ভি এস নাইপল : জীবন ও সাহিত্য V.S. Naipaul Books Biography

খুব দূর অতীত নয়, ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিটারেরি ফেস্টিভালে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ভগ্ন ও রুগ্ন স্বাস্থ্যের ভি এস নাইপল – পুরো নাম বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল। মঞ্চে তিনি হুইলচেয়ারে বসেছিলেন, পাশে ছায়ার মতো তাঁকে আগলে রেখেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া সাংবাদিক নাদিরা খানম আলভি। সেই আমাদের শেষ দেখা নাইপলকে। সেদিন সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন। অনেকদিন ধরে তাঁর শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছিল। আমার স্বল্পকালীন লন্ডনের প্রবাসজীবনে ১৯৮৬ সালে তাঁকে বেশ কটি অনুষ্ঠানে দেখেছি, কথা হয়েছে, তখন তাঁর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ছিল না। রঙ্গরসে ভরা প্রাণবন্ত মানুষটিকে ঢাকায় অনেক বেশি স্তিমিত মনে হলো।

নাইপল পেয়েছিলেন ৮৬ বছরের (১৭ আগস্ট ১৯৩২-১১ আগস্ট ২০১৮) চড়াই-উতরাই পার হওয়া এক সংগ্রামমুখর জীবন। জন্ম ত্রিনিদাদে ১৯৩২ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পরে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) প্রাক্কালে। তার পূর্বপুরুষরা বিশেষত প্রপিতামহ ছিলেন হতদরিদ্র। জন্মভূমি ভারত থেকে দারিদ্র্যের কারণে দেশত্যাগী হয়েছিলেন ১৮৮০ সালে। তাঁর মতো দরিদ্র ও ভাগ্যহত মানুষদের ব্রিটিশরা জাহাজভর্তি করে দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি ক্যারিবীয় অঞ্চলের এক ছোট দ্বীপে, যার নাম ত্রিনিদাদ সেখানে, নিয়ে গিয়েছিল। চাগুয়ানা নামে এক ক্ষুদ্র মফস্বল শহরে নানাবাড়িতে নাইপলের জন্ম। প্রপিতামহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের আখের খামারে দিনান্ত পরিশ্রম করে জীবনযাপন করতেন। সাত বছর বয়সে রাজধানী শহর পোর্ট অব স্পেনে চলে আসেন নাইপল। সেখানে তাঁর স্কুলজীবন অতিবাহিত হয়।

সন্তান অল্প বয়সে প্রেম করছে? যা করবেন আপনি

সেটাও ছিল নানাবাড়ি। বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। সবসময় কলহ আর কোলাহলে পরিপূর্ণ। এরকম জীবন তাঁর ভালো লাগেনি। অপরিসীম দারিদ্র্য আর অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত এরকম জীবন তাঁকে মানসিকভাবে পীড়িত করে তোলে। ১৮ বছর বয়সে একটা বৃত্তি পাওয়ার ফলে তিনি পড়াশোনা করতে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে চলে আসেন। জন্মভূমি ত্রিনিদাদকে বিদায় জানিয়ে কাক্সিক্ষত শহরে এসে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু দারিদ্র্য তাঁর পিছু পিছু আসে। ব্যয়বহুল শহর লন্ডনে তিনি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সামাজিকভাবেও তাঁকে নিপীড়িত হতে হয়।

নারীরা কম বয়সী পুরুষের প্রেমে পড়ে কেন?

অশ্বেতাঙ্গ নাইপলের, বর্ণবাদের কারণে, প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ বিলম্ব হয়। নিজেকে তিনি অনাহূত এবং আগন্তুক হিসেবে আবিষ্কার করেন। প্যাট্রেসিয়া অ্যান হেইল নামে এক ব্রিটিশ সহপাঠিনীর সঙ্গে এই সময় তাঁর প্রেম হয়। প্রথম পরিচয় থেকে প্রণয় এবং প্রণয় থেকে বিয়ে (১৯৫৫)। শুরু হয় জীবনের এক নতুন পর্ব। প্যাট্রেসিয়া তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসেন। নাইপল এ-সময় অর্থসংকটে ডুবেছিলেন। প্যাট্রেসিয়ার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তাঁর জীবন চলে। বলা চলে, এই ইংরেজ শ্বেতাঙ্গ নারী শুধু স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন নাইপলের অঘোষিত সেক্রেটারি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত (১৯৯৬) প্যাট্রেসিয়া তাঁর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন।

নাইপল প্যাট্রেসিয়াকে স্ত্রী হিসেবে কতটুকু মর্যাদা দিয়েছেন, তা এক বিতর্কিত বিষয়। নাইপলের জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ (Patrick French) তাঁর দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ হোয়াট ইট ইজ (The World is What it is)গ্রন্থে এ-প্রসঙ্গে অনেক কথা লিখেছেন : তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল বন্ধ্যা ও অসুখী। তিনি নিয়মিত বেশ্যাগমন করতেন। মার্গারেট গুডিং নামে এক অ্যাংলো আর্জেন্টাইন নারীর সঙ্গে প্রবল যৌনসম্পর্ক ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত জীবনাচরণে ছিলেন অসহিষ্ণু, উদ্ধত, বদমেজাজি, দুর্মুখ ও অত্যাচারী। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল।

১৯৫২ সালে নাইপল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বিপুল অর্থকষ্ট, বই ছাপার ব্যাপারে নতুন অশ্বেতাঙ্গ লেখক নাইপলের প্রতি প্রকাশকদের অসম্ভব অনীহা তাঁকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে ফেলে। এ-সময় তিনি আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। কিন্তু মহীয়সী নারী প্যাট্রেসিয়া তখন তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহস জোগান, তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন, তাঁকে সুস্থ করে তোলেন।

বাঁকুড়ায় পরকীয়া প্রেমিকের সাথে স্ত্রীকে বিয়ে দিলেন স্বামী

শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এ-সময় বিবিসি-তে সপ্তাহে একদিন ‘ক্যারিবিয়ান ভয়েস’ অনুষ্ঠানটি তিনি উপস্থাপন করতেন। একদিন বিবিসির ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকদের কক্ষে বসে ‘বোগার্ট’ (Bogart) গল্পটি লেখেন, যা পরবর্তী সময়ে মিগুয়েল স্ট্রিট (Miguel Street) গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় এবং পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। লন্ডনের এক সহৃদয় প্রকাশক তাঁকে উপন্যাস লিখতে উৎসাহিত করেন। কালক্ষেপণ না করে নাইপল দ্রুত দ্য মিস্টিক ম্যাসিউর (The Mystic Masseur) লিখে ফেলেন এবং তা ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়।

এরপর তাঁর বাবা ও প্রপিতামহের জীবনের দরিদ্র ও করুণ কাহিনি নিয়ে আ হাউজ ফর মি. বিশ্বাস (A House for Mr. Biswas) লিখে অভূতপূর্ব খ্যাতি অর্জন করেন ১৯৬১ সালে। এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসে তিনি একটি পরিবারের সংগ্রামমুখর জীবনের চালচিত্র তুলে ধরেন।

এ-উপন্যাসটি লেখার পর তাঁর মনে হলো, এরপর তাঁর আর কিছু লেখার নেই। লেখার সব রসদ তাঁর ফুরিয়ে গেছে। তিনি ভ্রমণ শুরু করেন। তাঁর ধমনিতে ছিল ভ্রমণস্পৃহা ও অপরিসীম ভ্রমণতৃষ্ণা। তিনি নতুন জায়গা, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন মানুষ দেখতে পছন্দ করতেন।

শুরু হলো তাঁর লেখক-জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। ১৯৬২ সালে তিনি ভারত ভ্রমণে যান, যেখানে একদা তাঁর পিতামহ পরম দরিদ্রতার ভেতর বসবাস করতেন। তিনি ভীষণ হতাশ হন, তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়। তিনি এই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রবন্ধের বই অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস (An Area of Darkness) লেখেন। ১৯৬৪ সালে বইটি প্রকাশের পর তিনি কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন। ভারত সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে।

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনী – Manik Bandopadhyay Biography in Bengali

তবু ভারত, তাঁর পিতামহের জন্মভূমি, তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। তাঁর নিজস্ব কোনো স্মৃতি নেই, তবুও বারবার তিনি ভারত ভ্রমণ করেন, সর্বসাকল্যে ভারত বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন।

১. অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস (১৯৬৪)

২. ইন্ডিয়া : এ ওন্ডেড সিভিলাইজেশন (১৯৭৭)

৩. ইন্ডিয়া : এ মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও (১৯৯০)

তিনটি বই-ই কঠোর সমালোচনার শিকার হয়।

নাইপলের প্রিয় বিষয় গৃহহীনতা, শেকড়হীনতা (rootlessness), সংস্কৃতির (conversion of culture) এবং ধর্মান্তরের রূপান্তর। ১৯৭৯ সালে, এই কৌতূহল ও আগ্রহ থেকে তিনি এশিয়ার চারটি অনারবীয় দেশ ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান ভ্রমণের পর লেখেন – অ্যামাং দ্য বিলিভারস : অ্যান ইসলামিক জার্নি © (Among the Believers : An Islamic Journey)।  বইটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর এসব দেশের সাহিত্য-সমালোচকরা রুষ্ট হন। তিনি আবার সমালোচনার শিকার হন। সতেরো বছর পর এই চারটি দেশ আবার ভ্রমণ করে ১৯৯৫ সালে লেখেন বেয়ন্ড বিলিফ : ইসলামিক এক্সকারসন্স অ্যামাং দ্য কনভার্টেড পিপলস (Beyond Belief : Islamic Excursions among the Converted Peoples)

অনারব এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের বিষয়ে লেখা এই দুটো ভ্রমণকাহিনি নাইপল সম্পর্কে বিতর্কের সৃষ্টি করে। তিনি আবার প্রশ্নবিদ্ধ হন। দ্বিতীয় বইটি তিনি পাকিস্তানি সাংবাদিক ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, ১৯৯৬ সালে যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, তাঁর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন।

সালমান রুশদী তাঁর এক প্রবন্ধে ভি এস নাইপল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন : ‘একটি দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতি সম্পর্কে এত অল্পসময়ে এরকম মতামত দেওয়া যায় না। বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে দেখতে হয়।’

নাইপল গবেষক নন; তিনি আখ্যায়ক, খালি চোখে তিনি যা অবলোকন করেছেন, তা-ই বর্ণনা করেছেন। বেয়ন্ড বিলিফ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : ÔThis is a book about people. It is not a book of opinion. It is a book of stories.’

বইটিতে তিনি ওই চারটি দেশের মানুষ সম্পর্কে লিখেছেন। গল্পের আঙ্গিকে সেসব দেশের মানুষের জীবনযাপনের কথা, প্রান্তিক মানুষদের কথা লিখেছেন। তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন এভাবে : ÔThe theme of conversion was always there; but I didn’t see is as clearly as I saw it on this second journey.’

নাইপল তাঁর দ্বিতীয় ভ্রমণে, তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে, Beyond Belief-এ অনেক বেশি সংযত, অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক, অনেক বেশি সচেতন। তিনি লিখেছেন : ÔWhen I started on this journey in 1979 I knew almost nothing about Islam – it is the best way to start on a venture – and that first book was an exploration of the details of the faith…’

তাঁর এই অনুসন্ধান থেমে থাকেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিণত হয়েছেন, ঋদ্ধ হয়েছেন।

নাইপল ১৯৭১ সালে বুকার পুরস্কার পান। ১৯৭৩ সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের হ্রস্ব-তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়; কিন্তু তিনি সেই কাক্সিক্ষত এবং প্রত্যাশিত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হন বিতর্কিত হওয়ার কারণে। তিনি যখন আফ্রিকা ভ্রমণ করেন ও সেই দেশ সম্পর্কে লেখেন দ্য মাস্ক অব (The Masque of Africa : Glimpses of African Belief), তখনো সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি আসলে একটি দেশের নৃতত্ত্ব, সমাজ-কাঠামো, ইতিহাস এসব বিষয়ে গভীর হোমওয়ার্ক করেননি বলে সাহিত্য-সমালোচকরা মনে করেন।

নাইপলকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সম্মাননা নোবেল পুরস্কারের জন্য এবং শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে তিনি এই পুরস্কার পান। তাঁর বই প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মকে দুভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. সৃজনশীল উপন্যাস (fiction) এবং দুই. প্রবন্ধ (non-fiction)। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলো :

 A House for Mr. Biswas (১৯৬১)

২. A Bend in the River (১৯৭৯)

৩. A Way in the World (১৯৯৪)

৪. In a Free State (১৯৭১)

৫. The Enigma of Arrival (১৯৮৭)

এ-উপন্যাসগুলোতে তিনি শেকড়হীন মানুষের উন্মূল বেদনার মর্মান্তিক আখ্যান তুলে ধরেছেন। গৃহহীনতা ও স্থানচ্যুতি – এই বিষয়দুটি তাঁর প্রিয় বিষয় হিসেবে উল্লিখিত অধিকাংশ উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। আত্মজৈবনিক আঙ্গিক ব্যবহার করে তিনি স্মৃতিময়তা, আত্মকথন এবং স্মৃতিচিত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। উপন্যাসগুলোতে নৈরাশ্য, উন্নাসিকতা এবং হতাশার হাহাকার প্রতিটি পৃষ্ঠাকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে।

চঞ্চল চৌধুরী শৈশব, শিক্ষা, ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত জীবন | Biography of Bangladeshi Actor Chanchal Chowdhury

কিন্তু এতকিছুর পরও সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর গদ্য – তাঁর সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত বাক্যের চাতুর্যময় ব্যবহার, যা পাঠককে এক মায়াময় পৃথিবীতে নিয়ে যায়। পাঠক তাঁর উপন্যাস শুরু করলে শেষ না করে থামতে পারেন না। এই শিল্পচাতুর্য একজন শক্তিশালী লেখকের খুব শানিত এক অস্ত্র।

চরিত্রচিত্রণেও নাইপলের মুন্শিয়ানা আমাদের অভিভূত ও মুগ্ধ করে।

তিনি তিরিশটির অধিক বই লিখেছেন এবং এই বইগুলোতে অসংখ্য বৈপরীত্যের সমাহার আমাদের বিস্মিত করে।

নাইপল মূলত আখ্যায়ক এবং গাল্পিক। তিনি যখন ভ্রমণকাহিনি রচনা করেন সেখানেও গল্প খোঁজেন। সেই গল্প কিংবদন্তি ও ইতিহাসের ভেতর সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। তিনি তাঁর প্রবন্ধের বই A Writer’s People : Ways of Looking and Feeling-এ এসব কথা অবলীলাক্রমে আত্মজৈবনিক আঙ্গিকে বলেছেন।

নাইপলের বাবা সিপেরসাদ নাইপল ছিলেন ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক এবং তাঁর স্বপ্ন ছিল একজন লেখক হওয়ার। ১৯২৯ সালে তিনি ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ানে (Trinidad Guardian) নিয়মিত প্রদায়ক হিসেবে লেখা দিতে শুরু করেন। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান (১৯০৬-৫৩)।

ভিএস নাইপল তাঁর ভ্রমণকাহিনিগুলোতে আত্মজৈবনিক উপাদানের পাশাপাশি ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিষয় ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন। ত্রিনিদাদের ওপর লেখা দ্য লস অব এলডোরাডো (The Loss of El Dorado) মূলত ত্রিনিদাদের ঐতিহাসিক আখ্যান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বর্ণনা, স্মৃতিময়তা এবং স্মৃতিকথন উপন্যাসটিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গত চার বছরে নাইপলের বেশকিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিক্ষিপ্তভাবে ছাপা হয়েছে। এগুলো গ্রন্থিত হয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে পাঠক উপকৃত হবেন।

দুটি গল্পগ্রন্থ মিগুয়েল স্ট্রিট (Miguel Street)  এবং আ ফ্ল্যাগ অন দ্য আইল্যান্ড (A Flag on the Island) অনেকটা নকশা-জাতীয়। তিনি গল্পের চেয়ে উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনির প্রতি বেশি সিরিয়াস ছিলেন, অধিকতর নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত প্যাট্রেসিয়া এবং নাইপল মিলে সাত হাজার দুশো পাউন্ডে লন্ডনের স্টকওয়েল পার্ক ক্রিসেন্ট এলাকায় তিন ফ্লোরবিশিষ্ট একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করেন। ত্রিনিদাদ থেকে লন্ডন এবং লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস, কিন্তু তারপরও নিজেকে তাঁর আগন্তুক বা outsider মনে হতো, এক উদ্বাস্তু চেতনা তাঁকে সারাজীবন কুরে কুরে খেয়েছে। তিনি ছিলেন নিজগৃহে পরবাসী, কোথাও তিনি মানসিকভাবে থিতু হতে পারেননি। তবে লন্ডন তাঁর জীবনদর্শন বদলে দিয়েছিল।

তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক প্রবন্ধ সংকলন আ রাইটারস পিপল (A Writer’s People: Ways of Looking and Feeling) গ্রন্থে লিখেছেন :

I had lived all my writing life in England; that had to be acknowledged, had to be part of my world view. I had been a serious traveller; that had to be acknowledged as well.

এ-কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, তাঁর লেখালেখি-জীবনের সবটুকু সময় ইংল্যান্ডে কেটেছে এবং এই ইংল্যান্ড তাঁর জীবনদৃষ্টি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে, বলা চলে তাঁকে বিনির্মাণ করেছে, জীবন ও জগৎকে তিনি ভিন্নভাবে অবলোকন করতে শিখিয়েছে। সেটাই তাঁর world view,পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।

তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।

ভি এস নাইপল বেঁচে থাকলে এ বছরের আগস্টে ৯০ বছর পূর্ণ করতেন। ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট এই নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হয়েছেন। মুত্যুর ২ বছর আগে তিনি ঢাকা লিটফেস্টে এসেছিলেন। তিনি একাধারে স্বদেশবিদ্বেষী, পরদেশবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী। খুব কম অঙ্গনই বাকি আছে যেখানে নাইপলের বিদ্বেষের বাষ্প লাগেনি। তবু নিজ লেখার গুণে তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী রাজত্ব করে গেছেন।

নাইপল নিজের পরিচয় সংকটের কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘ইংল্যান্ডে আমি ইংরেজ নই, ভারতে ভারতীয় নই।’ তিনি অবিরাম বৈরিতা সৃষ্টি করে গেছেন। আবার বন্ধুকে শত্রুতে পরিণত করেছেন।

ঈর্ষাকাতর বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ত্রিনিদাদের চাগুয়ানাস গ্রামে দরিদ্র হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সিপ্রসাদ নাইপল, মা দ্রোয়াপতি। পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান।  তার পিতামহ-পিতামহী ভারত থেকে ত্রিনিদাদের আখক্ষেতের ঠিকা শ্রমিক হিসেবে দেশান্তরী হন ১৮৮০ সালের দিকে। তখন দাসপ্রথা অবলুপ্ত হতে চলেছে; আখচাষের জন্য সস্তা শ্রমিক আনা সে-সময় অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। নাইপলের বাবা সাংবাদিকতা করতেন, তার খানিকটা সাহিত্যের উচ্চাশাও ছিল। ১৯২৯-এ তিনি ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এবং  চাগুয়ানাস প্রতিনিধির দায়িত্বও পান তার বাবা।

প্লেটো: এই প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকের জীবনী Plato Biography

নাইপল ১০-১১ বছর বয়স থেকেই জানতেন তিনি লেখকই হবেন। তিনি লেখকই হয়েছেন। উপনিবেশ থেকে শাসকের রাজ্যে উঠে এসে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন, নোবেল প্রাইজ জিতেছেন, নাইটহুড পেয়েছেন; বহু মানুষের অপছন্দের লেখক হয়েও ঈর্ষণীয় পাঠকভাগ্য তার।

তার দাবি অনুসারে, নাইপলের পিতামহ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। পরবর্তীতে তার পরিবারের ধর্মানুরাগ অন্তর্হিত হয়, এমনকি ধীরে ধীরে ভারতীয় ভাষা থেকেও সরে যায়। শেষদিকে নাইপলের মায়ের ব্যবহৃত একমাত্র ভারতীয় শব্দ ছিল ‘বেটা’। ভি এস নাইপল  বলেছেন,  ‘লেখক হতে হলে তোমাকে পৃথিবীর পথে বেরোতে হবে, পৃথিবীতে ঝুঁকি নিতে হবে, পৃথিবীতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে, পৃথিবীর খোঁজে বেরোতে হবে। বয়স বেড়ে গেলে কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে। বয়স্ক মানুষের বেলায় দিনগুলো ছোট, তখন বাইরে যাওয়া ও বাইরের পৃথিবীতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।… পৃথিবীর ব্যাপারে বিষাদময় বিষয়টি হচ্ছে এটি শুধু আহাম্মকে পরিপূর্ণ। আর আহাম্মকজন ও সাধারণজনের লাভের জন্য পৃথিবী পরিচালিত হয়ে থাকে।’

ভি এস নাইপল পাঠকের পছন্দ লেখক হলেও ঔদ্ধত্য, দুর্বিনীত আচরণ এবং কখনো কখনো একপেশে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন অনেক। মূলত ফিকশন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত নাইপল। বিভিন্ন রূঢ় মন্তব্যের কারণে বরাবরই আলোচনায় ছিলেন। এমনকি মৃত্যুর পরও তার সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘নাইপল কাউকেই ছাড় দেননি- ঔপনিবেশিক শাসককেও না, উপনিবেশে শাসিত প্রজাদেরও না।’

১৯৫৫ সালের গ্রীষ্মের এক অপরাহ্ণে নাইপল লিখে ফেললেন ‘বোগার্ট’;  ‘মিগেল স্ট্রিট’ এর প্রথম এপিসোড। ১৭টি এপিসোডের সমন্বয়ে এই ‘মিগেল স্ট্রিট’। তখনই প্রকাশ করতে সম্মত হলেন না প্রকাশক। তার আশঙ্কা ছিল, অপরিচিত ক্যারিবিয়ান লেখকের বই যদি বিক্রি না হয়। প্রকাশক তাকে উপন্যাস লিখতে বললেন। ১৯৫৫ সালের শরতে তিনি লিখলেন ‘দ্য মিস্টিক ম্যাসিওর’, যার অর্থ হতে পারে ‘অতীন্দ্রিয় অঙ্গমর্দনকারী’। ১৯৫৫ সালের ৮ ডিসেম্বর  প্রকাশক উপন্যাস প্রকাশের জন্য এর পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করলেন, নাইপল পেলেন ১২৫ পাউন্ড।

নাইপল কেমন লেখক?  এডওয়ার্ড সাইদ নাইপলকে অভিযুক্ত করেছেন। কারণ তিনি অযৌক্তিক ব্যাখ্যায় প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে আদিম, বর্বর এবং অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আফ্রিকা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জেনে আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করার ভান করেছেন, প্রাচ্যের মূল্যায়ন করেছেন। এডওয়ার্ড সাইদ যতটা না দুঃখে তার চেয়ে বেশি ক্রোধে তাকে নব্য বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশবাদ প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।

এভলিন ওয়াফ একবার বলেছিলেন, ‘নাইপলের গদ্য তার সমকালীন ব্রিটিশদের লজ্জা দেয়।’ এভলিনের মতো কাঠখোট্টা লেখক-সমালোচকের মুখে এটি একটি অসাধারণ প্রশংসা।

সালমান রুশদি মনে করেন, সাহিত্য বা রাজনীতি কোনো বিষয়ে তিনি ভি এস নাইপলের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। ডেরেক ওয়ালকট বলেছেন, ‘নাইপল নিগ্রোদের পছন্দ করেন না।’

নিজের মাতৃভূমি ত্রিনিদাদ সম্পর্কে নাইপল বলেছেন, ‘আনইম্পর্ট্যান্ট, আনক্রিয়েটিভ, সিনিক্যাল, এ ডট অন দ্য ম্যাপ।’

দেশবাসী সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটি বানরও দেখতে পাইনি যে আমার বই পড়ে। কেবল শারীরিক যে জীবন সেই জীবনই তারা যাপন করে; আমার কাছে তা ঘৃণ্যজীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী বর্বরদের সম্পর্কে পড়াশোনা করছে ত্রিনিদাদের লোক তাদের জন্য কৌতূহলের বিষয় হতে পারে।’ ত্রিনিদাদের ভারতীয় সমাজের ফাঁপা অবয়বটি নাইপলকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট ও বিচলিত করেছে।

নাইপল যেভাবে বর্ণনা করেছেন বাস্তবের ত্রিনিদাদ তার চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্ন, তার বিবরণীর চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। নাইপল যেসব মানুষের স্থবিরতা নিয়ে ঠাট্টা করেছেন, তারাই পুরনো রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ভেঙে পিপলস ন্যাশনাল মুভমেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পিপলস পার্টিসিপেশনকে জয়ী করেছেন। নাইপলের কথা সত্য হলে এত বড় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতো না। তারপরও বর্ণবাদী যে রেশ রয়ে গেছে তা দাসত্বের কাল এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের। হীনমন্যতার বীজ তো জন্মের পরপরই ড্রাম পিটিয়ে শিশুর কানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়—নাইপলের উপন্যাস ‘মিগেল স্ট্রিট’ এবং ‘অ্যা হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ এ কাজটি করেছে। নাইপল উপনিবেশবাদী সংস্কৃতি নিয়ে জীবনযাপনের তিক্ত চিত্র তুলে ধরেছেন, উপনিবেশ স্থাপনকারীদের সম্মান নাইটহুড সানন্দে গ্রহণ করেছেন। নব্য উপনিবেশবাদের পক্ষেই প্রকারান্তরে লিখে গেছেন।

রিচার্ড সুডান মনে করেন, ‘ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার যে উৎসব, যে কার্নিভাল—ভিএস নাইপল উদযাপনকারী ত্রিনিদাদবাসীর নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পারেননি। ত্রিনিদাদিয়ান যে অহংকার, তা তিনি অনুধাবন করেননি।’

ত্রিনিদাদ সম্পর্কে ভিএস নাইপলের নিজের কী মূল্যায়ন? তিনি লিখেছেন, ‘ত্রিনিদাদকে জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু যারা ত্রিনিদাদকে জানেন তারা বেশ ভালোই জানেন এটি সরল, ঔপনিবেশিক একটি অসভ্য সমাজ।’ ত্রিনিদাদ নিয়ে তার আরেকটি বক্তব্য হলো, ‘আমি এক ক্ষুদ্র জায়গায় বেড়ে উঠি এবং যখন তরুণ তখনই সেই জায়গাটা ছেড়ে যাই এবং বৃহত্তর পৃথিবীতে প্রবেশ করি।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘ত্রিনিদাদে কিছুই তৈরি হয়নি।’ এখানে এটাও বলা আবশ্যক, নাইপলের ইংল্যান্ড স্তুতিও নিষ্কলুষ নয়। তিনি বলেছেন, ‘ইংল্যান্ডের মানুষ নিজেদের আহাম্মক হওয়া নিয়ে বেশ গর্ব করে থাকে।’

নাইপলের ভারত

নাইপল বলেছেন, ‘আমার মতো মানুষ যদি সমাজ নিয়ে লেখেন যে সমাজের কোনো বুদ্ধিবৃত্তি জীবন নেই, তাতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। তারা যদি বইটা পড়ে—অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বই পড়ে না—কিন্তু তারা অনুমোদন চায়।… এখন ভারতের উন্নতি হয়েছে, বইগুলো গৃহীত হয়েছে (ভারতবিষয়ক নাইপলের ৩টি বই- ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’, ‘অ্যা ওন্ডেড সিভিলাইজেশন’ এবং ‘ইন্ডিয়া: অ্যা মিলিয়ন মিউটিনিজ নাউ’)।… চল্লিশ বছর আগে ভারতের মানুষ ধর্মীয় প্রথাবৃত্তে বন্দী ছিল, অন্যান্য দিকের মধ্যে এদিক দিয়েও আমি ভারতকে সাহায্য করেছি।’

ভারত নিয়ে লেখা ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’ এ তার হতাশা প্রতিফলিত কি না—খুশবন্ত সিংয়ের এমন প্রশ্নের জবাবে নাইপল বলেন, ‘এটা হতাশা নয়, আমি আহত হয়েছিলাম। এটা আমার জন্য বড় ধরনের ক্ষত। আপনাকে মনে রাখতে হবে আমরা ত্রিনিদাদের খুব হতাশ একটি সম্প্রদায়। ভারত নিয়ে আমাদের কাছে কোনো গল্প ছিল না। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, ত্রিনিদাদে আসার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা ভয়ানক কোনো জায়গা ছেড়ে এসেছেন। আমাদের ভারত-ধারণা বড় নির্মম। এদেশটা আসলে কেমন, আমাদের কাছে কখনো বর্ণনা করা হয়নি। কাজেই ভারত কখনো আমাদের কাছে সত্য হয়ে ওঠেনি। আমি যখন প্রথম এখানে আসি ভারত নিয়ে লেখার পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল না।’

নাইপলের আফ্রিকা

এ সম্পর্কে নাইপলের বক্তব্য হলো, ‘আফ্রিকা কোনো মজার জায়গা নয়। মজার জায়গা হয় সেটি, যা আত্মাকে উদ্বুদ্ধ করে, অনুভূতিকে সস্নেহে লালন করে। আমি যে আফ্রিকা সফর করেছি তার সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না।’ ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী তার উচ্চারণ, ‘আফ্রিকানরা লাথি চায়, এটাই একমাত্র জিনিস, যা তারা বোঝে।’

আফ্রিকার কালো মানুষদের সম্পর্কে নাইপল তার ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ গ্রন্থে বলছেন, ‘কালো মানুষ নিজের কথা লিখতে পারার শিক্ষা ও সাহস পেয়েছে অনেক পরে। সাদা মানুষ তাদের দেখেছে নিজেদের বোঝা হিসেবে।’ নাইপল আফ্রিকার যে দিকটাতে আলোকসম্পাত করেছেন, সাদা মানুষ সে পথে কখনো এগোয়নি।

অরবিন্দ আদিগা বলেছেন, ‘নাইপলের আফ্রিকানরা “মিমিক ম্যান”। তারা পশ্চিমের প্রতিষ্ঠানসমূহ- সরকার, আইন, পুলিশ ইত্যাদি তাদের জন্য কতটা লাগসই তা না ভেবেই অনুকরণ করে বলেছে, অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তাদের সমাজ ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে এবং কৃষ্ণ মহাদেশ- ডার্ক কন্টিনেন্টের যে বহুল চর্চিত ধারণা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।’

নাইপল লিখলেন, ‘আমি মনে করেছি এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, এটা ভীষণ হতাশার ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকে অনেক বড় সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমি আশা করেছিলাম বড় সংগ্রাম তাদের বড় মানুষে পরিণত করবে।’

আফ্রিকা নাইপলের কাছে বিড়াল সেদ্ধ করার আর গরুর নাড়িভুঁড়ি বের করার মহাদেশ হয়ে রইল। তিনি বললেন,  ‘আমার শৈশবে আমার মনে আছে “ব্ল্যাক” ছিল একটি অপমানজনক শব্দ। বরং লোকজন কালোর বদলে “কালার্ড” শুনতে পছন্দ করত; “আফ্রিকান” বলাটা ছিল অপমানজনক। পরিস্থিতি গায়ানাতে একটু ভিন্ন ছিল, সেখানে “আফ্রিকান” শব্দটি ব্যবহৃত হতো, কিন্তু “নিগ্রো” ছিল অপমানজনক শব্দ। আর এখন কালো খুব জনপ্রিয় এবং কবুল করে নেওয়া শব্দ।’

কিন্তু সেই কালো আফ্রিকার ভবিষ্যৎ কি?  নাইপল জবাব দিলেন, ‘আফ্রিকার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

হেনরি জেমস সম্পর্কে নাইপল বলছেন, ‘হেনরি জেমস পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে লেখক! লেখক যদি বৈরিতা সৃষ্টি করতে না পারেন তিনি মৃত।’ এ কারণেই কিনা তিনি ক্রমাগত বৈরিতা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তিনি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো বিশ্ববরেণ্য কথাশিল্পী সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি জানতেন না কোথায় আছেন, তিনি আমেরিকান হওয়া নিয়েই বড় ব্যস্ত ছিলেন।’ তার এই মন্তব্য বিপুলসংখ্যক সাহিত্যামোদীকে ক্ষুব্ধ করে।

১৯৮৬ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ওলে সোয়েঙ্কা সম্পর্কে নাইপল বলেছেন, ‘তিনি কিছু লিখেছেন নাকি?’ তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়াটা নোবেল কমিটির ‘অনেক উঁচু স্থান থেকে সাহিত্যের ওপর মূত্রপাত করার মতো ব্যাপার’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। ই এম ফস্টারকে নাইপল যৌনদানব বানিয়েছেন। বলেছেন, ‘ভারতে অবশ্যই ফস্টারের নিজের ধান্ধা ছিল। তিনি ছিলেন সমকামী আর ভারতে তার হাতে সময়ও ছিল। তিনি চিনতেন রাজভবন, কিছু মধ্যবিত্ত, আর মোহিত করার মতো কিছু বাগানবালক।’  নাইপল টমাস হার্ডি সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি একজন অসহ্য লেখক, তিনি লিখতে জানেন না, একটা প্যারাগ্রাফ কীভাবে তৈরি করতে হয়, তাও জানেন না। তার লেখা রোমান্টিক মেয়েলি কাহিনির মতো।’

নাইপলের ভাষ্য, নারী লেখকদের মধ্যে কেউই তার সমকক্ষ নন। জেন অস্টেন তো ননই। তিনি জেন অস্টিনের ‘আবেগময় উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ এবং ‘পৃথিবী সম্পর্কে আবেগময় অনুভূতি’র অংশীদার হতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, নারী লেখকরা ভিন্ন ধরনের- ‘আমি যখন কোনো লেখা পড়ি- এক দুই অনুচ্ছেদ পড়ার পরই আমি বুঝতে পারি তা নারীর লেখা না পুরুষের।’  তিনি মনে করেন, নারীর আবেগময় সংকীর্ণ দৃষ্টি তাকে গৃহের প্রভুতে পরিণত করতে পারে না। সেটা তার লেখাতেও প্রতিভাত হয়। ‘আমার প্রকাশক ভদ্রমহিলা চমৎকার রুচিশীল সম্পাদক ছিলেন কিন্তু তিনি যখন লেখক হলেন দেখুন মেয়েলি কি সব যাচ্ছেতাই লিখছেন।’ ভারতীয় নারী লেখকদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তারা মামুলি বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন।’

নিজের লেখা সম্পর্কে

নিজের লেখা সম্পর্কে নাইপলের মূল্যায়ন হলো, ‘আমি যখন আমার নিজের লেখা একটি বাক্য পড়ি, তখন দেখি এটার টিকে থাকার গুণাগুণ আছে। আমি ভাবি এটা বিস্ময়কর। লেখকের জীবনী এবং এমনকি আত্মজীবনী সবসময়ই অসম্পূর্ণতার দোষে দুষ্ট। তবে আমার সম্পর্কে মূল্যবান যা কিছু সব আমার বইগুলোতেই আছে। লেখক যদি বসে বসে কেবল শোষণ আর নিপীড়নের কথাই বলেন, তাদের পক্ষে বেশি কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। লেখকদের উচিত “অসম্মতিকে” প্ররোচিত করা।’

Leave a Reply