শান্তিনিকেতনের শ্যামলীতে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলেন জওহরলাল নেহরুর ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থ।

জ্যৈষ্ঠের দুপুরে শান্তিনিকেতনের শ্যামলীতে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলেন জওহরলাল নেহরুর ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থ। দ্রুত পাঠ শেষ হলে, বসলেন নেহরুকে পত্র রচনায়। ১৯৩৬ সালের ৩১ মে, ‘প্রিয় জওহরলাল’কে লিখলেন, “এই মাত্র আমি তোমার মহাগ্রন্থ পড়া শেষ করেছি। তোমার এই কীর্তির দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত ও গৌরবান্বিত। গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের মধ্য দিয়ে মনুষ্যজাতির এমন এক নিগূঢ় ধারা প্রবাহিত যা সত্যের জটিলতা অতিক্রম করে সেই ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাবার যিনি তাঁর কীর্তির চেয়ে মহৎ এবং পরিবেষ্টনের চেয়ে সত্য।

তোমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” রবীন্দ্রনাথের এই প্রশংসাপত্র পেয়ে উদ্বুদ্ধ নেহরু। চিঠি পেয়ে মুগ্ধতায় নেহরু ১০ জুন ১৯৩৬ সালে কবিকে জবাব পাঠালেন। লিখলেন, “অনেক বন্ধু আমার বইয়ের প্রশংসা করেছেন। কেউবা আমার সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু আপনার প্রশংসাবাণী আমাকে আনন্দিত ও শক্তিশালী করেছে। আপনার আর্শীবাদ পেলে আমি বোধহয় এক বিরুদ্ধ পৃথিবীর সামনে দাঁড়াতে পারি।” নেহরুর মনে যেমন সবসময়ই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিরাজিত, তেমনি রবীন্দ্রনাথের মনেও ছিল নেহরুর আনাগোনা। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর স্থায়িত্ব রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর হাতে। এ সম্পর্কে বলেছিলেন নেহরুকেও। নেহরুও পুরোপুরি অবহিত ছিলেন বিষয়টি। শান্তিনিকেতন কোনো কারণেই যাতে অতীত গৌরব হারিয়ে না ফেলে সে জন্যে কবিগুরুর তিরোধানের পরপরই তিনি শান্তিনিকেতনের হাল ধরেছিলেন।
তারই কর্মকুশলতায় বিশ্বভারতী স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৯৫১ সালে স্বীকৃত পেয়েছিলো। নেহরু হলেন বিশ্বভারতীর আচার্য। সেই থেকে বিশ্বভারতীর প্রায় প্রতিটি সমাবর্তনে তিনি যোগ দিয়েছেন। তাঁর কন্যা, শান্তিনিকেতনের ছাত্রী, রবীন্দ্রনাথের প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাও ছিলেন বিশ্বভারতীর আচার্য। তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধীও ছিলেন আচার্য। তিন প্রজন্ম শান্তিনিকেতনের প্রতি ছিলেন নিবেদিত।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় নেহরু শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন ৫ বার, রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর ১০ বার। বিশ্বভারতীর মর্মস্থলে রবীন্দ্রনাথের যে আদর্শ কাজ করে; ভারতের মর্মে মর্মে নেহরু সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। নেহরুর কাছে শান্তিনিকেতন ছিল এক স্বপ্নরাজ্য। লিখেছেনও তাই, “যখনই এখানে আসি, আমার সাহস বাড়ে আমি পুনরুজ্জীবিত হই। যেন আমার কানে আসে গুরুদেবের কন্ঠস্বর। তাঁর বাণী প্রতিধ্বনিত হয় আমার মনে। আমি তাতে উৎসাহিত হই এবং এখান থেকে ফিরে যাই। আশা করি যেমন আমি এসেছিলাম তার চেয়ে একটু উন্নত হয়ে ফিরছি।”
শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথ তো সমার্থক। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের অসংখ্য গুণগ্রাহী ছিলেন, যাঁদের মধ্যে গান্ধী ও নেহরু উল্লেখযোগ্য। গান্ধীর কাছে ‘শান্তিনিকেতনই ভারতবর্ষ’ ছিল। বলেছেনও, “আমি যেখানেই থাকি না কেন শান্তিনিকেতন সবসময় আমার হৃদয় জুড়ে থাকে।” আর নেহরু বলেছিলেন, ‘শান্তিনিকেতন হচ্ছে আমার কাছে ‘নিঃস্ব মরুস্থলীর মধ্যে এক মরুদ্যান’। শান্তিনিকেতন নিয়ে বোধহয় রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের সঙ্গে নেহরুর স্বপ্ন এক হয়ে গিয়েছিল। নেহরু কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায় নাগরদোলায়ও চড়েছেন।
ভারতে ঊনিশ শতকের শেষদিক থেকে এই একুশ শতক পর্যন্ত রাজনীতিতে নেহরু পরিবার এখনো বিদ্যমান। স্বনামধন্য আইনজীবি ও রাজনীতিক পন্ডিত মতিলাল নেহরুর একমাত্র সন্তান পন্ডিত জওহরলাল নেহরু জন্মেছিলেন ১৮৯০ সালে ১৪ নভেম্বর। আর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালের ৮ মে। নেহরু বয়সে ২৯ বছরের ছোট হলেও রবীন্দ্রনাথের খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলেন নিজের কর্মকুশলতায়। এমনিতে প্রাচুর্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা কাশ্মীরী বংশোদ্ভূত শৈশবে ইংরেজ গবর্ণেস এবং কৈশোরে ইংরেজ গৃহশিক্ষকের তত্বাবধানে বিদ্যার্জন করেছেন। এরপর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পাবলিক স্কুলে হ্যারোতে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ইনার টেম্পল থেকে বার-এট-ল পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখান। ১৯১১ সালে স্বদেশে ফেরার পর লাহোর হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। কিন্তু আইন পেশার চেয়ে রাজনীতি তাঁকে প্রভাবিত করে গভীরভাবে। কারণ পিতার রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা তখন কেবল উত্তর ভারত নয়, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে একযোগে স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেছিলেন। পুত্রের সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা, তাকে দ্রুত শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভারতের শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য সাইমন কমিশন ১৯২৮ সালে ভারতে আসেন। ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের একটি রূপরেখা তৈরির জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়, তাতে সভাপতি পিতা মতিলাল এবং সম্পাদক পুত্র জওহরলাল। পিতা-পুত্র উভয়ে ‘নেহরু রিপোর্ট’ই প্রণয়ন করেছিলেন। যাতে প্রাচ্যে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির প্রস্তাব ছিল।
নেহরুর রাজনৈতিক ধ্যান ধারণায় অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিলেন মহাত্মাগান্ধী। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ মনিষীর চিন্তাধারাও তাঁকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে গান্ধীর মত ও পথ গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেছিলেন। তারপরও গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ অটুঁট রেখেছিলেন। নেহরু শুধু রাজনীতিক নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাস এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনেও ছিল তার গভীর জ্ঞান। ১৯৩৬ সালেই প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনী। এছাড়া ‘ইন্ডিয়া এন্ড দি ওয়ার্ল্ড’, ‘দি ইউনিট অব ইন্ডিয়া’, ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিষ্ট্রি’, ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, ‘সোভিয়েত রাশিয়া-ইন্ডিপেন্ডেন্স এন্ড আফটার’ ইত্যাদি গ্রন্থ তাঁকে একজন ‘পন্ডিত’ হিসেবে অভিধা দিয়েছে। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে ১৯২০ সালে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই যাত্রা থেকে কংগ্রেসের চারবার সভাপতি শুধু নন, টানা ১৭ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কখনো জনগণের শ্রদ্ধা হারান নি। আধুনিক ভারতের তথা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধান স্থপতি হিসেবে তিনি স্বরিত হয়ে আসছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘জোট নিরপেক্ষে আন্দোলন’ তথা ‘ন্যাম’ গড়ার অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি। এক কৃতি মানুষের আবরণে আচ্ছাদিত ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এবং নেহরু দু’জনেই সোভিয়েত রাশিয়া সফর শেষে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন। নেহরু প্রথম রাশিয়া সফর শেষে এসে লিখলেন গ্রন্থ, ‘সোভিয়েত রাশিয়া’। আর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘রাশিয়ার চিঠি’। একজন রাজনীতিক এবং অপরজন কবি ও মনীষী। দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গীতেও আছে পার্থক্য। উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মতবিনিময়ও করেছেন। আইন অমান্য আন্দোলনকালে গ্রেফতার ও কারাদন্ডে দন্ডিত হন। কারাগারে তিনি মার্কসীয় দর্শনের উপর প্রচুর পড়াশোনা করেন। তাই তাঁর রাজনৈতিক চেতনায় সমাজতান্ত্রিক আবহ প্রাধান্য পেয়েছিল। জেলখানা থেকে কন্যা ইন্দিরাকে লেখা পত্রগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব শুধু নয়, সাহিত্যমূল্য আজো বিবেচ্য।
নেহরু দেশে ফেরার দু’বছরের মাথায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান এবং বিশ্বকবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্য বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে দেশ-বিদেশে প্রকাশিতও হচ্ছে তখন। নেহরুর দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্র রচনার প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৯১৫ সালে শান্তিনিকেতনে গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎকারের পরের বছর নেহরু সান্নিধ্যে আসেন গান্ধীর। আইন ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিতে নেমে এলেন নেহরু। গান্ধীই তাঁকে পথ দেখালেন। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিনওয়ালাবাগে সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ শাসক প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। ভারতের বড়লাটকে ১৯১৯ সালের ৩০ মে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়। নেহরু তা পাঠ শুধু নয়, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াও তাঁর দিনপঞ্জিতে তুলে রাখেন। “রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু সূক্ষ্মগ্রাহী ছিল তাঁর মন, এমন তীব্র আকাঙ্খা দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ছিল যে, কবিতা ও গানের ভাবলোক থেকে তাঁকে বারেবারে বেরিয়ে আসতে হতো। যখনই কোনো পরিস্থিতি তাঁর দুর্বিষহ মনে হয়েছে তখনই তিনি তাঁর কবিজনোচিত নেপথ্য থেকে ইংরেজ সরকার কিংবা স্বদেশের লোকদের প্রতি বজ্রনির্ঘোষে তাঁর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। বিশ শতকের প্রারম্ভে বঙ্গদেশে স্বদেশী আন্দোলনের ঝড় উঠলে পর দুর্গম পথযাত্রীদের পুরোধা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অমৃতসরের হত্যাকান্ডের পর যখন তিনি ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। সেই সময় রাজনৈতিক ভারতবর্ষের পুরোভাগে আর এশবার তাঁর দৃপ্ত মূর্তি দেখা গেলো।” নেহরু রাজনৈতিক ভারতের পুরোভাগে রবীন্দ্রনাথকে স্থাপন করেই ক্ষান্ত হন নি, ভারতবাসীর শিক্ষা-সংস্কৃতির কর্ণধাররূপেও কবিকেই কল্পনা করেছিলেন। কবির শান্তিনিকেতনকে তার শিক্ষাদর্শ মনে হয়েছিল। “শিক্ষার গঠনমূলক যে কাজ তিনি নিভৃতভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে শুরু করেছিলেন, আজ তার ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থানরূপে স্বীকৃত হয়েছে শান্তিনিকেতন। ভারত মানসের উপর বিশেষত দেশের তরুণ সমাজের উপর তাঁর অসাধারণ প্রভাব পড়েছে।” নেহরু যখন এই প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন, তখনো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার পরিচয় হয় নি। তবে রবীন্দ্রসান্নিধ্য নিশ্চয় তার বাসনায় ছিল। সে সুযোগও মিলে গেল বছরখানেক পর কলকাতায় যখন কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে। ১৯২০ সালের ৪ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলে। গান্ধীর সঙ্গে যোগ দিলেন নেহরু। অধিবেশন শেষে ফেরার পথে গান্ধীর সঙ্গে ১৩ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে যান। এই প্রথম তার শান্তিনিকেতন দর্শন। আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, “কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন সেরে ফিরে যাবার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর অতিপ্রিয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা ‘বড়দাদা’র (দ্বিজেন্দ্রনাথ) সঙ্গে দেখা করতে আমরা শান্তিনিকেতন গেলাম। আমরা সেখানে কয়েকদিন ছিলাম। আমর আরও মনে পড়ে সি.এফ. এন্ডরুজ আমাকে কতকগুলো বই দিয়েছিলেন, সেগুলি আমাকে আনন্দ দিয়েছিল এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।” তবে প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন হলেও নেহরুর আর প্রথম রবীন্দ্রদর্শন হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তখন ইউরোপে সফররত। রবীন্দ্রবিহীন শান্তিনিকেতনে নেহরু কয়েকদিন কাটালেন দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং এন্ড্রুজের সঙ্গে। যাদের অসাধারণ সরলতা নেহরুকে আকৃষ্ট করেছিলো। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘শান্তিনিকেতন প্রশাস্তি ‘শান্তিনিকেতন না যদি দেখিলে/ নয়ন তবে কি কারণ’ আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, কনিষ্ঠপুত্র দেবদাসও ছিলেন। তাঁদের আমন্ত্রণ উপলক্ষে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ-নেহরু প্রথম দেখা করে কোথায় কখন সে নিয়ে কেউ উল্লেখ করেন নি। নেহরু লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের সাক্ষাতের কথা মনেই পড়ে না। আমার শুধু অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম।”
জালিনওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের লেখা পত্র প্রকাশের পর ভারতবর্ষে আরো অনেক ঘটনা ঘটে। ১৯২১ সালে গান্ধীর প্রভাবিত অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর মতৈক্য বেশিদিন টেকেনি। ১৯৩৪ সালে বিহারে ভূমিকম্পজনিত দূর্ঘটনা সম্পর্কে গান্ধীর বিবৃতির প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গান্ধী বলেছিলেন, ‘অস্পৃশ্যতার পাপের ফলে বিধাতার কোপ’ এই ভুমিকম্প। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এর প্রতিবাদে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, “অস্পৃশ্যতার পক্ষে যাহারা হত বা আহত হইয়াছে, যাহাদের গৃহাদি ধংস হইয়াছে, বিধাতার শাস্তি তাহাদের উপর পড়িল, আর সারাদেশে যাহারা স্পর্শদোষ মানিয়া চলিতেছে তাহারা তো দিব্য বাঁচিয়া রহিল-এ কবি কেন, কাহারও পক্ষে মহাত্মাজীর এই যুক্তি মানিয়া লওয়া সম্ভব নয়ে।” রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিবাদ নেহরুকে তাঁর মতামত প্রকাশ্যে তুলে ধরতে সহায়তাই করেছিল। যুক্তিবাদী নেহরু গান্ধীর বক্তব্যকে মেনে নিতে পারেন নি। প্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে গান্ধীর বিবৃতির তিনিও প্রতিবাদ করলেন এই ভাষায় “অস্পৃশ্যতার পাপে ভূমিকম্প হয়েছে, গান্ধীজীর এই বিবৃতি পাঠ করে আমি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। এরূপ মন্তব্য বিভ্রান্তি কর। রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যের জবাবে যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তরকে আমরা স্বাগত জানাই।” নেহরু দূর থেকে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করেছেন তখনো। রবীন্দ্রনাথের রচনা তার পাঠ ও অনুধ্যানে তখন আলোড়ন তুলছিল। রাজনৈতিক বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যকে তিনি মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করছিলেন। লিখেছেন, “তখন রবীন্দ্রনাথ যা কিছু লিখেছেন এবং সেগুলি যত বেশি আমি পড়েছি ততই আমি তাঁর প্রশংসা করেছি এবং তাঁর সঙ্গে সহমত হয়েছি। তখনকার লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘সত্যের আহবান’ এবং গান্ধীজীর ‘মহাপ্রহরী’ বিস্ময়করভাবে সুখপাঠ্য ছিল এবং আমি বলি কি এখনো আছে। এই দুটি লেখা সত্যের দু’টি দিক উম্মোচিত করেছে। কোনোটিই তুচ্ছ নয়।”
দূর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে নেহরুকে ক্রমশ প্রভাবিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ তখনো সে ব্যাপারে স্পষ্ট হন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় নেহরুর জীবনে বড় ঘটনা। লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে দমকা বাতাসের মতো আসেন নি। আমি দেখে দেখে অবাক হই, কেমন করে তাঁর সৃষ্টি এবং কিছুটা তাঁর সত্তা আমাদের, আমাকে এবং আমার সময়কে গড়ে তুলছিল। গান্ধীজীর সঙ্গেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং তিনি আমাকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করেছেন। তথাপি আমি বলব যে আমার মনের তার রবীন্দ্রনাথের সুরেই বাঁধা, হলই বা আমার সমস্ত কাজকর্ম গান্ধীজীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।” নেহরু বহিরঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর আর অন্তরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তখন সমাসীন। দু’পাশে দুই মহীরুহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নেহরু দু’জনের কাছ থেকেই নির্যাস নিয়েছেন, আর নিজেকে পুষ্ট করেছেন। লিখলেন নেহরু, “পরবর্তী বছরগুলোতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়লো। তাঁর ধ্যানধারণা এবং জীবনে সাধারণ বিচার বুদ্ধির সঙ্গে আমি এক অকথিত আত্মীয়তা অনুভব করলাম। কারাজীবনে বাইরে থাকাকালে আমি ফাঁকে ফাঁকে নানা উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে তার সঙ্গে দেখা করেছি।” নেহরুর এই ভাষ্য অনুসারে তাঁর শান্তিনিকেতনে আগমনের একটি তথ্য মেলে। ১৯৩৪ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার ৩ নং মিন্টো পার্ক রোড থেকে নেহরু রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম পাঠান। এলাহাবাদ থেকে নেহরু সেদিনই কলকাতায় আসেন। এর আগে কলকাতায় এসেছেন গান্ধীর অনুগামী হিসেবে সাধারণের কাছে। আর এবার এসেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে। সঙ্গে স্ত্রী কমলা নেহরু। শান্তিনিকেতনে যাবার আগে পরপর তিনদিন কলকাতায় তিনটি জনসভা ও সমাবেশে ভাষণ দেন। ১৯ জানুয়ারি বিকেলের ট্রেনে নেহরু শান্তিনিকেতন পৌঁছেন। উত্তরায়ণ প্রাঙ্গনে তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ। কমলা নেহরুর অসুস্থতার কারণে আম্রকুঞ্জের পরিবর্তে উত্তরায়ণে এই আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ দশটি বৈদিকমন্ত্রে নেহরু-দম্পতিকে স্বাগত জানান। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন তাঁরা। দু’দিন এখানে কাটিয়ে বিদায় নেবার আগে ‘দর্শকলিপি’ খাতায় দু’জনে স্বাক্ষর দিয়ে লিখলেন, “ইন মেমরি অব এ ডিলাইটফুল ডে ইন লাইফস জার্নি।” শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে গিয়ে নেহরু কবিকন্ঠে শ্রুত সংস্কৃত বৈদিকমন্ত্রের ইংরেজি অনুবাদ চেয়ে কবির একান্ত সচিব অনিলকুমার চন্দকে চিঠি দিয়েছিলেন। যথাসময়ে তা নেহরুকে পাঠানো হয়েছিলো।
১৯৩৪ সালের ১৯ জানুয়ারি মূলত রবীন্দ্র-নেহরু প্রথম সাক্ষাৎ। নেহরু পরবর্তীসময়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, ১৯৩৪ সালের আগে তিনি আরও দু’বার শান্তিন্তিকেতন গিয়েছেন। “কমলার এই প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন। আমাদের মেয়েকে যেখানে পাঠাবার কথা আমরা ভাবছিলাম সেই জায়গাটা এবার স্বচক্ষে দেখবার জন্যই তিনি শান্তিনিকেতন এসছিলেন।” তাঁদের সঙ্গে ছিলেন নেহরুর সচিব উপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে দ্বিতীয়দিনের সকালে নেহরু ছাত্র ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলেন। বিকেলে শ্রীনিকেতন দর্শনে যান। শান্তিনিকেতনে তাঁরা ছিলেন ‘কোণার্ক’ বাড়িতে। রাতে শান্তিনিকেতন ছেড়ে ট্রেনে পাটনা যান তাঁরা। নেহরু বিহারের ভূমিকম্প এলাকায় ত্রাণকাজে থাকাকালে ভূমিকম্প সম্পর্কে গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথের বিবৃতি ও প্রতিবাদভাষ্য দেখেন। এর পরপরই নেহরু গ্রেফতার হয়ে যান কলকাতায় সরকার বিরোধী ভাষণদানের অভিযোগ। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আবার দু’বছরের জন্য কারাবাস বরণ করেন। নেহরু শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে যাবার সাতদিনের মাথায় ২৬ জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে এলাহাবাদ থেকে রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দকে সে সময়ে হাজারিবাগ জেলে বন্দী সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফ্ফার খানের পুত্র আবদুল গনির শান্তিনিকেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। নিজকন্যার পড়াশোনার কথা উল্লেখ করেন নি। অথচ শান্তিনিকেতনে অবস্থানকারে কন্যা ইন্দিরার অধ্যয়নের বিষয়ে কথা বলেছিলেন। কুড়িবছর বয়সী বন্ধুপুত্র গনি খান নেহরুর বাড়ীতে বসবাস করছিল। এই পত্রানুসারে গনি খানের শান্তিনিকেতনে ভর্তির সুযোগের আগেই ১২ ফেব্রুয়ারী নেহরু গ্রেফতার হন। পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারী কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেল থেকে লিখলেন অনিল চন্দকে নেহরু, “গতকাল আমাকে গ্রেফতার করে এখানে আনা হয়েছে। যেহেতু দু’তিনদিন আমি বিচারাধীন বন্দি, আমাকে চিঠি লিখতে দেওয়া হয়েছে; তাই আমি সে সুযোগে আপনাকে লিখছি। শান্তিনিকেতনে গনির জন্য ব্যবস্থাদি হয়েছে- একথা জানতে পারলে আমি খুশী হবো।” ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেহরু সহযোগী বন্ধু কারারুদ্ধ সীমান্ত গান্ধীর প্রতি দায়িত্ব পালনকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
নিজের কন্যার ভর্তির প্রসঙ্গটি নেহরু অনিল চন্দকে জানালেন, ১৯৩৪ সালের ২৭ এপ্রিল। রাজদ্রোহের অপরাধে আটক তখন, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে লেখেন “গত জানুয়ারিতে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনকালে আমি ও আমার পত্নী উভয়েই গুরুদেবের কাছে আমার কন্যা ইন্দিরাকে শান্তিনিকেতনে রাখার ব্যাপারে আলোচনা করেছি। কিন্তু সেই থেকে ইন্দিরার সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। এখন সে সবেমাত্র বোম্বাই থেকে ফিরেছে ম্যাট্রিক পরীক্ষার শেষে। ইন্দিরার ভবিষ্যৎ শিক্ষা সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত এবার আমাদের নিতেই হয়। কোনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে পড়ানোর ইচ্ছা আমাদের মোটেই নেই। তাঁদের উপর আমার কোনো আস্থা নেই। ইউরোপে অদূর ভবিষ্যতে তার যাবার কোনো সুযোগ নেই। আমার ইচ্ছা ইন্দিরা শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা করুক। ইন্দিরার অভিপ্রেত জেনে আপনাকে জানাব।” দীর্ঘ চিঠিতে নেহরু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অভিমত তুলে ধরেছিলেন। অনিলচন্দ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “ইন্দিরা শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসে শিক্ষাভবনে আইএ ক্লাসের ফাষ্ট ইয়ারে ভর্তি হন। তাঁকে লেখা কমলাজীর একখানি চিঠি থেকে জানতে পারি, তিনি ইন্দিরাকে নিজে সঙ্গে নিয়ে এসে কলেজে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে অসুস্থতার জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে আসতে পারেন নি।” ইন্দিরা এসেছিলেন পিতার একান্ত সচিবের সঙ্গে। শান্তিনিকেতনে মাত্র ১০ মাস ছিলেন। শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি তাঁকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছে মায়ে অসুস্থতার কারণে। কমলা নেহরুর অসুস্থতায় রবীন্দ্রনাথ প্রথমে উত্তরপ্রদেশের গভর্ণরকে নেহরুকে স্ত্রীর রোগশয্যার পাশে থাকার জন্য কারামুক্তির সুপারিশ করে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠান অক্টোবর মাসে। নেহরু একদিনের জন্য প্যারোলে ছাড়া পান। কমলা নেহরুর অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ইউরোপ নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের ১৬ এপ্রিল ভাওয়ালি স্বাস্থ্য নিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে নেহরু একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। নেহরু জানান, তিনি যেতে অসমর্থ হওয়ায় ইন্দিরাকে সাথে যেতে হবে। কারণ সেখানে অস্ত্রোপচার হবে। “এই নতুন পরিস্থিতি নানাভাবে আমাকে বেদনা দেয়। কিন্তু এর হাত থেকে নিস্কৃতির উপায় নেই। আমি জানিনে ভবিষ্যতে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে এবং ইন্দিরাই বা কি করবে। এর মধ্যে তার শান্তিনিকেতনের জীবনচর্চায় ছেদ পড়বে। …সে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে। শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে তার নিজের প্রশংসাই যথেষ্ঠ এবং স্পষ্ট যে, সেখানে সে অত্যন্ত সুখী। কাজেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসার তার কোনো ইচ্ছা নেই। আমিও চেয়েছিলাম আপনার আশ্রিত যত্নে ও তত্ত্বাবধানে থেকে দেহে মনে বড় হবার সময়ে আরও বেশি কিছুদিন সে শান্তিনিকেতনে থাকে। কারাবাসে থাকা অবস্থায় আমার মনে এই একটা বড় সান্ত্বনা ছিল যে জীবনের উন্নতির পক্ষে ঠিক পথে আমার মেয়েকে পরিচালনা করার জন্য তার চারপাশে ঘিরে আছেন আমার অন্তরঙ্গ যোগ্য বন্ধুগণ। আমার মেয়ের জীবনের এই গর্বে তার শিক্ষাঙ্গন রূপে শান্তিনিকেতনকে নির্বাচিত করেছিলাম বলেই সত্যই আমি ভাগ্যবান।” নেহরুর এই চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে বিদায় দিলেন। সেদিন ছিল নববর্ষের উৎসব। ইন্দিরা শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার পর ১৯৩৫ সালের ২০ এপ্রিল নেহরুকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করলেন, “ইন্দিরাকে আমরা সবাই এক মহামূল্য সম্পদ বলে মনে করতাম; ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাই তাকে বিদায় জানাতে হয়েছে। এই শুধু আমার আশা, অবস্থার উন্নতি হবে। এবং ইন্দিরা শীঘ্রই আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে তার পড়াশুনা শুরু করবে।” কিন্তু ছাত্রী হিসেবে ইন্দিরার আর শান্তিনিকেতনে আসা হয়নি।
১৯৩৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের এক স্যানাটোরিয়ামে কমলা নেহরুর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বেদনাহত হন। ১৯৩৬ সালের ৮ মার্চ শান্তিনিকেতনে তার স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। “একদিন তাঁর স্বামী যখন কারাগারে তখন তাঁর দেহের উপরে মরণান্তিক রোগের ছায়া ঘনায়িত, সেই সময়ে তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে আশ্রমে এসেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, সেই দুঃসময়ে তার কন্যাকে আশ্রম গ্রহণ করে। কিছুদিনের জন্য তাদের নিরুদ্বিগ্ন করতে পেরেছিলেম। সেই দিনের কথা আজ মনে পড়েছে। সেই প্রশান্ত গম্ভীর অবিচলিত ধৈর্যের মূর্তি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। …কমলা নেহরু যাঁর সহধর্মিণী, সেই জওহরলাল আজ সমস্ত ভারতের রাজাসনে প্রতিষ্ঠা হবার অধিকারী। অপরিসীম তাঁর ধৈর্য, বীরত্ব তার বিরাট, কিন্তু সকলের চেয়ে বড়ো তার সুদৃঢ় সত্যনিষ্ঠা। পলিটিক্স-এর সাধনায় আত্মপ্রবঞ্চণা ও পরপ্রঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলেন নি।” স্মরণসভার সেদিনটি ছিল বসন্তপূর্ণিমার। রবীন্দ্রনাথ বসন্তোৎসবে নেহরুর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিয়ে আরো বলেন, “আজ হোলির দিন। চারদিকে শুষ্কপত্র ঝরে পড়ছে। তার মধ্যে নব কিশলয়ের অভিনন্দন। আজ জরা-বিজয়ী নূতন প্রাণের অভ্যর্থনা জলে স্থলে আকাশে। এই উৎসবের সঙ্গে আমাদের দেশের নবজীবনের উৎসবকে মিলিয়ে দেখতে চাই। আজ অনুভব করব, যুগসন্ধির নির্মম শীতেরদিন শেষ হল, এর নবযুগের সর্বব্যাপী আশ্বাস। আজ এই নবযুগের ঋতুরাজ জওহরলাল।” এই ভাষণের ইংরেজ রূপান্তর ‘বিশ্বভারতী নিউজে’ প্রকাশিত হলে, নেহরু তা পড়ে রবীন্দ্রনাথকে ১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল এলাহাবাদ থেকে চিঠি দেন। তখন তিনি কারামুক্ত। “কমলা সম্পর্কে আপনি আপনার অতুুলনীয় উদারতায় যে কথাগুলি বলেছেন, তা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আপনাকে যদি কিছু বলতে হয় তাহলে আমি শুধু এই কথাই বলবো যে, আপনার আশীর্বাদ পেয়ে আমি কত শক্তি লাভ করি। শক্তি পাই এই কথা ভেবে যে, আপনি আমাদের মতো পথভ্রান্তদের ঠিক পথে চালিত করার জন্যই আমাদের মধ্যে রয়েছেন।”
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর রবীন্দ্রদর্শনে আগ্রহী নেহরু ১৯৩৬ সালের ৪ নভেম্বর সকালে শান্তিনিকেতন পৌঁছেন কৃষ্ণ কৃপালনি দম্পতিসহ। তার দিনকুড়ি আগে কবিগুরুকে পত্র লিখে এই আসার কথা জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন শ্রীনিকেতনে। নেহরু সেখানে গিয়ে কবির সঙ্গে দেখা করেন। শ্রীনিকেতন পল্লীসংগঠন বিভাগের ব্রতী বালকদের অভিবাদন গ্রহণ করেন প্রথমেই নেহরু। কাছাকাছি একটি সাঁওতালপল্লী ঘুরে দেখলেন। বোলপুরে জনসভায় বক্তৃতা করলেন। তখন নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছিল। শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ এবং নেহরুর মধ্যে প্রায় তিনঘন্টা আলোচনা হয়। তাঁদের এই আলোচনার কোনো লিখিত বা মুদ্রিত প্রতিবেদন আজো মেলেনি। কেবল মাসিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৪৩ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় বৈঠকের কথা উল্লেখ আছে। তবে ঐ সময়ে তোলা তিনটি আলোকচিত্র পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। একটি ছবিতে আছে, নেহরু ও রবীন্দ্রনাথ মুখোমুখি দু’টি চেয়ারে বসে আছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে কালীমোহন ঘোষ ও অনিল কুমার চন্দ। নেহরুর মুষ্টিবদ্ধ বাঁ হাত তার চিবুকের নীচে। মনে হয় কবির কথা শুনছেন আগ্রহ নিয়ে। আর কবির মুখমন্ডলে প্রসন্নতার আভাস। দ্বিতীয় ছবিটিতে একই ভাবে বসা দু’জনে। নেহরু উদগ্রীব হয়ে শুনছেন কবির কথা। কবির প্রসন্ন মুখমন্ডল আরো বেশি হাস্যোজ্জ্বল। তৃতীয় ছবিটিতে দেখা যায় বই হাতে নেহরু-হাস্যোজ্জ্বল মুখে রবীন্দ্রনাথকে কী যেন বলছেন। গম্ভীরমুখে কবি তা শুনছেন। এই ছবিগুলোর আলোকচিত্রী ছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকার প্রধান ফটোগ্রাফার তারক দাশ। এই সাক্ষাতের মাসখানেকেরও পর ১৬ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে নেহরু জানান যে, অক্সফোর্ডের সামারভিল কলেজে অধ্যয়নরত কন্যা ইন্দিরার একটি চিঠি পেয়েছেন, যাতে সে তার শান্তিনিকেতনের দিনগুলোর প্রশংসা করেছেন। নেহরু সেই চিঠি থেকে কয়েকটি ছত্র ইন্দিরার অগোচরে কবিকে না পাঠিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ইন্দিরা তাঁর পিতাকে লিখেছিলেন তার উপরে শান্তিনিকেতন ও তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের দিকটি। “শান্তিনিকেতনে থাকতে পেরেছিলাম বলে আমি আনন্দিত। মূখ্যত গুরুদেবের জন্য। ঠিক ঐ পরিবেশে পরম বস্তু ঘুরে বেড়ায়। কারও উপর ডানা ঝাঁপটায়। যদিও খুব গোপনে, চোখে চোখে রাখে স্নেহ পাহারায়। আমি অনুভব করতে পারি তাঁরই (রবীন্দ্রনাথ) পরম বস্তু আমার জীবন ও বিচারবুদ্ধিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।”
রবীন্দ্রনাথ ও নেহরু ক্রমশ পরস্পরের প্রতি একান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। নেহরু তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দিকটি উন্মোচিত করেছিলেন কবির কাছে। নেহরুর কবির প্রতি এক ধরণের অধিকার তৈরি হয়, যে কারণে “ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ দি ইন্ডিয়ান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন”-এর অবৈতনিক সম্পাদকরূপে রবীন্দ্রনাথের নাম তিনি অর্ন্তভুক্ত করেন। এজন্য রবীন্দ্রনাথকে সম্মত করাতে লিখেছিলেন, “স্পষ্টত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ ভারতবর্ষে নেই, যিনি এই পদ পূর্ণ করতে পারেন।” রবীন্দ্রনাথও প্রায়শই নেহরুকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানাতেন। নব প্রতিষ্ঠিত চীনাভবন আনুমানিক উদ্বোধনের জন্য রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুকে। ১৯৩৭ সালের ২৮ মার্চ নেহরুকে লেখা পত্রে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, “উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য আমি তোমার চেয়ে যোগ্য কোনো ব্যক্তির কথা ভাবতেও পারি নে। তুমি অবশ্যই আসিবে। যদি প্রয়োজন মনে করো তাহলে হাওয়াই জাহাজে করেই আসবে। হাওয়াই জাহাজে নামার জন্য আমাদের একটি সুন্দর জায়গা আছে।” আরও লিখলেন, “ইন্দিরাকে সঙ্গে আনতে ভুলো না যেন।” তবে ইন্দিরা এসেছিলেন, ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা ১৩৪৪ সালের ১ বৈশাখে। শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নেয়ার দু’বছর পর। তবে ছাত্রী হিসেবে নয়। পিতার প্রতিনিধি হয়ে। অসুস্থার জন্য আসতে না পারা নেহরু কন্যার মাধ্যমে বার্তা পাঠালেন কবির কাছে। “শুধু দ্বারোদঘাটনের জন্য নয়, আপনাকে এবং শান্তিনিকেতনকে দেখাবার জন্যও আমি শান্তিনিকেতনে আসতাম। কত বছর আপনাকে ও শান্তিনিকেতনকে দেখি নি। সশরীরে হাজির থাকার মতোই আমি আপনাদের সঙ্গে আত্মিকভাবে উপস্থিত থাকবো। চীনাভবন চীনা ও ভারতের মিলনের মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠুক-এই আমার কামনা।” বার্তাটি অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের ২২ নভেম্বর দু’জন বিশিষ্ট চীনা মুসলমান অতিথি রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে শান্তিনিকেতন যাবেন – এমন বার্তা জানিয়ে নেহরু কবিকে চিঠি দেন। জবাবে রবীন্দ্রনাথ ২৮ নভেম্বর বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য নেহরুকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানান। নেহরু ১ ডিসেম্বর পত্রে জানান, বাংলার অবস্থা অবশ্যই ভালো নয়। সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। কিন্তু সমগ্র ভারতের একই হাল, সংকটের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি কবির সঙ্গে অবশ্য আলোচনা করার জন্য আগ্রহ জানান। নেহরু ১৯৩৯ সালের ৩০ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে পৌঁছেন। পরদিন তিনি হিন্দী ভবনের দ্বারোদঘাটন করেন। উদ্বোধনের আলোকচিত্রে দেখা যায়, হিন্দীভবনের নবনির্মিত ভবনের প্রবেশপথে চেয়ারে আসীন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ডানপাশে খালিপায়ে দাঁড়িয়ে ভাষণরত নেহরু। রবীন্দ্রনাথের বাঁদিকে মাদুরে বসে পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন এবং অন্যান্য দু’একজন। সামনে শ্রোতাদের মধ্যে আছেন এন্ড্রুজ। নেহরু তিনদিন কাটান উত্তরায়ণে। আলোচনার জন্য সে সময়ের কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু শান্তিনিকেতন পৌঁছান। ২ ফেব্রুয়ারি দু’জনে শান্তিনিকেতন ছেঁড়ে যান। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে নেহরুর সেই শেষ শান্তিনিকেতন দর্শন। ইন্দিরাও ছিলেন এবার পিতার সঙ্গে।
শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নিয়ে বর্ধমান রেল জংশনে বসে নেহরু রবীন্দ্রনাথকে পত্র লেখেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে আর আসা হয়নি। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে নেহরু যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কবির সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন, সে হচ্ছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। নেহরুর স্মৃতিলিপিতে উল্লেখ রয়েছে “শেষবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নবভারতের জাতীয় সঙ্গীত রচনার জন্য আমি গুরুদেবকে অনুরোধ করি। তিনি কিছুটা সম্মত হন। ‘জনগণমন’ তখন আমার মনেই ছিল না। এই ঘটনার অনতিকাল পরেই রবীন্দ্রনাথ লোকান্তরিত হন।”
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-নেহরুর মধ্যে ১৯৩৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ও ৩১ ফেব্রুয়ারি সাক্ষাৎকারের চারমাস পর রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালের ২০ মে মংপু থেকেও অমিয় চক্রবর্তীকে পত্র দেন, যাতে নেহরু প্রসঙ্গ রয়েছে। “আমি সর্বান্তকরণে শ্রদ্ধা করি জওহরলালকে, যেখানে ধন বা অন্ধধর্ম বা রাষ্ট্র প্রভাব ব্যক্তিগত সংকীর্ণ সীমায় শক্তির ঔদ্ধত্য পুঞ্জিভূত করে তোলে সেখানে তার বিরুদ্ধে তার অভিযান। আমি তাকে প্রশ্ন করি, কংগ্রেসের দূর্গদ্বারের দ্বারীদের মনে কোথাও কি এই ব্যক্তিগত শক্তিমদের সাংঘাতিক লক্ষণ দিতে আরম্ভ করে নি? এতদিন পরে অন্তত আমার মনে সন্দেহ প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমি পলিটিশিয়ান নই, এই প্রসঙ্গে সে কথা কবুল করব। এই উপলক্ষ্যে একটা কথা বলা দরকার। গত কংগ্রেস অধিবেশনের ব্যবহারে বাঙালি জাতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে। এই নালিশটাকে বিশ্বাস করে নেওয়ার মধ্যে দুর্বলতা আছে। চারদিকে সকলেই বিরুদ্ধ চক্রান্ত করছে। সর্বদা মনের মধ্যে এই রকম সংশয়কে আলোড়িত হতে দেওয়া মনোবিকারের লক্ষণ। দূর্ভাগ্যক্রমে দেশে মিলনকেন্দ্ররূপে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্বেও ভারতবর্ষ এক প্রদেশের সঙ্গে আর এক প্রদেশের বিচ্ছেদের সাংঘাতিক লক্ষণ আকারেই থেকে থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ যাই হোক, প্রদেশে প্রদেশে জোর মেলেনি। …মহাত্মাজী যখন স্বদেশকে জাগাবার ভার নিয়েছিলেন, তখন একান্ত মনে করেছিলুম, তিনি জনগণের বিচিত্র শক্তিকে বিচিত্র পথে উদ্বোধিত করবেন। …আজ আমি জানি, বাংলাদেশের জননায়কের প্রধান পদ সুভাষচন্দ্রের। সমস্ত ভারতবর্ষে তিনি যে আসন গ্রহণের সাধনা করে আসছেন সে পলিটিক্সের আসরে। আমি পূর্বেই বলেছি সেখানে আমি আনাড়ি। …আমার মন আঁকড়ে ধরে আছে বাংলাকে। যে বাংলাকে আমরা বড়ো করবো সেই বাংলাকেই বড়ো করে লাভ করবে সমস্ত ভারতবর্ষ। তার অন্তুরের ও বাহিরের সমস্ত দীনতা দূর করবার সাধনা গ্রহণ করবেন। এই আশা করে আমি সুদৃঢ় সংকল্পে সুভাষকে অভ্যর্থনা করি।” রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিক্রিয়া নেহরুর নিশ্চয়ই জানা ছিল। সুভাষবসুর প্রতি গান্ধীর বিরাগ কিংবা নেহরুর ইর্ষাকাতরাত রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেছিল বৈকি।
রবীন্দ্রনাথের ৭৮তম জন্মদিনে ১৯৩৯ সালের মে মাসে (বৈশাখ, ১৩৪৬) জওহরলাল নেহরু শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে বার্তা পাঠান। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, “ভারতবর্ষে যাঁহারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবাদর্শে-পরিপুষ্ট হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছেন, তাঁহাদের পক্ষে দেশ জাতির উপর কবির অসামান্য প্রভাবের পরিমাপ করা সহজ নয়। আমিও সেই দুরূহ কার্য্যে হাত দিব না। আমি শুধু অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাইয়া বলিতে পারি, তিনি আমাদের নিকট দ্রুবতারার মত। কবি মানব জীবনের সূক্ষ্ম, সুন্দর ও মহত্তর সম্ভাবনার দিকে আমাদের মনকে সর্বদা সচেতন রাখিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্টি ও সমষ্টি জীবনের অধোগতির বিপদ সম্বন্ধে আমাদিগকে সতর্ক করিয়াছেন।” রবীন্দ্রনাথের সাথে নেহরুর এরপর আর কোনো পত্র যোগাযোগ হয় নি। কবির শেষ জন্মদিনে নেহরু কোন বার্তা পাঠান নি। তবে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের বার্তা পেয়ে নেহরু কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে শোকার্ত হৃদয়ের বেদনা জানান। “ভারতের সর্বশেষ জ্যোতিষ্ক শুধু ভারতেকেই নয় ভূমন্ডলকেই প্রদীপ্ত করে, অতীত ও বর্তমানের বহুবিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়ে, অস্ত গেল – আমাদের হৃদয় শূন্য হল। তথাপি আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হয় তাঁর কন্ঠস্বর। তাঁর নিত্যনতুন প্রজ্জ্বলন্ত বাণীই হবে আমাদের পথ নির্দেশক তারকা। আমার গভীর বিশ্বাস, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর উন্নতি এবং প্রসারকল্পে সহায়তা করাকে প্রতিটি ভারতবাসী তার নিজের কর্তব্য বলে জ্ঞান করবেন। কারণ, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের আদর্শের প্রতীক।” নেহরু তাঁর এই কথাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর যে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও ভক্তি শেষজীবন পর্যন্ত তা প্রমাণ রেখে গেছেন।
১৯৬৪ সালের ২৭ মে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু পরলোকগমণ করেন। তার পাঁচ মাস আগে ১৯৬৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে আচার্য হিসেবে ভাষণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ অতীত ভারতের ঋষিদের মতো তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক অনশ্বর উত্তরাধিকার। সেই অমূল্য উত্তরাধিকার আমরা সঞ্চিত রাখবো।” রেখে গেছেনও। নেহরুর পর ইন্দিরা, ইন্দিরার পর রাজীব গান্ধী শান্তিনিকেতন রক্ষাণাবেক্ষণে সজাগ ছিলেন। আজ নেহরুর তৃতীয় প্রজন্মও শান্তিনিকেতনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রবীন্দ্রনাথের গৌরব এখানেই।

Leave a Reply