মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – লিও টলস্টয়

এক মুচি তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে একজন চাষীর বাড়ির এককোণে পড়ে থাকত। তার নিজের ঘর বাড়ি জমি-জমা কিছুই ছিল না। মুচির কাজ করেই সে তার সংসার চালাত।তখন রুটির দাম ছিল চড়া, আর মজুরি ছিল কম; কাজেই রুজি-রোজগার যা হত দেখতে না-দেখতেই তা যেত ফুরিয়ে।মুচি আর তার স্ত্রী একটিমাত্র চামড়ার কোট ভাগাভাগি করে গায়ে দিত। সেকোর্টটারও তখন জীর্ণ দশা। তাই সে একটা নতুন কোট বানাবে বলে ভেড়ার চামড়া কিনবার জন্য তৈরি হতে লাগল।শীত পড়বার মুখেই মুচির হাতে বেশকিছু টাকা জমল ; তার স্ত্রীর ট্রাঙ্কে জমল তিন রুবল, আর গায়ের চাষীদের কাছে তার পাওনা হল পাঁচচ রুবল কুড়ি কোপেক। একদিন সকালে মুচি তার বউয়ের সুতির জ্যাকেট পরল শার্টের উপর, তার উপর চড়াল তার গরম কাফতান। তারপর তিন রুবল পকেটে ফেলে বেড়াবার একটা লাঠি কেটে নিয়ে রওনা হল।যেতে যেতে ভাবল : “চাষীদের কাছ থেকে আগে পাঁচচ রুবল আদায় করব, তার সঙ্গে যোগ করব পকেটের তিন রুবল; আর তাই দিয়ে কিনব নতুন কোটের জন্য একটা ভেড়ার চামড়া।” গাঁয়ে পৌঁছে প্রথমে গেল একজন চাষীর বাড়ি। চাষী তখন বাড়ি নেই। তার বউ বলল, “এখন তো কিছু দিতে পারব না, তবে এক হপ্তার মধ্যে টাকা-সমেত আমার স্বামীকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।”

গেল আর-একজন চাষীর কাছে। সে দিব্যি করে বলল, তার হাত একেবারে খালি; তবু জুতো-সারানো বাবদ দেয় কুড়ি কোপেকের ছোটঋণটা কোনোরকমে শোধ করে দেবে। মুচি মনে মনে ভাবল, নাহয় ধারেই ভেড়ার চামড়াটা কেনা যাবে। কিন্তু চামড়ার দোকানির মুখে অন্য কথা। সে বলল, “পুরো টাকাটা দিয়ে পছন্দমতো চামড়া নিয়ে যাও | দেনা শোধ করা যে কী জিনিস সে আমি ভালোই জানি।” সারা সকাল ঘুরে জুতো-সেলাই বাবদ কুড়ি কোপে আর মেরামতের জন্য একজোড়া জুতো হাতে পাওয়া ছাড়া আর কিছুই তার কপালে জুটল না।। মুচির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কুড়ি কোপেক দিয়ে মদ খেয়ে বাড়ির পথ ধরল।

কনে সাজিয়ে কুমিরকে বিয়ে করলেন মেয়র

সকালবেলা থেকেই তার বেশ শীত-শীত করছিল। কিন্তু এখন মদ খাবার পরে গরম কোট ছাড়াই শরীর বেশ গরম লাগছিল। এক হাতে লাঠি দিয়ে পথের বরফের টুকরাগুলোকে ঠুকতে ঠুকতে এবং অন্য হাতে মেরামতির জুতোজোড়ার ফিতে ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে পথ চলতে লাগল মুচি। আর নিজের মনেই বলতে লাগল : “কোট ছাড়াই বেশ তো গরম লাগছে। খেয়েছি তো একটুখানি, তাতেই তো দেখছি শিরার ভিতর যেন খই ফুটছে। তবে আর ভেড়ার চামড়ার দরকারটা কী! অবশ্যি বাড়িতে বউ আছে। সে আবার এই নিয়ে খিটিমিটি করবে। আচ্ছা, এও তো বড় লজ্জার কথা। তুমি একজনের কাজ করে দেবে আর সে তোমাকে কলা দেখাবে। ঠিক আছে, সবুর করো বাছাধন, এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমার টাকা না দিয়ে যাও, তাহলে তোমার মাথার টুপি আমি খুলে নেব। মজা মন্দ নয়! ওই আর একজন কুড়ি কোপেক যেন আমাকে ভিক্ষা দিলেন! কুড়ি কোপেকে কী হবে? দিব্যি গেলে বলল, হাত একেবারে ফাকা। আমিও তো বলতে পারতাম, শুধু কি তোমার হাতই ফাকা?

আমার হাত ফাঁকা নয়? আমার তো যা-কিছু সব এই কাঁধে। তোমার খাবার তুমি ক্ষেতে ফলাও, আর আমাকে তা কিনতে হয়। ফি হপ্তায় তিন রুবলের তো রুটিই কিনতে হয়। তাও আবার কোনোদিন হয়তো বাড়ি ফিরে দেখি রুটি ফুরিয়ে গেছে তখন আবার দেড় রুবলের ধাক্কা। কাজেই আমার যা পাওনা আমাকে দিয়ে দাও।” এমনিধারা ভাবতে ভাবতে মুচি চলছে। রাস্তাটা মোড় ঘুরতেই একটা গির্জা, গির্জার গায়ে একটা শাদমতো কী যেন তার নজরে পড়ল। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভালো করে নজর করেও জিনিশটা যে কী তা সে ঠিক ঠাওর করতে পারল না। ভাবল, “দেখতে অনেকটা যেন মানুষের মতো; তবে সারাটা দেহ কেমন যেন শাদা। তাছাড়া, মানুষ ওখানে করবেই বা কী?” আরও কাছে এগিয়ে সবটা পরিষ্কার দেখতে পেল। কী আশ্চর্য, গির্জার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা মানুষ। মৃতই হোক আর জীবিতই হোক, বসে আছে একেবারে উলঙ্গ আর নিচুপ হয়ে। মুচি ভয়ে শিউরে উঠল। ভাবল, “নিশ্চয় কেউ লোকটাকে খুন করে জামাকাপড় খুলে নিয়ে এখানে ফেলে গেছে। পালাই বাবা, কাজ এসব ঝঞ্চাটে জড়িয়ে !” মুচি লোকটাকে পেরিয়ে গেল। গির্জার অপরদিকে পৌছতেই লোকটাকে আর দেখা গেল । কিন্তু আরও খানিক এগিয়ে পিছন ফিরে চাইতেই দেখে, লোকটা যেন গির্জা থেকে সরে এসে নড়ছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুচি আরও ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, “লোকটা যে কে তাই-বা কে জানে! ভালো হলে এভাবে আসবে কেন। কাছে গেলে যদি লাফিয়ে পড়ে গলা চেপে ধরে, ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া শক্ত হবে। যদি তা নাও করে, সে তো আমার ঘাড়ে চাপবে।

ওরকম একটা ন্যাংটো লোককে নিয়ে করবই বা কী? নিজের গায়ের সামান্য জামা কাপড় তো ওকে খুলে দিতে পারব! ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন।” তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল মুচি। কিছুদূর যেতে-না-যেতেই বিবেক তাকে খোচাতে শুরু করল। “কী করছ তুমি সাইমন? একটা মানুষ মরতে বসেছে, আর তুমি তাকে ভয় পাচ্ছ? তুমি কি এতই ধনী যে টাকা-পয়সা চুরি যাবার ভয় করছ ? ধিক তোমাকে সাইমন, ধিক!” সাইমন মুখ ঘুরিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে চলল। কাছে গিয়ে খুব ভালো করে তাকাল সাইমন। লোকটি যুবক, দেখতে স্বাস্থ্যবান, শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, কিন্তু শীতে যেন জমে যাচ্ছে, যেন খুব ভয় পেয়েছে। কোনোরকমে হেলান দিয়ে বসে আছে, এমনকি সাইমনের দিকেও তাকাচ্ছে না, যেন দুটো চোখ তুলে তাকাবার ক্ষমতাও তার নেই। সাইমন কাছে যেতেই, লোকটা সহসা মাথা ঘুরিয়ে দুইচোখ মেলে সাইমনের দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সাইমনেরও যেন লোকটিকে বড় ভালো লাগল।

বাইক বন্ধের পর টোল আদায় কমেছে পদ্মা সেতুতে

বুটজোড়া মাটিতে রেখে খুলে ফেলল গায়ের কোট।বলল, “কথা পরে বলবে। আগে জামাটা পরে নাও। এক্ষুনি। এই নাও।” লোকটার কনুই ধরে সাইমন তাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করল। সাইমন দেখল, একটি একহারা পরিচ্ছন্ন দেহ, সুডৌল হাত-পা, মিষ্টি একখানি মুখ। মুচি তার কোর্টটা লোকটির গলায় জড়িয়ে দিল, কিন্তু সে ঠিক হাতার মধ্যে তার হাত দুখানি ঢোকাতে পারল না। সাইমন ঠিকমতো হাত ঢুকিয়ে তাকে কোর্টটা পরিয়ে দিয়ে বেল্ট এঁটে দিল। তারপর মাথার টুপিটা খুলে লোকটার মাথায় পরিয়ে দেবার উপক্রম করতেই তার নিজের মাথাটাই বেশ ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। সাইমন ভাবল, “আমার মাথাটা তো টাকে ভরা, আর ওর মাথ–ভরা কোঁকড়া চুল।” তাই সাইমন টুপিটা আবার নিজের মাথায় বসিয়ে দিল। ‘ওকে বরং বুটজোড়া দিই।” সাইমন বসে পড়ে বুটজোড়া তাকে পরিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো ঠিক হয়েছে ভাই, এইবার হাঁটো, শরীরটাকে গরম করে নাও। হাঁটতে পারবে তো?” উঠে দাড়িয়ে লোকটি সাইমনের দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না।

“আরে, কথা বলছ না কেন? নাও, এসো, আর যদি দুর্বল বোধ করো, আমার লাঠিটায় ভর দাও। পা-টা ঝেড়ে নাও একটু।” লোকটি হাঁটতে শুরু করল। অনায়াসেই হাঁটতে লাগল। একটুও পিছিয়ে রইল না।পথে যেতে যেতে সাইমন বলল, “তুমি কোথায় থাকো বলো?” “এ-অঞ্চলে নয়।” “সে তো জানি। এ-অঞ্চলের সব লোককে আমি চিনি। কিন্তু ওই প্রার্থনাঘরের কাছে তুমি। এলে কী করে? “বলতে পারব না।” “কেউ তোমাকে মেরেছিল বলে মনে হচ্ছে?” “কেউ আমাকে মারেনি। ঈশ্বর শাস্তি দিয়েছেন।” “ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন, সে তো সকলেই জানে। তুমি কোথায় যাবে?” “আমার কাছে সব জায়গাই সমান।” সাইমন বিস্মিত হল। লোকটি উদ্ধত নয়, তার কথাগুলো শান্ত, কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিছুই সে বলতে চায় না। সাইমন ভাবল, “কতকিছুই তো আমরা বুঝি না।” তারপর লোকটিকে বলল : “ঠিক আছে, নিজের আস্তানায় যাবার আগে তুমি আমার বাড়িতেই চলো।” সাইমন হাঁটতে লাগল। লোকটিও চলল তার পাশে পাশেই। বাতাস উঠল। বেশ শীত করছে। স্ত্রীর জ্যাকেটটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে ভাবতে লাগল :“ভেড়ার চামড়া আমাকে কোথায় টেনে এনেছে!

বেরিয়েছিলাম ভেড়ার চামড়ার খোঁজে, আর ফিরছি যখন তখন নিজের কোর্টটাও গায়ে নেই, বরং একটা ন্যাংটো লোককে নিয়ে চলেছি সঙ্গে করে। মাত্রোনা আমাকে ছেড়ে কথা কইবে না।” শেষের কথাটা মনে হতেই সাইমন ভীত হয়ে পড়ল। তবু লোকটির দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ে গেল প্রার্থনাঘরের কাছে তার সেই চাউনির কথা। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সাইমনের বউ সকাল-সকাল সব কাজকর্ম শেষ করে ফেলেছে। জ্বালানির কাঠ কেটেছে, জল এনেছে, ছেলেকে খাইয়েছে, নিজেও কিছু একটু মুখে দিয়েছে, তারপর বসে বসে ভাবছে, কখন রুটি বানাবে : আজ না কাল? সে ভাবল, “সাইমন যদি দুপুরের খাবারটা খেয়ে থাকে, রাতে আর বেশি কিছু খাবে না।

 

তাহলে যে-রুটি আছে তা দিয়ে কাল চলে যাবে।” রুটির টুকরোটা ঘোরাতে ঘোরাতে মাত্রোনা ঠিক করল : “আজ আর রুটি বানাচ্ছি না। যা ময়দা আছে তাতে আর-একখানি মাত্র পাউরুটি হবে। সেটা দিয়ে শুক্রবার চালিয়ে দেব।” কটিটা একপাশে সরিয়ে রেখে মাত্রোনা টেবিলে বসে স্বামীর শার্টের ফুটো সেলাই করতে লাগল। সেলাই করতে করতে সে স্বামীর কথাই ভাবছিল; ভাবছিল তার চামড়া কেনার কথা। “চামড়ার দোকানি তাকে না ঠকালে বাচি! লোকটা আবার যা সোজা-সরল ! নিজে সে কাউকে ঠকাবে না, কিন্তু একটা ছোটছেলেও তাকে বোকা বানাতে পারে। আট রুবল তো চাট্টিখানি কথা নয়।

একটা কোটের অভাবে গত শীতে বড়ই কষ্ট গেছে। নদীতে যেতে পারি না, বেরোতে পারি না কোথাও। লোকটা যখন সবকিছু গায়ে চড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, আমার তো গায়ে দেবার কিছুই থাকত না। আজ যদিও খুব সকালে বেরোয়নি, তবু এতক্ষণ তো তার ফিরে আসা উচিত। জানি না আবার কোথাও মজা লুটতে বসেছেন কি না।” মাত্রোনা যখন এইসব ভাবছে তখন সিড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সেলাইয়ের ভিতর সুঁচটা আটকে রেখে মাত্রোনা বাইরে মুখ বাড়াল। আরে! এ যে দুজন বাড়িতে ঢুকছে—সাইমন, আর তার সঙ্গে একটি অপরিচিত মানুষ! মাথায় টুপি নেই, পায়ে ভারী বুট।সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর মুখে ভদকার গন্ধ পেল সে। তাহলে তো মজা লুটেই এসেছেন! তার উপর এতক্ষণে নজরে পড়ল তার গায়ে কোর্টটাও নেই, আছে শুধু তারই জ্যাকেটটা। হাতেও কিছু নেই।মাত্রোনার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। সে ভাবল, এ তো মদ খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে এসেছে। এই বাজে লোকটার সঙ্গে ফুর্তিফার্তা করে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে ওকে।

” মাত্রোনার সামনে দিয়েই তারা ঘরে ঢুকল। ভালো করে সে দেখতে পেল আগন্তুক লোকটিকে। একটি হ্যাংলা চেহারার যুবক, গায়ে তাদেরই কোট, মাথায় টুপি নেই। কোটের নিচে শার্টও নেই। ভিতরে ঢুকে লোকটি সেখানেই দাড়িয়ে রইল, নড়ল না একটুও, চোখ তুলে তাকালও না। মাত্রোনার মনে হল লোকটা নিশ্চয় খারাপ, তাই ভয় পেয়েছে।মাত্রোনা ভুরু কুঁচকে স্টোভের দিকে এগিয়ে গেল। দেখতে লাগল ওরা কী করে।সাইমন টুপি খুলে বেঞ্চিটার উপর বসল, যেন কিছুই হয়নি। বলল, “আরে মাত্রোনা, রাতের খাবারটা বানাও।” মাত্রোনা অস্ফুটভাবে কী যেন বলে সেখানেই দাড়িয়ে রইল। সাইমন বুঝল বউয়ের মেজাজ বিগড়েছে, কিন্তু কিছু তো করবার নেই। আগন্তুকের হাত ধরে সে বলল, “এসো ভাই, এইখানে বস, কিছু খাওয়া যাক।” আগন্তুক সাইমনের পাশের বেঞ্চিটাতে বসল। সাইমন উঠে গিয়ে বউকে বলল, “কী রান্না করেছ বলো দেখি।” মাত্রোনা রাগে ফেটে পড়ল : “রান্না করেছি, কিন্তু তোমার জন্যে নয়। মদ খেয়ে তো বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। গেলে কোট কিনতে; ফিরে এলে নিজের কোটটাও খুইয়ে। আবার একটা ন্যাংটো রাস্তার লোককে ধরে এনেছ সঙ্গে করে। তোমাদের মতো মাতালদের জন্য আমি রান্না করিনি।” “দেখ মাত্রোনা, অকারণে বকবক কোরো না।

 

আগে শোনো লোকটা কেমনশুশুশুশু” “আগে বলো, টাকা কী করেছ।” সাইমন কোটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে নোট বের করে দেখাল। “এই দেখ টাকা। ত্রিফোন্ফ টাকা দেয়নি, কাল দেবে বলেছে।” মাত্রোনার রাগ আরও চড়ে গেল। কোট তো আনেইনি, আবার তাদের একটিমাত্র কোট খয়রাত করেছে একটা ন্যাংটো লোককে। তাকে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে।টেবিলের উপর থেকে টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে রাখতে সে বলল, “কিছু নেই; যত রাজ্যের ন্যাংটো মাতালদের আমি খাওয়াতে পারব না।”

ধর্মীয় পোশাক পরায় ৪২ দেশে হয়রানি, না পরায় ১৯ দেশে

“আহ্ মাত্রোনা, চুপ করো! আগে শোনো লোকটা কে…” “একটা বোকা মাতালের কথা আবার কী শুনব। গেলে চামড়া কিনতে, তাও মদ খেয়ে উড়িয়ে দিলে।” সাইমন বউকে বোঝাতে চাইল যে সে মাত্র কুড়ি কোপেকের মদ খেয়েছে, আর এই লোকটাকে কী অবস্থায় পেয়েছে কিন্তু এক কথা বলবার আগে বউ তাকে দশ-কথা শুনিয়ে দিল।বকবক করতে করতে একসময় মাত্রোনা সাইমনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে জামার আস্তিন চেপে ধরে বলে উঠল, “শিগগির আমার জ্যাকেট দাও! ওটাই তো আমার একমাত্র সম্বল, তাও তুমি নিয়ে নিয়েছ নিজে গায় দেবে বলে। এক্ষুনি ফিরিয়ে দাও, মাতাল, কুকুর কোথাকার! তারপর জাহান্নামে যাও!” সাইমন জ্যাকেটটা খুলতে চেষ্টা করতেই মাত্রোনা সেটা ধরে দিল টান। ফলে তার সেলাই গেল ছিড়ে। সেটাকেই টেনে নিয়ে নিজের মাথায় জড়িয়ে মাত্রোনা দরজার দিকে পা বাড়াল।হঠাৎ সে দাড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল তার। মাত্রোনার মনে হল, রাগ দমন করা দরকার; এ লোকটা কে তাও জানা দরকার।

মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – পর্ব -২ – লিও টলস্টয়

 

মাত্রোনা থামল। বলল :“লোকটা যদি ভালোই হবে তাহলে সে এমন ন্যাংটো কেন, কেন গায়ে দেবার একটা শার্টও জোটেনি। আর তুমি যদি ভালোভাবেই ছিলে সারাদিন তাহলে এই স্যাঙাকে কোথেকে জুটিয়েছ সেকথা এতক্ষণ খুলে বলোনি কেন?”

সাইমন বলল, “বেশ তো, এখুনি সব বলছি। আমি হেঁটে আসছিলাম; দেখি প্রার্থনাঘরের পাশে লোকটি বসে আছে; গায়ে কিছু নেই, শীতে জমে গেছে। ভেবে দেখ, লোকটি একেবারে উলঙ্গ, আর এটা গরমকাল নয়। ঈশ্বরই আমাকে ওর কাছে পাঠিয়েছিলেন, নইলে সে নির্ঘাত মারা যেত। বলো, তখন আমি কী করি? আমি তাকে হাত ধরে তুললাম, জামা-জুতো পরালাম, নিয়ে এলাম এখানে। মনটাকে একটু নরম কর মাত্রোনা; এরকম করা পাপ। মনে রেখোঁ, আমরাও একদিন মরব।”

মাত্রোনা আবার বকুনি দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় আগন্তুকের দিকে তার চোখ পড়ল।আগন্তুক তখনও বেঞ্চির এককোণে চুপ করে বসে আছে। দুখানি হাত রেখেছে হাঁটুর উপর, মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের উপর। চোখ-ভুরু কুঁচকে আছে, যেন ভিতর থেকে কোনোকিছু আঘাত করছে তাকে।মাত্রোনা চুপ করে গেল।সাইমন বলল, “মাত্রোনা, তোমার মধ্যে কি ঈশ্বরের ভয় নেই?”

এই কথা শুনে মাত্রোনা আবার আগন্তুকের দিকে চাইল। সহসা তার মনটা গলে গেল। স্টোভের কাছে গিয়ে সে খাবার তৈরি করল। টেবিলের উপর একটি ছোট বাটি রেখে তাতে কাস ঢালল, রুটির শেষ টুকরোটা এনে দুজনের দিকে এগিয়ে দিল দুটো কাঁটা-চামচ। “এবার খাও”, মাত্রোনা বলল। সাইমন আগন্তুককে ডেকে নিল টেবিলে। “বসো হে ভালো মানুষ।” সাইমন রুটি কেটে খেতে শুরু করল। মাত্রোনা টেবিলের একপাশে দাড়িয়ে দেখতে লাগল আগন্তুককে। বেচারির জন্য এবার দুঃখ হল তার।

সহসা আগন্তুক যেন খুশি হয়ে উঠল। থেমে গেল তার ভুরুর কোঁচকানি। মাত্রোনার দিকে দুচোখ তুলে তাকিয়ে সে হেসে ফেলল।খাওয়া শেষে টেবিল পরিষ্কার করে মাত্রোনা আগন্তুককে জিজ্ঞেস করল :“তুমি কোখেকে আসছ?” “এ-অঞ্চল থেকে নয়।” “রাস্তার ধারে এলে কেমন করে?” “বলতে পারি না।” “তোমার সবকিছু কি কেউ চুরি করেছিল ?” “ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিয়েছেন।” “তাই কি তুমি ন্যাংটো হয়ে সেখানে পড়েছিলে?”

“তাই আমি সেখানে পড়ে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। সাইমন আমাকে দেখতে পেল; দয়া হল তার, কোট খুলে আমাকে পরিয়ে দিল। আসতে বলল এখানে। এখানে এলে তুমি আমাকে খাদ্য দিলে, পানীয় দিলে, আমাকে দয়া করলে। ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।”

মাত্রোনা উঠে দাড়াল। সাইমনের যে শার্টটা সে সেলাই করছিল সেটা জানালার তাক থেকে তুলে নিয়ে আগন্তুককে দিল। খুঁজে পেতে এনে দিল একটা ট্রাউজারও। “তোমার তো শার্ট নেই। এইগুলো পরে ঐ তাকের উপরে বা স্টোভের উপরে যেখানে খুশি শুয়ে পড়ো।” আগন্তুক গায়ের কোটটা খুলে শার্ট ও ট্রাউজার পরে তাকের উপরে শুয়ে পড়ল। মাত্রোনা বাতি নিভিয়ে দিয়ে কোর্টটা নিয়ে স্বামীর পাশে শুল।

তার মনে পড়ল, রুটির শেষ টুকরোটাও তারা খেয়ে ফেলেছে। কালকের জন্য কিছুই নেই। মনে পড়ল, শার্ট আর ট্রাউজার দুটোই সে দান করেছে। অমনি তার মন খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল আগন্তুকের হাসিটি; অমনি মন খুশি হয়ে উঠল আবার।মাত্রোনা অনেকক্ষণ জেগে রইল। একসময় তার খেয়াল হল সাইমনও ঘুমোয়নি।“সাইমন!” “উ ?” “রুটির শেষ টুকরোটাও আমরা খেয়ে ফেলেছি। কালকের জন্য কিছু বানিয়েও রাখিনি। কাল কী হবে আমি জানি না। প্রতিবেশীর কাছে কিছু ধার চাইতে হবে।” “আমরা বেঁচে থাকব; খেতেও পাব।”

বউটি চুপ করে রইল। “যাই হোক, লোকটি নিশ্চয়ই ভালো; তবে, নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলে না এই যা।” “কথা বলার তার দরকার নেই।” “সাইমন!” “উ।” “আমরা তো দিলাম, কিন্তু আমাদের কেউ কিছু দেয় না কেন?” কী জবাব দেবে সাইমন জানে না। সে বলল, “পরে কথা হবে।” সে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে সাইমনের ঘুম ভাঙল। ছেলেমেয়েরা তখনও ঘুমুচ্ছে। বউ গেছে প্রতিবেশীর বাড়ি রুটি ধার করতে। পুরানো ট্রাউজার আর শার্ট পরে আগন্তুক উপরের দিকে তাকিয়ে বেঞ্চিতে বসে আছে। তার মুখখানি আজ কালকের চাইতেও উজ্জ্বল।সাইমন বলল, “দেখ ভাই, পেট চায় খাবার, আর শরীর চায় জামা-কাপড়। প্রত্যেককেই উপার্জন করতে হবে। তুমি কী কাজ জানো?” “আমি কিছুই জানি না।” সাইমন বিস্মিত হয়ে বলল, “ইচ্ছা থাকলে মানুষ সবকিছু শিখতে পারে।”

“মানুষ কাজ করে; আমিও কাজ করব।” “তোমার নাম কী?” “মিখাইল।” “দেখ মিখাইল, নিজের সম্পর্কে তুমি কিছুই বলতে চাও না, সে তোমার খুশি। কিন্তু উপার্জন তো তোমাকে করতেই হবে। আমি যা কাজ দিই তা করবে। তাহলে আমি তোমাকে খেতে দেব।” “ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। নিশ্চয়ই শিখব। বলে দাও কী করতে হবে।”

সাইমন দেখিয়ে দিল কেমন করে সেলাই করতে হয়। মিখাইল বেশ তাড়াতাড়ি সেটা রপ্ত করে নিল। মোটা সুতো দিয়ে কী করে সেলাই করতে হয় মিখাইল শিখে ফেলল তাও।

সাইমন যা-কিছু দেখায় তাই সে শিখে ফেলে। তিনদিনের দিন থেকে সে এমনভাবে সেলাইয়ের কাজ করতে লাগল যেন সারাজীবন সে সেলাই করে আসছে। তার কাজে কখনও ভূল হয় না। সে খায়ও কম। শুধু মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নেয়, আর সেই সময়টা আকাশের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে। কখনও সে ঘর ছেড়ে বাইরে যায় না; একটি বাজে কথা বলে না; হাসিঠাট্টাও করে না।প্রথমদিন সন্ধ্যায় মাত্রোনা যখন তার জন্যে খাবার তৈরি করছিল কেবলমাত্র সেই দিন তারা তাকে একবার হাসতে দেখেছিল।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, ধীরে ধীরে বছরও শেষ হয়ে আসে। এখন মিখাইলের মতো সুন্দর আর মজবুত জুতো আর কেউ সেলাই করতে পারে না। সারা জেলার লোক জুতোর জন্য সাইমনের বাড়ি আসতে লাগল। ফিরে গেল তার বরাত।

একদিন শীতকালে সাইমন বসে মিখাইলের সঙ্গে কাজ করছে, এমন সময় তিন-ঘোড়ার একখানি ঘন্টা বাধা দ্ৰেজগাড়ি তার কুঁড়ের দরজায় এসে দাড়াল। একটি ছোটছেলে কোচয়ানের আসন থেকে লাফ দিয়ে নেমে খুলে দিল গাড়ির দরজা। ফারকোট গায়ে একজন ভদ্রলোক স্লেজ থেকে নেমে সাইমনের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। মাত্রোনা ছুটে গিয়ে খুলে দিল দরজা। মাথা নিচু করে তিনি ঘরে ঢুকলেন। আবার যখন মাথা উঁচু করলেন তখন মাথা প্রায় ছাদ ছোয়-ঘেঁয়। ঘরের একটা কোণই তিনি দখল করে ফেললেন প্রায়।

সাইমন উঠে দাড়িয়ে নমস্কার দিয়ে হাঁ করে ভদ্রলোককে দেখতে লাগল। এরকম মানুষ সে এর আগে কখনও দেখেনি। সাইমন নিজে রোগা, মিখাইলও তাই ; মাত্রোনা তো একগাছি শুকনো লাঠির মতো দেখতে। কিন্তু ইনি—যেন অন্য জগতের লোক; ফোলা ফোলা লাল মুখ, ষাড়ের মতো ঘাড়, ঢালাই লোহা দিয়ে গড়া দেহ।

ভদ্রলোক হাঁপাতে লাগলেন। গায়ের কোট খুলে বেঞ্চিতে বসে বললেন :“বড় মুচি কে?” সাইমন সামনে এগিয়ে বলল :“আজ্ঞে আমি।” ভদ্রলোক চাকরটাকে চেঁচিয়ে বললেন : “এই—ফেড়কা, চামড়াটা নিয়ে আয়।” ছেলেটা দৌড়ে একটা বাডিল নিয়ে এল। ভদ্রলোক বান্ডিলটা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলেন।চামড়াটা দেখিয়ে ভদ্রলোক সাইমনকে বললেন, “দেখ মুচি, বেশ মন দিয়ে শোনো। এটা দেখতে পাচ্ছ?”

“আজ্ঞে যা।” “জিনিশটা কেমন ঠিক বুঝতে পারছ?” সাইমন হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল : “ভালো চামড়া।” “ভালোই বটে! বোকারাম, এমন চামড়া তুমি জীবনে দেখ নি! এটা জার্মানির জিনিশ দাম কুড়ি রুবল।” সাইমন ভয় পেয়ে বলল :“এমন জিনিশ আমরা কোথায় দেখব।” “সে যাহোক। এই চামড়া দিয়ে তুমি আমাকে নতুন জুতো তৈরি করে দিতে পারবে কি?”“আজ্ঞে পারব।”

ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন :“শুধু পারব বললেই হল না। কী জিনিস সেলাই করতে হবে বুঝতে পারছ কি? আমাকে এমন জুতো তৈরি করে দিতে হবে যা একবছরের মধ্যে ছিড়বে না, কুঁচকাবে না, বা সেলাই খুলে যাবে না। যদি পারো, চামড়াটা নিয়ে কাটাকুটি কোরো যদি না পারো নিয়ো না, কেটো না। আমি আগেই বলে রাখছি, একবছরের আগে যদি জুতোর সেলাই ছেড়ে বা জুতো দুমড়ে যায়, আমি তোমাকে জেলে দেব! আর একবছরের মধ্যে যদি না-ঘেঁড়ে বা না কুঁচকে যায়, তাহলে তোমাকে মজুরি দেব দশ রুবল।”

সাইমন ভয় পেয়ে গেল। মিখাইলের দিকে তাকিয়ে তাকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে ফিসফিস্ করে বলল ; “ভাই, কী করি?” মিখাইল মাথা নেড়ে বলল :“কাজটা নিয়ে নিন।” ভদ্রলোক চাকরটাকে চেঁচিয়ে ডেকে বাঁ-পায়ের বুট খুলতে বললেন। তারপর পা-টা বাড়িয়ে দিলেন। “মাপ নাও।”

সাইমন আঠারো ইঞ্চি লম্বা একখানা কাগজ সেলাই করে সেটা বেশ ভালো করে মুছে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর মাপ নিতে আরম্ভ করল। পায়ের তলা মাপল, পাতার উপরটা মাপল, তারপর পায়ের গুলি মাপতে গেল। কিন্তু কাগজটা ততদূর পৌছল না। সেই বিরাট পায়ের গুলিটা একটা গাছের গুঁড়ির মতো।বাইরে তখন অনেক লোক উকিঝুকি মারছে।ভদ্রলোকের নজর পড়ল মিখাইলের উপর।“ও কে ? ও কি তোমার লোক ?” “ও আমার কারিগর। ও-ই তো জুতো সেলাই করবে।”

ভদ্রলোক মিখাইলকে বললেন :“দেখ হে, মনে রেখোঁ এমনভাবে সেলাই করতে হবে যেন একবছরের মধ্যে কিছু না হয়।” সাইমন মিখাইলের দিকে তাকাল। মিখাইল তখন ভদ্রলোকের দিকে না-তাকিয়ে তাঁর পিছনে ঘরের কোণে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে মৃদু হেসে উঠল, আর তার সারাশরীর ঝলমল করে উঠল। “হা করে দেখছ কী বোকারাম? বরং নজর রেখোঁ জুতো যেন ঠিক সময় তৈরি হয়।” মিখাইল বলল : “ঠিক যে-সময়ে দরকার হবে তখনি তৈরি পাবেন।” “তাহলেই হল।”

বুট পায়ে দিয়ে ফারকোট গায়ে দিয়ে ভদ্রলোক দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু মাথা নিচু করতে ভুল হওয়ায় তার মাথাটা লিন্টেলের সঙ্গে ঠোক্কর খেল।কিছুক্ষণ শাপমন্যি করে মাথা ঘষতে ঘষতে ভদ্রলোক স্লেজে চেপে চলে গেলেন।যাবার পর সাইমন বলল “ব্যাটা যেন পাহাড়! মাথায় লেগে দরজাটা জখম হল, কিন্তু ওর কিছুই হল না।”মাত্রোনা বলল : “ওদের যেমন জীবন তাতে শক্তপোক্ত তো হবেই। এরকম লোহার মানুষকে মৃত্যুও ছুঁতে পারে না।”

সাইমন মিখাইলকে বলল : “কাজটা যখন নিয়েছি, দেখোঁ যেন কোনোরকম গোলমালে না পড়ি। চামড়াটা দামি, ভদ্রলোকও বদমেজাজি। দেখতে হবে যাতে কোনো ভুল না হয়। তোমার হাতও এখন আমার হাতের চেয়ে পাকা। মাপজোকগুলো নিয়ে চামড়াটা তুমিই কাটো, আমি বরং উপরের চামড়াটা সেলাই করব।”

সেই কথামতো মিখাইল ভদ্রলোকের চামড়াটা নিয়ে টেবিলের উপরে পাতল। দুই ভাজ করে কাচি নিয়ে শুরু করল কাটতে।ঘরে ঢুকল মাত্রোনা। মিখাইলের চামড়া কাটা দেখে সে অবাক হয়ে গেল। মুচির কাজ মাত্রোনাও ভালো বোঝে। সে দেখল, মিখাইল চামড়াটা বুটের মতো করে না-কেটে গোল-গোল টুকরা করে কাটছে। কিছু বলতে গিয়েও মাত্রোনা ভাবল :“হয়তো ভদ্রলোকদের বুট কেমন করে বানায় আমি জানি না। মিখাইল নিশ্চয় আমার থেকে ভালো জানে।”

কাটা শেষ করে মিখাইল সুতো নিয়ে সেলাই করতে শুরু করল।মাত্রোনা আবারও অবাক, কিন্তু এবারও সে কিছু বলল না। মিখাইল সেলাই করেই চলল।বেলা দুপুর হলে সাইমন উঠে দাড়িয়ে চোখ ফেরাল। এ কী! ভদ্রলোকের চামড়াটা দিয়ে মিখাইল যে একজোড়া চটি তৈরি করে ফেলেছে।সাইমন আর্তনাদ করে উঠল। ভাবল :“আজ একবছর মিখাইল এখানে আছে, কোনোদিন একটা ভুল করেনি, আজ সে এমন মারাত্মক ভুল কেমন করে করল ? ভদ্রলোক অর্ডার দিয়ে গেলেন উচু বুটের, আর ও তৈরি করে বসেছে চটিজুতো! ভদ্রলোককে আমি মুখ দেখাব কেমন করে?

সে মিখাইলকে বলল : “এ তুমি কী করেছ ভাই? ভদ্রলোক যে অর্ডার দিয়ে গেলেন বুটের?” সাইমন সবে কথা বলতে আরম্ভ করেছে, এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল। সাইমন ও মিখাইল জানালা দিয়ে তাকাল। ঘোড়ায় চড়ে একটি লোক এসেছে।তারা দরজা খুলে দিল। সেই ভদ্রলোকের একটি চাকর ঢুকল ভিতরে। “কর্ত্রী আমাকে পাঠালেন সেই বুটের ব্যাপারে।” “বুটের আবার কী হল?” “কী হলই বটে! আমার মনিবের আর বুটের দরকার নেই। তিনি মারা গেছেন।” “বলো কী!”

“এখান থেকে তিনি বাড়ি ফেরেননি, স্লেজের মধ্যেই মারা গেছেন। আমরা যখন বাড়ি পৌছলাম, সকলে তাকে ধরাধরি করে নামাতে এল; কিন্তু তিনি একটা বস্তার মতো গড়িয়ে পড়লেন। তাকে স্রেজ থেকে নামিয়ে আনতে না-আনতেই কর্ত্রী আমাকে ডেকে বললেন : “মুচিকে বলবে, একজন ভদ্রলোক চামড়া জমা দিয়ে একজোড়া বুটের অর্ডার দিয়েছিলেন, সে বুট আর দরকার নেই, বরং যত শীঘ্র সম্ভব সেই চামড়া দিয়ে শবাধারের জন্য একজোড়া চটি যেন তৈরি করে দেয়। যতক্ষণ তৈরি না হয় অপেক্ষা করে চটি নিয়ে তবে আসবে। তাই আমি এসেছি।”

মিখাইল টেবিল থেকে টুকরো চামড়াগুলো নিয়ে গোল পাকাল, তৈরি-চটিজোড়া একসঙ্গে বেঁধে অ্যাপ্রন দিয়ে ভালো করে মুছে সেগুলি দিয়ে দিল ছেলেটাকে। ছেলেটা হাত পেতে চটিজোড়া নিল। “বিদায়, মশায়রা। শুভদিন।”

 

মানুষ কী নিয়ে বাঁচে – শেষ -পর্ব– লিও টলস্টয়

 

আরও একবছর কেটে গেল। এখন সাইমনের বাড়িতে দুবছর পূর্ণ হল মিখাইলের। সে ঠিক আগের মতোই আছে। কখনও কোথাও যায় না, একটা বাজে কথা বলে না। এতদিনের মধ্যে মাত্র দুবার হেসেছে : একবার, যখন স্ত্রীলোকটি তার জন্য রাতের খাবার তৈরি করেছিল, দ্বিতীয়বার সেই ভদ্রলোককে দেখে। লোকটিকে নিয়ে সাইমনেরও খুশির সীমা নেই। কোথা থেকে সে এসেছে, সে আর জিজ্ঞেস করে না। তার একমাত্র ভয়, পাছে মিখাইল চলে যায়। একদিন, দুজনই বাড়িতে। মুচির বউ উনুনে পাত্র চাপাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা বেঞ্চির পাশে।

দৌড়োদৌড়ি করছে আর জানালা দিয়ে দেখছে মাঝেমাঝে। একটা জানালার পাশে বসে সাইমন সেলাই করছে। আরেকটা জানালার পাশে বসে মিখাইল জুতোর গোড়ালিতে কাঁটা মারছে।সাইমনের ছোটছেলে দৌড়ে এসে মিখাইলের ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে জানালা দিয়ে তাকাল। “মিখাইলকাকা, দেখ, ছোট-ছোট মেয়েদের নিয়ে একজন বণিকের স্ত্রী এই দিকেই আসছে। একটি ছোটমেয়ে আবার খোড়া।”সঙ্গে সঙ্গে মিখাইল হাতের কাজ রেখে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। সাইমন অবাক হয়ে গেল। এর আগে মিখাইল তো কখনও রাস্তার দিকে তাকায়নি! অথচ এখন সে কী যেন দেখবার জন্য জানালার একেবারে ধার ঘেঁষে বসেছে। সাইমনও জানালা দিয়ে তাকাল। দেখল, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা একটি স্ত্রীলোক তার বাড়ির দিকেই আসছে। দুটি মেয়েকে সে হাত ধরে নিয়ে আসছে। দুটি মেয়ে দেখতে একেবারে একরকম। দুজনেরই ফারকোট আর গরম স্কার্ফ গায়ে। দুজনকে আলাদা করাই মুশকিল, শুধু একজনের পা একটু বাকা, সে খুঁড়িয়ে হাঁটে। স্ত্রীলোকটি সিড়ি বেয়ে উঠে হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল এবং মেয়েদুটিকে সামনে রেখে ঘরের ভিতরে পা দিল।

“নমস্কার।”

“আসুন। কী চাই আপনার?” স্ত্রীলোকটি বসল টেবিলের পাশে। মেয়েদুটি তার হাঁটু ঘেঁষে দাড়াল।স্ত্রীলোকটি বলল, “এই মেয়েদের বসন্তকালে পরার মতো চামড়ার জুতো চাই।” “ভালো কথা, করে দেব। এত ছোট জুতো এর আগে আমরা করিনি, কিন্তু সবরকমই আমরা করতে পারি। আগাগোড়া চামড়ার জুতোও করাতে পারেন, আবার কাপড়ের লাইনিং দেওয়াও করাতে পারেন। এই আমার বড় কারিকর মিখাইল।” সাইমন মিখাইলের দিকে তাকাল। সে তখন হাতের কাজ রেখে মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে।সাইমন খুবই বিস্মিত হল। এ কথা ঠিক যে মেয়েদুটি দেখতে খুব সুন্দর। কালো চোখ, গোলগাল লাল টুকটুকে শরীর। গায়ের কোট আর স্কার্ফও সুন্দর। কিন্তু মিখাইল কেন যে একান্ত পরিচিতের মতো তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে কিছুতেই বুঝতে পারল না। যাহোক সাইমন স্ত্রীলোকটির সঙ্গে দরদাম করতে লাগল। খোঁড়া মেয়েটাকে কোলের উপর তুলে স্ত্রীলোকটি বলল: “এর দুপায়ের মাপ নাও; একপাটি জুতো করো খোঁড়া পায়ের মাপে, আর তিন-পাটি করো ভালো পায়ের মাপে। তাহলেই হবে।

এদের দুজনের পা ঠিক এক মাপের। এরা যমজ।” মাপ নেবার পর সাইমন বলল, “আহা, এমন সুন্দর মেয়েটি, এরকম কেমন করে হল? জন্মের থেকেই কি এই রকম?” “না, ওর মা-ই পা-টা ভেঙে ফেলেছিল।” এই সময় মাত্রোনা ঘরে ঢুকে বলল, “আপনি তাহলে ওদের মা নন?” “না গো ভালোমানুষের মেয়ে, আমি ওদের মা নই, কোনোরকম আত্মীয়ও নই। এদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নেই। আমি ওদের লালন-পালন করেছি মাত্র।” “আপনার মেয়ে নয়, অথচ আপনি ওদের এত ভালোবাসেন!” “ভালো না বেসে কী করি? এদের দুজনকেই যে আমার বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি। আমার নিজের একটি সন্তান ছিল, ঈশ্বর তাকে নিয়ে নিলেন। এদের যত ভালোবাসি তত ভালো বুঝি সেটাকেও বাসতাম না।” “এরা তাহলে কার মেয়ে?” স্ত্রীলোকটি বলতে আরম্ভ করল। “ছ-বছর আগেকার কথা। একসপ্তাহের মধ্যে এরা বাবা-মাকে হারাল; বাপকে কবর দেওয়া হল মঙ্গলবার, মা মারা গেল শুক্রবার। জন্মের তিনদিন আগে বাপকে হারাল, মা মারা গেল জন্মের দিন। তখন আমার স্বামী আর আমি চাষবাসের কাজ করি। আমরা ছিলাম তাদের প্রতিবেশী ; পাশের বাড়িই ছিল আমাদের ! ওদের বাবাও একজন চাষী, জঙ্গলে কাজ করত। কেমন করে যেন একটা গাছ তার উপরে পড়ে; শরীরের একেবারে আড়াআড়ি। ফলে ভিতরটা একেবারে গুঁড়ো হয়ে যায়। তাকে যখন বাড়ি নিয়ে এল, তখন সব শেষ। সেই সপ্তাহেই তার স্ত্রীর দুটি যমজ মেয়ে হল, এই দুটি মেয়ে। দুঃখে-দুর্দশায় সে ছিল একেবারে একা-যুবতী বা বৃদ্ধা কোনো আত্মীয়াই ছিল না। একাই সে শিশুদের জন্ম দিল, একাই মারা গেল।

“পরদিন সকালে আমি তাকে দেখতে গেলাম। ওর বাড়ি পৌঁছে দেখি বেচারি তখন মরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মরবার ঠিক আগে সে পাশ ফিরে একটা মেয়ের উপর গড়িয়ে পড়ে। তাতেই ওর বাঁ-পা গুঁড়িয়ে বেঁকে যায়। লোকজন জড়ো হয়ে তাকে ধোঁয়াপোঁছা করে, পোশাক পরিয়ে কফিন তৈরি করে কবর দেবার ব্যবস্থা করল। মেয়েদুটি একা পড়ে গেল। কোথায় তাদের রাখা হবে? তখন একমাত্র আমার কোলেই সন্তান ছিল আমার সেই ছেলের বয়স তখন আট সপ্তাহ। কাজেই তখনকার মতো আমিই তাদের ভার নিলাম। সুস্থ মেয়েটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগলাম। প্রথমটা পা-ভাঙা মেয়েটাকে দুধ দিইনি, ও যে বাচবে তা ভাবিনি। পরে ভাবলাম: এমন পরীর মতো মেয়েটা কেন মারা যাবে? আমার মনে দয়া হল। তাকেও দুধ দিতে লাগলাম। আমার তখন বয়স অল্প, স্বাস্থ্য ভালো, ভালো খাওয়াদাওয়া করতাম। ঈশ্বরও বুকে এত দুধ দিতেন যে অনেক সময় উপচে পড়ত। একসঙ্গে দুজনকে খাওয়াতাম, তৃতীয়জন অপেক্ষা করত। একজন থামলে তখন তৃতীয়টিকে খাওয়াতাম। ঈশ্বরের বুঝি ইচ্ছা যে আমি এই দুটোকেই মানুষ করি, তাই দ্বিতীয় বছরেই আমরা নিজেরটিকে কবরে শুইয়ে দিলাম। ঈশ্বর আমাকে আর সস্তান দিলেন না, কিন্তু আমাদের অবস্থা ফিরতে লাগল।

এখন আমরা মিলের মালিক হয়েছি। আমাদের আয় যথেষ্ট, থাকিও ভালোভাবে। নিজেদের ছেলেপিলে নেই, এই দুটিকে না পেলে কী নিয়ে আমি বাঁচতাম ! ওদের ভালো না বেসে কি আমি পারি ! ওরাই তো আমার প্রদীপের সলতে।” মাত্রোনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল :“এইজন্যই বুঝি লোকে বলে :বাপ-মা ছাড়া তুমি বাঁচতে পারো, কিন্তু ঈশ্বরকে ছেড়ে বাঁচতে পারো না।” কথাবার্তা শেষ করে স্ত্রীলোকটি যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। মুচি আর তার বউ দরজা পর্যন্ত গেল তাদের সঙ্গে। তারপর মিখাইলের দিকে তাকাল। হাঁটুর উপরে দুই হাত ভাজ করে সে বসে আছে। চেয়ে আছে উপরের দিকে। হাসছে। সাইমন তার কাছে গিয়ে বলল :“এইবার সব কথা খুলে বলো তো মিখাইল।” হাতের কাজ সরিয়ে রেখে মিখাইল বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। অ্যাপ্রনটা খুলে মুচি আর তার বউকে নমস্কার করে বলল : “তোমরা দুজনে আমাকে ক্ষমা করো। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন। তোমরাও ক্ষমা করো।” উভয়ে দেখতে পেল, মিখাইলকে ঘিরে একটা আলো ঝলমল করছে। সাইমন দাড়িয়ে মিখাইলকে নমস্কার জানিয়ে বলল : “বুঝলাম মিখাইল, তুমি সাধারণ মানুষ নও, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও চলে না।

শুধু একটা কথা বলো : প্রথম সাক্ষাতের পরে তোমাকে যখন বাড়ি নিয়ে আসি তখনই বা তুমি বিষন্ন ছিলে কেন, আবার আমার স্ত্রী যখন তোমাকে রাতের। খাবার পরিবেশন করল তখনই বা তুমি হাসলে কেন? তারপর, সেই ভদ্রলোক যখন বুটের অর্ডার দিলেন, তখনই ভূমি দ্বিতীয়বার হাসলে কেন? এবং এইমাত্র স্ত্রীলোকটি যখন মেয়েদুটিকে নিয়ে এল তখনই বা তুমি তৃতীয়বার হাসলে কেন? বলো মিখাইল, তোমার চারদিকে এমন আলো কেন, আর কেনই বা তুমি তিনবার হেসেছ?” মিখাইল বলল :“আমার শাস্তি হয়েছিল, কিন্তু এখন ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন, তাই এই আলো। আমি তিনবার হেসেছি, কারণ তিনটি ঐশ্বরিক সত্য আমার জানবার ছিল। ঈশ্বরের সেই সত্য আমি জেনেছি। প্রথম সত্য জানলাম যখন তোমার স্ত্রী আমার প্রতি করুণা করল; তাই আমি প্রথমবার হাসলাম। আরেকটি সত্য জানলাম যখন ধনীলোকটি বুটের অর্ডার দিল, তাই দ্বিতীয়বার হাসলাম। এখন এই মেয়েটিকে দেখে আমি তৃতীয় এবং শেষ সত্যটি জানলাম।

তাই তৃতীয়বার হাসলাম।” সাইমন বলল :“বলো মিখাইল, কেন ঈশ্বর তোমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, আর ঈশ্বরের সত্য তিনটিই বা কী? সব আমি জানতে চাই।” মিখাইল বলল : “ঈশ্বরের আদেশ আমি অমান্য করেছিলাম, তাই তিনি আমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম স্বর্গের দেবদূত। ঈশ্বরকে আমি অমান্য করেছিলাম।” “আমি স্বর্গের দেবদূত ছিলাম। ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছিলেন একটি স্ত্রীলোকের আত্মা নিয়ে যেতে। পৃথিবীতে উড়ে গিয়ে দেখলাম একটি স্ত্রীলোক অসুস্থ হয়ে একাকী শুয়ে আছে। সবেমাত্র তার দুটি যমজ সন্তান জন্মেছে—দুটি মেয়ে! মেয়েদুটি মায়ের পাশে পড়ে আছে, ওদের যে দুধ খাওয়াবে সেই শক্তিও প্রসূতির নেই। শ্রীলোকটি আমাকে দেখতে পেল, বুঝতে পারল তার আত্মা নিতেই আমি এসেছি। চোখের জল ফেলে সে বলল: ঈশ্বরের দূত! আমার স্বামী গাছচাপা পড়ে মারা গেছে সবাই মিলে সবে তাকে কবর দিয়েছে। আমার বোন নেই, খালা-চাচি নেই, দাদি-নানি নেই বাপ-মা-মরা মেয়েদুটোকে দেখার কেউ নেই। আমার আত্মা নিয়ো না।

মেয়েদুটোকে খাইয়ে পরিয়ে তাদের পায়ে দাড়াবার মতো করে তুলতে দাও। বাপ মা ছাড়া তো সন্তান বাচতে পারে না ” প্রসূতির কথা শুনে আমি একটি মেয়েকে তার বুকে তুলে দিলাম, আরেকটিকে তুলে দিলাম তার কোলে, তারপর স্বর্গে ঈশ্বরের কাছে চললাম। ঈশ্বরের কাছে উড়ে গিয়ে বললাম : সদ্যপ্রসূতির আত্মা আনতে আমি পারিনি। গাছ চাপা পড়ে বাপ মরেছে মায়ের দুটি যমজ সন্তান জন্মেছে সে আমাকে অনুরোধ করল তার আত্মা না নিতে। সে বলল : ‘আমার মেয়েদের লালন পালন করতে দাও, তাদের পায়ে দাঁড়াবার মতো সময় দাও। বাপ-মা ছাড়া শিশুসন্তান বাচতে পারে না। …সে মায়ের আত্মা আমি আনি নি।” তখন ঈশ্বর বললেন : “যাও মায়ের আত্মা নিয়ে এসো, আর তিনটি সত্য জেনে এসো; জেনে এসো; মানুষের কী আছে, মানুষের কী নেই, আর মানুষ কী নিয়ে বাঁচে। এই তিন সত্য জেনে তবে স্বর্গে ফিরে আসবে। আমি আবার পৃথিবীতে উড়ে গেলাম, মায়ের আত্মা নিয়ে এলাম।” “শিশুদুটি মায়ের বুক থেকে গড়িয়ে পড়ল। তার মৃতদেহ শয্যার উপরে ঘুরে পড়তেই একটি মেয়েকে চাপা দিল; তার পা গেল বেঁকে। আত্মা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে উড়ে চলেছি এমন সময় আমি ঝড়ে পড়লাম, আমার পাখদুটো খসে পড়ল। আত্মা একাই ঈশ্বরের দিকে চলে গেল।

আমি পৃথিবীতে একটি পথের ধারে পড়ে গেলাম।” সাইমন ও মাত্রোনা বুঝতে পারল কাকে তারা খাইয়েছে, পরিয়েছে ; কে তাদের সঙ্গে এতদিন ছিল। তখন ভয়ে ও আনন্দে তারা কাঁদতে লাগল। দেবদূত বলল :“মাঠের মধ্যে উলঙ্গ অবস্থায় আমি একা পড়ে রইলাম। মানুষের কী দরকার আমি জানতাম না। শীত বা ক্ষুধা কাকে বলে তাও জানতাম না। কিন্তু তখন আমি মানুষ হয়ে গিয়েছি। আমি তখন ক্ষুধায় কাতর, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি; কিন্তু কী যে করব কিছুই জানি না। তখন মাঠের মধ্যে তৈরি একটি ঈশ্বরের প্রার্থনাঘর দেখতে পেয়ে আশ্রয়ের আশায় সেখানেই গেলাম। প্রার্থনাগৃহ তালাবন্ধ। ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। ঠাণ্ডা বাতাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রার্থনাগৃহের পিছনে বসে রইলাম। সন্ধ্যা নেমে এল। আমি অভুক্ত, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি, সারা শরীর কাঁপছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম : একটা লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে, হাতে একজোড়া বুট; নিজের মনেই কী যেন বলছে। মানুষের মরণশীল মুখ আমি দেখলাম। সেমুখ দেখে আমার ভয় হল। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আমি শুনতে পেলাম লোকটি বলছে, এই বরফের মতো ঠাণ্ডায় কী করে সে নিজের শরীরকে বাচাবে, কেমন করে তার স্ত্রী-পুত্রকে খাওয়াবে। আমি ভাবলাম : ‘ঠাণ্ডায় ও ক্ষুধায় আমি মরে যাচ্ছি, আর এই লোকটা শুধু নিজের কথাই ভাবছে ; কেমন করে নিজেকে আর বউকে ফারকোট দিয়ে ঢাকবে, কেমন করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে খাওয়াবে।

এ কখনও আমাকে সাহায্য করবে না।’ লোকটি আমাকে দেখল, ভুরু কোচকাল, যেন আরও ভয় পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি হতাশায় ভেঙে পড়লাম। হঠাৎ শব্দ শুনে বুঝলাম লোকটা ফিরে আসছে। আমি চোখ তুললাম, কিন্তু দেখলাম এ যেন সে-লোক নয়। তখন তার মুখে ছিল মৃত্যুর ছায়া, এখন সহসা সে যেন বেঁচে উঠেছে, তার মুখে আমি ঈশ্বরকে দেখতে পেলাম। সে আমার কাছে এল, আমাকে জামা-জুতো পরাল, সঙ্গে করে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। লোকটির বাড়িতে ঢুকতেই তার বউ এগিয়ে এসে বকবক করতে লাগল। বউটি যেন লোকটির চাইতেও ভয়ংকরী— তার মুখ দিয়ে যেন একটি মৃত আত্মা কথা বলছে, মৃত্যুর দুর্গন্ধে আমার যেন দম আটকে আসছিল। সেই ঠাণ্ডায় সে আমাকে বাইরে তাড়িয়ে দিতে চাইল। আমি জানতাম, আমাকে তাড়িয়ে দিলেই সে মারা যাবে। তখন তার স্বামী তাকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটির মনে পরিবর্তন এল। তারপর সে যখন খাবার দিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি দেখলাম তার মুখে মৃত্যুর ছায়া আর নেই সে যেন বেঁচে উঠেছে; তার মুখেও আমি ঈশ্বরকে দেখতে পেলাম। “তখনই আমার মনে পড়ে গেল ঈশ্বরের প্রথম কথা : ‘জেনে এসো, মানুষের কী আছে।’ আমি জানলাম, মানুষের প্রেম আছে। আমি খুশি হলাম, কারণ ঈশ্বর আমাকে যা বলেছিলেন সেই সত্য আমার কাছে প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছেন। সেই আমি প্রথমবার হাসলাম। কিন্তু সবকিছু তখনও শেখা হয়নি। তখনও জানিনি, মানুষের কী নেই, বা মানুষ কী নিয়ে বেঁচে থাকে।

“তোমাদের সঙ্গে একটি বছর কাটালাম। তারপর একদিন একজন লোক এসে এমন বুটের অর্ডার দিল যা একবছরের মধ্যে ছিড়বে না বা ফাটবে না। তার দিকে তাকাতেই তার পিছনে আমার সঙ্গী মৃত্যুদূতকে দেখতে পেলাম। বুঝলাম, সূর্যাস্তের আগেই সে এই ধনীলোকটির আত্ম নিয়ে যাবে। তখন ভাবলাম :‘মানুষ একবছরের কথা ভাবে, অথচ সে জানে না যে সন্ধ্যা পর্যন্তও তার আয়ু নেই।” তখনই মনে পড়ল ঈশ্বরের দ্বিতীয় কথা: ‘জেনে এসো, মানুষের কী নেই।’ “মানুষের কী আছে আমি আগেই জেনেছি।

এখন জানলাম, মানুষের কী নেই। তখনই আমি দ্বিতীয়বার হাসলাম। আমার সঙ্গী দেবদূতকে দেখে এবং ঈশ্বর আর একটি সত্য আমার কাছে প্রকাশ করেছেন জেনে আমার ভারি আনন্দ হল। “কিন্তু তখনও আমার সব জানা হয়নি। আমি তখনও জানি নি, মানুষ কী নিয়ে বাঁচে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, কবে ঈশ্বর বাকি সত্যটা আমার কাছে প্রকাশ করবেন। ষষ্ঠ বছরে দুটি যমজ মেয়ে নিয়ে স্ত্রীলোকটি এল। আমি তাদের চিনতে পারলাম ; তারা কী করে বেঁচে আছে তাও শুনলাম। সব শুনে ভাবলাম : ‘মেয়েদের জন্য মা আমার কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল, মায়ের কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম—ভেবেছিলাম বাব-মা ছাড়া শিশুসন্তান। বাচতে পারে না, অথচ একজন অপরিচিতা তাদের বড় করে তুলেছে!’ অন্যের মেয়ের প্রতি স্নেহে স্ত্রীলোকটি যখন কাদল, তখন তার মধ্যে আমি জীবন্ত সৃষ্টিকর্তাকে দেখতে পেলাম, আমি জানলাম মানুষ কী নিয়ে বাচে। তখন আমি বুঝলাম, ঈশ্বর আমার কাছে তৃতীয় সত্য প্রকাশ করেছেন, আমাকে ক্ষমা করেছেন। তাই আমি তৃতীয়বার হাসলাম।” দেখতে দেখতে দেবদূতের দেহ নেমে এল। এমন তীব্র আলো দিয়ে সে দেহ গড়া যে সেদিকে তাকানো যায় না। অতি উচ্চকণ্ঠে সে কথা বলতে লাগল। মনে হল, কথাগুলো তার ভিতর থেকে আসছে না, স্বর্গ থেকে আসছে। দেবদূত বলল: “আমি জানলাম, মানুষ নিজের কৌশলে বাচে না, বাচে প্রেমে।” “মানুষ হিসাবে আমি বেঁচে রইলাম—আমার চেষ্টায় নয়, বেঁচে রইলাম যেহেতু একজন পথের লোক ও তার স্ত্রীর হৃদয়ে প্রেম ছিল, তারা আমাকে দয়া করেছিল, ভালোবেসেছিল।

বাপ-মা-হারা মেয়েদুটি বেঁচে রইল কোনো স্বার্থচিন্তার দ্বারা নয়, বেঁচে রইল, যেহেতু অপরিচিতার হৃদয়ে প্রেম ছিল, সে তাদের দয়া করেছিল, ভালোবেসেছিল। সব মানুষই বেঁচে থাকে—নিজেদের পরিকল্পনা অনুসারে নয়, মানুষের হৃদয়ের প্রেমের শক্তিতে। ‘আগে জানতাম ঈশ্বর মানুষকে জীবন দান করেন, তিনি চান তারা বেঁচে থাকুক; এখন আমি আরও কিছু জানলাম।” “আমি বুঝতে পারলাম, যদিও মানুষ মনে করে যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রচেষ্টাতেই সে বাঁচে, সে কিন্তু বাঁচে একমাত্র প্রেমে। যে মানুষ প্রেমময়, ঈশ্বর তার সঙ্গী, তার মধ্যে তিনি আছেন; কারণ তিনিই প্রেম।” দেবদূত ঈশ্বরের জয়গান করতে লাগল, তার কণ্ঠস্বরে কেঁপে কেঁপে উঠল ঘরখানি। ঘরের ছাদ দুইভাগ হয়ে পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত একটা অগ্নিস্তম্ভ উঠে গেল। সাইমন, তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা পড়ে গেল মেঝেয়। দেবদূতের পিঠে পাখা গজাল, সে উড়ে গেল আকাশে।সাইমনের যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন তার কুঁড়েঘর যেমন ছিল তেমনি আছে, আর তার নিজের পরিবার ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই।

Leave a Reply