পোশাক নিয়ে ধর্মান্ধদের রাজনীতি তসলিমা নাসরিন

আমাদের সময় পরিবারের ছ’সাতটি ছেলের মধ্যে যেটি নিরেট বোকা, আস্ত গবেট, আকাট মূর্খ, লেখাপড়ায় খারাপ, নির্বোধ, বুদ্ধিহীন অথবা যে ছেলেটির মাথায় শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করতো, যে ছেলে চুরি করতো, অশ্লীল গালিগালাজ করতো, মারপিট করতো, সেটিকে স্কুলে না পাঠিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হতো। সময় বদলে গেছে। তার পরও আমার মনে হয় না ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজকাল খুব বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেকে পাঠানো হয়। কিছুদিন পরপরই দেখছি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেরা সমাজবিরোধীদের মতো রাস্তাঘাটে দাপাচ্ছে, গাড়ি ভাংচুর করছে, জনগণের সম্পত্তিতে আগুন ধরাচ্ছে, ইটপাথর হাতে নিয়ে দৌড়োচ্ছে, মানুষের দিকে ছুড়ছে, মানুষকে রক্তাক্ত করছে।

এরা অনেকটা রোবটের মতো, এদের গুরুরা যে ভায়োলেন্সের দিকে এদের লেলিয়ে দেয়, এরা সেই ভায়োলেন্সের দিকে কোনওরকম প্রশ্ন না করে এগিয়ে যায়। শুনেছি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেরা এখন অবলীলায় দেশের নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে যাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের শিক্ষা দেওয়া হলেও পরীক্ষায় উচ্চমানের নম্বর দেওয়া হয়। সেই নম্বরের দৌলতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পায়, যেখানে প্রতিযোগিতায় হেরে যায় স্কুল কলেজ থেকে পাস করা বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী ছেলেমেয়ে।

 

এভাবেই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দখলে চলে যাবে। কিছুদিন আগে লক্ষ করলাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিখ্যাত ভাস্কর্যের নিচে বোরখা-পরা কিছু মেয়ে আর ভিনদেশি পোশাক পরা কিছু ছেলে অদ্ভুত সব ব্যানার আর পোস্টার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওসবে লেখা ‘দেশীয় মূল্যবোধ বিরোধী পোশাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতকে অভিনন্দন’, ‘পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ হোক’, ‘দেশীয় মূল্যবোধ বিরোধী সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়।’ ‘ছোট পোশাক = নারী উন্নয়ন এটাই সায়েন্স’, ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না পণ্য বানায়’, ‘দেশি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমদানিকারকরা কালচারাল টেররিস্ট’ ইত্যাদি। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা এই ছেলেমেয়েদের ছোট পোশাক নিয়ে ঘোর আপত্তি। বাংলাদেশে ছোট পোশাক পরতে তো আমি কোনও মেয়েকে দেখি না।

সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের |

কক্সবাজারের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়েও মেয়েরা বোরখা হিজাব, সালোয়ার-কামিজ ওড়না, শাড়ি কাপড় পরা অবস্থায় পানিতে নামে। ছোট পোশাক যদি পরে কেউ, সে পুরুষ, ধার্মিক অধার্মিক সব রকম পুরুষ। তারা প্রায় উলঙ্গ শরীরে সমুদ্রে নামে। মেয়েরা না পরে বিকিনি, না পরে সুইমস্যুট। দিন দিন বাংলাদেশের মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কাপড় চোপড়ে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ভালো কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘এখন আধুনিক যুগ, রোবটিক যুগ, এখন নারীদের পোশাকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করার সময় নয়। যারা পোশাক নিয়ে তৎপর হয়েছেন তারা দেশের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। বর্তমানে রোবটিক যুগে টেকনোলজি নিয়ে আমাদের আলোচনার বিষয় হবে।

মানুষের পক্ষে আর কী কী করা সম্ভব আলোচনা হবে সেসব নিয়ে। অথচ একটি শ্রেণি নারীদের কাপড়ের মাপ কত হবে, তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কত থাকা উচিত, নারীদের কপালে টিপ পরা নিয়ে বিতর্ক তুলছে। এসব নিয়ে নারীদের দফায় দফায় হয়রানি হতে হচ্ছে। একটি শ্রেণি নিজেদের সুবিধার্থে ধর্মের নামে নানা ধরনের নিয়ম তৈরি করছে। অথচ তারা নিজেরাও ধর্মে যা বলা নেই তা-ই করছে।’ সেসব নিয়ে কেউ কথা বলার নেই বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। দীপু মনি নিজে তাঁর ব্লাউজের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে কব্জি পর্যন্ত করে নিয়েছেন।

এতে ধর্মান্ধরা সন্তুষ্ট, কিন্তু যারা এখনও ব্লাউজের দৈর্ঘ্য বাড়ায়নি, তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে, যেন দৈর্ঘ্যটা বাড়িয়ে নেয়। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকেও যদি ব্লাউজের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে মৌলবাদীদের রোষানল থেকে মুক্তি পেতে হয়, তাহলে ক্ষমতাহীন সাধারণ মেয়েরা কী করে মুক্তি পাবে? এই ধর্মান্ধ অপশক্তির গ্রাস থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সরকার কি কিছু করছে? যারা ব্লাউজের দৈর্ঘ্য বাড়াতে চায় না, যারা হিজাব বোরখা পরতে চায় না, যারা তাদের পছন্দের পোশাক পরতে চায়, সে পোশাক ছোট হলেও পরতে চায়তাদের পোশাক পরার স্বাধীনতার জন্য এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কি কিছু করবেন না দীপু মনিরা? রোবটিক টেকনোলজিতে মনোযোগ দিতে হবে বললেই তো ধর্মান্ধরা মনোযোগ দেবে না। তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে অথবা ধর্মান্ধ ওয়াজি দ্বারা মগজ ধোলাই হওয়া ছেলেমেয়ে।

ধর্ম তাদের অস্ত্র, তাদের কী করে দীপু মনিরা নিরস্ত্র করবেন? ধর্মকে তো সরকারও যত্রতত্র নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। সময় সময় ধর্ম তাদেরও অস্ত্র বটে। যারা এই অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে চায় না, তাদের দেখতে না চাওয়ার অধিকার একটি গণতন্ত্রে কিন্তু অবশ্যই থাকা দরকার। এই যে দেশি পোশাক দেশি সংস্কৃতি চাই বলে চিৎকার করছে ছেলেমেয়েরা তারা কি জানে দেশি পোশাক বা দেশি সংস্কৃতি ঠিক কী? আন্দোলন করা ছেলেমেয়ে কেউই কিন্তু দেশি পোশাক পরেনি।

তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী

মেয়েরা পরে আছে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির সংস্কৃতির পোশাক, আর ছেলেরা পরে আছে ইউরোপের এবং মধ্য-এশিয়ার পোশাক। দেশি পোশাক পরতে হলে তো ছেলেমেয়ে উভয়কেই ছোট পোশাক পরতে হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা নেংটি পরতো, পূর্বনারীরা বক্ষবন্ধনীও পরতো না, তারাও ওই নেংটিই পরতো। অন্তরীয় উত্তরীয় কোমরবন্ধ এসেছে আরও পরে। দেশি পোশাকের উদ্দেশ্য ছিল কিছু কাপড়ের টুকরো দিয়ে শুধু যৌনাঙ্গটুকু ঢেকে রাখা। বিদেশিরা আমাদের অঞ্চলে এসে কাপড় চড়িয়েছে আমাদের পূর্বনারীপুরুষের গায়ে। সেলাই করা কাপড়ও তাদের কল্যাণে জুটেছে। আজ উপমহাদেশে যে পোশাকই দেখি, তার খুব কমই দেশি পোশাক। পোশাকের বিবর্তন ঘটেছে। নেংটি একসময় ধুতি হয়েছে, ধুতিই একসময় শাড়ি হয়েছে। বিদেশিরাই শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ আর পেটিকোটের ধারণা দিয়েছে।

সত্য বলিতে দ্বিধা করিও না- তসলিমা নাসরিন Taslima Nasrin

আজকাল যে ইসলামের ছবি আমরা দেখছি, সেই ইসলাম রাজনৈতিক ইসলাম। সপ্তম শতাব্দীতে রাজনৈতিক ইসলামেরই জয়জয়কার ছিল। সেই ইসলাম ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি ইসলামের প্রবেশ ঘটে। সেই ইসলামে উদারতা আর মানবতার স্থান ছিল। একসময় সেই সুফি ইসলামকে ঘাড় মটকে খেয়ে এ অঞ্চলে ঢুকে গেছে কট্টর সালাফি ইসলাম, যে ইসলামকে বিশ্বাস করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে জগৎব্যাপী জিহাদী সন্ত্রাস, আইসিস, আল কায়দা, আল শাবাব, বোকো হারাম এ রকম অসংখ্য সংগঠন। আমাদের দুর্ভাগ্য, যে উদার সুফি ইসলামের চেহারা দেখে আমরা বড় হয়েছি, আমাদের জীবদ্দশায় সেই ইসলামকে বিদেয় করে এসে গেল কট্টরপন্থী রাজনৈতিক ইসলাম। এই রাজনৈতিক ইসলামকে দুধকলা দিয়ে পোষা হচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামে দীক্ষিত হওয়া ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য করা হয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত সুন্দর পরিবেশ তারা নষ্ট করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তারা ধর্মের চাদর দিয়ে ঢেকে অন্ধ বানাবে, এতে আসলেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরাই ধর্মের রোবট। বিজ্ঞানের রোবট নিয়ে ভাবার আগে অবিজ্ঞানের রোবট নিয়ে ভাবতে হবে। বিজ্ঞানবিরোধী এবং সমাজবিরোধীদের হাতে এখন সমাজ। এদের ভয়ে মন্ত্রীরা তটস্থ, সাধারণ মানুষরা তো তটস্থ হবেই। এদের হাত থেকে রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদ্যাপীঠ, শিল্পকলা, বিজ্ঞান একাডেমি, সাহিত্য সংস্থা, নৃত্য-সঙ্গীত একাডেমি ইত্যাদি বাঁচাতে হবে। এসব না থাকলে গৌরব করার মতো দেশে কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

Leave a Reply