনি সন্দেহে বয়স্ক মহিলাদের মারা হচ্ছে যদি তাদের চোখ লাল হয়। ডাইনি শিকার করে আফ্রিকাতে মূলত করে ডাইনির আত্নীয় স্বজনরা তার সম্পত্তির লোভে।

২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয় যে কেবল গাম্বিয়াতেই প্রায় হাজারখানেক নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করে হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত আর নেপালে এই ঘৃণ্য অপরাধ ঘটছে নিয়মিতই। ২০০০ সালের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ২৫০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ডাইনি নিধনের নামে! ২০১৬-১৭ সালে কেবল উড়াষ্যাতেই ৯৯টি এবং রাজস্থানে ১২৭টি ডাইনি নিধনের অভিযোগ দাখিল হয়েছে পুলিশের খাতায়। এই আধুনিক সভ্য সমাজেও মধ্যযুগীয় এই বর্বরতা সমাজের ঘাড়ে চেপে বসে আছে বহাল তবিয়তে।

ডাইনি অপবাদে ১ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!

প্রতিদিন গড়ে তিনজন ডাইনি শিকারের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। গত ২২ বছরে এক হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ভারতের ঝাড়খণ্ডে।

চলতি বছরে এ পর্যন্ত পাঁচজন, এই কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত হয়েছেন, এদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আইএএনএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝাড়খণ্ড পুলিশের রিপোর্টে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেয়েছে।

রিপোর্ট বলা হয়েছে, ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় এক হাজার জনের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা।

একবিংশ শতাব্দীতে রাজ্যে ডাইনি অপবাদে পিটিয়ে খুন। এই কুসংস্কারে সবচেয়ে বেশি ঘটে ঝাড়খণ্ডে। ২০০০ সালে বিহার থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয় ঝাড়খণ্ডকে।

প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ২৪ জন এই কুসংস্কারের শিকার হয়েছেন।

চলতি বছরের গত ২ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলার লুকিয়া গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে মারধর করেন স্থানীয়রা। মৃত্যু হয় সেই মহিলার। মাকে রক্ষা করতে ছুটে যান দুই ছেলে। রক্ষা পায়নি তারাও। তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে নির্মম প্রহার করা হয়। দুই ভাই গুরুতর আহত হন। এখন অজয়ের চোখটাই নষ্ট হওয়ার পথে। এ ঘটনায় পুলিশ যে অভিযোগ করে সেখানে মূল অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং পঞ্চায়েতপ্রধান। সব মিলিয়ে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ।

খুনতি জেলার অদকি থানার তিরলা গ্রামে ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি এক দম্পতিকে পিটিয়ে খুন করেন প্রতিবেশীরা। অভিযোগ, তারা ‘কালাজাদু’ জানতেন। এই খবর পাঁচ দিন পর প্রকাশ্যে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ জানুয়ারি, আবারো ডাইনি সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। থেতাই থানার অন্তর্গত কুড়পানি গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে বেধড়ক মারধর করা হয়।

অভিযুক্তের বয়ান অনুযায়ী, ঝড়িয়ো নামে এক প্রতিবেশীর কুনজরে অকালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার স্ত্রী। এখনও রাঁচির এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ওই মহিলা।

ডাইনি সন্দেহে ২৭ জানুয়ারি আবারও একটি খুনের ঘটনা ঝাড়খণ্ডে। খুনের বীভৎসতা চমকে দেওয়ার মতো।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মহিলাকে খুনের পর গাড়িতে তার দেহ লুকিয়ে রাখেন অভিযুক্তরা। তার পর গাড়িটিকে খুনতি থানা এলাকার একটি নির্জন জঙ্গলে ফেলে রেখে আসেন চার অভিযুক্ত। আর এই খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পেশায় নার্স! পুলিশি জেরায় সালোমি মিজ নামে ওই নার্স জানান হঠাৎ তার ছেলের মৃত্যু হয়। নার্সের ঘোর সন্দেহ, নোরা লকড়া নামে তার ভাড়াটে ডাকিনী বিদ্যা করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন।

২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। গুমলা জেলায় পাঁচজনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে আট জনের বিরুদ্ধে। সেখানেও কারণ সেই এক ডাইনি অপবাদ। তার আগের দুমাসে তিন জন এই কুসংস্কারের বলি হন।

ঝাড়খণ্ড পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সাত বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ডাইনি সন্দেহে খুনের ঘটনা ৩৫টি।

সিআইডি-র রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে ডাইনি সন্দেহে ৪৬ জন মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়। ২০১৬ সালে ৩৯, ২০১৭ সালে ৪২, ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ২৭ এবং ২০২০ সালে ২৮ জন এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন।

২০২১ সালের পুরো তালিকা এখনও আসেনি। তবে পুলিশের খাতায় এমন ২৪ খুনের মামলা রুজু হয়েছে। গত সাত বছরে ঝাড়খণ্ডে ২৩০ জনের মৃত্যুর কারণ হল ডাইনি অপবাদ। গত ২২ বছরে সংখ্যাটা এক হাজারের বেশি।

‘ডাইনি’ অপবাদে মা ও চার সন্তানকে হত্যা!

ভারতের ওডিশায় ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে এক নারী ও তাঁর চার সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় পুলিশ ছয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযুক্ত আরও কয়েকজনকে খোঁজা হচ্ছে। পুলিশের বিশ্বাস, ওই নারী ও তাঁর সন্তানদের হত্যার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত ছিল।

ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি

বিবিসির আজ বুধবারের খবরে বলা হয়েছে, নিহত নারীর নাম মাংরি মুন্ডা। গত শনিবার সন্তানসহ এই নারীর লাশ একটি কুয়ার মধ্যে পাওয়া যায়। মাংরি মুন্ডার বাড়ির কাছেই কুয়াটির অবস্থান।

ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে নারীহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। ওডিশার স্থানীয় জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা কবিতা জালান বলেন, মাংরি মুন্ডা হত্যার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি নিজেকে ‘ডাইনি তাড়ানোর ওঝা’ বলে দাবি করেছে।

স্থানীয় কিছু মানুষের অভিযোগ, মাংরি মুন্ডা নাকি ‘জাদুটোনা’ করে গ্রামের কয়েকটি পরিবারের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলেন। সুন্দরঘর জেলার একটি গ্রামে থাকতেন মাংরি। ডাইনি অপবাদ দিয়ে গত শুক্রবার গভীর রাতে তাঁর বাড়িতে একদল লোক আক্রমণ চালায়। ওই সময় মাংরির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। মা-সন্তানের ওপর লাঠিসোঁটা ও কুঠার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণকারীরা। পরে মা ও সন্তানদের কুয়ায় ফেলে দেওয়া হয়।

পুলিশ কর্মকর্তা কবিতা জালান বলেন, এ ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

তবে শুধু ওডিশা নয়, ভারতের আসাম ও ঝাড়খণ্ডেও ডাইনি অপবাদে নারীদের হত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। ২০১৭ সালে শুধু ওডিশাতেই ডাইনি অপবাদে হত্যার অভিযোগে ৯৯টি মামলা নথিবদ্ধ হয়েছিল। এর আগের বছর নথিবদ্ধ হয়েছিল ৮৩টি মামলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্ধবিশ্বাস‌‌ ও কুসংস্কারের কারণেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

ডাইনি ভেবে তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা, গ্রেপ্তার ১০

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডে ডাইনি সন্দেহে রবিবার রাতে এক পরিবারের তিনজনকে পুড়িয়ে মারার পর আজ (মঙ্গলবার) ওই ঘটনায় অন্তত দশজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রাজ্যের পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, স্থানীয় গ্রামবাসীরা ওই পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল তারা বলি দেওয়ার জন্য ছোট ছেলেমেয়েদের অপহরণ করেছে – কিন্তু সেই অভিযোগের আদৌ কোনও সত্যতা মেলেনি।

ডাইনি অভিযোগে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মারার ঘটনা আদিবাসী-অধ্যুষিত ঝাড়খন্ডে মোটেও বিরল নয়, এবং পুলিশ বা প্রশাসনের বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও এই প্রথা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ঝাড়খন্ডের লোহারডাগা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কাইরো-তে রবিবার রাত দশটা নাগাদ শত শত গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা ও মশাল নিয়ে ঘিরে ধরেছিল গোবর্ধন ভগতের বাড়ি।

ডাইনি অপবাদে তিনশ বছরে ৬০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা!,৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি

গ্রামের মোটামুটি সম্পন্ন পরিবার তারা, ছেলেরা বিএসএফ বা পুলিশে কাজ করে। বাড়ির কর্তা গোবর্ধন ভগত নিজে অবশ্য বছর পনেরো আগে একটি বাচ্চা ছেলের মাথা কাটার অভিযোগে জেল খেটেছিলেন।

সে রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে জেলার পুলিশ-প্রধান কার্তিক এস বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ওই গ্রামবাসীরা তার বাড়িকে ঘিরে ফেলে শ্লোগান দিতে থাকে – বাচ্চাদের বলি দেওয়া চলবে না, আমরা ওদের উদ্ধার করতে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে অবশ্য ওরকম কোনও বাচ্চা ও বাড়িতে ছিল না, পুরোটাই ছিল মিথ্যা গুজব।”

“কিন্তু উত্তেজিত গ্রামবাসীরা এক পর্যায়ে বাড়ির লোকদের ভেতরে আটকে রেখেই সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় – বাড়িতে তখন মোট সাতজন সদস্য ছিলেন, তাদের চারজনকে আমরা কোনওক্রমে উদ্ধার করতে পারলেও তিনজনকে বাঁচাতে পারিনি”, জানান পুলিশ-প্রধান।

এর পরই পুলিশ গ্রামের পঁচিশজন ব্যক্তি ও আরও পাঁচশো বেনামি লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে এবং তাদের মধ্যে থেকে মঙ্গলবার দশজনকে গ্রেফতার করা হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ভিক্টিমরা কথা বলার মতো অবস্থায় এলে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আরও অনেক অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা যাবে বলে পুলিশ ধারণা করছে।

তারা আরও মনে করছে, এই পুরো ঘটনার পেছনে ছিল গ্রামের এমন একটা ধারণা যে গোবর্ধন ভগত ডাইনিবিদ্যার চর্চা করেই পরিবারে আর্থিক উন্নতি নিয়ে এসেছেন।

ঝাড়খন্ডের মূখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস। ডাইনি নিয়ে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার।

এই ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে সম্প্রতি বারবার মুখ খুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেও।

মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস জনসভায় বলেছেন, “এ রাজ্যে বারবার নির্দোষ মহিলারা এই কারণে প্রাণ দিচ্ছেন। রাঁচিতে কিছুদিন আগে পাঁচজন মহিলাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, পশ্চিম সিংভূম থেকেও এমন ঘটনার কথা প্রায়ই কানে আসে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, ওঝাদের ফাঁদে পা-দিয়ে এভাবে নির্দোষ লোকেদের প্রাণ নেওয়াটা আদিবাসী সমাজের কলঙ্ক – যা আমাদের ঘোচাতেই হবে।”

ঝাড়খন্ডে ডাইন বা ডাইনি সন্দেহে কাউকে মেরে ফেলার ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটে, কেন ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন ডিসকভারি মিডিয়া নেটওয়ার্কের শ্যারন উইলিয়ামস।

তিনি বলেন, “ওঝারা অনেক সময় সন্দেহভাজনদের নাম লিখে এক একটা চালের পুঁটলি পিঁপড়েদের খেতে দেন। যে পুঁটলিটা আগে শেষ হয়, তাকে ডাইনি বলে শনাক্ত করা হয়। গাছের ডালে নাম লিখেও অনেক সময় দেখা হয়, কোন ডালটা আগে মরে।’

“এর পেছনে কুসংস্কার, অশিক্ষা তো আছেই – তা ছাড়া একটা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও কিন্তু আছে বলেই মনে হয়। বিধবা মহিলাদেরই বেশি ডাইনি বলে মারা হয়ে থাকে – যাতে তাদের জমি বা সম্পত্তি সহজে জব্দ করা যায়।”

লোহারডাগার ঘটনাতেও কোনও অর্থনৈতিক কারণ ছিল কি না, গোবর্ধন ভগত ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কারা কেন গুজব ছড়িয়েছে – তার সবই এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

Leave a Reply