(৫টি রচনা) বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা

সূচনা : বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ । ভৌগােলিক কারণে এখানকার প্রকৃতি ষড়ঋতুর চক্রে আবর্তিত হয় । মধ্যমমানের সূর্যতাপ ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এখানকার পরিবেশকে রেখেছে নাতিশীতােষ্ণ । তাই প্রতি দুই মাস পর পর এখানকার প্রকৃতি ধারণ করে ভিন্নরূপ । ঋতুতে ঋতুতে চলে এখানে সাজবদলের পালা । সে কারণেই বুঝি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় । জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে তুমি বিচিত্ররূপিনী ॥ ষড়ঋতুর পরিচয় : পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ঋতুর সংখ্যা চারটি হলেও বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ । এখানে প্রতি দুই মাস অন্তর নতুন ঋতুর আবির্ভাব ঘটে । ঋতুগুলাে হলাে- গ্রীষ্ম , বর্ষা , শরৎ , হেমন্ত , শীত ও বসন্ত । এ ছয়টি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয় এবং প্রকৃতিকে করে তােলে অপরূপ বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় । তাই প্রকৃতিপ্রেমিকের উচ্চারণ- Bangladesh is the favourite playground of nature , decorated with six seasons .

গ্রীষ্মকাল : ঋতু আবর্তনের শুরুতেই আসে গ্রীষ্মকাল । বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এ দুই মাস গ্রীষ্মকাল । গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে খাল – বিল , ডােবা , পুকুর শুকিয়ে যায় । নদ – নদীর পানি কমে যায় । মাঠ – ঘাট খাঁ খাঁ করতে থাকে । সবুজ ঘাসের উপর পড়ে ধুলার আস্তরণ । প্রকৃতিতে কখনাে তিন চার দিন গুমােট ভাব পরিলক্ষিত হয় । আবার কখনাে শুরু হয় কালবৈশাখীর তাণ্ডব নৃত্য । ভেঙে যায়

গাছপালা , ঘরবাড়ি ; লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু । অন্যদিকে বাংলার প্রকৃতি অকৃপণ হাতে উপহার দেয় আম , জাম , লিচু , কাঁঠাল ইত্যাদি । গ্রীষ্মের রােদের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির মুখে শােভা পায়

“ রােদ যেন নয় শুধু ঘন ঘন ফুলকি আগুনের ঘােড়া যেন ছুটে চলে দুলকি । ”

বর্ষাকাল : গ্রীষ্মের পরেই বর্ষা আসে মহাসমারােহে । আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল । দিগ্বিজয়ী যােদ্ধার বেশেই বর্ষা ঋতুর আবির্ভাব । মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে উঠে । শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টিপাত । নদী – নালা ও খাল – বিল পানিতে ভরে যায় । অনেক সময় দিনের পর দিন আকাশে সূর্যের মুখ দেখা যায় না । সারাদিন মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয় । প্রকৃতিতে ফিরে আসে সজীবতা । জমিতে জমিতে ধান , কৃষকের মুখে হাসির বান । এ প্রসঙ্গে কবি উল্লেখ করেন ।

“ বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর । আউসের ক্ষেত জলে ভর ভর কালিমাখা মেঘে উপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে , ওগাে , আজ তােরা ” যাস নে ঘরের বাহিরে । ”

শরৎকাল : বর্ষা শেষে বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আসে শরৎ । ভাদ্র – আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল । তখন প্রকৃতিতে বিরাজ করে এক মনােমুগ্ধকর অবস্থা । এ রূপের জন্যই শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানি । আকাশে তখন সাদা মেঘ দল বেঁধে ভেসে বেড়ায় । শরতের মায়াময় রৌদ্র কিরণে প্রকৃতি চঞ্চল হয়ে উঠে ।

গাছ – পালা , তরু – লতায় তখন দেখা যায় সবুজের সমারােহ । সৌন্দর্যে বিমােহিত কবির উচ্চারণ

“ আজিকে তােমার মধুর মুরতি

হেরিনু শারদ প্রভাতে ।

হেমন্তকাল : ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের আনন্দ নিয়ে আগমন ঘটে হেমন্তের । কার্তিক – অগ্রহায়ণ দুই মাস এ ঋতু বিরাজ করে । মাঠে মাঠে তখন ফসল কাটার গান । ঘরে ঘরে চলে নবান্ন উৎসব ; আত্মীয়স্বজনকে পিঠাপুলি খাওয়ানাের নিমন্ত্রণ । প্রভাতে সূর্যকিরণে দূর্বাঘাসের উপরে শিশির বিন্দুগুলাে মুক্তার মতাে উজ্জ্বল হয়ে উঠে । হেমন্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন

“ কী শােভা কী ছায়া গাে কী স্নেহ কী মায়া গাে কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে । ”

শীতকাল : কুয়াশার মলিন চাদর গায়ে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া সাথে নিয়ে আসে শীত । পৌষ – মাঘ দুই মাস শীতকাল । প্রকৃতি তখন শীর্ণ , শুষ্ক ও স্নান । সর্বত্রই রিক্ততার আভাস । উত্তুরে হাওয়া বইতে থাকে । লেপ , চাদর ও গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে সবাই শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে । মানুষের মন থাকে ক্লান্ত ও নিস্তেজ । তবু খেজুর রসের পায়েস , টাটকা শাকসবজি , নানা রকমের পিঠা বাঙালির জীবনে বয়ে আনে খুশির জোয়ার । এ খুশিতে একাত্ম হয়ে কবি গেয়ে উঠেন—

“ পৌষ – পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে , আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে । ”

বসন্তকাল : সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত । ফাল্গুন – চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল । তখন গাছে গাছে ফুল , ফুলে ফুলে অলি , সুন্দর ধরাতল । পাখির কলকাকলি , কোকিলের সুমধুর তান , দক্ষিণের হাওয়া , আম্রমুকুলের গন্ধ , ফুলের সমারােহ প্রভৃতি মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মায়ালােক । মানুষের প্রাণে তখন আনন্দের জোয়ার । আনন্দে আত্মহারা কবি গেয়ে উঠেন

“ ওগাে দখিনা মলয় , আজি তব পরশনে কার কথা পড়ে মনে । মধুপ হয়েছে আজি পাগলপারা কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া । ”

See also  (রচনা) কর্মমুখী শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা

উপসংহার : প্রকৃতির নিয়মে আমাদের এ লীলাভূমি বিভিন্ন সময় সজ্জিত হয় নানা সাজে । ঋতুচক্রের খেলায় প্রকৃতি আলপনা আঁকে মাটির বুকে , আকাশের গায়ে , মানুষের মনে । তাই ঋতু বদলের সাথে সাথে এখানে জীবনের রঙও বদলায় । তার প্রভাব পড়ে মানুষের মনে । রূপবৈচিত্র্যের এ প্রাকৃতিক খেলার কারণেই বাংলার মানুষের মন এত উদার ও ভালােবাসায় পূর্ণ ।

Read more: (৫টি রচনা) ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ২

ভূমিকা: ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা , শরৎ , হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ছয় ঋতুর আবর্তন বাংলাদেশকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। প্রত্যেকটি ঋতুরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্র। এক এক ঋতু আমাদের জীবনে আসে এক এক রকম ফুল, ফল, আর ফসলের সম্ভার নিয়ে। বাংলার প্রকৃতিতে ষড়ঋতুর পালাবদল আল্পনা আঁকে অফুরন্ত সৌন্দর্যের। তাতে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে হৃদয়। গ্রীষ্মের দাবাদাহ্, বর্ষার সজল মেঘের বৃষ্টি , শরতের আলো- ঝলমল স্নিগ্ধ আকাশ, হেমন্তের ফসলভরা মাঠ, শীতের শিশির ভেজা সকাল আর বসন্তের পুষ্প সৌরভ বাংলার প্রকৃতি ও জীবনে আনে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। ঋতুচক্রের আবর্তনে প্রকৃতির এ সজবদল বাংলাদেশকে রূপের রানিতে পরিণত করেছে। বাংলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে ধ্বনিত হয়- “জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে- তুমি বিচিত্ররূপিনী॥”

ঋতুচক্রের আবর্তন: বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জলবায়ূর প্রভাব ও ভৌগোলিক অবস্থান। এ দেশের উত্তরে সুবিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিনে প্রবাহিত বঙ্গোপসাগর। সেখানে মিলিত হয়েছে হাজার নদীর স্রােতধারা। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হয় বৃষ্টি। বৃষ্টির ধারা এ দেশের মাটিকে করে র্উবর, ফুল ওফসলে করে সুশোভিত। নদীর স্রােতে বয়ে আনে পলিমাটি। সে মাটির প্রাণরসে প্রাণ পায় সবুজ বণ বনানী, শ্যামল শস্যলতা। তার সৌন্দর্য্য এ দেশের প্রকৃতি হয়ে উঠে অপরুপ। এভাবেই নব নব সাজে সজ্জিত হয়ে এ দেশে পর পর আসে ছয়টি ঋতু। এমন বৈচিত্র্যময় ঋতুর দেশ হয়তো পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ঋতু পরিচয়: বর্ষপঞ্জির হিসাব বছরের বারো মাসের প্রতি দুই মাসে এক ঋতু। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল এবং ফাল্গুন -চৈত্র বসন্তকাল। তবে ঋতুর পালাবদল দিন কাল মাসের হিসাব মেনে চলে না। অলক্ষে বিদায় নেয় একেক ঋতু, নিঃশাষে আগমন ঘটে নতুন কোনো ঋতুর। প্রকৃতির এক অদৃশ্য নিয়মে যেন বাঁধা ঋতুচক্রের এ আসা যাওয়া।

গ্রীষ্মকাল: ঋতুর আবর্তনের শুরুতেই আসে গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে খাল-বিল, ডোবা, পুকুর , শুকিয়ে যায়। নদ-নদীল পানি কমে যায়। মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করতে থাকে। সবুজ ঘাসের উপর পড়ে ধুলার আস্তরণ। প্রকৃতিতে কখনো তিন চার দিন গুমোটি ভাব বিরাজ করে। আবার কখনো শুরু হয় করবৈশাখীল তান্ডব নৃত্য। ভেঙে যায় গাছাপালা, ঘরবাড়ি। লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছুকে। অন্যদিকে বাংলার প্রকৃতি অকৃপণ হাতে উপহার দেয় নানা ধরণের ফল-ফলদি যেমন -আম জা, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি । গ্রীষ্মের প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির মুখে শোভা পায়- “রোদ যেন নয় শুধু ঘন ঘন ফূলকি আগুণের ঘোড়া যেন ছুটে চলে দুলকি।

বর্ষাকাল: গ্রীষ্মের পর বর্ষা আসে মহাসমারোহে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। শুরু হয় অঝোর বৃষ্টিপাত। অবিরাম বষর্ণে নদী-নালা ও খাল-বিল পানিতে ভরে যায়। অনেক সময় দিনের পর দিন আকাশে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সারা দিন মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়। প্রকৃতিতে ফিরে আসে সজীবতা। জমিতে ধান, কৃষকের মুখে হাসির বান। এ প্রসঙ্গে কবি উল্লেক করেন। “বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর আউসের ক্ষেত জলে ভর ভর কালিমাখা মেঘে ওপারে আধাঁর ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে”।

শরৎকাল: বর্ষা শেষে শরৎ আসে তার মনোমুগ্ধকর রূপ নিয়ে। এ রূপের জন্যই শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানি। আকাশে তখন সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। শরতের মায়াময় রৌদ্রকিরণে প্রকৃতি চঞ্চল হয়ে উঠে। গাছপালা, তরুলতায় তখন দেখা যায় সবুজের সমারোহ । নদী তীরে কাশফুল ফোটে । রাত্রিতে শিশির ঝরে। শিউলি ফুলের গন্ধে মন উদাস করে তোলো। বাংলাদেশের রূপ লাবণ্য যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। শুরু হয় শারদীয় উৎসব। শরতের সৌন্দর্যে বিমোহিত কবির উচ্চারণ- “আজিকে তোমার মধুর মুবতি হেরিনু শারদ প্রভাতে।”

হেমন্তকাল: শরতের পর আসে হেমন্ত। মাঠে মাঠে তখন ফসল কাটার গান ।ঘরে ঘরে চলে নবান্ন উৎসব, আত্মীয় স্বজকে পিঠাগুলি খাওয়ানো নিমন্ত্রণ। প্রভাতে সুর্যকিরণে দুর্বাসের উপরে শিশি বিন্দুগুলো মুক্তার মতো উজ্জ¦ল হয়ে উঠে। হেমন্তের প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের জৌলুশ নেই , রুপসজ্জার প্রাচুর্য নেই, কিন্তু আছে এক কল্যাসী মুর্তি। তাই রুপালি হেমন্ত মানবমনে বযে নিয়ে আসে আনন্দ। রাশি রাশি ভরা ভরা সোনার ধান কৃষকের চোখে জাগয় নতুন স্বপ্ন। হেমন্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন- “কী শোভা কী ছায়া গো- কী স্নেহ কী মায়া গো কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কুলে কুলে।”

শীতকাল: হেমন্তের পর আসে শীতকাল। প্রকৃতি তখন শীর্ণ, শুষ্ক, ও ম্লান থাকে। সর্বত্রই রিক্ততার আভাস। উত্তুরে হাওয়া বইতে থাকে। লেপ, চাদর ও গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে সবাই শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের মন থাকে ক্লান্ত ও নিস্তেজ। তবু খেজুর রসের পায়েস, টাটকা শাকসবজি ,নানা রকমের পিঠা বাঙালির জীবনে বয়ে আনে খুশির জোয়ার। এ খুশিতে একাত্ম হয়ে কবি গেয়ে উঠেন– পৌষ-পার্বনে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”

See also  (৫টি রচনা) শ্রমের মর্যাদা রচনা

বসন্তকাল: সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতি তার সন্ন্যাসবেশ ত্যাগ করে নতুন রূপ ধরে। তখন গাছে গাছে ফুল, ফুলে ফুলে অলি, সুন্দর ধরাতল। পাখির কলকাকলি, কোকিলের সমধুর তান দক্ষিনের হাওয়া. আম্র মুকুলের গন্ধ , ফুলের সমারোহ প্রভৃতি মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মায়ালোক। মানুষের প্রাণে তখন আনন্দের জোয়ার। আনন্দের আত্মহারা কবি গেয়ে উঠেন– “ওগো দখিনা মলয়, আজি তব পরশনে কার কথা পড়ে মনে। মধুপ হয়েছে আজি পাগলধারা কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া।”

উপসংহার: রুপসি বাংলার রঙ্গমঞ্চে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলা যুগ যুগ ধরে অভিনীত হচ্ছে। এ অভিনয়ের পালায় মানুষের মনেও বিচিত্র রুপের প্রতিফলন ঘটছে। প্রকৃতির এমন রুপবৈচিত্র পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাই প্রতিটি ঋতুই আপন আপন বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল। ছয়টি ঋতু যেন ছয়টি রঙের পাখি, নিজস্ব সুরে করে ডাকাডাকি । রূপ বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক খেলার কারণেই বাংলার মানুষের মন এত উদার ও কোমল।

Read more: আমাদের বিদ্যালয় রচনা (4টি রচনা) | OUR SCHOOL

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ৩

ভূমিকা:

ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলা, বঙ্গ প্রকৃতির  ঋতুরঙ্গে তার কী ছন্দময় , সংগীতময়, অনুরূপ রূপবদল! ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা। অনুপম বৈচিত্র্যময় ঋতুরঙ্গের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। তাইতো কবিগুরু লিখেছেন- “ওমা ফাগুণে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে কী দেখেছি মধুর হাসি।”

ঋতুচক্রের আবর্তন:

বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জলবায়ুর প্রভাব ও ভৌগলিক অবস্থান। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর, মৌসুমি বায়ু এদেশের ঋতু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এসব কারণেই এদেশে বারো মাসে ছয়টি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয়।

ঋতুভেদে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্রের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমণ করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহের তারতম্যে ঋতুগুলো একটি অপরটি থেকে আলাদা।

ঋতুচক্রে বাংলাদেশ বনাম অন্য দেশ:

পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র ষড়ঋতুর দেশ। বারো মাসে ছয়টি ঋতু তাদের আলাদা আলাদা রূপ নিয়ে হাজির হওয়া এই পৃথিবীতে বিরল। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই দুইটি বা তিনটি করে ঋতু দেখা যায়। তবে কোনো কোনো দেশে চারটি ঋতুও দেখা যায়।

বাংলাদেশের ঋতুভেদ:

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। রূপসী বাংলার ছয়টি ঋতু যেন তার ছয়টি সন্তান। দুই মাস মিলে একটি ঋতু। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ মিলে বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন মিলে শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ মিলে শীতকাল এবং ফাল্গুন-চৈত্র মিলে বসন্তকাল।

মৌনী-তাপস গ্রীষ্ম:

বঙ্গ প্রকৃতির ঋতু রঙ্গশালায় প্রথম ঋতুনায়ক গ্রীষ্মকাল। বর্ষচক্রের প্রথম দৃশ্যেই ক্রুব্ধ দুইচোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এই মহাতাপসের। নির্দয় নিদাম সূর্য কঠিন হাতে ছুড়ে মারে তার নিদারুন খড়তপ্ত অগ্নির্বাণ। প্রখর তাপদাহে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। কবিগুরু লিখেছেন-
“ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে,মাঠ-ঘাট চৌচির জল নেই পুকুরে।”

গ্রীষ্মের প্রকৃতি:

গ্রীষ্মের মরু রসনায় ধরিত্রীর প্রাণ শোষিত হয়ে কল্পিত শিখা উঠতে থাকে মহাশুণ্যে। এই দারুণ জ্বালায় স্তব্ধ করে দেয় সকল পাখপাখালিকে, জীব-জানোয়ারকে। সর্বত্রই এক ধূ ধূ মরুভূমি। সবকিছু হয়ে যায় নির্জীব, প্রাণহীন, রসহীন। মাঝে মাঝে কালবৈশাখী গ্রাস করে প্রকৃতিকে।

গ্রীষ্মের ফুলফল:

গ্রীষ্ম ঋতু কোনো ফুলের ঋতু নয়। তাই ফুল ফোটাবার কোনো তাড়া নেই তার। শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নেয় সে। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, তরমুজ, আমড়া এই ঋতুতে জন্মে। বকুল, টগর, জবা এই ঋতুর ফল।

সজল বর্ষা:

বর্ষা  বাংলা বর্ষের দ্বিতীয় ঋতু। এই ঋতুতে আবহাওয়া সবসময় ঠান্ডা থাকে। কবিগুরু লিখেছেন-

“আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।”পিপাসার্ত বাংলাদেশকে বর্ষাকালের হাতে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তুলে দিয়ে বিদায় নেয় গ্রীষ্মকাল। দূর-দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে উঠে নবীন কালো মেঘের স্তুপ। ধরণীর বুকে নেমে আসে বৃষ্টি।

বর্ষার প্রকৃতি:

“এদিক দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল,
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।”
বর্ষার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা থাকে। শুরু হয় বজ্রপাতের সাথে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত। নদীনালা, খালবিল পানিতে ভরে যায়। প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। সবকিছু সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে।

See also  (৫টি রচনা) শীতকাল রচনা | শীতের সকাল রচনা

বর্ষার ফুলফল:

বর্ষায় তেমন কোনো ফল পাওয়া না গেলেও বর্ষায় নানান রকমের ফুল পাওয়া যায়। বর্ষার ফুলগুলো হলো কেয়া, কদম, কামিনী, জুঁই, শিউলি ইত্যাদি। বর্ষায় আনারস, শশা, পেয়ারাসহ নানান রকমের ফল পাওয়া যায়। কবিগুরু বলেন-
“গুরুগুরু ডাকে দেয়া,ফুটিছে কদম কেয়া।”

শুভ্র শরৎ:

“আজি ধানের ক্ষেত্রে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা
নীল -আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। শরৎকে বলা হয় ‘ঋতুরাণী’। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি আলোচ্ছায়ায় শরৎ আগমণ করে।

শরৎকালের প্রকৃতি:

শরৎকালের প্রকৃতি থাকে নির্মল ও স্বচ্ছ। আকাশে সাদা মেঘ ঘুরে বেড়ায়। রাতের মেঘমুক্ত আকাশে থাকে অজস্র তারা। শিউলি ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরে উঠে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীতীরে কাশফুল। গাছে পাকে তাল। তাই কবির উচ্চারণ-
“আজিকে তোমার মধুর মুরতিহেরিনু শারৎ প্রভাতে।”

ধূসর হেমন্ত:

হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ ঋতুনাট্যের সে চতুর্থ শিল্পী। সে উদাসীন, পৌঢ় এবং বিষণ্ণ। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধণায় থাকে নিমগ্ন। হেমন্ত শীতের আগাম বার্তা নিয়ে আসে। ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের ধুম পড়ে। ‘তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই গেয়েছেন-

‘ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’

উদাসী শীত:

শীত ঋতুচক্রের পঞ্চম ঋতু। শীতকাল সাধারণত শুষ্ক ঋতু। এটি সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। এসময় হিমালয় থেকে উত্তুরে বাতাস দেশে প্রবেশ করে। তাই দেশের উপর দিয়ে শৈতপ্রবাহ বয়ে যায়। এসময় গরিবেরা শীতের প্রকোপে অনেক কষ্ট করে থাকে। তারা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন তৈরি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বড়লোকের ঘরে তখন থাকে উৎসবের আমেজ। পিঠাপুলির আনন্দে সকলে থাকে আত্মহারা। কবি বলেছেন-

“এলো যে শীতের বেলা বরষ-পরে,এবারে ফসল কেটে নাওগো ঘরে।”

শীতের প্রকৃতি:

শীতকালে প্রকৃতি শুষ্ক ও ম্লান থাকে। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। উত্তর দিক থেকে আসতে থাকে হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাস। এসময় দিন ছোট হয় এবং রাত বড় হয়। গাছপালার পাতা, লতা শুকিয়ে যেতে থাকে। বৃষ্টির অভাবে নদীর পানিও অনেকটা কমে যায়। ভোরবেলা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় চারপাশ। অনেক কাছের জিনিসও তখন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না। এইসময় অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে অনেক নাম না জানা অতিথি পাখি। নতুন নতুন শাক-সবজির আনাগোনায় জমিগুলো ভরে যায়।

শীতের ফুল ও ফল:

শীতকাল নানা ধরণের শাকসবজির কারণে খুবই সমাদৃত। এসময়ের ফল হলো বরই আর কমলালেবু। এসময় নতুন নতুন শাকসবজিতে হাট-বাজার, প্রকৃতি পরিপূর্ণ থাকে। খেজুড়ের গুড় ও রসের গন্ধে চারিদিক মো মো করে। এসময় গাদা, সূর্যমুখী, ডালিয়াসহ নানান ধরণের ফুল ফুটে থাকে।কবি গুরু তাই শীতকে নিয়েও কবিতা লিখতে ভোলেননি-
‘শীতের হাওয়া লাগল আজি
আমলকির ঐ ডালে ডালে।’

ঋতুরাজ বসন্ত:

বসন্ত ঋতুচক্রের সর্বশেষ ঋতু। মাঘের সূর্য উত্তরায়নে পাশ হয়ে চলে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্ত আসে পুষ্পরাত্রির পরম লগ্নে, মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসের জাদুস্পর্শে। বর্ণ বিরল পৃথিবীর সর্বত্র লাগে অপূর্ব পুলক প্রবাহ। বসন্তের মোহমায়তায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন-

‘আহা! আজি এ বসন্তে-
কতফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে, কত পাখি গায়’।

বসন্তের প্রকৃতি:

বসন্তে বনবিথীর রিক্ত শাখায় জাগে কচি কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহুতান। অশোক, শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জরীর গন্ধ লাগে সারা গগনতলে। কবিগুরু লিখেছেন-
“মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে,নয়ন ভুলানো রূপে কে তুমি এলে।”

মানব মনে ষড়ঋতুর প্রভাব:

মানবমনে ঋতুচক্রের প্রভাব অপরিসীম। গ্রীষ্মে মানবমন থাকে ক্লান্ত, অবসন্ন। মানবমনে সর্বদাই অস্থিরতা বিরাজ করে তাপদাহের কারণে। বর্ষার আগমণ মানবমনকে করে শান্ত, স্নিগ্ধ। মানবমনে লাগে বৃষ্টির দোলা। বাদলের দিনে কবিমন নতুন গান রচনা করেন। শরৎ এর রূপ দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। প্রবল বর্ষণ থেকে রেহাই পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। হেমন্তে সকলে ভাসে ফসলের আনন্দে। শীতকালের রুক্ষতা মানুষকে গ্রাস করলেও শীতের পিঠাপুলি মানুষের মনকে করে পুলকিত। আর বসন্তের স্নিগ্ধ হাওয়া, ফুলের সুবাস মানুষের মনকে করে তুলে আরও উদার। তাই বাংলার মানুষ এতটা সহজ সরল।

উপসংহার:

সত্যিই অনবদ্য সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাংলার সেই আগের রূপ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।যান্ত্রিক সভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে চলেছে যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আশঙ্কাজনক। শুধু জননী জন্মভূমির রূপেই নয়, রূপসি বাংলার এই ষড়ঋতু নানা বর্ণ, গন্ধ, রঙের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়। প্রকৃতির এমন রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই।  তাইতো জীবনানন্দ দাশ গেয়েছেন-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছিতাই আমি পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাই না আর।”

আজকে আপনাদের বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা দিয়েছি আশা করি আপনাদের উপকার হয়েছে।

Read more: করোনা ভাইরাস রচনা | সকল শ্রেণির জন্য প্রবন্ধ কোভিড-১৯ সম্পর্কে রচনা COVID-19   | Corona virus composition

 

 

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা পয়েন্ট, বাংলাদেশের ষড়ঋতু অনুচ্ছেদ, বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল রচনা, ষড়ঋতু কি?, বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয় কেন, ষড়ঋতু নাম, বাংলাদেশের ষড়ঋতু নিয়ে কবিতা, ছয় ঋতুর বাংলাদেশ অনুচ্ছেদ,

বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা class 5, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা class ৮, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ক্লাস ৬, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা class 9, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ক্লাস ৪, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা ক্লাস 4, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা class 6, বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা class 3,

Leave a Reply