Deprecated: Function WP_Dependencies->add_data() was called with an argument that is deprecated since version 6.9.0! IE conditional comments are ignored by all supported browsers. in /home/amadersa/public_html/wp-includes/functions.php on line 6131
রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলা সংস্কৃতির এবং বাঙালির সর্বোচ্চ সম্পদ

রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলা সংস্কৃতির এবং বাঙালির সর্বোচ্চ সম্পদ

দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত তো এক সময় বড় বড় শিল্পীরাই নিতে পারেননি, প্রতিবাদ করেছিলেন, এমনকী তাঁকে ব্রাত্য করেছিলেন। কারণ তিনি সুর খানিকটা বদলে দিতেন গাওয়ার সময়। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিখুঁত ভাবে গাওয়ার চেষ্টা রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই চলছে। তারপরও পুরোনো ছক ভেঙে বেরিয়ে আসার ঔদ্ধত্যও কোনও কোনও শিল্পী দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন তাঁর দেওয়া সুরেই তাঁর গান গাওয়া হোক।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নানা ভাবে নানা শিল্পীই গান। আধুনিক সব বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করেন কিছু শিল্পী। কিছু শিল্পী নিজের মতো করে একটু আধটু সুর এদিক ওদিক করে পরিবর্তন আনতে চাইছেন গানে। এসব কারও ভালো লাগে, কারও লাগে না। এ নিয়ে বিতর্কও কম নয়। কেউ বলেন বেশি লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে ইয়ং জেনারেশান যেমন মিউজিক পছন্দ করে তেমন কিছুটা মেশাতে হবে, কেউ বলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপি মেনেই গাইতে হবে। যাঁরা পরিবর্তন চান, এবং যাঁরা চান না, তাঁরা সকলেই শিল্পী, শিল্পীদের কোনও মতই একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
রোদ্দুর রায় ইচ্ছে করেই বিকৃত করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। তিনি জানেন গানটি, বিকৃত করছেন জেনেই বিকৃত করেন, তিনি গান নিয়ে মজা করেন, ফাজলামি করেন, স্যাটায়ার করেন। অশ্লীলতা করছেন জেনেই তিনি অশ্লীলতা করেন। রোদ্দুর রায় আর হিরো আলম এক নয় । হিরো আলম রবীন্দ্রসঙ্গীত বিকৃত করে গায় না। সে সিরিয়াসলি গায়। ওইরকমই সে গাইতে পারে, ওর চেয়ে ভালো সে পারে না।
হিরো আলম আপাদমস্তক একটা অশিক্ষিত লোক। সে জানে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন । সে উচ্চারণ করতে জানে না রবীন্দ্রনাথ শব্দটি, সে কাজী নজরুল ইসলামকে বলে ‘নরজুল’। সে জানেই না ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘নরজুল’ কী লিখেছেন তাও সে জানে না। একটা অশিক্ষিত লোক গ্রামে গ্রামে ডিশ বিক্রি করতো, সে নানারকম গানে ঠোঁট মিলিয়ে জঘন্য সব ভিডিও বের করতো, সেসব ভিডিওতে লম্ফ ঝম্ফ করার জন্য ভাড়া করে মেয়ে নিয়ে আসতো। অতি নিম্ন রুচির লোকেরা সেসব দেখতো। অশিক্ষিত এবং নিম্ন রুচির লোকের অভাব নেই বাংলায়, সে কারণে হিরো আলমের জনপ্রিয়তা। হিরো আলম কোনও শিল্পী নয়, সে ভিন্ন সুরে বা বিকৃত সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না, সে জানেই না আসল সুর কোনটি। সুর তো সুর, গানের কথাও সে উচ্চারণ করতে জানে না।
কেউ কেউ বলবেন,সে গান জানে না বলে কি তার গাওয়ার অধিকার নেই? নিশ্চয়ই তার অধিকার আছে, সে ইউটিউব ভাসিয়ে ফেলুক তার তথাকথিত গানে, অশিক্ষিতরা শুনবে সেগুলো, অনেকে শুনবে তাকে নিয়ে অট্টহাসি হাসার জন্য। লোক হাসানোও তো একটা কাজ, সেটাই না হয় করছে সে। কেউ কেউ বলবেন, কত কত লোক কত দুর্নীতি করছে, লুঠ করছে, খুন করছে, তাদের তুলনায় তো হিরো আলম ভালো।
নিঃসন্দেহে ভালো। তাই বলে অখাদ্যকে খাদ্য বলে মেনে নিতে হবে কেন? পুলিশের কাছে মুচলেকা দিতে হয়েছে, সুতরাং জনগণের বিচারে সে ভিকটিম। ভিকটিমকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেক সময় লোকে তাদের কাজকেও সমর্থন করে ফেলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলা সংস্কৃতির এবং বাঙালির সর্বোচ্চ সম্পদ, সেটিকে মানুষের কাছে ভুলভাবে পৌঁছে দেওয়ার এবং হাস্যকরভাবে পরিবেশন করার অধিকার তার থাকতে পারে, কিন্তু তার অখাদ্যকে অখাদ্য বলার অধিকারও মানুষের আছে, তার অশিক্ষা আর রুচিহীনতাকেও অশিক্ষা আর রুচিহীনতা বলে ডাকার অধিকারও মানুষের আছে।
যখন বাংলাদেশে ছিলাম, আমার বাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশের লোক আসতো, জানতে চাইতো আমি ”লজ্জা” বইটি কেন লিখেছি। একঘণ্টা- দু’ ঘণ্টা থাকতো, আর নানা প্রশ্ন করে যেত। আমি সোজা উত্তর দিতাম, ‘আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা পড়েছি, যা উপলব্ধি করেছি, তার ভিত্তিতেই লিখেছি লজ্জা’। এরপর এল ”ফেরা” বইটি কেন লিখেছি জানতে। বলেছি, ‘ফেরা একটি উপন্যাস, আমার কি উপন্যাস লেখার অধিকার নেই?’ ওদের কথায় মনে হতো আমার সেই অধিকার নেই। আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যেত। প্রতিটি অদ্ভুতুড়ে প্রশ্নের উত্তর আমি শান্ত কণ্ঠে দিয়েছি, এবং কঠিন কণ্ঠে এও জানিয়ে দিয়েছি, ‘তোমরা যতই বাড়ি বয়ে এসে আমাকে ভয় দেখাও, থ্রেট করো, আমার যা ইচ্ছে করে লিখতে, আমি তা-ই লিখে যাবো।’
আমাকে ডিবির লোকেরা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যে কারণে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিল, এবং থ্রেট করেছিল, তা হলো, আমি সচেতনতা ছড়াচ্ছিলাম সমাজে, সাম্প্রদায়িকতা আর অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলাম। আজও সচেতন মানুষের বাকস্বাধীনতাকে সরকার অপরাধ হিসেবে দেখে। তাই পুলিশকে লেলিয়ে দেয় সচেতনতা বন্ধ করতে।
বাংলাদেশের হিরো আলম একটা অজ্ঞ, অশিক্ষিত, গুণহীন, ভাঁড় জাতীয় কুৎসিত লোক। সে বাংলা শব্দের উচ্চারণ জানে না, সে বাংলায় কথা বলে। সে গান জানে না, গান গায়। সে নাচতে জানে না, নাচে। সে রাজনীতি জানে না, রাজনীতি করে। সে জানেও না যে সে জানে না এসব। এই ভাঁড়টাকে পুলিশ ডেকে নিয়ে তার ভাঁড়ামো বন্ধ করতে বলেছে। বলেছে যা তুই জানিস না, তা তুই করবি না। মূর্খটা ভয় পেয়ে নাকে খত দিয়ে এসেছে, আর এসব ছাইপাঁশ করবে না।
প্রশ্ন হলো, পুলিশের কাজ কি মানুষকে বলা যা তুই পারিস না তা তুই করবি না? সাহিত্য সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার ভার পুলিশকে কে দিয়েছে? যে কারও গান যে কেউ গাইতে পারে, হিরোর ছাইপাঁশ যাদের অপছন্দ তারা তার ছাইপাঁশ দেখবে না, ব্যস মিটে গেল। কপিরাইট ইস্যু যেখানে, সেখানে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে কপিরাইটওয়ালারা। পুলিশের কাজ নয় শাসানো। পুলিশ তো দেখছি মানুষের ব্যক্তি জীবনেও এরপর নাক গলাবে, কে কার সঙ্গে প্রেম করছে, কে কার সঙ্গে শুচ্ছে, কে হিজাব পরছে না, কে দাড়ি রাখছে না, এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে যাকে তাকে থানায় ডেকে নেবে। পুলিশের কাজ সমাজের ক্রাইম বন্ধ করা। প্রেম করা, সেক্স করা, হিজাব না পরা, দাড়ি না রাখা কোনও ক্রাইম নয়। হিরো আলমের অজ্ঞতাও কোনও ক্রাইম নয়, তার মূর্খতা, গুণহীনতাও কোনও ক্রাইম নয়।
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কুরুচি আর বিকৃতির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে আসেনি পশ্চিমবঙ্গ। তাই বাংলাদেশের হিরো আলমকে পুলিশের কাছে গিয়ে মুচলেকা দিতে হয়েছে বিকৃত সুরে এবং ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত সে আর গাইবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রোদ্দুর রায়কে এ কারণে পুলিশেরা তলব করেনি, তাকে এ ধরণের কোনও মুচলেকাও দিতে হয়নি।
এ থেকে কী বোঝা গেল? বোঝা গেল যেমন ইচ্ছে তেমন করে গান গাওয়ার অধিকার পশ্চিমবঙ্গে বেশি, এমনকী রবীন্দ্রসঙ্গীতও রুচিহীন ভাবে গাওয়ার অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিকৃত সুরে ভুল উচ্চারণে অন্য যে কোনও গান গাওয়ার যে কারও অধিকার থাকুক, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অধিকার নেই।
লোকে যে যাই বলুক, বাংলাদেশের এই রবীন্দ্রপ্রেম আমার বেশ ভালো লেগেছে।
পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রপ্রেমে সারা বছর হাবুডুবু খেলেও, প্রেমদৌড়ে বাংলাদেশের কাছে এবার গোহারা হেরেছে বটে।

 

Leave a Reply