মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা | মাদকাসক্তি ও আমাদের যুবসমাজ

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা

ভূমিকা:

মাদকাসক্তি নামক এই ছোট অথচ ভয়ংকর শব্দটি বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের যুবসমাজের জন্য আরো ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিকাল থেকেই মানুষ এই নেশার জালে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই নেশারই নাম মাদকাসক্তি। মাদকদ্রব্য এমন একটী দ্রব্য, যা সেবন করলে একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষে পরিণত হয়ে যেতে পারে এবন তার স্থায়িত্ব যতক্ষন পর্যন্ত ঈঊ দ্রব্যের নেশা দেশের মধ্যে থাকে। তবু মানুষ যুগ যুগ ধরে এই নেশায় আক্রান্ত। এই নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার জীবনে নেমে আসে দুর্দিন এবন নেমে আসে অন্ধকার।

মাদকাসক্তি কী:

বিভিন্ন নেশার দ্রব্য গ্রহণ করে নেশা করার প্রবণতাই মাদকাসক্তি। নেশা ক্ষণিকের জন্য মনের যন্ত্রণা লাঘব করে, সকল বেদনা থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করে, নেশার ফলে বাস্তব চৈতন্যকে অবলুপ্ত করে তাকে নিয়ে যায় এক স্বতন্ত্র জগতে এসব বিশ্বাস থেকেই মাদকাসক্তির বিকাশ। মাদকদ্রব্য  হিসেবে বহু উপকরণ রয়েছে। যেমন ; মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, মারিজুয়ানা, চরস, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি। সাম্প্রতিককালে হিরোয়িনের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, বিষাদ, কৌতুহল এসব থেকেই নেশা গ্রহণের সূত্রপাত ঘটে এবং জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সঙ্গদোষ, কালো টাকার উত্তাপ ও ব্যয়ের অপরিচ্ছন্ন পন্থা যুবসমাজের বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মাদকাসক্তির ক্ষতিকর দিক:

মাদকদ্রব্য গ্রহণের আসক্তি সুপাচীন কাল থেকে প্রচলিত থেকে যুগে যুগে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এক সময় চীন দেশের লোকজন আফিম খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিককালে মাদকাসক্তির প্রভাবে বহুলোকের বিশেষত যুবসমাজের ধ্বংস নেমে আসছে, শুরু হয়েছে এক ভয়াবহ অবক্ষয়ের। বিভিন্ন রকম দৈহিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে দেহের অক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাদকাসক্তির ফলে মানসিক ভারসাম্যহীন্যতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন চেতনা নাশক মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে মানসিক আচ্ছনতা দেহের মাংসপেশির কম্পন ও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ফলে মাদকাসক্তির পরিণাম হিসেবে ব্যক্তিজীবনে আসে ব্যর্থতা এবং জাতীয় জীবনে আসে সর্বনাশ।

মাদকাসক্তির প্রভাব:

সারা বিশ্ব জুড়ে মাদকাশক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক উন্নত দেশে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা জাতির জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। এই সর্বনাশা নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্যের প্রসারের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সর্বনাম নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে তরুণ সমাজের মধ্যে এর সম্প্রসারণের প্রবণতা খুব বেশি। শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তা, বেকারত্বের অভিশাপ, দারিদ্রের গ্রাস এসব কারণে যুবসমাজ ক্রমেই নেশার দিকে ধাবিত হচ্ছে। নেশাগ্রস্তদের নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের কারণে তারা অন্যায় ও অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় নেশাগ্রস্তরা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে তৎপর হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহারের প্রেক্ষিতে এবং ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সহজেই ধারণ করা যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার:

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় আমাদের দেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজ মারাত্মকভাবে মাদকাসক্তির শিকার বাংলাদেশে কী পরিমাণ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হয় এবং কত লোক মাদকাসক্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনো নেই। তবে এদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ ভাগ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে বলে বিশেষজ্ঞ ধারণা। দেশে ৩৫০টি বৈধ গাজার দোকান আছে। দর্শনার রয়েছে সরকার অনুমোদিত একমাত্র মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু এন্ড কোম্পানি। বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেশীয় মদ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ও বিক্রি হয়।

মাদকদ্রব্যের ব্যবহার:

আজকাল  মাদকদ্রব্য বিভিন্নভাবে সেবন বা গ্রহণ করা হয়। এক ধরণের মাদক আছে যা নাকে টানা হয়। আবার কোনো দ্রব্য ধোয়ার সাথে পান করা হয়। কোনটি গিলে খাওয়া হয়। আবার কোনটি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষের মতো মাদক সেবনকারী রয়েছে এবং এর সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও নেশায় আক্রান্ত হছে।

মাদকদ্রব্যের ধরণ বা প্রকার:

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য চালু রয়েছে। মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম ইত্যাদি অনেক প্রাচীনকালের। বর্তমানের হেরোইন, মারিজুয়ানা, এল.এস.ডি, হাসিস, কোকেন, প্যাথিড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি বেশি প্রচলিত। এ পর্যন্ত যেসব মাদকদ্রব্যের কথা জানা গেছে তার মধ্যে নারকাটকসই প্রধান। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে হেরোইন সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চেয়ে এর দাম তুলনামূলক বেশি এবং নেশায় আক্রান্ত করে গভীরভাবে।

মাদক সেবনের কারণ:

সাময়িক জীবনের প্রতি বিমুখতা ও নেতিবাচক মনোভাব থেকেই মাদকাসক্তির জন্ম। অভ্যাস থেকে আসক্তি, ধূমপান একদিন পরিণত হয়। হেরোইন আসক্তিতে ধনতান্ত্রিক সমাজে ও অর্থনীতিতে ব্যক্তির ভোগের উপকরণ অবাধ ও প্রচুর। বর্তমানে সিনেমা ও টেলিভিশনে যেসব অশ্লীল নৃত্য, ছবি, কাহিনী ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে সেসব অনুকরণ করতে গিয়ে তরুণ সমাজ তাদের নৈতিক অধঃপতন ডেকে আনছে। তাছাড়া আবার অনেকসময় অস্থিরতা, কুচিন্তা, অভাব অনটন, পারিবারিক কলহের কারণে তরুণ সমাজ এই মোহের জালে আচ্ছন্ন হয়।

মাদকের উৎসভূমি:

গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড), গোল্ডেণ ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান)। গোল্ডেন ওয়েজ হেরোইনের মূল উৎস। মাদকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো আফিম। পপি ফুলের নির্যাস থেলে কৃষকরা তৈরি করেন কাচা আফিম। তা থেকে হয় মারফিন বেস। আফিম থেকেই তৈরি হয় সর্বনাশা হেরোইন। প্রাপ্ত তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, জ্যামাইকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ের, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হয়। হাশিস উৎপন্ন করার জন্য জ্যামাইকা, মরক্কো, জর্দান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত ও নেপাল সমধিক পরিচিত।

মাদকদ্রব্য চোরাচালান:

মাদকাসক্তির ব্যক্তিগত দিক ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবসায়িক দিক আছে যা বিশাল অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য সাধারণত পাকিস্তান ও ভারত থেকে পাচার হয়ে যায় পশ্চিমে ইউরোপে। বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেন, পসচিম জার্মানি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করা হয় চোরাচালানের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের মাঝামাঝি হওয়ার ফলে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া :

মাদকের ভয়াবহ বিসার গোটা বিশ্বের জন্যে আজ উদ্বেগজনক। আজ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনে এটা এক নম্বর সমস্যা। প্রায় ৪ কোটি আমেরিকান নর-নারী কোকেন সেবন করে, কমপক্ষে ২ কোটি মারিজুয়ানা সেবন করে। ১২ লক্ষ হেরোইনসেবী। এই অবস্থা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতেও রয়েছে। কিন্তু সমস্যা এখন শুধু ইউরোপ আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অশুভ ছায়া এশিয়া-আফ্রিকার দেশে দেশে ইতোমধ্যেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

See also  (৫টি রচনা) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার রচনা

পরিণাম:

এদের খপ্পরে পড়ে নেশাগ্রস্ত দিকভ্রান্ত আমাদের তরুণ সমাজ। তারা হয়ে উঠে এদের বাহন ও পসচিমের গিনিপিগ। একজন তরুণের স্বপ্নভরা কৈশোরের ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো ভাঙছে দিন-রাত তার পাশে অরাজকতা বৈষম্য-শোষন। বর্তমানে তরুণরা আস্থা হারাচ্ছে জীবনে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস থাকছে না, আর্থিক কাঠামো এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসেরও শ্রদ্ধা নেই। ব্যবসায়িক স্বার্থে হেরোইন আসছে নানা পথে নানা মাধ্যমে ব্যবহার করছে স্বপ্নভাঙা মেরুদন্ডহীন যুবক সমাজ। মধ্যবিত্ত ও সচেতন সমাজই নেশার শিকার, এদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে আসমান জমিন তফাত। পরিণতি, উর্বরা মেধার অপমৃত্যু, উজ্জ্বল পরমায়ুর অবক্ষয়।

বিশ্বজুড়ে মাদক-বিরোধী আন্দোলন বনাম বাংলাদেশ:

বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম মাদকপ্রতিরোধ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে বিশ্বর ২৩টি রাষ্ট্র মাদক প্রতিরোধ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগদান করে। মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ইরানে ৩১ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে ঢাকার তেজগাওয়ে স্থাপিত মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র কাজ করছে। খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আরও তিনটি মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের কারণ:

সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক শান্তিলাভের আশা থেকেই এই মারাত্মক নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থা উৎকট অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসায়ের পথ। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়া চক্র। মাদকের ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও হীনস্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধ চিন্তা:

বিশ্বজুড়ে যে মাদকবিষ ছড়িয়ে পড়েছে তার থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশে দেশে নানা সংস্থা ও সংগঠণ মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যম মাদকবিরোধী জনমত গঠণে সক্রিয় হয়েছে।

সমাজের নেতাদের কর্তব্য:

মাদকদ্রব্যের প্রচার ও প্রসার রোধে সমাজের নেতারা নিজ নিজ স্থান থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন। কোনো এলাকার নেতা বা সর্দার যদি মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন, তবে সে এলাকায় মাদকের অবাধ ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে।

আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা:

সবচ্যে গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারের। কেননা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই সরকারের প্রধান দ্বায়িত্ব। শক্ত হাতে মাদকাসক্তির মতো অন্যতম অপরাধ দমন করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তব্য:

বিশ্বের সকল দেশের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। এর উৎপাদন, বিপনন ও পাচার রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে সচেতন হতে হবে। তাহলে এ ব্যবস্থার উত্তোরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এজন্য সকল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সজাগ থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

প্রতিকার:

মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম থেকে বর্তমান সময় ও মানুষকে বাঁচাতে হলে এই ভয়াল ব্যাধির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে মাদকাসক্ত করে।, তরুণদের কর্মসংস্থান করলে তারা কর্মময় জীবনযাপন করবে। শিক্ষার যথার্থ প্রসার ঘটলে, মানুষের নৈতিক জ্ঞান অর্জিত হলে নেশাগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, মাদকাসক্তদের যেমন নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা জরুরি তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মাদকব্যবসায়ীদের আইনানুকভাবে শাস্তি দেওয়া।  বাংলাদেশে কোনো মাদক ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারীর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে এমন তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

উপসংহার:

মাদকের ব্যবহার এখন জাতীয় সমস্যারূপেই বিবেচিত হচ্ছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, ক্ষমতালোভী, রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এরা প্রত্যেকেই এই ভয়াবহ অবস্থার জন দায়ী। সবাই মিলে সংগঠিতভাবে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বজার রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমরা সেইদিন মাদকবিরোধী আন্দোলনে সফল হবো যেদিন সকলে মিলে সুস্থ জীবনবোধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে গেয়ে উঠতে পারব জোড়ালো মাদকবিরোধী সংগীত-
“প্যাথিড্রিন, হেরোইন, নেশার আস্তানা,দুমড়ে মুচড়ে দিতে ধরো হাতখানাচলো প্রতিরোধ গড়ে তুলি প্রতিবিশ্বের প্রান্তর জুড়েমরণ আসে যদি তবু  পিছু ফেরোনা।”

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা ২

ভূমিকা: একদিন এ. বাংলা ছিল শিল্প সংস্কৃতির মিলনস্থল। কিশাের-যুবকের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসে এ শ্যামল বাংলা আন্দোলিত হতাে। সেদিন সবার স্বপ্ন ছিল বাংলা হবে সােনার বাংলা। কিন্তু সেই চির চেনা বাংলা মা আজ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তার ধমনীর শােণিত ধারায় আজ প্রবেশ করেছে মৃত্যুকুটিল কাল নাগিনীর বিষ। এ বিষ ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা মায়ের সব প্রান্তরে । এ বিষের নাম মাদক।এর শিকার হয়ে হাজার হাজার বঙ্গসন্তান আজ নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছে। দিন যত যাচ্ছে এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এখনই দরকার সম্মিলিত প্রয়াস, মাদক মুক্ত সমাজ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার।

মাদকাসক্তি কী: মাদকাসক্তি হচ্ছে এমন কত গুলাে দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবহার যা গ্রহণ করলে মানুষের স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন সাধিত হয় এবং এসব দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি নেশা ও আকর্ষণ উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ: বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য এদেশে পাওয়া যায়। প্রচলিত মাদকদ্রব্যসমূহ হলাে : ইয়াবা, হেরােইন, প্যাথিড্রিন, মরফিন, আফিম, ক্যানাবিস, কোকেন, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ভাং, চরস, হাসিস, ফেনসিডিল ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য দুভাগে বিভক্ত। যথা : প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক ।ক) প্রাকৃতিক : প্রাকৃতিক উপায়ে যেসব মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় তা-ই প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য। তাড়ি, আফিম, গাঁজা, ভাং, চরস, হাসিস, মারিজুয়ানা ইত্যাদি এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

খ) রাসায়নিক : পরীক্ষাগারে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় তা রাসায়নিক মাদকদ্রব্য। এগুলাে প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপন্ন মাদকদ্রব্যের চেয়ে বেশি নেশা সৃষ্টিকারী ও ক্ষতিকর। যেমন : হেরােইন, মরফিন, কোকেন, সঞ্জীবনী সুরা ও বিভিন্ন প্রকার অ্যালকোহল।

মাদক দ্রব্যের উৎস: হেরােইনের মূল উৎস আফিম, আর আফিম পাওয়া যায় পপি উৎপাদনের মাধ্যমে। গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গােল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গােল্ডেন ওয়েজ এ তিন স্থানে পপি উৎপাদিত হয়। গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের পরিধি থাইল্যান্ড, বার্মা ও লাওস। প্রাপ্ত তথ্য মতে যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বাে, গুয়েতেমালা, জ্যামাইকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডসহ ১১টি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হচ্ছে। কলম্বিয়া, পেরু, ব্রাজিল, বলিভিয়ায় কোকেন উৎপন্ন হচ্ছে।

বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার: বিশ্বের শতাধিক দেশের ৫০/৬০ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত বলে WHO- এর রিপাের্টে প্রকাশ। মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত বিপদজ্জনক।

মাদকাসক্তির কারণ: আমাদের দেশে নিম্নলিখিত কারণে মাদকাসক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে :

ক) বেকারত্ব, হতাশা ও বন্ধু-বান্ধবের প্ররােচনা।

See also  (৫টি রচনা) বসন্তকাল রচনা | বসন্তের প্রকৃতি রচনা

খ) ধর্মীয় অজ্ঞতা ও ভ্রান্ত দর্শন।

গ) মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা।

ঘ) পিতামাতার অতিমাত্রায় শাসন।

ঙ) অপসংস্কৃতি ও নােংরা পরিবেশ।

চ) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের দ্বন্দ্ব।

ছ) চিত্তবিনােদনের সুযােগ সুবিধার অভাব।

মাদকাসক্তি ক্ষতিকর প্রভাব : সমাজে মাদকদ্রব্য ব্যবহারের প্রভাব বিভিন্নরূপে দেখা দেয়। যথা :

ক) আত্মগত বহিঃপ্রকাশ: মাদকদ্রব্য ব্যবহারের প্রভাবে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে তার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এভাবে একটি অস্তিত্বের বিনাশ ঘটে।

খ) মেয়াদি প্রতিক্রিয়া : মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে ক্ষুধা ও যৌন অনুভূতি দ্রুত কমে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। উগ্র মেজাজ, রাগান্বিত ভাব, নিদ্রাহীনতা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি ক্ষণস্থায়ী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মাদকাসক্ত মেয়েদের সন্তানের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।মাদকাসক্তির পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া : মাদকাসক্ত ব্যক্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব ব্যাপক। সে তার নেশার উপকরণের অর্থ যােগাড় করতে গিয়ে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। মাদকদ্রব্য ক্রয়ের জন্য চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিতে লিপ্ত হয়ে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। এছাড়া শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, মাফিয়াচক্র, আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীর দৌরাত্ম বৃদ্ধি পায়। বর্তমান বিশ্বের বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এ মাফিয়া চক্রের করতলগত।

মাদক নিয়ন্ত্রণের উপায় : মাদকদ্রব্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ বর্তমান বিশ্বে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এজন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে :

ক) মাদকদ্রব্য আমদানি রোধ: স্থল, নৌ ও বিমানপথে পাহারা জোরদার করতে হবে, যাতে মাদকদ্রব্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে।

খ) প্রস্তুতকারক ও সরবরাহকারীদের করণীয়: যারা এ গর্হিত কাজে লিপ্ত তাদেরকে দেশের জনগণের কল্যাণের দিকটি চিন্তা করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

গ) পারিবারিক কর্তব্য : প্রত্যেক পরিবার প্রধানের উচিত নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দান করা এবং এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

ঘ) সরকারি উদ্যোগ: মাদক ব্যবসার লাইসেন্স বাতিলসহ সব ধরনের কাজে সরকারি ভূমিকা থাকবে অগ্রগণ্য।

ঙ) আইন প্রণয়ন ও প্রয়ােগকারী সংস্থার ভূমিকা : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়ােগকারী সংস্থার। দেশে আইন- শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধপ্রবণতা দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ সংস্থাদ্বয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । সর্বাগ্রে মাদকাসক্তির মতাে এত বৃহৎ অপরাধ দমনে এ সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

চ) গণমাধ্যম: রেডিও, টিভি, সিনেমা, পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন প্রােগ্রাম প্রচার করে এর সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।

মাদকাসক্তির প্রতিকার ও বাংলাদেশ: মাদকাসক্তির প্রতিকার আন্দোলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক। আধূনিক (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) এর প্রভাবে মাদকবিরােধী প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং পত্র-পত্রিকায় মাদক বিরােধী প্রচারণা চলছে। টিভি, রেডিওতে মাদকাসক্তির ভয়ানক পরিণাম প্রচার করে নাটক প্রচার করা হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে Narcotics Control Act-1990 চালু আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশও ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের পাচার, অপব্যবহার-বিরােধী দিবস হিসেবে পালন করে। ১৯৯১ সালের ২২ জানুয়ারি SAARC Convention on Narcotics Drugs and Echotrohic Sutestance -এর অনুমােদন প্রদান করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তিও সম্পাদন করেছে।

উপসংহার : মাদকাসক্তি আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। এর ছােবলে হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশে এর প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। এটি প্রতিরােধে এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে এদেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ মাদকের অতল গর্ভে হারিয়ে যাবে। আজকে আমাদের মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার শপথ নিতে হবে।

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা ৩

ভূমিকা : বর্তমান বাংলাদেশের একটি অন্যতম সমস্যা হলাে মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তির মর্মভেদী যন্ত্রণা, মর্মস্পর্শী ক্রন্দন শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের অনেক দেশেই অনুভূত হচ্ছে। আর এর বিষাক্ত ছােবলে যুবসমাজ ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। পরিণতি ভয়াবহ জানা সত্ত্বেও যেন স্বেচ্ছায়ই মানুষ এ মাদকের সাগরে অবগাহন করছে। রবিঠাকুরের সেই চরণ তাই এসব সচেতন মাদকপ্রেমীদের সাথে পুরােপুরি মিলে যায়- “আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান। মাদকের এ উন্মাদ নেশাই সমাজে সৃষ্টি করে মাদকাসক্তির মতাে মারাত্মক সমস্যা।

মাদকাসক্তি : মাদকাসক্তি শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায় ‘মাদক’ ও ‘আসক্তি। মাদক হলাে নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য আর আসক্তি বলতে বােঝায় কোনাে কিছুর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত টান বা আকর্ষণ। মাদকদ্রব্য সেবনে মানবদেহে সংবেদন হ্রাস পায় এবং বেদনাবােধ বন্ধ হয়ে যায়। মাদকদ্রব্য একবার সেবন করা শুরু করলে তা আর সহজে ছাড়া যায় না। এর পরিণামে ব্যক্তি প্রাঙ্গনয়ত মারফ ” করতে থাকে এবং হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত।
মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ : বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য রয়েছে। সেগুলাের মধ্যে ভাং, গাজা, মদ ও আফিম প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা নেশার সামগ্রী। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মাদকদ্রব্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক মাদকদ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে— হেরােইন, মারিজুয়ানা, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, পপি, হাসিস ও মফিন। মাদকদ্রব্যগুলাে আবার বিিভন্ন দিক থেকে ভাগ করা হয়।

যেমন-ধূমপান জাতীয় : গাঁজা বা ক্যানাবিস, মারিজুয়ানা, হাশিশ বা চরস, ভাং, আফিম ও হেরােইন। তরল জাতীয় : ফেনসিডিল, বাংলা মদ, তাড়ি, হুইস্কি, ব্রান্ডি, ভদকা ইত্যাদি। ইনজেকশন জাতীয় : পেথিডিন, মরফিন, কোডিন, টিউজেসিক, মনােজেসিক, বুনােজেসিক, টনােজেসিক, কোকেন ও হেরােইন। ট্যাবলেট জাতীয় : ইয়াবা বা স্পিড, ডব্লিউ ওয়াই, ক্যানবিনল, কোডিন, ডন, এমফিটামিন ।

বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ট্যাবলেট : যেমন- ডায়াজিপাম, ভ্যালিয়াম, রিলাক্সেন, সেডিল, লােরাজিপাম, অ্যাটিভান, ক্লোরাজায়াজিপােক্সাইড বা লিব্রিয়াম ইত্যাদি।

মাদকদ্রব্যের উৎস : সারাবিশ্বে বেশ কয়েকটি মাদক উৎপাদনকারী বলয় রয়েছে। তন্মধ্যে গােল্ডেন ক্রিসেন্ট, গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এবং গােল্ডেন ওয়েজ অন্যতম। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক এবং এর আশপাশের অঞ্চলগুলাে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘গােল্ডেন ক্রিসেন্ট’ । গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ গড়ে উঠেছে লাওস, থাইল্যান্ড এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলাে। আর এ দুয়ের মধ্যবর্তী এলাকাগুলাে নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গােল্ডেন ওয়েজ’ নামক অঞ্চলটি। এসব এলাকায় প্রচুর আফিম, গাঁজা, পপি ও কোকেন উৎপন্ন হয়। তাছাড়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া, মেক্সিকো, পেরু, প্যারাগুয়ে, নিকারাগুয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে মাদক উৎপাদন এবং মাদক ব্যবসার বিশাল নেটওয়ার্ক।

মাদকাসক্তির কারণ : বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযােগ্য অংশ মাদকাসক্ত, যা দেশ ও জাতির কল অস্বস্তিকর। বর্তমান বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করা না গেলেও বিভিন্ন বেসরকারি সংসার ভ = এ সংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক মনে করা হয়। এদের শতকরা ১০ ভাগ অর্থাৎ ৫ লক্ষই হেরােইন আসক্ত, যাদের বয়স ১৫ থেকে বছরের মধ্যে। এ সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিশ্বে মাদকাসক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে শতকরা ১ ভাগ সম্পন্ন বাংলাদেশে এ বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ। এর প্রধান কারণ মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় এসব মাদক। বর্তমানে ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে অত্যন্ত দামি মাদক ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবহার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবা ট্যাবলেট এবং এসবের আমদানিকারক, বিক্রেতা ও ব্যবহারকারী ধরাও পড়ছে। ইয়াবার এই ব্যাপকতা দেখে দেশবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তবে মাদকাসক্তি বৃদ্ধির প্রধান কারণ সহজলভ্যতা হলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। বেকারত্ব, জীবনে হতাশা, সঙ্গদোষ, সন্তানের প্রতি পিতামাতার অমনােযােগিতা বা ঔদাসীন্য, পিতার কালাে টাকার প্রাচুর্য, ক্ষেত্র বিশেষে পিতামাতার উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপন, নীতি-নৈতিকতাহীন রাজনীতির দুবৃত্তায়ন, চাঁদাবাজি ও গডফাদার সংস্কৃতি। আবার যেকোনােভাবে রাতারাতি ধনবান হওয়ার উন্মত্ত আকাক্ষার ফলেও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং সংগত কারণেই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেখান থেকে ফিরে আসার ইচ্ছা থাকলেও আর ফিরে আসতে পারে না। আবার অনেকে সামাজিক বৈষম্য, অবিচার, স্বার্থপরতার নগ্ন বাস্তবতায় জীবনের কাছ থেকে পলায়নপর হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা, হতাশা এবং গভীর নিরাশা। ফলে তারা বাস্তবের মুখােমুখি দাঁড়াতে পারে না। মুক্তির স্বাদ খোজে হেরােইন, কোকেন কিংবা ফেনসিডিলের বােতলে । আর মুক্তি মেলে জীবনের বিনিময়ে।

See also  (৫টি রচনা) একটি ঝড়ের রাত রচনা / একটি ঝড়ের অভিজ্ঞতা রচনা

মাদকাসক্তির কুফল : মাদকাসক্তির কুফল বহুমুখী। শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ক্ষতির পাশাপাশি এর গভীর প্রভাব আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি সবকিছুর ওপরই পড়ে। অত্যন্ত উচ্চমূল্যে মাদকদ্রব্য ক্রয় করে মাদকাসক্ত ব্যক্তি সংসার, সমাজ এবং দেশের। অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অর্থের অভাবে সে অন্যায়-দুর্নীতির পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করে না। বস্তুত, মাদকাসক্তির কারণে দেশের তরুণ সমাজ তিলে তিলে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় এবং দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অগ্রগতি সবকিছু মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে ।

মাদকাসক্তির পরিণাম : মাদকাসক্তির পরিণাম নিশ্চিত মৃত্যু। তবে সেই মৃত্যুর পথে রয়েছে অসহ্য নারকীয় যন্ত্রণার ভয়াবহতা। সেই মৃত্যু সহজ নয়। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে মস্তিস্কের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে তিলে তিলে মাদকদ্রব্য সেবনকারীর স্মৃতিশক্তি লােপ পেয়ে সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র অসুস্থ হয়ে পড়ে । কর্মক্ষমতা লােপ পেয়ে মানুষ পরিণত হয় জড় মাংসপিণ্ডে। জীবন্ত অবস্থায় কিছুকাল বেঁচে থেকে একসময় অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বিশ্বব্যাপী মাদকবিরােধী তৎপরতা : অবৈধ মাদক কারবারিদের প্রতিরােধকল্পে সারাবিশ্বে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আন্দোলন। ১৯৮৭ সালে ২৩টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মাদকবিরােধী আন্দোলনে অংশ নেয়। পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান প্রভৃতি দেশে মাদক চোরাচালানের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ব্রাজিল ও কলম্বিয়ায় মাদক উৎপাদক ও চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশেও ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ নামে একটি বিভাগ কাজ করছে।

মাদকাসক্তর প্রতিকার বা প্রতিরােধের উপায় : আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে প্রথমে নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং অপরকেও সচেতন করতে হবে। সচেতনতার মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভয়ংকর এইসব মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাদক পাচার ও বিস্তার রােধে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়ােজনে সরকারের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়ােগ করে মাফিয়াদের দমন করতে হবে। এর পাশাপাশি মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তি এক ধরনের মনােদৈহিক রােগ। উপযুক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। এ ব্যাপারে পিতা-মাতাসহ নিকটস্থ। অন্যান্য অভিভাবকের সচেতনতা ও উদ্যোগ খুবই জরুরি। সন্তানকে মাদক থেকে দূরে রাখতে এবং মাদকাসক্ত সন্তানকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সচেতন পিতা-মাতা অর্থাৎ অভিভাবকদের ভূমিকা মুখ্য ।এক্ষেত্রে অন্যরা সহায়তা করতে পারে মাত্র। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তরা আমাদেরই আপনজন। এদের ঘৃণা কিংবা তাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে না দিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিতে হবে এবং প্রয়ােজনে সহায়তা করতে হবে। ব্যক্তিজীবনে মাদক গ্রহণ তাে নয়ই বরং একে ঘৃণা করতে হবে এবং প্রতিরােধ করার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে স্লোগান তুলতে হবে মাদক ভয়ংকর, একে প্রতিরােধ। করুন।

আরও পড়তে পারেন:  Top Ten Motivational Speaker Biography || বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০জন মোটিভেশনাল স্পিকারের জীবনী

ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবােধ বজায় রেখে পড়াশুনা, খেলাধুলা ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকা কল্যাণকর। পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ় মনোেবলসহ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কঠোর পরিশ্রম, সাধনা, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস একজন মানুষকে তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। তাই ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’- এই চিরন্তন সত্য প্রবাদটি সর্বাবস্থায় মেনে চলতে হবে। মাদক, এইডস, সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে জাতিকে সর্বতােভাবে রক্ষা করতে হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে জরিপ চালিয়ে মাদকাসক্তদের চিহ্নিত করে এদের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস আক্রান্তদের শনাক্ত করতে হবে। সরকার ও এনজিওগুলাের সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে এদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। দরিদ্র মাদকাসক্তদের ঋণ দিয়ে ব্যবসায় কিংবা কর্মসংস্থানের সুযােগ করে দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া শনাক্তকৃত এইচআইভি/এইডস আক্রান্তদের অবাধ মেলামেশার সুযােগ না দিয়ে তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এদের প্রতি ঘৃণা তাচ্ছিল্য প্রদর্শন নয়, মানবিক আচরণ করতে হবে। দেশে। বেকারত্ব দূর করাসহ দারিদ্র্য বিমােচন করতে হবে। ব্যাপক শিল্পায়ন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোটি কোটি কালাে, টাকা বাজেয়াপ্ত করাসহ সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি রােধ করে মানুষে মানুষে সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাসহ শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব অধিকাংশই সরকারকে বহন করে ছাত্র সমাজকে শিক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে। কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত বেকারদেরকে বেকার ভাতা দিতে হবে। তবেই একটি মাদক মুক্ত, সুস্থ-সুন্দর যুবসমাজ ও উন্নত জাতি আশা করা যায়।

উপসংহার : সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনে মাদকাসক্তির বিলােপ সাধন করা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয় । কিন্তু ব্যক্তিগত বা কয়েকজনের সম্বিলিত উদ্যোগে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সামাজিক প্রতিরােধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে এ সমস্যাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তবেই দেশ ও জাতি এ সর্বনাশা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে।

আজকে আপনাদের কে মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা দেওয়া হয়েছে আশা করি আপনাদের অনেক উপকার হয়েছে।

Leave a Reply