সমাদরণীয় কালের কণ্ঠের শুক্রবারের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিচিত্রিতাবিষয়ক ক্রোড়পত্র শিলালিপি ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত বর্তমান লেখকের একটি অতি অকিঞ্চিৎকর লেখা ‘কে এই রামসুন্দর বসাক’ শিরোনামে তরুণ কবি শ্যামলচন্দ্র নাথের অনুলিখনটি যে হনুলিখনে পরিণত হয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবে, কে ভেবেছিল। আর লেখাটি কেন এমন হলো তা বোধের অগম্যই রয়ে গেল। জানামতে, কবিতা ঘুড়ি পদ্য লেখার ব্যাপারটা বাঙালি ঘরানা অনুযায়ী অনেকটা শ্মশ্রু-সমুদ্ভবের মতোই। কিন্তু গদ্য লিখতে যে যথাযথ ঋজু টানটান বাগবিন্যাস, সঠিক তথ্যনির্ভর, তদুপরি কিছুটা পঠন-পাঠনের প্রয়োজন হয়, সে কথাটি বাবু শ্রী শ্যামলনাথ বেমালুম তালগোল পাকিয়ে বসে আছেন।
রাম সুন্দর বসাক প্রনীত আদি বাল্যশিক্ষা
প্রথমে সুধী পাঠকবৃন্দকে উলি্লখিত হনুলিখনটি পুরোটা পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। আমার মূল বক্তব্য ছিল, বিশেষ করে আমরা পূর্ববঙ্গবাসীরা প্রথম বাল্যপাঠ নিয়েছি রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা আর আদর্শলিপি থেকে। যখন সমগ্র বাংলা সাহিত্য স্বমহিমায় বিরাজ করছে। প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বর্ণ পরিচয়’ আর স্বয়ং কবিগুরুর ‘সহজপাঠ’। এই বই দুটির তুলনায় ঢাকার অখ্যাত অবজ্ঞাত রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’র প্রাথমিক পাঠ আমরা যারা সাধারণ মানুষরা নিয়েছি, আমাদের হনুলেখক কবি সাহেব আমার বক্তব্যকে তাঁর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে যা উপস্থাপন করেছেন, তা এককথায় গর্হিত বললেও কম বলা হয়।
এক জায়গায় তিনি ‘বসাক’ সম্প্রদায় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিয়েছেন এভাবে_সাধারণত বসাকরা ছিলেন ‘ডাকাত’। এর মানে কী? বসাক পদবি (লোকেশ্বর বসুর আমাদের পদবির ইতিহাস অনুযায়ী) বসাক অবশ্যই বস্_বস্ত্র সম্পর্কিত। বসক থেকে? এ রকম প্রতি ছত্রে ছত্রে শ্যামলচন্দ্র নাথ তাঁর অশেষ জ্ঞানগম্যির যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন, তা এককথায় শিউরে ওঠার মতো। যেমন_তিনি এক জায়গায় প্রকৃত ইতিহাসবেত্তার মতো গভীর অনুসন্ধিৎসায় সবচেয়ে দুঃখের বিষয় লিখেছেন এই যে কে রামসুন্দর বসাক তা আমরা অনেকেই জানি না।
রাম সুন্দর বসাক প্রনীত আদি বাল্যশিক্ষা
তাঁকে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, কিছু নেই। ঢাকায় বসাকরা বাস করে। তাঁরা অনেককাল ধরে বাস করে আসছেন। যেমন_রথখোলার মদনমোহন বসাক লেন। তা কী হলো। লেখাটার মাথামুণ্ডু বোঝার কোনো উপায় নেই। জানি ছাপাখানায় সচরাচর ভূতদের দৌরা@ে@@@্য চেনা দায়। এখানে ভূতবেশী কে? হনু লেখাটি বা মূল লেখক। এই আমি। রচনাটি পড়ার পর প্রীতিভাজন শ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ টেলিফোন করে আমার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে পাঠক্রম বিষয়ে তাঁর লেখার ইচ্ছার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন।
বেলাল চৌধুরী
কালিদাস গোপাল ভাঁড় খনার জনপ্রিয় বচন
ধাঁধাঁ 1000 শালি দুলাভাই এর রসের ধাঁধা
বাল্যশিক্ষা ও আদর্শলিপি” নিয়ে কিছু কথা-তাপস কুমার নন্দী
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”। বাঙালির শাস্বত শিক্ষা- সংস্কৃতিতে বাল্যকালের শিক্ষার প্রথম ধাপের এই প্রত্যয়টির প্রায়োগিক দিক আমাদের “বাল্যশিক্ষা”র শুরুতে সীতানাথ বসাক প্রণীত “আদর্শলিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়” বইয়ের প্রথমেই “অ’তে- অসৎ সংঘ ত্যাগ কর” বাক্যটি দিয়ে কোমলমতি শিশুদের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু হত। তার পরের বাক্যটি “আ’তে–আলস্য দোষের আকর”।
সামাজিক জীবন দর্শনে সততা ও পরিশ্রমের অনিবার্যতার বিষয়কে সামনে রেখে আদর্শলিপির শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের এই দুটি আদর্শ ভিত্তিক বাক্যের পাঠ দিয়ে বঙ্গশিশুর মনে শিক্ষা ও আদর্শের ভিত্তি রচিত হত। সততা ও পরিশ্রমের এই আদর্শিক মননশীলতা গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি সফল, সার্থক, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দময় জীবন গঠনের মূল শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা গেলে আদর্শবাণ অথবা সফলতম একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
রাম সুন্দর বসাক প্রনীত আদি বাল্যশিক্ষা
ভাল হয়ে চলতে গেলে, সুস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন জীবন ব্যবস্থায় ভালভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে এই দুটি বাক্যের ভাব সম্প্রসারণগত অর্থ জীবনের আদ্যান্তের প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি কর্ম ও ক্রিয়ায় অনুকরণীয় এবং প্রায়োগিক। প্রতিটি জীবন ও সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক এবং প্রাকৃতিক বিবর্তিত ধারায় ‘অসততা’ ও ‘অলসতা’ পরিহার করা প্রতিটি মানুষের সামাজিক মানুষ হিসেবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি অনিবার্য এবং সার্বক্ষণিক চ্যালেঞ্জ। আমাদের বাল্যশিক্ষার সুচনায় এই দুটি আদর্শিক বাক্যে সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরে প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পথ প্রদর্শিত হয়েছে।
রাম সুন্দর বসাক প্রনীত আদি বাল্যশিক্ষা
সময় ও সামাজিক বিবর্তনের ধারায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের এই সনাতনী শিক্ষার প্রচলন বা প্রতিফলন কতটুকু, অথবা প্রকৃতপক্ষে এই আদর্শিক শিক্ষার কোন মূল্যবোধ অথবা প্রয়োগের প্রয়োজন আধুনিক সমাজে আদৌ রয়েছে কিনা তা নিয়ে ভাববার, সতর্ক বিচার বিশ্লেষণের সময় এসেছে। গুণ ও গুণীর কদর, সত্য ও নিষ্ঠার মূল্যায়ন, শ্রম ও মেধার যাচাই বাচাইএ আজ নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ।
বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তিত ধারায় সত্য-সুন্দর, স্বার্থ-সমাজ, ন্যায়- নৈতিকতার প্রকৃত অর্থ নিয়ে অযথা সংশয়, তথা ভিন্নমত আজ যুক্তি, তর্কে ও বিতর্কের মধ্যে নিমজ্জিত। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রচলিত এই বাক্য দুটির প্রচলন অব্যাহত রেখে এর নুন্যতম ভাবার্থও যদি ব্যক্তি ও সামাজ জীবনে প্রতিফলিত করার সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেত তা হলে আমাদের বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা আরও সুন্দর ও সহনশীল হত, সমাজে ন্যায়-নীতির কদর, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধের বাস্তবানুগ মূল্যায়ন হত। ‘ভাল’-‘খারাপ’ বিষয়টি আপেক্ষিক।
রাম সুন্দর বসাক প্রনীত আদি বাল্যশিক্ষা
সমাজ-সংস্কৃতি, ব্যক্তি, পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এর মাত্রা, গুরুত্ব নির্ণয় এবং বিচারিক মূল্যায়ন এক বা অভিন্ন নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও একটি শিশু অথবা একজন শিক্ষানবিস একই জিনিষ সমান দক্ষতা বা মানে শিখার কথা নয় এবং সম্ভবও নয়। তারপরও কোন বিষয়ের মৌলিক দিক, সর্বজন গ্রাহ্য সাধারণ ভাবার্থে ভিন্নতা থাকার কথা নয়।
সমস্যা আমাদের তখনি, যখন মানবতা, সমাজ ও সংস্কৃতিকে আমরা রাজনীতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণের সাথে বা বৈষম্যে গুলিয়ে ফেলি। মানবিক, সামাজিক ও সহাবস্থানের সমন্বিত এবং সামগ্রিক মূল্যবোধকে আমরা ব্যক্তি, কোটারী, দল বা ধর্মীয় স্বার্থে ব্যবহার করি। প্রতিটি মানুষ বাল্যশিক্ষায় আদর্শলিপির প্রণীত প্রথম দুটি চয়নের বাস্তবানুগ ও প্রায়োগিক অর্থ যদি যথার্থভাবে প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলায় অভ্যস্থ হত, তবে বাঙালি জাতি আরও সৎ, কর্মঠ, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করা সম্ভব হত। অনিবার্য হত আমাদের ব্যক্তিগত সুখ ও সামাজিক শান্তি।