প্রতিবন্ধী হয়েও শ্রেষ্ঠ স্বামী, সফল ব্যাংক কর্মকর্তা

চন্দন কুমার বনিক, অন্য সবার মত তিনি স্বাভাবিক নন। তারপরও সবার মত তিনিও স্বপ্ন দেখতেন সফল হওয়ার। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেই থেকে তার পথচলা। তবে বাধা এক জায়গাতেই। কারণ তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারপরও সকল প্রতিবন্ধকতার পথ পেরিয়ে চন্দন কুমার বনিক আজ সফল; তিনি হয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা।

চন্দন কুমার বনিকের জন্ম ১৯৮৭ সালে। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও ইউনিয়নের জালালি বানিয়াপাড়া গ্রামে। বাবা রোহিনী চন্দ্র বনিক ছিলেন ঐ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য। এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন কৃষক ও ব্যবসায়ী, তিনি ২০১৯ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। মা অলকা রাণী, তিনি একজন গৃহিণী।

চন্দর কুমারের দুই বোন চন্দনা রাণী ও নিপা রাণী। দুই বোনেই স্বাভাবিক, তাদের বিয়ে হয়েছে। তারা এখন স্বামীর সংসার সামলাচ্ছেন। ভাই বোনদের মধ্যে চন্দন কুমার বনিক সবথেকে বড়।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জন্মের প্রায় ৩ বছর বয়সে চন্দর কুমার বনিক পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা করেও চন্দনকে সুস্থ করতে পারেনি স্বজনেরা। তখন থেকেই চন্দন হয়ে যায় শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। এরপর থেকে থমকে যায় চন্দনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তবে চন্দনের বাবা রোহিনী চন্দ্র বনিক ছেলের সেই থমকে যাওয়া জীবন সচল করতে হাল ধরেন। লক্ষ্য ছিল একটাই ছেলেকে সফল দেখতে চান রোহিনী চন্দ্র বনিক।

সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ১৯৯২ সালে চন্দন কুমার বনিককে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় বাড়ির পাশ্ববর্তী কদমরসুল হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা অথবা বন্ধুদের সহযোগিতায় প্রতিদিন সেই বিদ্যালয় যাতায়াত করত চন্দন। সেই বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয় চন্দন। এরপর ২০০৩ সালে কদমরসুল হাট স্কুল এন্ড কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ ও ২০০৫ সালে ভুল্লী ডিগ্রি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো ফলাফলের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় চন্দন কুমার বনিক।

পরে বাবার ইচ্ছেই ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে অনার্সে ভর্তি হয় চন্দন। সেখানে ২০০৯ সালে অনার্স প্রথম বিভাগে পাশ করে চন্দন। ২০১০ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেন চন্দন কুমার বনিক।

আর এই শিক্ষাজীবনে সবচেয়ে পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতায় এতদূর অবধি পথ পেরিয়ে এসেছেন চন্দন কুমার বনিক। তবে সামাজিকভাবে চন্দন ও তার পরিবারকে নানা কটুক্তি করা হতো প্রতিনিয়তই। সব বাধাবিপত্তি পাড়ি দিয়ে শেষ করেন লেখাপড়া।

 

পড়ালেখা শেষ করে ৩ বার বিভিন্ন ব্যাংকে পরীক্ষায় উর্ত্তীণ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন চন্দন কুমার বণিক। ২০১৫ সালে ধরা দেয় সেই সোনার হরিণ। চাকরি মেলে সোনালী ব্যাংকে অফিসার পদে। তার কর্মদক্ষতায় খুশি সহকর্মীরাও। তখন থেকে চন্দন কুমার বনিকের জীবনের গল্পের মোড় নেয় নতুন রূপে।

২০১৬ সালে পারিবারিকভাবে ব্যাংকার চন্দন কুমার বনিকের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে দুটো সন্তান রয়েছে। ২০১৯ সালে চন্দনের বাবা রোহিনী চন্দ্র বনিকের মৃত্যু হয়। তখন থেকে বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চন্দনা জুয়েলার্সে অবসর সময়ে বসেন ব্যাংকার চন্দন কুমার বনিক।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক রাপ্পী বলেন, প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয় তার উদাহরণ চন্দন কুমার বনিক। প্রতিবন্ধীরাও সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে চন্দর তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের সিনিয়র সাংবাদিক মজিবর রহমান খান বলেন, তিন বছর বয়সে চন্দন কুমার বনিক পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। এরপরও সে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। পড়ালেখা শেষ করে চন্দন সোনালী ব্যাংকে চাকরিও পেয়েছে। এলাকায় এখন সে অনুপ্রেরণা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে এবং চন্দনকে আদর্শ মনে করছে।

সফল প্রতিবন্ধীদের তালিকা, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র ,প্রতিবন্ধীদের সমস্যা ,প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য করনীয়, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ট্রেনিং, ব্যবস্থা প্রতিবন্ধিতার ধরণ প্রতিবন্ধী ভাতা কারা পাবে, প্রতিবন্ধী সনদ যাচাই প্রতিবন্ধী কোটা ২০২১

চন্দনের মা অলকা রাণী বনিক বলেন, চন্দনকে বহু কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। মাটিতে অ আ ক খ ১ ২ লেখা শিখিয়েছি। তারপর যাকে যখণ পেয়েছি তার হাত-পা ধরে চন্দনকে স্কুলে পাঠিয়েছি। তারপরও মানুষজন অনেক ধরনের খারাপ কথা বলতো। সকল বাধা অতিক্রম করে এবং চন্দন লেখাপড়া শেষ করে এখন সে সোনালী ব্যাংকে চাকরি করছে। আমি অনেক খুশি হয়েছি।

চন্দনের স্ত্রী মনিষা রাণী বনিক বলেন, চন্দনের মত একজন স্বামী পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। অনেকেই কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক স্বামী পেয়েও সুখী নয়, কিন্তু আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী চন্দনের মত একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে বড় ধন্য মনে করি। বিয়ের হওয়ার পর আমার দুটো সন্তান হয়েছে একজন ছেলে, আরেকজন মেয়ে। আমি অনেক ভালো ও সুখে আছি। সবথেকে সুখী মানুষ আমি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিসের অফিসার চন্দন কুমার বনিক বলেন, লেখাপড়া করতে গিয়ে বিনা কারণে সহপাঠীদের মার হজম করতে হয়েছে। এছাড়াও অনেক মানুষের কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছে। এখন নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে এই ভেবে যে, এখন আমি একটা ভালো চাকরি করছি। গ্রামে গেলে লোকজন আমাকে দেখতে আসে। পরিবারের লোকজনের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কখনও নিজেকে বোঝা মনে করিনি এবং আমার পরিবারও আমাকে বোঝা মনে করিনি। প্রতিন্ধীরা যে সমাজের বোঝা তা নয়। আমরা একটু সহযোগিতা পেলেই অনেক কিছুই করতে পারবো। আমার মূল লক্ষ্য ছিল, ভবিষ্যতে ভালো একটি চাকরি করা, সেই লক্ষ্য আমার পূরণ হয়েছে। আর এজন্য সবথেকে বড় অবদান আমার বাবা। তিনি বেঁচে থাকলে খুবই ভালো হতো। প্রতিবন্ধীদের জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি।

ঠাকুরগাঁও সোনালী ব্যাংক লিমিটেড প্রিন্সিপাল অফিসের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আব্দুল হামিদ বলেন, চন্দন কুমার বনিক দীর্ঘদিন ধরে সোনালী ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন। অন্যান্য সহকর্মীদের উপর যেভাবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ঠিক সেভাবেই চন্দনের উপরও দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং চন্দন অন্যান্যদের চেয়ে খুবই ভালো কাজ করে। চন্দনের মত একজন অফিসার পেয়ে আমরা ধন্য।

তিনি বলেন, চন্দন কুমার বনিককে যেমন সোনালী ব্যাংক সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে; ঠিক তেমনি চন্দনের মত সমাজের অন্য প্রতিবন্ধীদেরকেও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সোনালী ব্যাংকের মত অন্যান্য ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসবে।

Leave a Reply