শেখ রাসেল: শিশুদের প্রতিবাদের কণ্ঠ হয়ে বেঁচে আছেন

শেখ শহীদুল ইসলাম বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভাগ্নে। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে খালার বাড়িতে থেকেছেন। খালাতো ভাই শহীদ শেখ রাসেলকে জন্ম থেকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময়কাল পর্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন শেখ শহীদ। বড় ভাই হিসেবে রাসেল তাকে যেমন সম্মান করেছেন, তেমনই তিনিও স্নেহও করতেন শেখ রাসেলকে। রাসেলের জীবনকাল নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নানা স্মৃতিচারণ করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম।

রাসেলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ শহীদ বলেন, ‘‘১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর যেদিন শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করে, সেদিন পিতা মুজিব পাশে থাকতে পারেননি। ওই সময় মিসেস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনি প্রচারণায় তাঁকে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। ফাতেমা জিন্নাহ বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া চট্টগ্রাম যেতে চাচ্ছিলেন না। সন্তানসম্ভবা বেগম মুজিব (ফজিলাতুন নেসা মুজিব) যখন এটা জানতে পারলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে চট্টগ্রাম যেতে সন্মতি দিলেন এবং বললেন ‘তুমি যাও। আমি এদিকটা সামলাতে পারবো।’ ফলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই রাসেলের জন্ম হয়।’’

সাধারণ মানুষের প্রতি শেখ রাসেলের ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা-Sheikh Rasel

শেখ শহীদ জানান, শেখ রাসেলের জন্ম হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৫৬৭ নম্বর বাড়ির যে ঘরটায়, বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতেন সেই ঘরটায়। বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় শেখ রাসেল স্বাভাবিকভাবে সবার প্রিয় ছিল। সবার আদরে সে বড় হচ্ছিল।’

রাসেলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ শহীদ বলেন, ‘‘১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর যেদিন শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করে, সেদিন পিতা মুজিব পাশে থাকতে পারেননি। ওই সময় মিসেস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনি প্রচারণায় তাঁকে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। ফাতেমা জিন্নাহ বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া চট্টগ্রাম যেতে চাচ্ছিলেন না। সন্তানসম্ভবা বেগম মুজিব (ফজিলাতুন নেসা মুজিব) যখন এটা জানতে পারলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে চট্টগ্রাম যেতে সন্মতি দিলেন এবং বললেন ‘তুমি যাও। আমি এদিকটা সামলাতে পারবো।’ ফলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই রাসেলের জন্ম হয়। এই’

শেখ শহীদ জানান, শেখ রাসেলের জন্ম হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৫৬৭ নম্বর বাড়ির যে ঘরটায়, বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতেন সেই ঘরটায়। বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় শেখ রাসেল স্বাভাবিকভাবে সবার প্রিয় ছিল। সবার আদরে সে বড় হচ্ছিল।’

তিনি বলেন, ‘‘রাসেল যখন থেকে কিছুটা বুঝতে শিখেছে, সে দেখেছে পিতা বঙ্গবন্ধু কারাগারে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়ার পর তিনি (মুজিব) কারাগারে যান, আর মুক্তিপান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এর আগেও ১৯৬৫ সালে কয়েকবার গ্রেফতার হন। এই সময়কালে রাসেলকে নিয়ে কারাগারে যেতাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সেই সময় রাসেল বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে আসতে চাইতো না। দেখতাম সে কিছুতেই বঙ্গবন্ধুকে ছাড়তে চাইতো না। বিদায়ের সময় বঙ্গবন্ধু রাসেলকে বলতেন ‘আমি আমার বাড়ি (জেলখানা) যাই। তুমি তোমার বাড়ি যাও। এই ঘটনা বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়েও উল্লেখ রয়েছে।’’

স্মৃতি চারণে তিনি বলেন, ‘রাসেল পিতার স্নেহ হতে বঞ্চিত হলেও তার মা বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব তাকে পিতৃ ও মাতৃ উভয় স্নেহ দিয়ে পিতৃ স্নেহের ঘাটতি মিটিয়েছেন। আমরা দেখেছি, পরম স্নেহ ও আদরে রাসেলকে লালন-পালন করেছেন। সঙ্গে তার বোন শেখ হাসিনাও অত্যন্ত স্নেহ-আদরে রাখতেন রাসেলকে, মাকে সাহায্য করতেন। সাহায্য করতেন বোন শেখ রেহানাও।’

পিতাকে কাছে না পাওয়ার একটি বেদনা রাসেলের মধ্যে কাজ করতো উল্লেখ করে বয়সে ১৬ বছরের বড় খালাতো ভাই শহীদ বলেন, ‘রাসেল আস্তে আস্তে যখন বড় হচ্ছিল, তখন আমাদের মনে হতো— একটি প্রশ্ন যেন তার মনের ভেতরে চাপা থাকতো। সে পিতাকে কাছে পাচ্ছে না। এই অভাবটি তার কাজকর্ম ও আচরণে ফুটে উঠতো।’

রাসেলকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য শেখ শহীদই নিয়ে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শেখ রাসেল ১৯৬৯ সালে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়। খালার (বেগম মুজিব) নির্দেশে আমিই তাকে ওই স্কুলে ভর্তির জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই সময় স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন মিসেস রাজিয়া মতিন চৌধুরী। তিনি রাসেলের সঙ্গে কথা বললেন। কেন ওই স্কুলে পড়তে চায় সেই প্রশ্নও করলেন। রাসেল উত্তর দিয়েছিল— আমার বড় আপা (শেখ হাসিনা) ও বড় ভাই শেখ কামাল এই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমিও এখানে পড়তে চাই।’

শেখ শহীদ জানান, রাসেল ওই স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে সহপাঠীদের মন জয় করেছিল। সে সহপাঠীদের সঙ্গে এমন আচরণ করতো না যে, সে শেখ মুজিবের ছেলে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির বা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে। বরং সে সহপাঠীদের সঙ্গে স্বাভাবিক ছাত্রের মতো আচরণই করতো। বয়সে কচি হলেও তার মেধা ও মননের অপূর্ব সমাহার দেখেছি। তার স্মরণ শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তার মনে সেই সময় হাজারো প্রশ্ন জাগতো। আমাদের সবার কাছে সে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতো। উত্তর পেতে চেষ্টা করতো। আমরা আত্মীয়-স্বজন পরিবার পরিজন দেখেছি, রাসেল অত্যন্ত বন্ধু বৎসল ছিল।  সে আমাদের কাছে স্নেহ-ভালোবাসা পেতে আসতো। অল্প বয়সেই সে আমাদের সম্মান করতো। স্কুলে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত টিফিন বা বেশি করে চকলেট জাতীয় খাবার নিয়ে যেতো। কারণ সে একা খেতো না। বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের দিয়েই খেতো। এভাবে তার একটি চরিত্র গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত পিতা-মাতার থেকেই এই চারিত্রিক গুণটি সে অর্জন করেছিল।

১৯৭২ সালে জাপানের এক ভদ্র মহিলা, চলচ্চিত্রকর নাগিসা ওসিমা বঙ্গবন্ধুর ওপর ডকুমেন্টারি করার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লক্ষ্য করছি একটি ছোট্ট ছেলে সব সময় আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করে, ছেলেটি কে? কেনই বা সে আপনার চারপাশে থাকে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছেলেটির বাবা বেশিরভাগ সময় কারাগারে থাকতো। ফলে সে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি তার বাবা, তাই সে সব সময় আমার পাশে ঘুর ঘুর করে।’

শেখ শহীদ বলেন, ১৯৬৯ সালে আমিও জেলে ছিলাম। আমি জেল থেকে ছাড়া পাই ১৪ ফেব্রুয়ারি। জাতির পিতা ছাড়া পান ২২ ফেব্রুয়ারি। আমি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাওয়ার পর রাসেলকে কোলে তুলে নিই। রাসেল কোলে উঠে আমাকে প্রশ্ন করলো-‘আব্বা কখন আসবে?’

তিনি জানান, রাসেলকে স্কুলে ভর্তির জন্য আমি যখন নিয়ে যাই, পথে সে প্রশ্ন করেছিল— ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’ আমি স্কুলে ভর্তির কথা বললাম। তখন সে পাল্টা প্রশ্ন করলো— ‘স্কুলে আমি পড়বো? আমি কী যেকোনও সময় আম্মার কাছে চলে আসতে পারবো?’ এ ধরনের অনেক স্মৃতি আমার রয়েছে। বয়স কম হলেও সে অনেক কিছু বুঝতো। বুদ্ধিমত্তা ছিল অত্যন্ত প্রখর। বয়সের তুলনায় ম্যাচিউরিটি তার বেশি ছিল।

শহীদ জানান, কনিষ্ঠ হওয়ায় সে পরিবারের সবার ভীষণ আদরের ছিল। দুর্ভাগ্য মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়সে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে পিতা-মাতা ও দুই ভাইসহ আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে তার জীবনেরও অবসান হয়।

পচাঁত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করে শেখ শহীদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি, মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়সে নিষ্পাপ রাসেলকে ঘাটতচক্র নির্মম বুলেট দিয়ে হত্যা করলো। ঘাতকদের কাছে রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য করুণ মিনতি করেছিল। কিন্তু নির্দয় ঘাতকরা মায়ের কাছে নেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওপরে নিয়ে কচি বুকে বুলেট বিদ্ধ করেছিল। রাসেল আজকে নেই। কিন্তু সে সারা বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিবাদের কণ্ঠ হিসেবে বেঁচে আছে। তার সঙ্গে যে নির্দয় ও নির্মম আচরণ হয়েছে, তা যেন পৃথিবীর আর কোনও শিশুর ভাগ্যে না ঘটে, এই বাণীটি রেখে যেতে চাই। প্রতিটি শিশুর জীবন নিরাপদ হোক, রাসেল নিজের জীবন দিয়ে এই বাণী বিশ্বের কাছে রেখে গেছে।’

Leave a Reply