রক্ষা পেল প্রথম আর্ট স্কুল ‘মহেশ্বরপাশা’

আপাতত ভেঙে ফেলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের প্রথম অঙ্কন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলনার মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের ঐতিহাসিক ভবনটি। সারা দেশের মানুষের প্রতিবাদের মুখে খুলনা সিটি করপোরেশন ভবনটি ভাঙার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিদ্যালয় কমিটিকে ডেকে ভবন ভাঙার কাজ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

১৯৭৪ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও কবি জসিমউদ্দীন এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের প্রথম অঙ্কনশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেন। শিল্পী এস এম সুলতান নানা সময়ে এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। ১৯০৪ সালে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশার নিজ বাড়ির গোলপাতা ঘরে খুলনা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রায় বাহাদুর শশীভূষণ পাল। অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা আর্ট স্কুলের পর এটিই দ্বিতীয় আর্ট স্কুল এবং তত্কালীন পূর্ব বাংলার প্রথম আর্ট স্কুল। ইতিহাস সমৃদ্ধ মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য গত বছরের ২১ জুলাই পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

 

গত ৪ জানুয়ারি দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত মোট ছয়টি দরপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের শিল্পরুচিবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক শতাব্দী প্রাচীন ভবনটি মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কিনে নেয়। এদিকে, দেশের প্রথম অঙ্কনশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে আজ শনিবার খুলনা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগ খুলনা।

 

প্রতীক নিতে এসে লাঞ্ছিত স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রতীক নিতে এসে লাঞ্ছিত স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী

এর আগে, ইতিহাসখ্যাত ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ভবনটি রক্ষার আহ্বান জানান দেশের বিশিষ্টজনেরা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, ডা. সারওয়ার আলী, সেলিনা হোসেন, মফিদুল হক, মুনতাসীর মামুন, নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ আরো অনেকে। বাংলার প্রথম আর্ট স্কুল শিল্পী শশীভূষণ পাল এই আর্ট স্কুলের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী কামিনী সুন্দরী, জ্যেষ্ঠপুত্র সুধাংশু শেখর পাল ও সুরেন্দ্রনাথ পাল। পরবর্তীকালে মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুল ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৩ সালে নগরীর বয়রায় স্হানান্তরিত করে এই স্কুলটিকে আর্ট কলেজ হিসেবে উন্নীত করার পর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘শশীভূষণ আর্ট কলেজ’। পরে এই কলেজের নামকরণ করা হয় ‘খুলনা আর্ট কলেজ’। ২০০৯ সালে খুলনা আর্ট কলেজটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। যার বর্তমান নাম ‘চারুকলা স্কুল’।

 

খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশা অনেককাল আগে থেকে একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। ১৯২১ সালে তৈরি যশোর-খুলনার মানচিত্রে এ গ্রামের অবস্হান নির্দেশিত হয়েছে। শিল্পপ্রেমী শশীভূষণ পাল আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মহেশ্বরপাশা গ্রামের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ১৯১৭ সাল থেকে স্কুলটিতে নিয়মিতভাবে ‘বার্ষিক শিল্পকর্ম’ প্রদর্শনী শুরু হয়। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ নির্বাচন করে ভারতের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পাঠানো হতো। ১৯১৮ সাল থেকে তত্কালীন গভর্নমেন্ট ও জেলা বোর্ড থেকে স্কুলের নামে সাহাঘ্য আসতে থাকে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এ সাহাঘ্য স্হায়ী ও নিয়মিত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালের দিকে মাসিকভিত্তিতে সরকারি এ সাহাঘ্যের পরমাণ দাঁড়ায় ১৬০ ও জেলা বোর্ডের ৪০ টাকা। ১৯২০ সালে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহারাজ বাহাদুর এ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তিনি স্কুলটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯২২ সালের জুলাই মাসে এ স্কুল পরিদর্শনে আসেন তদানীন্তন বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন। স্কুল দেখে তিনি খুব খুশি হন। গভর্নর লর্ড লিটন পরে লর্ড রোনাল্ড সে’ও খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন স্কুলটি পরিদর্শন করার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী তারা বহুবার স্কুলটি পরিদর্শন করেন। ১৯২৮ সালে আর্ট স্কুলে নির্মিত হয় ‘নতুন ভবন’। ১৯২৯ সালের ১৯ মে এই ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তদানীন্তন খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ কুইনটন। খুলনা-যশোর মহাসকের পশ্চিম পাশে অযত্ন-অবহেলায় আজও যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ তার গুরুত্ব হারায়। তারপরও স্কুলটিতে কোনোরকম কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রানি ভিক্টোরিয়ার আবক্ষমূর্তিসহ আর্ট স্কুলের ছোট-বড় অসংখ্য মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর স্কুলের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ শশীভূষণ শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষক আলাউদ্দীন আহমদের হাতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে ভারতে চলে যান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্কুলটি আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ করে আশির দশকের শুরুতে এ স্কুলটির প্রতি পুনরায় সুধীজনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে থাকে। ১৯৮৩ সালে স্কুলটি নতুনভাবে চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তখন এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘শশীভূষণ আর্ট কলেজ’।

প্রতিবাদের মুখে ভবন ভাঙা আপাতত বন্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট ভবনটি ঘিরে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ভবনটি অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন খুলনাসহ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। ইতিমধ্যে দেশের প্রথম অঙ্কনশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে স্হানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগ। এছাড়া ইতিহাসখ্যাত ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ভবনটি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।

 

মহেশ্বরপাশা শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী পুরোনো ভবনটি অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি। গত ৫ জানুয়ারি একজন ঠিকাদার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় দরপত্রের মাধ্যমে নিলাম পেয়েছেন। তবে, এখনো ভবন অপসারণের কোনো চিঠি আমরা হাতে পাইনি। আমরা চাই ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ভবনটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষণ করা হোক।

 

এছাড়া গত বুধবার দুপুরে খুলনার সাংস্কৃতিক সংগঠক ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রিয় নাগরিকরা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের অফিস কক্ষে দেখা করে শতাব্দী প্রাচীন মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের ঐতিহাসিক ভবনটি রক্ষার জন্য দাবি জানান। তাদের দাবির মুখে সিটি মেয়র তাত্ক্ষণিকভাবে ফোন করে শশীভূষণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ও দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আলীকে ডেকে পাঠান। সেখানে সাংস্কৃতিক সংগঠকদের উপস্হিতিতে আপাতত ভবন ভাঙার কাজ স্হগিত রেখে স্হাপনাটি সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন।

 

খুলনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি হুমায়ুন কবির ববি বলেন, উন্নয়নের নামে খুলনার ইতিহাস-ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতিমধ্যে শত বছরের ঐতিহ্য পৌরভবন, ডাকবাংলো ভবন, পোস্ট মাস্টার জেনারেলের কার্যালয় ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের শিল্পকলার পথিকৃত্ শশীভূষণ পাল কর্তৃক ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম অঙ্কন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের প্রথম একাডেমিক ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রিয় মানুষেরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না।

 

ইত্তেফাক

 

 

Leave a Reply