নায়ক সালমান খানের জীবনী | salman khan biography

বলিউডের অন্যতম নায়ক সালমান খান নিজের অভিনয় প্রতিভার চেয়ে আলোচনার টেবিলে সবসময়ই বেশি হাজির হয়েছেন বদমেজাজ, সাংবদিকদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং বিভিন্ন সময় নানা ধরণের বেআইনি কাজ করে। এবারের অয়োজন এই চিরতরুণ এই নায়কের অনায়কসুলভ কান্ডকারখানা নিয়ে। লিখেছেন তানজীর তুহিন।
১৯৬৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে নামকরা চিত্রনাট্যকার সলিম খানের ঔরসে সালমা খানের গর্ভে যে শিশুর জন্ম হয়, তার নাম রাখা হয় আবদুর রশিদ সলিম সালমান খান। সেও ভবিষ্যতে বাবার মত বিখ্যাত হবে এই আশাটি সবাই করলেও বড় হয়ে, বিখ্যাত হয়ে দারুণ অভিনয়ের পাশাপাশি সবসময়ই বিতর্কে বেড়াজালে নিজেকে বন্দী করে রাখবে সে-এই আশংকা নিশ্চয়ই কারও কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিজের অভিনয় প্রতিভা ছাড়াও বদ মেজাজ এবং অশোভন ব্যবহার দিয়ে বলিউডে আলাদা ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি, সালমান খান।
Salman_Sangeeta১৯৮৮ সালে ‘বিবি হো তো অ্যায়সি’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখা সালমান খান তার দ্বিতীয় ও তুমুল সাফল্য পাওয়া ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ (১৯৮৯) ছবির জন্য লাভ করেন ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার। দীর্ঘ ১৯ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি বহু ব্যবসাসফল ছবির নায়ক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সজন, হাম আপকে হ্যায় কৌন, করণ-অর্জুন, বিবি নাম্বার ওয়ান, হাম দিল দে চুকে সানাম, তেরে নাম, পার্টনার ইত্যাদি। আর ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ছবিটিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় তাকে আরেকবার এনে দেয় সেরা পার্শ্ব অভিনেতার সম্মান, ১৯৯৮ সালে। এগুলোর বাইরেও তার বহু ছবি আছে, যেগুলো তাকে এনে দিয়েছে ব্যবসায়িক সফলতা। তবে সেই গল্প আরেকদিন।
নিজেকে হিন্দি সিনেমার একজন সেরা অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে সংগ্রামে নেমেছেন সল্লু ভাই, সেটা নিয়ে যতোটা না আলোচনা হয়েছে গত ১৯ বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি চায়ের টেবিলে ঝড় তুলেছেন প্রেমিকাদের সঙ্গে নানা কাণ্ডকীর্তি এবং এসবের কারণে চারপাশের মানুষের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে। প্রেমিকাদের তালিকাও কম দীর্ঘ নয় তার। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সঙ্গীতা বিজলানি, সোমি আলী, ঐশ্বরিয়া রাই ও হালের ক্যাটরিনা।
Salman Katrina Kaifচলতি বছর ১৮ জুলাই ছিল সালমনের বর্তমান প্রেমিকা মডেল কাম অভিনেত্রী ক্যাটরিনা কাইফের জন্মদিন। সে উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে অন্য অনেকের মতোই উপস্থিত ছিলেন শাহরুখ খান, তার পরিবার মানে গৌরি এবং বাচ্চারা। বন্ধুর সাথে দুষ্টুমি করতে করতে হঠাৎ করে কিং খান সালমান -ঐশ্বরিয়ার প্রেম নিয়ে মজা করে দুয়েকটা কথা বলে ফেলেন। কিন্তু কথাটি ধরতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি প্রেমিকা নিয়ে বরাবরই সিরিয়াস সালমান। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি রেগে টং হয়ে যান। পারলে তখনই শাহরুখকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেন! কিন্তু অনুষ্ঠান বলে কথা। তার ওপর শাহরুখ অতিথি নারায়ণ। হাজার হলেও বাস্তব পরিবেশে চাইলেও সিনেমার মতো যখন তখন যার-তার সাথে মারামারি করা যায় না। তবে দারুন খেপে যান সালমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরেক খান আমির আর ক্যাটরিনা সালমানকে শান্ত করেন। তবে এসবে তো আর মনের ঝাল মেটে না। তাই পরে ব্লগে ইচ্ছামত শাহরুখকে গালিগালাজ করেন বলিউডের ব্যাড বয়। কিন্তু আফসোস, তাতেও তার ‘বিখ্যাত এবং কুখ্যাত রাগ’ একবিন্দুও কমলো না। তাই দুয়েকদিন পরে একরাতে পুরো মাতাল হয়ে ড্রাইভারেকে নিয়ে ছুটে গেলেন শাহরুখের বাড়িতে।
শাহরুখ তখন শুটিংয়ে। বাড়ির বুদ্ধিমান দারোয়ান দেখেই বুঝল ‘এনিথিং ইজ সিরিয়াসলি রং’। মনিবকে ফোন করে গেট আগলে সটান দাঁড়িয়ে থাকলো সে। বেচারা সালমান তখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই গালাগালির তুবড়ি ছুটিয়ে আর গৌরী এমনকি অবলা শিশুদের নানা হুমকি ধামকি দিয়ে ফিরে গেলেন নিজের গোলায়। এ ঘটনা রাষ্ট্র হয়ে যেতে সময় নিল না। মানইজ্জত বাঁচাতে ওদিকে বুদ্ধিমতি ক্যাটরিনা সালমানের ওপর যারপরনাই অসন্তুষ্ট হয়ে ঘোষনা দিলেন, “আমি আর তোমার সঙ্গে কোনো ছবিতে অভিনয় করব না।” ফলে বিপদে পড়ে গেল প্রেম বেচারা। সঙ্গে সালমানও। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!
Salman_Aishwaryaশাহরুখের বিচার-বুদ্ধি কেমন! আর কেউ জানুক আর নাই জানুক-তিনি তো অন্তত জানেন যে, এককালের প্রিয় বন্ধু সালমান ঐশ্বরিয়াকে নিয়ে কথা বললেই মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। সেই যে ’৯৯ সালে ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এর সেটে নির্মল ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল দুজনের মাঝে, সেটা মোটেও এতোকিছুর পরেও ভুলে যেতে পারেন না সল্লূ। তখন থেকেই একটু উল্টোপাল্টা কিছু হলেই তিনি মাথা গরম করে, রাগের বশে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেন। নিজের বিবেকের কাছে তিনি কেমন-এটা জানা না গেলেও একবার সাংবাদিকদের সাথে ছবির ‘ভালো ছেলেটি’ বলে ফেলেছেন আবেগের বশে, “আমি ঐশ্বরিয়াকে খুব ভালোবাসি এবং এটা কোন টিনএজ প্রেম না।”
Salman Somy Aliমনে অছে তো, পাকিস্তানী অভিনেত্রী সোমি আলির সাথে প্রেমের অবসানের পর পরই ঐশ্বরিয়ার সাথে তার সস্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যদিও ঐশ্বরিয়ার প্রতি তার এই অপরিসীম ভালোবাসাকে নিন্দুকেরা সবসময়ই ‘অভিনয়’ বলে মনে করেছেন। ‘বিশ্বপ্রেমিক সালমান তার কুৎসিত ব্যবহারের জন্য এই বিশ্বসুন্দরীকেও ধরে রাখতে পারবে না’-এই বক্তব্যও দিতে পিছ পা হননি বলিউডের অনেকেই। কারণ ঐশ্বরিয়ার সাথে প্রেমের আগেই বেআইনি কাজের জন্য কয়েকটি মামলায় জড়াতে হয় তাকে। এমনকি কয়েকবার গ্রেপ্তারও হতে হয়েছে। আবার অ্যাশের সঙ্গেও তিনি প্রায়ই নানা কারণে দুর্ব্যবহার করতেন। এজন্য সম্পর্কের দু-এক বছরের মধ্যেই তাদের মনোমালিন্য শুরু হয়। ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিই, শেষের দিকে কয়েকদিন তিনি নিয়মিত অ্যাশের বাড়ি যেতেন এবং সারারাত দরজায় আঘাত করে চিৎকার করে আজেবাজে কথা বলতেন এবং ভয়ভীতি দেখাতেন। তার প্রেমের ধরণটাই কেমন যেন!
এতোসবের পরেও ভক্তরা কিন্তু ‘সালমান খান দ্য কিং’-এর পাশে ছিলেন সবসময়ই। এগুলোকে গুজব বলে তো উড়িয়ে দিতেনই আর মুখেও বলতেন, সবই হচ্ছে রাজকুমারের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র। তবে ২০০২ সালে ঐশ্বরিয়ার সঙ্গে সালমানের ব্যবহার তাদের এই অন্ধবিশ্বাসকেও টলিয়ে দেয়। সে সময় ঐশ্বরিয়া যখন সালমানকে পুরোপুরি অবহেলা করতে শুরু করেন তখন তার প্রতি সালমানের দুর্ব্যহারের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এ কারণে ঐশ্বরিয়ার বাবা-মা এমনকি মুম্বাই পুলিশের কাছে সালমানের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দেন এবং দাবি করেন, সালমান তাদের বাসায় ঢুকে জানালার কাঁচ ও বিস্তর আসবাবপত্র ভাঙচুর করেছে। পাশাপাশি নানা ধরণের ভয়ও দেখিয়েছে।
আরো আছে, এখানেই শেষ নয়। রমেশ সিপ্পি’র ‘কুছ না কহো’ ছবির সেটে জোর করে ঢুকে সালমান ঐশ্বরিয়াকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করেন এবং তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন।
Salman_Khan’০২ এর মার্চে মুম্বাইয়ের ‘অলিভস’ নাইট ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ঋষি কাপুরের ছেলে নায়ক রণবীর কাপুর উপস্থিত অতিথিদের ঐশ্বরিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে বলায় সালমান ক্ষেপে রণবীরকে মারধর করেন যা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সালমানের বিশেষ বন্ধু বলিউডের ‘ভাই’ সঞ্জয় দত্তের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়। পরে অবশ্য ক্ষমা স্বর্গীয়-এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী সালমান রণবীরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাকে গিফট দেন।
ওই বছরের শেষ দিকে শাহরুখ-ঐশ্বরিয়ার একত্রে অভিনীত এক ছবির শুটিং স্পটে গিয়ে ঐশ্বরিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করার সময় শাহরুখ মধ্যস্ততা করতে এলে সালমান তার সাথেও দুর্ব্যবহার করেন। শেষ পর্যন্ত আরো অনেক ঘটনা, খবরের শিরোনাম, মান অভিমান এবং ঐশ্বরিয়া শারীরিকভাবে নাজেহাল হওয়ার অভিযোগ করলে এই দারুণ আলোচিত জুটির জুটির বিচ্ছেদ হয়।
এরপরে ক্যাটরিনার সঙ্গে তার প্রেমকাব্য তো সবারই জানা।
এসব তো গেল সালমানের প্রেম-প্রীতিকে ঘিরে বিতর্কের কথা। এছাড়াও তার আরও অনেক কুকীর্তি আছে।
১৯৯৮ সালে রাজস্থানের যোধপুরে যশরাজের ছবি ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ এর সিকুয়েলের জন্য একটি গানের শুটিংয়ে যান সালমান। সেখানে থর মরুভূমিতে শিকারের সময় বিরল প্রজাতির ‘চিঙ্কারা’ হরিণ মেরে ফেলেন এবং হোটেলে তার বাবুর্চির কাছে রান্নার জন্য পাঠান! ব্যস, যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবাদীরা খেপে গেলো। ব্যাপারটা শেষতক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে রাজস্থান আদালত পাঁচ বছরের জন্য জেলেও পাঠায়। তিনি ২০০৭ সালের ২৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হন এবং ৬ দিন জেল খেটে ৩১ আগস্ট জামিনে বের হয়ে আসেন।
হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হেনে একবার তাদের পবিত্র ‘কৃষ্ণমৃগ’ শিকার করেন সালমান। ফলে গড়ে ওঠা তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জেল হলেও তিনি উচ্চতর আদালতে আপিলের মাধ্যমে বের হয়ে আসেন।
২০০০ সালে মাফিয়াদের সাথে সম্পর্ক রাখার সন্দেহে গ্রেপ্তার হন সালমান। ’০৫ সালে মুম্বাই পুলিশ ২০০১ সালের একটি মোবাইল কলের রেকর্ড উদ্ধার করে। সে রেকর্ড অনুযায়ী, সালমান ঐশ্বরিয়াকে মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতের মানুষের সাখে কাজ করার জন্য বলছেন এবং তার কথা না শুনলে ক্ষতি হবে বলে ভয় দেখিয়েছেন। পুলিশি তদন্তে বলিউডের আরো অভিনেতা- অভিনেত্রীর সাথে মুম্বাইয়ের মাফিয়াদের সম্পর্ক থাকতে পারে সন্দেহ করা হয়। অবশ্য সেটা বাস্তবে প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ।
২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঐশ্বরিয়ার সাথে ঝগড়া করে মাতাল হয়ে মুম্বাইয়ের রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ফুটপাথে গাড়ি উঠিয়ে দেন। এতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা আশ্রয়হীন দরিদ্র একজন সামান্য মানুষের করুণ মৃত্যু হয়। আহত হন আরো তিনজন।
তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রতিবাদে সালমানের বক্তব্য কী, সেটাও জানা যাক।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘চিরসবুজ’ এই নায়ক বলেন, “আমি সবসময় সত্য কথা বলতে চেষ্টা করি। এতে যদি কারও খারাপ লাগে তাহলে আমি কী করব?” চারপাশের ঝামেলা আর গুজবের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি যদি এতো খারাপই হতাম তাহলে কেন মানুষ আমার কাছে অটোগ্রাফ নিতে আসে? বাবা-মায়েরা কেন তাদের বাচ্চাদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়? আমার সম্পর্কে তারাই খারাপ কথা লেখে কিংবা বলে- আমার সত্য কথা শুনে যাদের ভালো লাগে না।”
তাদের পরিচয় জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের অধিকাংশ হল পাপারাজ্জি। তারা সবসময় আশা করে, আমি তাদের কথামত চলব। যখন আমার কোনকিছু তাদের স্বার্থে আঘাত করে তখনই তারা আমার সম্পর্কে যা খুশি লিখে দেয়।”
এতো এতো বিতর্ক সত্বেও সালমান কিন্তু এখনো বরিউডের হার্টথ্রব নায়ক। তার চুলের স্টাইল, তার পোশাকের ব্রান্ড সবকিছুই ভক্তরা দারুণভাবে অনুসরণ করেন। ফলে ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি লন্ডনের মাদাম তুসোর জাদুঘরে চতুর্থ ভারতীয় তারকা হিসেবে সালমান খানের মোমের মূর্তি স্থাপিত হয়।
এখন এই আশাটুকু হয়তো করা যায়, জনপ্রিয় এই তারকা ভক্তদের কথা ভেবে অচিরেই হয়তো নিজের এসব বাজে আচরণ এবং কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ‘আইডল’ অভিনেতাটি হয়ে যাবেন। হয়ে যাবেন সেই নায়ক যার আনন্দে হাসে আবার যার শোকে চোখের জল ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষ, হাজারো তরুণী যার মতো প্রেমিক খুঁজে বেড়ায়। আর অনেক শিশুই হতে চায় ‘এক একজন সালমান খান’।

Leave a Reply