সাঁওতাল কৃষকের বিষপান: আত্মহত্যার আড়ালে বৈষম্যের বলী

রাজশাহীর তানোরে দুই সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি যেভাবে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেছেন, তা আমাদের যেমন বেদনাহত; তেমনই বিক্ষুব্ধ করেছে। দেশে সাম্প্রতিককালে আত্মহত্যার সংখ্যা ও প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার যেসব আর্থসামাজিক কারণ রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এই অঘটন মিলিয়ে দেখার অবকাশ নেই। ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে কীটনাশকের মতো কৃষি উপকরণে আত্মহত্যার ঘটনা আগে কখনও দেখিনি আমরা। প্রাণ হারানো দুই কৃষক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলেই কি এমন মর্মান্তিক পরিণতি? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবেরকে গরিবের মধ্যেও গরিব আখ্যা দিয়েছিলেন বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দলেও তার বঞ্চনার কারণে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের বঞ্চিত কৃষকশ্রেণির মধ্যে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি আরও কঠিন। সাধারণ কৃষকের মতো জোতদার, দাদনদার, আড়তদারদের নিষ্পেষণ ছাড়াও খোদ ‘সংখ্যাগুরু’ কৃষকের চাপেও দিনাতিপাত করতে হয় তাদের। এখন দেখা যাচ্ছে; পয়সা দিয়ে সেচের পানি কিনতে গিয়েও তাদের এতটা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে যে, মরণের মধ্যে শরণ খুঁজতে হয়েছে। আর এটা যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- একই এলাকায় একই সম্প্রদায়ের দুই কৃষকের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট।
সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, তানোরের ওই দুই কৃষকের পরিবারের সাংবৎসরিক আয়ের উৎস ছিল একখণ্ড বর্গা জমি। সেখান থেকে ধানের প্রধান মৌসুম বোরো ফসল ঠিকমতো ঘরে তুলতে না পারলে আরেক বোরো মৌসুম পর্যন্ত ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এদিকে, চৈত্রের এই কাঠাফাটা সময়ে জমিতে যদি পর্যাপ্ত সেচ না দেওয়া যায়, তাহলে ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই শুকিয়ে মরবে; ফসল হয়ে ঘরে উঠবে না। ওদিকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ পরিচালনার জন্য ঠিকা ‘অপারেটর’ বারবার তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। পালাক্রমে সেচের পানি দেওয়ার কথা থাকলেও মৃত্যুর আগের ১০-১২ দিন তাদের পালা আসেনি। বোরো মৌসুমের চাষাবাদ ঠিকমতো না হলে কেবল সারাবছরের ভাতের ব্যবস্থা অনিশ্চিত হবে না- ‘বর্গা’ জমির মালিকের কাছেও গুনতে হবে অর্থদণ্ড। এমন পরিস্থিতিতে দুই কৃষকের সামনে আত্মহত্যার বিকল্প আর কী ছিল? সরকারি সহায়তায় পাওয়া কুঁড়েঘরে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থাকা পরিবারসহ না খেয়ে মরার চেয়ে বিষপানকেই যদি তারা শ্রেয় মনে করে; দোষ দেওয়া যায় কি? এই আত্মহত্যা তাই আমাদের কাছে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই প্রতিভাত।
আমরা এখন দেখতে চাইব, অবিলম্বে এ ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

অস্কার মঞ্চে উপস্থাপককে চড় মারলেন উইল স্মিথ

সেচের পানি নিয়ে হয়রানির অভিযোগ আগে যেমন আমলে নেওয়া হয়নি; দুই কৃষকের মৃত্যুর পর তদন্তও গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অবশ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সেচের পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রমাণ হলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে। আমরা দেখতে চাইব, ফলের মধ্য দিয়েই বৃক্ষের পরিচয় প্রমাণ হয়েছে। কেবল ‘প্রশাসনিক ব্যবস্থা’ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদি বৈষম্যের কারণেই দুই কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন, তাহলে এর জন্য দায়ীদের বিচার হতে হবে ফৌজদারি আইনে।

তদন্ত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেচ না পাওয়া চৌচির জমিতে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার মতো মিলিয়ে যায়- মনে রাখতে হবে। অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।
একই সঙ্গে ওই এলাকায় অন্যান্য কৃষকও এমন পরিস্থিতিতে রয়েছেন কিনা, খতিয়ে দেখতে হবে। কৃষির উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় অর্থে স্থাপিত সেচ প্রকল্পগুলোতে বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের যেসব অভিযোগ উঠে আসছে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সবকিছুর আগে দুই কৃষকের পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

তাদের সন্তানদের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগে একটি বৈষম্যহীন সমাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে যে অবিচার দেখিয়ে গেলেন; সেখান থেকে দৃষ্টি সরানো উচিত হবে না। অভিনাথ ও রবি মারান্ডি নিজেদের জীবনের বিনিময়ে যে প্রতিবাদ করে গেলেন; সামষ্টিক কল্যাণ ও ন্যায্যতার স্বার্থেই আমরা তা বৃথা যেতে দিতে পারি না।

তথ্যসূত্র:samakal

Leave a Reply