তসলিমা নাসরিন-এর দাওয়াত

রোহানের বাবা মারা যাওয়ার পরই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো সংসারে। রোহান মুখ কালো করে বসে থাকে। আত্মীয় স্বজনকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে।ফোনেও কারও সঙ্গে কথা বলে না। হাসপাতাল থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে নিল। খাওয়ায় রুচি নেই। টেলিভিশন অন করে না। কোথাও যায় না। আমি আমার চাকরি করে যেতে থাকি, প্রতিদিন বাড়ি ফিরে ভাবি রোহানকে বোধহয় স্বাভাবিক দেখবো। কিন্তু স্বাভাবিকের লেশমাত্র নেই তার আচার আচরণে। তাকে বলি, ‘বাবাদের বয়স হলে তো মারা যায়ই, এ কারণে এত ভেঙে পড়লে চলবে? খাচ্ছো না একেবারে, না খেলে শরীর খারাপ হবে, ইচ্ছে না হলেও কিন্তু খেতে হবে! যদি বাড়িতে ভালো না লাগে, চলো দূরে কোথাও যাই, বেড়ালে হয়তো মন ভালো হবে। ছুটি যখন নিয়েছো, শুধু শুধু শুয়ে বসে নষ্ট করছো কেন? মায়ের কাছেও তো থেকে আসতে পারো ক’দিন।’

কোনও উত্তর দেয় না রোহান।

একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে দেখি রোহান পাজামা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে বসে আছে। ‘কী ব্যাপার, এই পোশাক কেন?’ রোহান কোনও উত্তর দিল না। ঘণ্টা খানিক পর বুঝলাম কেন সে ওই পোশাক পরেছে। আমাকে না বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল, পেছনে দৌড়ে এলাম, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

রোহান বললো, ‘মসজিদে।’

‘মসজিদে? কেন?’

‘কেন আবার? নামাজ পড়তে।’

রোহান সোজা হেঁটে গেল। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়। আগে কোনওদিন রোহানকে নামাজ পড়তে দেখিনি, আর এখন কিনা দিব্যি মসজিদে যাচ্ছে নামাজ পড়তে। ভেবে নিই, বাবা মারা যাওয়ার পর মৃত্যুভয় তাকে এমন আঁকড়ে ধরেছে যে সে ধর্মকর্ম করে ভয় থেকে মুক্তি চাইছে। এরকম হতেই পারে। সময়ই শোকের শুশ্রুষা করে।

বাংলাদেশের যে গ্রামে বউসহ সব কিছুই ভাড়াতে পাওয়া যায়

এর পর থেকে পাঁচ বেলা নামাজই রোহান মসজিদে গিয়ে পড়ছে। মসজিদ থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরছে। গেটের কাছে প্রায়ই লক্ষ করছি দু’তিনটে টুপি দাড়িওয়ালা লোক তার সঙ্গে কথা বলছে, হাতে কিছু কাগজ পত্র দিচ্ছে। রোহান ঘরে ফিরেই কম্পিউটার নিয়ে বসছে। গুগলে ইসলাম খুঁজছে। যা পাচ্ছে পড়ছে। মন দিয়ে আওলাকির লেকচার শুনছে। রোহানকে চা দেওয়া হয়। অনেক সময় চা চায়ের মতো পড়ে থাকে।

একদিন আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কারা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে প্রায়ই?’

রোহান মাথা নেড়ে বললো, ‘ওদের চিনবে না।’

আমি পাশের সোফায় বসে বললাম, ‘চিনবো না তো চেনাও। কী চায় তারা? রোগী?’

‘না।’

‘তাহলে?’

‘মসজিদে পরিচয়। ইসলামের দাওয়াত দিতে আসে।’

‘ইসলামের দাওয়াত আবার কী জিনিস?’

‘তুমি বুঝবে না।’

‘না বোঝার কী আছে? বুঝিয়ে বলো।’

‘ইসলাম সম্পর্কে কী জানো তুমি? ঘোড়ার ডিম জানো। সারা জীবন কী করেছো? ইসলামকে জানার কোনও চেষ্টাও তো করোনি।’

‘সে তো তুমিও করোনি।’

‘আমি এ ক’দিনে যা জেনেছি, তাতে জানার তৃষ্ণা অনেক বেড়ে গেছে।’

‘দাওয়াত দিতে আসা লোকগুলো বুঝি জানে অনেক?’

‘হ্যাঁ, ওরা অনেক জ্ঞানী। ওদের জ্ঞানের তিল পরিমাণ জ্ঞান আমার নেই।’

‘তুমি ডাক্তার, তুমি তো আর মাদ্রাসায় পড়োনি। ইসলাম সম্পর্কে এত জ্ঞান থাকার তো তোমার কথা নয়। ডাক্তারি জ্ঞান থাকলেই তো যথেষ্ট।’’

রোহান এমন রেগে যায় যে সোফা ছেড়ে উঠে শোবার ঘরে গিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকে।

ভেবেছিলাম, দু তিন সপ্তাহ পার হলে তার আর ভালো লাগবে না মসজিদে এতটা সময় কাটানো, বা ঘন ঘন নামাজ পড়াকেও তার অর্থহীন বলে মনে হবে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে আমাকে ভুল প্রমাণ করলো রোহান। আগের চেয়ে বেশি জায়নামাজে সময় কাটাতে শুরু করলো সে। দাড়িও রাখতে শুরু করলো। শার্ট প্যান্ট পরা বাদ দিয়ে দিল, স্যুট টাই পরা তো বাদই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর নানা রকম কনফারেন্সের আয়োজন করে শহরের ক্লিনিকগুলো। দুজনই আমন্ত্রণ পাই, আমি যাই, রোহান যায় না। রোহানের ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করি, ‘কী বিচিত্র দাড়ি রেখেছো, এবার পারলারে গিয়ে শেভ করে এসো, জয়েন করতে হবে তো চাকরিতে’।

রোহান উত্তর দেয় না।

ছুটি শেষ হয়ে গেলেও সে হাসপাতালে যায় না।

আমি বলি, ‘জানিনা কী হয়েছে তোমার। নামাজ লোকে পড়ে, কিন্তু তোমার মতো করে নামাজ পড়তে কাউকে দেখিনি। অবসেসড হয়ে গেছো। তুমি আর আগের রোহান নও। ভয়ঙ্কর রকম বদলে গেছো। সারা রাত কী সব প্রিচারদের লেকচার শুনছো ইন্টারনেটে। একগাদা কোরান হাদিসের বই কিনে এনেছো, লোকেরা এসে দাওয়াতের কাগজপত্র দিয়ে যাচ্ছে, কী সব জেহাদের কথা লেখা ওসবে দেখলাম। এগুলোর মধ্যে কী আনন্দ পাচ্ছো জানিনা। আমার সঙ্গে কথা বলা তো ছেড়েই দিয়েছো। কী ঘোরের মধ্যে থাকো, সে তুমিই জানো।’

আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে রোহানের কিছু যায় আসে না। সে যা করছিল, তা-ই করে যেতে থাকে। হাসপাতালের চাকরিতে সে আর যোগ দেয় না। সে নাকি আর ডাক্তারি করবে না। ডাক্তারি পড়া, ডাক্তারি চাকরি করা –সবই নাকি তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাকে আল্লাহ রসুল সম্পর্কে আরও জানতে হবে, সে মুসলমান, সাচ্চা মুসলমানের জীবন তাকে যাপন করতে হবে। তাকে জিহাদ করতে হবে। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। রোহান, আমার ধারণা হয়, রোহানের নিজের নয়, অন্য কারও শিখিয়ে দেওয়া কথা আওড়াচ্ছে। একটা যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আচমকা এমন বিরাট পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে না। আমার সংশয় হয়, দাওয়াতের কাগজ, দাওয়াত দিতে আসা কয়েকটি লোক, আওলাকির লেকচার, জিহাদের পুস্তিকা — এসব রোহানকে বদলে দিয়েছে। তাকে কিভাবে এখন বাস্তবে ফিরিয়ে আনা যায়, হাসপাতালের চাকরিতে ফের যোগ দেওয়ানো যায়, এ নিয়ে আমি টাঙ্গাইলে তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি, তার মা’র সঙ্গেও। রোহানকে এই ফোনের ব্যাপারে কিছু আমি জানাই না। বড় ভাই না আসতে পারলেও রোহানের মা আসেন ঢাকায়। রোহানের কাণ্ড কারখানা দেখে তিনি তাজ্জব বনে যান। রোহানকে আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ধর্ম কর্ম করো, রোজা করো, নামাজ পড়ো, পরকালের জন্য নেকি করো ভালো কথা, তাই বলে ইহজগতকে তো হেলা করলে চলে না, তোমার চাকরি আছে, সংসার আছে, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব আছে, এগুলো অবহেলা করার কথা তো আল্লাহ বলেননি। ডাক্তারি তো মানুষের সেবা। মানুষের সেবা করলেই তো পূণ্য অর্জন করা যায়।’ কে শোনে কার কথা! রোহানকে ফেরাতে না পেরে হতাশ হয়ে রোহানের মা দু’ সপ্তাহ পর ফিরে গেলেন টাঙ্গাইলে।

আমার একার টাকায় কী করে সংসার চলবে? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না রোহান। সে ঠিক এই জগতে বাস করে না। তার চোখে অন্য একটি জগতের স্বপ্ন। মনে মনে সেই জগতেই সে চলাফেরা করে। মাঝে মাঝে আমার দিকে এমন চোখে তাকায় যেন চেনে না আমাকে। এর মধ্যে রমজান মাস এলো। প্রতিটি রোজা রাখলো রোহান। রাতে উঠে উঠে রেনুর মা তাকে খাবার গরম করে দিত। সারা রাতই সে নানা রকম নামাজ পড়তো । সশব্দে সুরা আওড়াতো। এতে আমার ঘুমের অসুবিধে হয় বলে রোহানের জন্য অন্য একটি ঘর গুছিয়ে দিলাম। রোহান দিব্যি আলাদা ঘুমোতে শুরু করলো। সময় পেরোতে থাকে, আমার আর বোধ হতে থাকে না আমরা স্বামী স্ত্রী। যেন রোহান গ্রাম থেকে আসা দূর সম্পর্কের কোনও মাথা-খারাপ আত্মীয়।

হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্টার ছিল রোহান, আর আমি গাইনি বিভাগের ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট। কী অবলীলায় এমন ভালো চাকরি ছেড়ে দিতে পারলো রোহান! অথচ তার স্বপ্ন ছিল পোস্ট গ্রাজুয়েশান শেষ করে প্রফেসর হবে মেডিসিনের। সব স্বপ্ন এত দ্রুত কী করে উড়ে যায় বা যেতে পারে! আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি রোহানকে, ‘তুমি না প্রফেসর হবে? কোথায় গেল তোমার সব প্ল্যান?’

রোহান উত্তর দিল, ‘এই দু’দিনের দুনিয়ায় প্রফেসর হওয়ার কোনও মূল্য নেই। আসল দুনিয়ার জন্য ভাবো, লতা।’

আমি বলি, ‘ আমি তো কোনও অন্যায় করছি না, কারও ক্ষতি করছি না, বরং উপকার করছি মানুষের। তাদের রোগ শোক সারাচ্ছি। এভাবেই সওয়াব কামাই করি।’

‘না, না, এভাবে হয় না, দুনিয়ার সব মোহ ছেড়ে ছুড়ে আল্লাহর পথে আসতে হবে।’

‘তুমি কি মোহ বলতে চাকরি বোঝাচ্ছো? আমি চাকরি ছাড়বো না। চাকরি ছাড়লে খাবো কী?’

‘যিনি পেট দিয়েছেন, তিনিই খাবার দেবেন’। রোহানের মুখে স্মিত হাসি। যেন সে নিজের চোখে দেখেছে যিনি পেট দেন তিনিই খাবার দেন। তার এই তথ্য ভুল , এমন সংশয় তার চোখে মুখে নেই।

আমাকে হঠাৎ করে সকাল থেকে বলা শুরু করলো, ‘কী সব অসভ্যের মতো বেরোচ্ছ বাইরে, বোরখা পরে বাইরে যাও।’

আমি বললাম, ‘আমি কি হাসপাতালে বোরখা পরে রোগী দেখবো? রোগীর অপারেশান করবো?’

সেন রাজবংশ | সেন সাম্রাজ্য | বাংলার সেন বংশ (sena dynasty)[ ১০৭০ খ্রি–১২৩০ খ্রি ]

‘হ্যাঁ করবে।’

‘কেন? কী যুক্তি এর পেছনে?’

‘আমি চাই না তোমাকে কোনও পরপুরুষ দেখুক।’

‘দেখলে অসুবিধে কী? আমার কলিগ, আমার প্রফেসর, রোগীর আত্মীয়, আমার ছাত্ররা আমাকে দেখবে না কেন?’

‘এই জন্য বলি যে কোরান পড়। আল্লাহ পর্দার কথা বিশেষ করে বলেছেন। তোমার শরীরের যে সব অংশ পর্দার বাইরে থাকবে, সেই সব অংশ দোযখের আগুনে পুড়বে।’

এবার আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে গেল। বললাম, ‘তোমার মাথা ঠিক নেই রোহান, তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।’

বিতর্কের জন্য নয়, আমি সত্যিই মনে করি রোহানের থেরাপি নেওয়ার সময় অনেক আগেই এসে গেছে, তার বাবার মৃত্যুর পরই। কিন্তু রোহান থেরাপিস্টের কাছে যাবে না। সে গম্ভীর গলায় বলে দিল, যেহেতু আমি বোরখা পরছি না, হিজাব পরছি না, আল্লার আদেশ অমান্য করছি,আমি যেন বরং থেরাপিস্টের কাছে যাই।

সংসারের খরচ আমার বেতন থেকেই যেতে থাকে। রোহান সারাদিন তার ঘরটিতে বিছানা ভর্তি কোরান হাদিসের বইএর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। আমার ঘরে আসার, আমার পাশে শোওয়ার, আমার সঙ্গে অন্তত সংসার নিয়ে দু’চারটে জরুরি কথা বলারও তার কোনও আগ্রহ নেই। আমি তার ঘরে গেলে সে পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত, এইসব বলে আমাকে বেরিয়ে যেতে বলে। একবার ডেঙ্গু হলো আমার, হাসপাতালে সাতদিন থাকতে হলো। রোহান একদিনের জন্যও আমাকে দেখতে আসেনি। ধানমণ্ডি থেকে আমার পরিবারের লোকেরা এসে দেখে গেছে। ঘরে ফিরলেও আমি কেমন আছি, তা জানতে চায়নি সে। আমি টের পাই, আমার জন্য যত ভালোবাসা ছিল তার, সব উবে গেছে। আমার বিশ্বাস হয় না এই রোহানের সঙ্গে বিয়ের আগে আমি পাঁচ বছর প্রেম করেছি। আমার মা রোহানের বদলে যাওয়ার খবর সব পেয়েছেন, এসে দেখেও গেছেন তার ঘোরের মধ্যে বাস করার চিত্র। বলেছেন আমি যেন ধানমণ্ডিতে গিয়ে থাকি। যে ডাক্তার ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে ধর্মান্ধ’র জীবন যাপন করছে, তাকে নিয়ে ঘর সংসার করে আমি যে সুখী হবো না, সে আমার মা কোনও রকম রাখঢাক না করে বলে গেছেন। আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নই। আমার মনে হতে থাকে রোহানের ঘোর একদিন কাটবে।

এক মধ্যরাতে যখন সে আমার বিছানায় এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে শারীরিক সম্পর্কের জন্য হাত বাড়ালো, ভেবেছিলাম রোহান বুঝি বাস্তবে ফেরত এসেছে, আবার ভালোবাসছে আমাকে, অনেকদিন যৌনতার স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে সে অস্থির হয়ে উঠেছে, তার ঘোর কেটে গেছে । কিন্তু না, মৈথুন শেষে সে বললো, ‘সন্তান চাই, প্রচুর সন্তান প্রসব করতে হবে তোমাকে, লতা। কাফেরে ভরে গেছে দুনিয়া। মুসলমান ছেলে-মেয়ে জন্ম দিতে হবে আমাদের। এ-ইতো আমাদের ঘরের জেহাদ। ঘরে বাইরে জেহাদ করতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’

রোহান অপ্রকৃতস্থের মতো বকতে থাকে বিছানায় শুয়ে। আমি পাশ ফিরে, দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে জল। রোহানকে বুঝতে দিই না।

প্রতিরাতে রোহান মৈথুনে মেতে উঠতে থাকে, অনেকটা জোর করেই। যে স্পর্শে ভালোবাসা নেই, শুধু অদ্ভুত উদ্দেশ্য আছে, সেই স্পর্শ আমাকে উত্তেজিত করে না, বরং শীতল করে দেয়। আগের মতো রোহান আর আমার নাইটি সম্পূর্ণ খুলে নেয় না, আলগোছে নাইটি সরিয়ে সে তার বীর্যপাতের কাজটি করে। আগে আমার শীর্ষসুখ না হলে সে শেষ করতো না শরীরে শরীর ডুবিয়ে মাছ মাছ খেলা, এখন ভুলেই গেছে সুখ বলে কিছু একটার পরোয়া করতে হবে তাকে। একদিন আমি বললাম, ‘এসব ভালোবাসাহীন সম্পর্ক ভালো লাগছে না আমার। মুসলমান সন্তান জন্ম দিতে হবে, কারণ কাফেরে ভরে গেছে দুনিয়া। এই উদ্দেশ্য নিয়ে মিলিত হতে আমি আর পারছি না।’

এরপর আক্ষরিক অর্থেই রোহান আমাকে ধরে বেঁধে জোর জবরদস্তি যা করলো, তার নাম ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি যদি তার জিহাদে অংশ না নিই, তাহলে সে আরেকটি বিয়ে করবে, জোর গলায় আমাকে জানিয়ে দেয়।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। রোহানের উপস্থিতি আমার স্নিগ্ধ শীতল শান্তির নীড়কে নরক বানিয়ে ছেড়েছে।

এরপর একদিন যে কাণ্ডটি সে ঘটায়, আমি কল্পনাও করিনি রোহান ঘটাবে। মগবাজারে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে দোকানে কোরান হাদিসের বই, নবী এবং নবীর বিবিদের জীবনী, জায়নামাজ, তসবিহ, যমযমের পানি, খেঁজুর, এসব বিক্রি করতে শুরু করলো। নিজেই দোকানে বসে। রোহানের সহকর্মীদের বলেছিলাম, ‘রোহান বাড়িতেই রেস্ট নিচ্ছে। মানসিক ট্রমাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ঠিক এক্ষুনি জয়েন করছে না, কিছুদিন পর করবে।’ যাদের বলেছি, তাদের যে কেউ মগবাজার মোড়ে গেলেই টের পাবে আমি মিথ্যে বলেছি। রোহান রেস্ট নিচ্ছে না, বরং দিব্যি পণ্য বিক্রিতে ব্যস্ত।

রোহানকে যারা ‘’দাওয়াত’’ দিয়েছে, বাড়ির আশেপাশেই যারা ঘুরঘুর করে, রোহান বেরোলেই তার পেছন পেছন মসজিদে যায়, মার্কেটে যায়, তাদের কারও সামনেই রোহান আমাকে যেতে দেয়নি। কারণ আমার পরনে বোরখা নেই। কারণ পরপুরুষের সামনে যাওয়া নারীর বারণ। রোহানের এই চক্রটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। রোহানকে খুঁজতে আগের চেয়ে বেশি লোক আসতে থাকে। পরনে সকলের আরব দেশের আলখাল্লা। এমন একটা সময় একদিন নতুন হওয়া পরহেজগার বন্ধুদের নিয়ে রোহান চলে যায় আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে প্রায় ছ’মাস কাটিয়ে ফেরত আসে দেশে। তখন থেকেই রোহানের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব আমি অনুভব করি।

তারপরও আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আফগানিস্তানে কেন গিয়েছিলে?’

‘জিহাদের ট্রেনিং নিতে।’ রোহানের সোজা উত্তর।

‘কী ধরণের জিহাদ? লোকে বলে জিহাদ মানে নিজের ভেতরের খারাপ জিনিসগুলোর বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ। সেটার জন্য কি ট্রেনিংএর দরকার হয়। মনোবল থাকলেই তো হয়।’

‘এ জিহাদ অন্য জিহাদ। এ তুমি বুঝবে না।’

‘না বুঝলে বুঝিয়ে বলো, আমি বুঝতে চাই।’

‘লতা, তোমাকে আমি বলে দিচ্ছি, তুমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়ো, বোরখা পরে বাইরে না যাও, তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাকবে না। মনে রেখো, আমার এত চেষ্টাতেও তুমি প্রেগনেন্ট হওনি। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করি, সেটা চাও?’

আমি এবার নরম কণ্ঠে বলি, ‘হ্যাঁ আমি চাই তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটি বিয়ে করো’।

‘আরেকটি বিয়ে করতে হলে তোমাকে তালাক দেওয়ার দরকার তো হবে না। আমাদের ধর্ম তো চার বিয়ে পর্যন্ত মানে।’

‘এত যে বিয়ে করবে, বউকে খাওয়াবে কি ? ওই তসবিহ বেচার টাকায় খাওয়াতে পারবে তো? আমি কিন্তু বাড়িভাড়া দিচ্ছি। যে কোনও সময় আমি তোমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি। তা জানো? যাও টাঙ্গাইল গিয়ে চার বউ নিয়ে থাকো। কে বাধা দিয়েছে? তোমার পাগলামি সহ্য করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। এক সময় ভালোবাসতাম, তাই এতদিন সহ্য করেছি। আর পারছি না।’

এবার রোহান বলে, ‘তোমাকে আমার তালাক দেওয়াই উচিত। তুমি জিহাদ করতে চাও না, তোমাকে দিয়ে আমি করবোটা কী? বাচ্চা জন্ম দিতেও অক্ষম তুমি। তোমার ডাক্তারি চাকরি নিয়ে তুমি কি কবরে যাবে? কবরের আজাব সইবে কী করে? আখেরাতের সম্বল কিছু করেছো? কিছুই করোনি। তুমি আমার যোগ্য পার্টনার নও, সেটা জানো? ’

‘জানি রোহান জানি। যোগ্য পার্টনার হতে হলে কী করতে হয় একবার বলো তো! ‘

‘’তোমাকে চাকরি ছাড়তে হবে। তোমাকে আমার পাশে থাকতে হবে। জিহাদে অংশ নিতে হবে। আমি যেভাবে বলবো, সেভাবে চলতে হবে, নিজের জীবন দিয়ে হলেও ধর্মকে বাঁচাতে হবে। ইসলামের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’

আমি এবার জোরে হেসে উঠি। হাসতে হাসতে টের পাই আমার মাথা বনবন করে ঘুরছে। ধপ করে বসে পড়ি বিছানায়।

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর রোহানের কী হয় কে জানে, দোকান বিক্রি করে দিয়ে, সুটকেস গুছিয়ে টাঙ্গাইলে নিজের বাপের বাড়ি চলে যায়। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, আবার বুকে চিনচিনে কষ্টও অনুভব করি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম রোহানকে, সেই সময়ের টুকরো টুকরো স্মৃতি টুকরো টুকরো হীরের মতো।

আমি আমার মতো জীবন যাপন করতে থাকি। ফ্ল্যাট বাড়িটা ছেড়ে ডক্টরস কোয়ার্টারে উঠবো ভেবেছিলাম, উঠিনি। রোহান যদি নিজের ভুল শুধরে কোনও একদিন আমার কাছে ফিরে আসে, সে কারণে উঠিনি। এক মন অপেক্ষা করে তার, আরেক মন ভুলতে চেষ্টা করে তাকে। রোহান আমার জীবনে একই সঙ্গে স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্ন । তৃষ্ণা আর হাহাকার। আনন্দ এবং বেদনা। অভিমান করেই খবর রাখি না তার, সেও খবর নেয় না। কয়েক বছর গেলে খবর পাই, টাঙ্গাইলে ফিরে গিয়ে গ্রামের মাদ্রাসায় পড়া এক পর্দানশীন মেয়েকে সে বিয়ে করেছিল। বউ গর্ভবতী হওয়ার পর বউকে নিয়ে সিরিয়ার রাকায় চলে যায় সে, সেখানের পবিত্র মাটিতেই নাকি তার সন্তান জন্ম নেবে। রাকাই নাকি ভবিষ্যত। রাকাই পৃথিবীকে একদিন দারুল ইসলাম বানাবে। সিরিয়া থেকে একবার শুনেছি তার মাকে ফোন করেছিল রোহান। ওই একবারই। তারপর আর যোগাযোগ করেনি। রোহান বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, কেউ জানে না।

Leave a Reply