বেতন বৈষম্য শিক্ষকতায় | বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য, চমকে ওঠার মতো যতো তথ্য

দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতন বৈষম্য চমকে ওঠার মতো। বৈষম্য রয়েছে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও। অথচ তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে একই শিক্ষাগত যোগ্যতায়। সরকারি শিক্ষকরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পাচ্ছেন।

বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকরাও কেন্দ্রীয়ভাবে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের’ (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাচ্ছেন।

অপরদিকে, একই সিলেবাস ও কারিকুলামে পাঠদান করলেও বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৮ ভাগই বেসরকারি খাতের। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সংখ্যায়ও তারাই বেশি।

সরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা : সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, সব সুযোগ-সুবিধা পান তারা। স্কেলভিত্তিক পূর্ণ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসাভাতা হিসেবে ১৫০০ টাকার পাশাপাশি বার্ষিক পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও পান। এর বাইরে পান স্কেলভিত্তিক উৎসব বোনাস।

পরবর্তী স্কেল নির্ধারণকৃত ও চলমান আছে। ধারাবাহিক প্রমোশন আছে ও বদলির ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩৫,৫০০ টাকা (ষষ্ঠ গ্রেড)। অথচ বেসরকারি প্রধান শিক্ষকদের স্কেল ২৯ হাজার স্কেল (সপ্তম গ্রেড)। সরকারি শিক্ষকদের বিভাগীয় ভাতার ব্যবস্থা আছে। অবসরের পর পরিপূর্ণ অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশন আছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্বল্প ও নির্ধারিত ব্যয় করতে হয়। সন্তানরা সরকার থেকে শিক্ষা ভাতাও পান।

সবচেয়ে বড় পার্থক্য পদমর্যাদার। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার পদমর্যাদার। কিন্তু বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো পদমর্যাদা নির্ধারণ করা নেই।

বেসরকারি শিক্ষকরা যা পান : বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলও সরকারিদের সমানই। তবে কেবল মূল বেতনটুকুই সমান, বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন তারা। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বড় অংশই আবার এমপিওভুক্ত নন।

দেশের ২৬ হাজার বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী প্রতি মাসে সরকার থেকে মূল বেতন পান। সঙ্গে দেওয়া হয় নামমাত্র বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা। তাদের বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের শতভাগ বেতন দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় মাত্র এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া। এটি নির্ধারিত।

অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসাভাতা নির্ধারিত মাত্র ৫০০ টাকা। আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা টাইম স্কেল পেতেন। তাও পুরো চাকরি জীবনে মাত্র দু’বার। বর্তমানে টাইম স্কেল বন্ধ। ঈদ অথবা পূজা-পার্বণে বোনাস হিসেবে সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের শতভাগ পেলেও বেসরকারি শিক্ষকরা উৎসব ভাতা হিসেবে পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা ৫০ ভাগ অর্থ।

জানা গেছে, ১২ হাজার টাকা এবং ১৬ হাজার টাকা স্কেলে নিয়োগকৃত সহকারী শিক্ষকদের পরবর্তী বেতন স্কেল নির্ধারণ করা নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের সরাসরি প্রমোশন এবং বদলিও নেই।

বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো বিভাগীয় ভাতা নেই। দীর্ঘকাল চাকরি করার পর তাদের অনেকটা শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরে যেতে হয়। এককালীন সামান্য অবসর ভাতার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মাসিক পেনশন নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ব্যাপক ব্যয় করতে হয়। তাদের সন্তানদের জন্য কোনো শিক্ষা ভাতা নেই।

 

সম্প্রতি বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন অর্থমন্ত্রীর কাছে কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ প্রস্তাবিত বেতনকাঠামো শতভাগ যৌক্তিক বলে মনে করেন। প্রস্তাবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ রয়েছে। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকেরা সরকারি শিক্ষকদের সমান হারে মূল বেতনের শতভাগ পেলে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান আছে।
১৯৮০ সালে সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ প্রদানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। আরও কিছুদিন পরে ৫০ শতাংশ মূল বেতনের সঙ্গে ১০০ টাকা বাড়িভাড়া সংযোজন করা হয়। ৩৪ বছর যাবৎ বিভিন্ন সরকার মূল বেতন ও ভাতা বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ মূল বেতন, ২০ শতাংশ উৎসব ভাতা, ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ও ৩৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা প্রদান করেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া, ২০ শতাংশ উৎসব ভাতা, ৩৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং সারা জীবনে কোনো ইনক্রিমেন্ট না পাওয়া কত দুর্ভাগ্যজনক, তা-ও বিবেচনার দাবি রাখে। অথচ বেতন কমিশনের প্রতিবেদনে বিদ্যমান অপ্রতুল, হাস্যকর ও অসম্মানজনক বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব করা হয়নি।
গত ২৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘যেকোনো শাসন ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গেলে একটা কার্যকর, সৎ, স্বচ্ছ ও মেধাবী প্রশাসন থাকা দরকার। সেটা তৈরি করতে গেলে যাঁরা প্রশাসনযন্ত্রের অংশ, তাঁদের দেখভাল করতে হবে। অনেকে বলেন, আমলাতন্ত্র ভালো নয়। কিন্তু ক্যাডার হিসেবে প্রথম যাঁরা চাকরিতে আসেন, তাঁদের বেতন ১১ হাজার টাকা। অথচ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ৪৭ হাজার টাকায় আমরা প্রভাষক নিয়োগ করি। ১১ হাজার টাকায় কী কাজ করবেন, সেবাই বা কী দেবেন তাঁরা? রক্ষণশীল গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা আধুনিক চিন্তাশীল ও উৎপাদনশীল প্রশাসনযন্ত্র সৃষ্টি করাই কমিশনের প্রথম উদ্দেশ্য।’
চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, আধুনিক চিন্তাশীল ও উৎপাদনশীল প্রশাসনযন্ত্রের উদ্ভাবক ও স্থপতি যে শিক্ষক সমাজ, তাঁদের অবজ্ঞা করে কীভাবে কার্যকর প্রশাসনের জন্য যথোপযুক্ত নাগরিক পাওয়া সম্ভব?
লেখক: অধ্যক্ষ, এম এস জোহা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

 

নন এমপিও শিক্ষকদের বেতন, বেসরকারি শিক্ষকদের আগস্ট মাসের বেতন ২০২১ ,বেসরকারি শিক্ষকদের ১০০ বোনাস, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির নতুন খবর, বেসরকারি শিক্ষকদের জুলাই মাসের বেতন, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ এনটিআরসিএ, শিক্ষক নিয়োগ উচ্চতর গ্রেডে, বেতন নির্ধারণ পদ্ধতি,সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, একই স্কেলের দাবিতে আইনি

Leave a Reply