যেভাবে ভারতবর্ষজুড়ে মানুষ শিকার করত ঠগিরা

ঠগিদের নিয়ে, খুব সম্ভব, সবচেয়ে বড় কলেবরে বই লিখেছেন ফিলিপ মিডোয টেলর—কনফেশন্স অভ আ থাগ। এ বইয়ে যেসব অপরাধ-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে—দুঃখজনক হলেও—তার বেশিরভাগই সত্য। ঘটনাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজানো এবং বইয়ের প্রধান চরিত্র আমির আলির ভয়ংকর ও দুঃসাহসিক জীবনকাহিনী পাঠকদের কাছে আরেকটু আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্যে কিছু কিছু জায়গায় সামান্য কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে কেবল।

ঠগিদের নিয়ে, খুব সম্ভব, সবচেয়ে বড় কলেবরে বই লিখেছেন ফিলিপ মিডোয টেলর—কনফেশন্স অভ আ থাগ। এ বইয়ে যেসব অপরাধ-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে—দুঃখজনক হলেও—তার বেশিরভাগই সত্য। ঘটনাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজানো এবং বইয়ের প্রধান চরিত্র আমির আলির ভয়ংকর ও দুঃসাহসিক জীবনকাহিনী পাঠকদের কাছে আরেকটু আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্যে কিছু কিছু জায়গায় সামান্য কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে কেবল।

আমার সঙ্গে আমির আলির পরিচয় হয় ১৮৩২ সালে। সে সময় অনেক ঠগি ধরা পড়ে। তাদের অনেকেই রাজসাক্ষী বা সরকারি চর বনে যায়। এদেরই একজন আমির আলি। এরা নিজের অপরাধ স্বীকার করে এবং অন্য দস্যুদের ধরিয়ে দিতে রাজি হয়। এমনকি সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেও দ্বিধা করেনি।

আমির আলিকে দলের অন্যান্য দস্যুর সাথে সওগর থেকে নিজাম রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই তস্কররা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে যেসব পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও লোমহর্ষক দস্যুতার বর্ণনা দেয়, তা গোটা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। তীব্র কৌতূহল-মেশানো আতঙ্কে শুনেছিলাম ওদের জীবনকাহিনি। সেই বিস্ময় ও আতঙ্কের অনুভূতি লেখার মাধ্যমে পাঠকদের মধ্যে সঞ্চারিত করার সাধ্য আমার নেই।

এই কাহিনির সত্যতার সমর্থনে আমি কেবল এটুকু বলতে পারি—আমির আলি নিজ মুখে স্বীকার করেছে, দস্যুজীবনে নিজ হাতে সাতশো উনিশজন মানুষকে খুন করেছে সে। ও যে বাহাদুরি নেবার জন্যে এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলেনি, তা প্রমাণ হয়েছে ওর সঙ্গীদের সাক্ষ্যে। আমির আলি একদিন আমাকে আফসোস করে বলেছিল, ‘আহ্! হুজুর, বারো বছর কয়েদখানায় ছিলাম আমি। নইলে এতদিনে কমপক্ষে এক হাজার মানুষকে খুন করতে পারতাম!’

ঠগি সম্প্রদায়টা সত্যিকার অর্থেই সুবিশাল। বিশাল এই দলের এতগুলো খুনে সদস্য কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে—জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে—কীভাবে সাধারণ জীবনযাপন করত, তা-ই এক বিরাট আশ্চর্যের বিষয়। এই বিপুল জনারণ্যে থেকে কারও মনে কোনো সন্দেহ না জাগিয়েই দলের বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত তারা।

ভারতবর্ষ এক সুবিস্তৃত মহাদেশ। বিশাল এই মহাদেশ কখনো কোনো একক শাসকের অধীনে আসেনি। আদিকাল থেকে খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত এই অঞ্চল। এই বিভক্ত রাজ্যগুলোর বেশিরভাগের শাসকই অদক্ষ। তাই শাসনব্যবস্থাও ছিল খানিকটা শিথিল। প্রত্যেকে নিজের খেয়াল-খুশিমতো রাজ্য পরিচালনা করতেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। পরস্পরকে ঈর্ষার চোখে দেখতেন তাঁরা।

ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের শাসকেরা মহাদেশব্যাপী শান্তি বজায় রাখার জন্যে নিজেদের মধ্যে কোনো সন্ধি করতেন না। ছিল না কোনো পুলিশবাহিনীও। ফলে রাজপথগুলোতে পথচারীরা যে একটু নিরাপদে চলাফেরা করবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। কিছু কিছু শাসক অবশ্য নিপুণভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। সেসব রাজ্যে রাজকর্মচারীদের ভয়ে দস্যু-লুটেরার দল উৎপাত করবার সাহস পেত না। কিন্তু এ ধরনের সুশাসন সামগ্রিকভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাগ্যে কখনো জোটেনি।

তাছাড়া প্রাচীন ভারতবর্ষে পথচারীদের যাতায়াতের জন্যে সাধারণ যানবাহনের ব্যবস্থা কোনো কালেই ছিল না। ভালো ছিল না পথঘাটের অবস্থাও। অনেক দূরদেশে যেতে হলেও হয় পদযাত্রা, নয়তো ঘোড়াই ছিল একমাত্র অবলম্বন। এতে সময় লাগত অনেক। এরকম দূরযাত্রায় কোনো পথিকদল পথিমধ্যে আরেকদল অপরিচিত পথিকের দেখা পেলে নিঃসঙ্কোচে তাদের সঙ্গে মিশে যেত। কারণ এভাবে দল বেঁধে না চললে লুটেরা ও তস্করদের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব ছিল না। কোম্পানি আমলে সৈন্যদের চলাচলের জন্যে যে-কটা রাস্তা বানানো হয়েছিল, সেগুলোর অবস্থাই কেবল কিছুটা ভালো ছিল। বাকি রাস্তাগুলোকে রাজপথ বলার জো ছিল না। সমতল মাঠের বুকে লোক-চলাচলের ফলে একটা আঁকাবাঁকা রেখা তৈরি  হতো। ওটাই ছিল তখনকার ‘রাজপথ’। বন, জঙ্গল, পর্বত ও অকর্ষিত জমির বুক চিরে চলে যেত এই সরু পায়েচলা রাস্তা। চলতে চলতে মাঝেসাঝে এক-আধটা গ্রামের দেখা পাওয়া যায় কেবল। ওগুলোতেও মানুষ খুব কম। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামের দূরত্ব বিস্তর। দুই গাঁয়ের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলোতে জনমনিষ্যির চিহ্নও নেই। এমন বিজন পরিবেশে লুটেরাদের দল নির্বিঘ্নে অসহায় পথচারীদের হত্যা করে, সর্বস্ব লুটে নিতে পারত।

এই নির্জনতার সুযোগ নিয়ে সারাদেশে অসংখ্য ডাকাতদল ঘুরে বেড়াত নির্বিঘ্নে। একেক দস্যুদল পরিচিত ছিল একেক নামে। নানা উপায়ে নিজেদের কাজ হাসিল করত এরা। কেউ ছদ্মবেশে ছিঁচকে চুরি-ডাকাতি করত, কেউ কেউ আবার দল বেঁধে পথিকদের ওপর আক্রমণ করে লুটে নিত তাদের সর্বস্ব।

এই দস্যুদলগুলোর মধ্যে ঠগিদের দলটাই ছিল সবচেয়ে বড়। এরা যেমন সুসংগঠিত ছিল, তেমনি নিপুণভাবে সারত লুণ্ঠনকাজ। এরাই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও খুনে তস্করদল। ঠগিরা থাকতও লোকচক্ষুর আন্তরালে। কিছুতেই নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিত না।

কোনো নগর পেরোবার সময় অভিযাত্রীরা নগরের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখত না। শহর থেকে খাবারদাবার ও রসদ জোগাড় করত কেবল। মাঝেসাঝে শহরে ঢুকত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে, গাছের ছায়ায় বা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম নিত। ফলে কে কখন কোন গাঁ থেকে কোন গাঁয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জো ছিল না।

অসংখ্য জাতি, ধর্ম ও পেশার লোকের বাস ভারতবর্ষে। কাজেই ইচ্ছেমতো ছদ্মবেশ ধরে যে-কারও সঙ্গে মিশে যেতে পারত ঠগি ও লুটেরাদের দল। ঘুণাক্ষরেও কারও মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক  হতো না। তাছাড়া এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে সোনা-রুপা, মণি-মুক্তো পাঠানো  হতো আর্থিক লেনদেনের জন্যে। এ কথা সবাই-ই জানত। তাই ছদ্মবেশী ডাকাতদলের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন থাকলেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করত না কেউ। সঙ্গে যে ধনরত্ন আছে, এ কথা যাতে কেউ জানতে না পাওে সেজন্যে ছেঁড়া-তালি দেয়া জীর্ণ পোশাক পরত অনেকে। তাছাড়া রাহা-খরচের জন্যেও সঙ্গে টাকাপয়সা রাখতে  হতো সবাইকে। কোনো নতুন রাজ্যে প্রবেশের করার সময় সীমান্তে কর্মরত রাজকর্মচারীরা পথিকদের মালসামান তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করে উপযুক্ত শুল্ক আদায় করে নিত। কাজেই কোনো জিনিস লুকিয়ে রাখবার উপায় ছিল না। যেসব কর্মকর্তা শুল্ক আদায় করত, তাদের অধস্তন অনেক কর্মচারীর সঙ্গে ঠগি ও অন্যান্য দস্যুদলের যোগাযোগ থাকত। অতএব, পথিকদের কার কাছে কী আছে, সে খবর নিমেষে পৌঁছে যেত ডাকাতদের কাছে।

তদন্ত থেকে আরও জানা গেছে, ভারতের সর্বত্রই বহু বনেদি জমিদার ও গাঁয়ের প্রধান রাজকর্মচারীর সঙ্গে বংশপরম্পরায় গোপন যোগাযোগ ছিল ঠগিদের। ডাকাতদেও নরহত্যা ও লুটের ব্যাপারগুলো ধামাচাপা দিয়ে রাখত এরা। আর ডাকাতেরা বিপদে পড়লেই তাদের নানাভাবে সাহায্য করত, আশ্রয় দিত। দস্যুরা লুটপাট করে যা পেত, তা থেকে নিয়মিত বখরা পেত এসব জমিদার ও রাজকর্মচারীরা। প্রত্যেক গ্রামে ও নগরে বেশ কিছু সন্ন্যাসী, ফকির ও সাধু বাস করত। এরা থাকত লোকালয়ের বাইরে, বৃক্ষবেষ্টিত বাড়িতে। এসব জায়গা ছিল দস্যু, ডাকাত ও লুটেরাদের নিরাপদ আশ্রয়। কিছু কিছু ফকির-সন্ন্যাসী নিরীহ পথিকদের খাবার ও আশ্রয়ের লোভ দেখিয়ে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে এসে তুলে দিত দস্যুদের হাতে। দেশের এমন বেহাল দশার সুযোগ নিয়েই ঠগিদের মতো বিশাল দস্যুদল সবার অগোচরে, নির্বিঘ্নে দস্যুতা ও লুটপাট করতে পেরেছিল ভারতজুড়ে।

নানা কিংবদন্তি ও গুজবের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ঠগি সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস। কর্নেল স্লিম্যানের অনুমান: মোগল ও তাতাররা ভারত আক্রমণ করার বহুদিন পর, অনেক যাযাবর মুসলমান ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ভারতজুড়ে লুটপাট চালাত। খুব সম্ভব এ সম্প্রদায়গুলো থেকেই ঠগিদের উৎপত্তি। হিন্দুদের দাবি—ঠগিদের উৎপত্তি ভবানী দেবী থেকে। দাবিটাকে অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, ঠগি-দস্যু হিন্দু বা মুসলিম যে-ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, ভবানী বা কালীর পুজো করত প্রত্যেকেই। এবং হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠানের মতো কতগুলো আচারও পালন করত এরা।

জনশ্রুতি অনুসারে এ সম্প্রদায়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন। কিন্তু আকবরের রাজত্বকালের আগে এদের অস্তিত্বের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে অনেক ঠগি ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। এ ঘটনার পর ১৮১০ সাল অবধি দু-একজন স্থানীয় রাজা মাঝেসাঝে দু-একজন দস্যুকে ধরে শাস্তি দিয়েছেন বটে, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বা কর্তৃপক্ষ এর আগে এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু জানত না।

যেভাবে ভারতবর্ষজুড়ে

সে বছরই কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনেক সৈন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। আবার বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার সময়ও লাপাত্তা হয় অনেক সৈন্য। তাদের কোনো খবর না পেয়ে সন্দ্রেহের উদ্রেক হয় কমান্ডার-ইন-চিফের মনে। ঠগিদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবার আদেশ দেন তিনি সৈন্যদের। ১৮১২ সালে লেফটেন্যান্ট মন্শেল নিহত হন ঠগিদের হাতে। খুনিরা যেসব গ্রামে থাকত বলে খবর পাওয়া যায়, তদন্তের জন্যে দক্ষ একদল সৈন্য নিয়ে ওসব জায়গায় যান মি. হ্যালহেড। কিন্তু দস্যুদল তাঁকে বাধা দেয়।

তদন্তে বেরিয়ে আসে, বহু ঠগি সিন্দৌস পরগনার আওতাধীন গ্রামগুলোতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, নিরাপত্তার জন্যে নিয়মিত মোটা অঙ্কের করও দেয় সিন্ধিয়ার সরকারকে। সে সময় হিসেব করে জানা যায়, শুধু ওই গ্রামেই ন’শোরও বেশি ডাকাতের বাস ছিল। বাধা দেবার পর, সৈন্যদের তাড়া খেয়ে, ডাকাতদল নানান জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়েও এরা বিভিন্ন প্রদেশে দস্যুবৃত্তি করে বেড়াত।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ১৮১৬ সালের আগ পর্যন্ত এই তস্করদের দমন করবার জন্যে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ ঠগিদের ব্যাপারে সবাই বহু আগে থেকেই জানত। মাদ্রাজের ‘সাহিত্য পত্রিকা’য় ডাক্তার শেরউডের একটা প্রশংসনীয় প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল এ বিষয়ের ওপর। লেখাটিতে দক্ষিণ ভারতের ঠগিদের যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির কথা বর্ণিত হয়, তার প্রতিটা অক্ষর সত্য। অনেকে ভেবেছিল, প্রবন্ধটি সত্য নয়, অতিরঞ্জিত কল্পনা মাত্র। কেননা কোনো মানুষ যে অমন নিষ্ঠুুর, খুনে ও রক্তপিপাসু হতে পারে, তা ছিল তাদের চিন্তা এবং কল্পনারও অতীত। কিন্তু তখন থেকে শুরু করে ১৮৩০ সাল অবধি ভারতের প্রায় সব অংশেই—বিশেষ করে বুন্দেলখণ্ড ও পশ্চিম মালওয়াতে—অনেক তস্কর ধরা পড়ে মেজর মর্থউইক আর ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডলো ও হেন্লি-র হাতে। বিচারে পথচারীদের হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করে অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু এসব ঘটনা দেশে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। জনমনেও কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি করেনি। শাসনব্যবস্থার দিকে ছুটে যায়নি প্রশ্নের বাণ। এত বড় একটা দস্যু-সম্প্রদায় তাই লুটতরাজ চালিয়ে যেতে থাকল নির্বিঘ্নে।

সে বছর ও তার কয়েক বছর আগ থেকে ভয়াবহ রকমের বেড়ে গেল ঠগিদের উৎপাত। এদের নৃশংসতার বাড়াবাড়িতে সরকারের পক্ষে আর উদাসীন থাকা সম্ভব হলো না। এই তস্করদলের অত্যাচার দমন করার জন্যে সরকারপক্ষ থেকে দেশব্যাপী শুরু হলো ব্যাপক ধরপাকড়। মি. স্টকওয়েল, স্মিথ, উইলকিন্স, বর্থউইকদের মতো প্রভাবশালী সিভিল অফিসারদের নজর পড়ল এদিকে। যেসব ঠগি ধরা পড়েছিল তাদের কয়েকজনকে বলা হলো, তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে, সঙ্গীদের ধরিয়ে দিলে মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যাবে। এ উদ্যোগ কাজে দিল। যেসব ডাকাত এ প্রস্তাবে রাজি হলো, তাদের মধ্যে ছিল ফিরিঙ্গিয়া নামের এক কুখ্যাত দস্যুনেতা।

সার্কাস ও সুন্দরী ‌ সার্কাসের দলে বাঘের সঙ্গে খেলা দেখানো প্রথম ভারতীয় নারী।

কর্নেল স্লিম্যান ছিলেন নর্মদা নদীর তীরবর্তী প্রদেশগুলোর রাজনৈতিক প্রতিনিধি। ফিরিঙ্গিয়া নিজের ও তার সহচরদের যেসব নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিল, তা তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না। সে সময় তিনি বৃক্ষবেষ্টিত একটা উদ্যানে তাঁবু ফেলে থাকছিলেন। রাজসাক্ষীর কথামতো কেবল ওই কুঞ্জবন খুঁড়েই পাওয়া গেল তেরোটি নরকঙ্কাল। বন্দি দস্যু জানায়, আশপাশে আরও বেশ কিছু জায়গা খুঁড়লেও এমন অনেক কঙ্কাল পাওয়া যাবে। এবার নির্দ্বিধায় লোকটার কথা বিশ্বাস করলেন কর্নেল। সাক্ষী আরও জানাল, ডাকাতি করতে বের হবার জন্যে বিরাট একটা ঠগিদল জড় হচ্ছে রাজপুতানায়। তার তথ্যের ভিত্তিতে বড় একটা দল ধরা পড়ল ডাকাতি করতে বের হবার সময়।

এরপর থেকেই ব্যাপক সমারোহে শুরু হলো ঠগি-নিধন কর্মসূচি। প্রায় সব দল থেকেই দু-একজন করে রাজসাক্ষী পাওয়া গেল। যখন দেখল ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সঙ্গীদের ঠিকুজি-কোষ্ঠী পুলিশকে জানিয়ে দেয়া, গড়গড় করে বলে দিল সবার নাম-ধাম। নিরীহ পথিকদের হত্যা করে যেখানে লাশ পুঁতে রেখেছিল, দেখিয়ে দিল ওসব জায়গা। জায়গাগুলো খুঁড়তেই বেরিয়ে এল অসংখ্য নরকঙ্কাল।

ধরপাকড় শুরু হবার পর জানা গেল, গোটা ভারতজুড়ে অরাজকতার রাজত্ব কায়েম করেছে এই ঠগিরা। নির্বিঘ্নে করে বেড়াচ্ছে দস্যুবৃত্তি, খুন, রাহাজানি। প্রথম এদের খোঁজ পাওয়া গেল মধ্যপ্রদেশগুলোতে। কিন্তু যত বেশি রাজসাক্ষী পাওয়া যেতে লাগল, ততই জানা যেতে লাগল, এই অল্পকটা প্রদেশে সীমাবদ্ধ নয় এদের দস্যুতা। এরা ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ভারতবর্ষে। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে আসাম অবধি এমন কোনো রাজ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেল যেখানে ঠগিদের দৌরাত্ম্য নেই। এমন কোনো প্রদেশ পাওয়া গেল না যেখানে ঠগিদের হাতে খুন হওয়া শত শত নিরীহ পথচারীর কঙ্কাল পুঁতে রাখা হয়নি।

যেভাবে ভারতবর্ষজুড়ে

সে সময় (১৮৩১-৩২) গোটা ভারতে এই ঠগি-কাণ্ড যে চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। অনেক জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা কিছুতেই স্বীকার করলেন না যে তাঁদের অজান্তে, তাঁদেরই ঘরের কাছে বসে এতদিন ধরে নিঃশব্দে চলেছে এমনতর লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড। ঠগিদের এসব নৃশংস কর্মকাণ্ড ও ম্যাজিস্ট্রেটদের মনোভাব স¤পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা দেবার জন্যে কর্নেল স্লিম্যানের বই থেকে খানিকটা অংশ হুবহু তুলে দিচ্ছি:

‘১৮২২, ‘২৩ ও ‘২৪—এ তিন বছর নর্মদার উপত্যকায় অবস্থিত নরসিংপুর জেলার শাসনভার বর্তেছিল আমার ওপর। এলাকার কোথাও সামান্য ছিঁচকে চুরি-ডাকাতি হলেও খবর আসত আমার কাছে। গোটা জেলার ছোট-বড় সব চোর-ডাকাতের স্বভাব-চরিত্র ও গতিবিধি ছিল আমার নখদর্পণে। সে সময় কেউ যদি এসে বলত, আমার আদালত থেকে মাত্র চারশো গজ দূরে, কুন্দেলি গ্রামে একদল খুনি বাস করে; কিংবা সওগর ও ভূপালগামী রাজপথের পাশের মুণ্ডেসুর গ্রামের গাছে-ঘেরা কুঞ্জবনের মাটির নিচে শত শত লাশ শুয়ে আছে; অথবা ফি-বছর হিন্দুস্তান ও দাক্ষিণাত্য থেকে বড় বড় তস্করদল এসে কয়েকদিন থাকে এই উদ্যানে এবং আশপাশের রাজপথগুলোর নিরীহ পথিকদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে তাদের হত্যা করে—তাকে আমি নির্ঘাত মহাবোকা বা উন্মাদ ঠাওরাতাম। পাগল ঠাওরাতাম কেউ যদি এসে বলত, দুজন প্রভাবশালী জমিদারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সংঘটিত হয় এসব নৃশংস অপরাধ, এবং কেবল লুটকার্যের জন্যেই বিশাল এই কুঞ্জবন গড়ে তুলেছিল এই জমিদারদের পূর্বপুরুষেরা।

কিন্তু হায়, কথাগুলো অক্ষওে অক্ষরে সত্য। মুণ্ডেসুরের এই কুঞ্জবনে পুঁতে রাখা হয়েছে শত শত পথিকের লাশ। সত্যি সত্যিই কুন্দেলি গ্রামে থাকে একদল গুপ্তঘাতক। এবং আমি নরসিংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালেই পুনা ও হায়দ্রাবাদ অবধি রাজপথগুলোতে লুটতরাজ করে বেড়াত এই নরপশুর দল।’

ঠগিদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাবার জন্যে আরেকটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়।

উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ঠগি দমনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন

হিঙ্গোলির সেনানিবাসে থাকত সে জেলার ঠগি-সর্দার, হরি সিং। লোকটা ওখানকার সুপরিচিত ব্যবসায়ী, সবার শ্রদ্ধাভাজন। অনেক মান্যগণ্য লোকের সঙ্গে কারবার ছিল তার। এমনকি আমার সঙ্গেও বেশ হৃদ্যতা ছিল। যখনকার ঘটনা, তখন ওই জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ক্যাপ্টেন রেনল্ডস। একদিন বোম্বে থেকে কিছু কাপড় আমদানির জন্যে অনুমতিপত্র চেয়ে আবেদন করল হরি সিং। একই সময়ে হিঙ্গোলির পাশের একটা শহরের এক কাপড় ব্যবসায়ী কাপড়চোপড় নিয়ে আসছিল। এ খবর জানা ছিল হরি সিঙের।

যা-ই হোক, অনুমতিপত্র নিয়ে চলে গেল সে। তারপর পথিমধ্যে অনুচর ও গাড়ির গাড়োয়ানসহ খুন করল সেই ব্যবসায়ীকে। লুট করা মালসামান নিয়ে ফিরল হিঙ্গোলিতে। সেই অনুমতিপত্র দেখিয়ে ওসব কাপড়চোপড় প্রকাশ্যে বিক্রি করল সেনানিবাসে। লোকটা যদি গ্রেপ্তার হয়ে এ কথা স্বীকার না করত, তবে কেউ কোনোদিন এসব লোমহর্ষক ঘটনার ব্যাপারে জানতেও পারত না।

হরি সিং আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেনানিবাসের বাজারেই অনেককে খুন করেছে। বাজারটা সৈন্যদের মূল বাসভবন থেকে বড়জোর একশো গজ তফাতে। হত্যা করার পর নিরীহ মানুষগুলোর লাশ পুঁতেছিল ওখান থেকে বড়জোর পাঁচশো গজ দূরে। এই হতভাগাদের কবর যখন খোঁড়া হয়, আমি নিজে তখন হাজির ছিলাম সেখানে। কয়েকটা করে মৃতদেহ পাওয়া গেল একেকটা কবরে। যেসব দস্যু ধরা পড়ে রাজসাক্ষী হয়েছিল, একের-পর-এক কবর দেখিয়ে দিচ্ছিল তারা নির্বিকার চেহারায়। নরপিশাচের দল ভাবলেশহীন থাকলেও, অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেছিলাম আমরা। একের-পর-এক দেহাবশেষ বেরোতে শুরু করল। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বাদ দিলাম খোঁড়াখুঁড়ি।

নবীনগর-চন্দ্রা ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তীব্র যানজট

সেনাছাউনি থেকে একটা চওড়া রাস্তা বেরিয়ে গেছে। সে রাস্তার পাশেই ছিল একটা শুকনো, অগভীর খাল। সেই খালেই পুঁতে রাখা হতো সব মৃতদেহ।

ঠগিদের এসব নিষ্ঠুর, বীভৎস কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জানার পর সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। বলা বাহুল্য, সফলও হলেন। ব্যাপারটা খুব গুরুত্বের সাথে নিলেন তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। চৌকস অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হলো ঠগি-আক্রান্ত জেলাগুলোতে। স্থানীয় রাজারাও তাঁদের যেসব প্রজা ঠগি হিসেবে ধরা পড়ত, তাদের জন্যে কোনো সুপারিশ করতেন না। অনেক জমিদার ও গ্রামপ্রধান ঠগিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সুখের বিষয়, তাদের সেই কুপ্রচেষ্টা সফল হয়নি। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি না করে কাউকে পথ চলতে দিত না পুলিশ। এমনকি কাউকে তিলমাত্র সন্দেহ হলেও ডাক পড়ত যেসব ঠগি রাজসাক্ষীদের। তারা এসে শনাক্ত করত সন্দেহভাজন লোকটা আসলেই ঠগি কি না।

ঠগি-দমন বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ক্যাপ্টেন রেনল্ডস গ্রেপ্তার হওয়া ঠগিদের একটা তালিকা করেছেন। এ তালিকা থেকে ঠগি-দমন কর্মসূচির সাফল্যের একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। পাঠকদের সুবিধার্থে ১৮৩১ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ঠগিদের তালিকা নিচে দেয়া হলো:

পেনাং ও অন্যান্য দ্বীপে নির্বাসিত     ১,০৫৯
ফাঁসির দণ্ড পাওয়া     ৪১২
যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত     ৮৭
জামিনের অভাবে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত     ২১
বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত     ৬৯

বিচারে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত

    ৩২

জেল থেকে পলাতক

    ১১

জেলে মৃত্যু

    ৩৬

রাজসাক্ষী হয়েছে

    ৪৮৩

দোষী সাব্যস্ত কিন্তু সাজা হয়নি

    ১২০

বিভিন্ন জেলে আছে কিন্তু এখনও বিচার হয়নি

   ৯৩৬
    মোট    ৩,২৬৬

ক্যাপ্টেন রেনল্ডস জানিয়েছেন, এই তালিকা তৈরির সময় আরও ১৮০০ কুখ্যাত ঠগি রয়ে গেছে তালিকার বাইরে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তারা। ওদেরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আরও কত নাম না-জানা তস্কর যে পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে সে তো সহজেই অনুমেয়।

যেভাবে ভারতবর্ষজুড়ে

এই পাষাণ খুনেদের হাতে ফি-বছর না জানি কত সহস্র পথিক অকালে প্রাণ খুইয়েছে! মারাঠা ও পিন্ডারিদের যুদ্ধের সময়কার বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে নির্বিঘ্নে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালাত এরা। নারী-শিশু-বৃদ্ধ কাউকে নিস্তার দিত না। ১৮৩১ সালের আগে এদেরকে নির্মূল করার জন্যেও তেমন কোনো জোরদার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ঠগিদের নৃশংস খুনের কাহিনি জনসম্মুখে আসবার পর স্রোতের মতো চিঠি আসতে শুরু করল ঠগি-দমন বিভাগের অফিসারদের কাছে। এসব চিঠিতে তারা লিখেছে, অনেকদিন ধরে তাদের আত্মীয় বা বন্ধু লাপাত্তা। নিশ্চয় ঠগিদের হাতে বলি হয়েছে তারা। স্বজনদের মৃতদেহ ওরা কোথায় পুঁতেছে, সরকার যদি দয়া করে তাদের জানায়, তাহলে অন্তত আপনজনের শেষকৃত্যটুকু করতে পারার সান্ত্বনা পাবে তারা। এই রক্তলোলুপ তস্করদের অত্যাচারের অশুভ প্রভাব কতদূর অবধি গিয়ে আঘাত হেনেছিল, তারই প্রমাণ এসব চিঠিপত্র।

অনেক উপায়ে দস্যুতা করে বেড়াত লুটেরার দল। সেরকম একটা পদ্ধতি ছিল গঙ্গার বুকে নৌযাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়া। এসব দস্যুরা নৌকাতেই থাকত। শিকারের আশায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত গঙ্গার বুকে। কোনো নৌযাত্রী দেখলে খাতির জমিয়ে ফেলত তাদের সঙ্গে। তারপর সুযোগ বুঝে লুটে নিত তাদের সর্বস্ব। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য যে-ডাকাতি প্রচলিত ছিল, তা হলো ছেলেধরা। বাবা-মাকে খুন করে তস্করের দল ছেলেদের বেচে দিত ক্রীতদাস হিসেবে—অল্পবয়েসি মেয়েদের বেচে দিত পতিতালয়ে।

পাঠকদের মনে অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঠগিদের বীভৎস কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিইনি আমি এ বইয়ে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে: এই ভয়ংকর তস্করদের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ স¤পর্কে পাঠকদের অবহিত করা।

এ বইয়ের বর্ণিত স্থান-কাল-পাত্র প্রায় সবই সত্য। বইটি ঠগি সম্প্রদায় স¤পর্কে পাঠকদের জানার তৃষ্ণা যদি এতটুকুও মেটাতে পারে, তাহলেই বুঝব আমার পরিশ্রম সার্থক।

কর্নেল ফিলিপ মিডোয টেলর

লণ্ডন, জুলাই, ১৮৩৯

[ফিলিপ মিডোয টেলরের কনফেশন্স অভ আ থাগবইয়ের অনুবাদ ঠগির জনানবন্দি (সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত) থেকে নেওয়া]

Source: tbsnews.net

Leave a Reply