বিশ্ব শিক্ষক দিবস এর প্রতিপাদ্য বাস্তবায়নে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল “শিক্ষা পুনরুদ্ধারে কেন্দ্র বিন্দুতে শিক্ষকরা”। সময়োপযোগী প্রতিপাদ্য নিঃসন্দেহে। শিক্ষার ক্ষতি পূরন করতে শিক্ষককেই অগ্রনী ভুমিকা পাল করতে হবে। এখানে শিক্ষককে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত।এই দায়িত্ব পালনে আমরা কতটুকু সুযোগ পাই।সভা, সমাবেশ, সেমিনারে যতই শিক্ষা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা বলা হউক না কেন? বাস্তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় করন করা হচ্ছে। এ বছর অন্য বছরের চেয়ে বেশ জাক জমকপূর্ণ ভাবেই বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। এটা অনেকটাই আশার কথা। যদিও রাষ্ট্রীয় ভাবে পালিত হয় নাই। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে রাষ্টপতি, প্রধানমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের বানী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় টেলিভিশনে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।যেহেতু আমরা ইউনেস্কোর সদস্য। ইউনেস্কোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়েরা আসিন ছিলেন বা এখনও আছেন। তাহলে এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ভাবে আমাদের দেশে কেন বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে না? ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর সুপারিশমালা যা শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ হিসাবে খ্যাত তা স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিশ্বশিক্ষক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হয়।

 বিশ্ব শিক্ষক দিবস

এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউনেস্কো সদস্য ভুক্ত রাষ্ট্র প্রধানেরা।তাহলে সেটা পালন করার কথা রাষ্ট্রের কিন্তু সেই ১৯৯৪ সাল থেকে পালন করে আসছি শুধু শিক্ষক সংগঠনগুলো। তাও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এ দিবস পালন করে না।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও এ দিবস পালন করেনা শুধুমাত্র বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বা বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি বিশ্বশিক্ষক দিবস পালন করেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বশিক্ষক দিবস পালন না হলেও তারা বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্বশিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্তিত থাকেন।অনেকটা হিন্দু সমাজের পূজারী ব্রাহ্মণদের মত নিজের বাড়িতে পূজোর খবর নেই কিন্তু অন্যের বাড়ির পূজোতে পৌরহীত্ব করেন। যাক অন্য প্রসংগে চলে যাচ্ছিলাম। আজ এ প্রসংগে লিখব না।আমার লেখার বিষয় ছিল এবারের বিশ্বশিক্ষক দিবসে প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে। এ বারে প্রতিপাদ্য বিষয় কী আমাদের শিক্ষা প্রশাসন জানে? আমার মনে হয় না। এ বারের প্রতিপাদ্য বিষয় করোনা কালে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের ভুমিকা প্রধান্য দেওয়ার বিষয়টি ঈঙ্গিত দেয়। আমাদের দেশে কী তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় একেবারেই নয়।করোনা কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু দিন আগেও অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে তার কোন প্রমাণ নেই। করোনা কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল কিন্তু শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা করা হত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।তার পরের দিনই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পরিপত্র দিতেন অনলাইন ক্লাস নিতে হবে।

 বিশ্ব শিক্ষক দিবস

অনলাইন ক্লাস নেওয়া জন্য শিক্ষকবৃন্দ প্রস্তুত ছিল কী? তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল কী? অনলাইন ক্লাস নেওয়া জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা তার নিজ বাড়ি প্রস্তুত ছিল কী? প্রস্তুত করার যা যা প্রয়োজন তা তাদের ছিল কী ? তা সংগ্রহ করার সক্ষমতা আছে কী নেই খোঁজ নিয়েছেন কী কেউ? এ বিষয় কোন গবেষণা নেই।

ইচ্ছে হল একটা পরিপত্র দিয়ে দায়িত্ব শেষ। কিছুদিন পরে অনলাইন ক্লাস নেওয়া হয়েছে কী না তা জানতে চেয়ে পরিপত্র। ক্লাস যে নিয়েছেন তার লিংক পাঠানোর জন্য পরিপত্রের ভারে আমরা আর চলতে পারি না।কেন্দ্রীয় ভাবে চাপিয়ে দিয়ে কোন কার্যক্রম যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। কাজটি যাদের দিয়ে করাবেন তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সুযোগ থাকতে হবে। করোনা কালে সকল সিদ্ধান্ত উপর থেকে চাপিয়ে দিয়েছেন।

এত দিন পরে এসে বলছেন যে স্কুলে সংক্রমণ দেখা দিবে সেটা বন্ধ করে দিবেন। একটু আগে এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যেত না। করোনা আসার আগেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেন কেন? তখন কী এলাকা ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যেত না।করোনা কালে কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে কোন সভা করেছেন? দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি, সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত কী করে নিবেন? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সমস্য ও সুযোগ আলাদা আলাদা।সমাধানের পথও আলাদা, সমস্যা সমাধানের পথও ভিন্ন ভিন্ন হবে নিশ্চয়। সেই সুযোগ আপরা রেখেছে কী? বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা সংগঠনকে আপনারা এড়িয়ে চলেন কারণ তাদের ডাকলে তারা তাদের বৈষম্য নিরসনের কথা বলবে। তাই তাদের এড়িয়ে যাওয়া। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যা কিছু হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ভালো স্কুলগুলো সরকার সরকারি করন করেছেন। নিজ উদ্যোগে কয়টি স্কুল সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।সরকারি করন হওয়ার পরে তারা সব বুঝতে শিখে গেল। তারাই সকল সিদ্ধান্ত নেয়।সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বাস্তব সমস্যার কাছেও যেতে পারে না।

 বিশ্ব শিক্ষক দিবস

পরিপত্র জারি করে ১০ দিনের মাথায় তা স্পটিকরনের জন্য আরেকটি পরিপত্র দিয়ে দেন।পরিপত্র দেওয়ার সময় এত ব্যস্ততা কেন? আসল কথা তা নয় তারা এ বিষয় ভুক্তভোগী নয়।আমরা পরিপত্র প্রদানের সাথে সাথে তার অস্পষ্টতা বুঝতে পারলাম আর আপনারা তা বুঝতে পারলেন না। তাহলে কাজ যত ছোট হউক তা করার অভিজ্ঞতা না থাকলে সে যত বড়ই হোউক না কেন কাজটি তার জন্য হবে কষ্টসাধ্য।

করোনার পরে স্কুল খুলে দেওয়া হল কী কী করতে হবে তার লম্বা তালিকা দিয়ে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রত্যেক শ্রেণির সপ্তাহে কত দিন ক্লাস নিবে, দিনে কতটা ক্লাস নিতে হবে সব দিয়ে দিলেন। শিক্ষা পুনরুদ্ধারের শিক্ষকের কী ভুমিকা রাখলেন? স্বাভাবিক ভাবে প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন যেটুকুন সময় দিত তাও এখন দিতে পারছে না। তাহলে শিক্ষকবৃন্দ কীভাবে শিক্ষার ঘাটতি পোষাবেন। ১৮ মাসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাহিরে ছিল অটো প্রমোশন পেয়ে উপরের শ্রেনিতে উঠেছে। পূর্বের শ্রেণির ঘাটতি পুষবে কী করে তার কোন নির্দেশনা আছে কী? তারপরেও কথা থেকে যায়, যারা করোনার পরে স্কুলে ভর্তি হয়েছে তাদের না হয় শিক্ষকবৃন্দ ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারল বা দেওয়ার চেষ্টা করল।কিন্তু যে সকল শিক্ষার্থী পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার জন্য শিক্ষা থেকে ঝরে পরেছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরে আনার ব্যবস্থা কে নিবে? করোনা শুরুতে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ছিল তার প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী ঝরে পরেছে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস

এদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?সে জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা কী বাজেটে আছে? এ সব ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব কে দিবে? এখানে বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়ার কেউ নেই। কারণ এই খাতে বরাদ্দে তাদের কোন লাভ নেই। আমি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের বিপক্ষে নই। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করে নয়ন অভিরাম অট্টালিকা তৈরি করলেন সেখানে পড়তে যারা আসবে তাদের খোঁজ রাখলেন না।তাহলে তো ঐ ফাঁকা অট্টালিকা ফাঁকাই থাকবে।ঐ অট্টালিকায় যারা শিক্ষা দিবে এবং নিবে তাদের জন্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে যত কারপন্যতা। সেখানে বরাদ্দ চাইলে না দেওয়ার হাজারো যুক্তি খুঁজে। কারন তাতে সংশ্লিষ্টদের কোন লাভ নেই। শিক্ষা পুরুদ্ধারে আমার কিছু প্রস্তাব করছি।

০১.প্রথমই বলব সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় করন থেকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

০২.সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতা প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।

০৩.শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকবৃন্দ ম্যানেজিং কমিটিকে সাথে নিয়ে শিক্ষা পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা করবেন।

০৪. প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষা অফিসারের সাথে যোগাযোগ করবে।

০৫. এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।

০৬. শিক্ষক ঝরে পরা শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করবে। ০৭.তাদের ঝরে কারণ খুঁজে বের করবে। সেই জন্য যে আর্থিক সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন সেটা সরকারকে করতে হবে।

০৮.ঝরে পরা রোধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে।

০৯.পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে তাদের অতিরিক্ত সময় ক্লাস নিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। সে জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

১০ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

না হলে এ ব্যর্থতার দায় শিক্ষক সমাজ নিবে না। ফাঁকা বুলিতে কাজ হবে না।শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সকলকে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে দ্বিগুণ কাজ করতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আলোচনায় একতফা আলোচনা করতে দেখলাম। আমরা সবাই সব কিছুতেই নিজের স্বার্থ নিয়ে কথা বলি বা নিজের না পাওয়া নিয়েই কথা বলি তাহলে চলবে না।বিশ্ব শিক্ষক দিবস কী শুধু শিক্ষকের অধিকার মর্যাদা ও পাওনা নিয়েই?

আমাদের অধিকার মর্যাদা, প্রাপ্তির সাথে দায়িত্ব কর্তব্য করনীয় সম্পর্কে বলতে। এর একটি অপরটি সাথে অত্যন্ত গভীরভাবে সম্পর্ক যুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি আশা করা যায় না।

তবে কোন কাজ কাউকে দিলে অবশ্যই তাকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। কাজটি দিয়ে যদি ভাবেন কাজটি তার দ্বারা হবে না। আর সার্বক্ষনিক তার ভুল ধরতে থাকেন তাহলে কাজটি সুন্দর হবে না। বরং কাজ করতে দিয়ে করার জন্য সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে হবে।বিশ্বশিক্ষক দিবসে এবারে প্রতিপাদ্য অনুযায়ী আমাদের উপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা যথাভাবে পালনের জন্য সর্বপ্রকার সহযোগিতা সরকারকে করতে হবে।

দুলাল চন্দ্র চৌধুরী

সাংগঠনিক সম্পাদক

বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ।

ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি

Leave a Reply