সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা কি || সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা বলতে কী বুঝ || সাধু রীতি ও চলিত রীতি কাকে বলে?

#সাধুভাষাচলিতভাষা

#সাধুভাষা ও #চলিতভাষা বলতে কী বুঝ  #সাধু রীতি ও #চলিতরীতি কাকে বলে? উদাহরণসহ আলোচনা করো:

সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা:

বাংলা ভাষার দুটি রূপ—সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা।

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষারই লেখ্য ও কথ্যরূপ আছে। বাংলা ভাষার লেখ্যরীতি হিসেবে সাধু এবং কথ্যরীতি হিসেবে চলিতরীতির উদ্ভব হয়েছে।

More Reading : ভাষা কি/ভাষা কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি ?

সাধু ভাষা:

সাধু ভাষা বা সাধুরীতির জন্ম হয় ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের সময়। সে সময় লিখিত ভাবে সাধু ভাষা ছিল আরষ্ট ও কৃত্রিম। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হওয়া মুখের ভাষা ছিল স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত।

বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ সম্পদ, ক্রিয়া ও সর্বনামের পূর্ণরূপ এবং কিছু ব্যাকরণসিদ্ধ উপাদান ব্যবহার করে ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের পদবিন্যাস প্রণালির অনুকরণে পরিকল্পিত যে নতুন সর্বজনীন গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হয়, তাকে সাধু ভাষা বলে।

সাধু প্রাঞ্জল হয়ে উঠতে দীর্ঘদিন লেগেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম এই কাজ করেন। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাধুভাষার জনক বলা হয়।ফ

অর্থাৎ যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে, তাকে সাধুভাষা বলে।

ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সাধুরীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সাধারণত গদ্য সাহিত্যে ব্যবহূত বাঙালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।’

উদাহরণ:

জন্মিলে মরিতে হয়, আকাশে প্রস্তর নিক্ষেপ করিলে তাহাকে ভূমিতে পড়িতে হয়, খুন করিলে ফাঁসিতে যাইতে হয়, চুরি করিলে কারাগারে যাইতে হয়, তেমনি ভালোবাসিলেই কাঁদিতে হয়। অপরাপরের মতো ইহাও জগতের একটি নিয়ম।

চলিত ভাষা:

চলিত ভাষা সৃষ্টির মূল প্রেরণা ছিল বাংলা ভাষাকে সব ধরনের কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত করা। চলিত ভাষার সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।

চলিত ভাষা বা চলিত রীতি সাধু ভাষার তুলনায় অনেক নবীন বা নতুন। কারন সাধু ভাষা বা সাধুরীতির সৃষ্টি হয় ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে। আর সেখানে চলিত ভাষা বা চলিত ভাষারীতির সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টব্দে।

চলিতভাষা হচ্ছে মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ভাষা। যে ভাষা মানুষ দৈনন্দিন জীবনে কথা বলতে ব্যবহার করে তাকেই চলিত ভাষা বা চলিতরীতি বলা হয়ে থাকে।

তদ্ভব শব্দ, ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ এবং লেখকের মনোভাব অনুযায়ী পদবিন্যাস প্রণালির ব্যবহারসহ যে স্বচ্ছন্দ, চটুল ও সর্বজনীন সাহিত্যিক গদ্যরীতি মুখের ভাষার আদলে গড়ে উঠেছে, তার নাম চলিত ভাষা।

বাংলাদেশের উত্তরাংশসহ কলকাতা ও ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষিত জনগণের মুখের ভাষার আদলে যে শক্তিশালী সাহিত্যিক গদ্য প্রবর্তিত হয়, তাই চলিত ভাষা বা চলিত গদ্য বলে খ্যাত।

প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ চলিত গদ্যের সার্থক রূপকার।

অর্থাৎ যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে বিদ্যমান থাকে, তাকে চলিত ভাষা বলে। উদাহরণ: তারা কাজ করছে।

উদাহরণ:

মেয়ের বয়স অবৈধ রকমের বেড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে সে জন্যই তাড়া।

সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য

More Reading : Alphabets (বর্ণমালা) Small and large letters together, Vowels, Consonants

১: সাধু ভাষায় সমাপিকা ও অসমাপিকা, এই দুই প্রকার ক্রিয়াপদের‌ই পূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া অনেকগুলি সর্বনাম পদের‌ও পূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: আসিতেছে, করিয়াছিলাম, দেখিয়াছি, বলিয়া থাকিব, শুনিতাম, ইহা, উহা, তাহারা, যাহার ইত্যাদি।

২: সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের আধিক্য দেখা যায়। যেমন: গৃহ, ভবন, গগন, বাটী, তৃণ, ঘৃত, মৃগয়া, বৎস, হস্ত, পদ, বৃক্ষ, কুজ্ঝটিকা, মৃত্তিকা ইত্যাদি।

৩: সাধু ভাষায় অনুসর্গগুলির পূর্ণ রূপ দেখা যায় এবং কিছু তৎসম অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন: হ‌ইতে, চাহিয়া, থাকিয়া, কর্তৃক ইত্যাদি।

৪: সাধু ভাষা অনেকটা সংস্কৃত ভাষার অনুসরণে গঠিত হ‌ওয়ার কারণে এই ভাষার ধ্বনিঝংকার অপেক্ষাকৃত বেশি।

৫: সন্ধিবদ্ধ ও সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার সাধু ভাষায় তুলনামূলক ভাবে বেশি দেখা যায়।

৬: সাধু ভাষায় সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের কিছু কিছু ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: দ্বাদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ ইত্যাদি।

৭: সাধু ভাষা মানুষের মুখে প্রচলিত ভাষার উপর নির্ভর করে গঠিত হয়নি, তাই এই ভাষা অপেক্ষাকৃত দুর্বোধ্য।

চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য

১: চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত, কথ্য রূপটি ব্যবহার করা হয়। যেমন: করেছি, গেছলাম, দেখবো, আসছে, করেছে, ও, এ, তার, ওর ইত্যাদি।

২: চলিত ভাষায় দেশি ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহার তৎসম শব্দের চেয়ে বেশি। বিদেশি শব্দ‌ও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। যেমন: গাছ, ঘর, ঘাস, হাত, পা, বাড়ি, ঘি ইত্যাদি।

৩: চলিত ভাষায় তদ্ভব ও বিদেশি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। অনুসর্গের পূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয় না। যেমন: হতে, চেয়ে, থেকে, দিয়ে ইত্যাদি।

৪: চলিত ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বলে এর ধ্বনিঝংকার সাধু বাংলার মতো নয়।

৫: চলিত ভাষায় সন্ধিবদ্ধ ও সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার তুলনামূলক ভাবে কম। তবে এ কথা ঠিক যে চলিত গদ্যেও সমাসবদ্ধ ও সন্ধিবদ্ধ শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার হয়ে থাকে।

৬: চলিত ভাষায় সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার সাধারণত হয় না।

৭: চলিত ভাষার ভিত্তি হল মানুষের মুখের ভাষা। তাই এই ভাষা অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য।

সাধু থেকে চলিতে রূপান্তরের নিয়ম

সাধু থেকে চলিতে রূপান্তরের জন্য মূলত ক্রিয়াপদ, অনুসর্গ ও সর্বনাম পদের রূপ বদলে নিতে হয়। এরকম কিছু শব্দের তালিকা নিচে দেওয়া হল। তালিকার বাঁ দিকে সাধু ভাষার শব্দ ও ডানদিকে ওই শব্দের চলিত রূপটি দেওয়া হল।

সাধু রূপ                            চলিত রূপ

অতঃপর ————————— এরপর

অদ্য ——————————— আজ

অপেক্ষা (অনুসর্গ) ————- চেয়ে

আগমন করিতেছেন ———– আসছেন

আগমন করিয়াছি ————– এসেছি

আজ্ঞাক্রমে ——————— আদেশ অনুসারে

ইতস্তত ——————-ইতিউতি/এদিক-ওদিক

করি ——————————- করি*

করিতে ————————— করতে

করিতেছি ———————— করছি

করিতেছিল ———————- করছিল

করিতেছিলাম ——————- করছিলাম

করিতেছিলে ——————— করছিলে

করিব —————————– করব

করিয়া —————————- ক’রে

করিয়া থাকিব ——————- ক’রে থাকব

করিয়াছি ————————- করেছি

করিয়াছিলাম ——————- করেছিলাম

করিয়াছে ———————— করেছে

করিয়ো ————————— কোরো

করিলাম ————————- করলাম

কল্য —————————— কাল

কার্যকালে ———————– কাজের সময়

গ্রহণ-পূর্বক ———————- গ্রহণ করে/নিয়ে

তথাপি ————————— তবুও

তথাপি ————————— তা সত্ত্বেও

তথায় —————————- সেখানে

তদনুসারে ———————– সেই মতো

তদীয় —————————- তার

তাহাদিগকে ——————— তাদেরকে

তাহাদিগের ———————- তাদের

থাকিতে ————————- থাকতে

দর্শন করিতে ——————- দেখতে

দর্শন-পূর্বক ——————— দর্শন করে/ দেখে

দেখিয়া ————————- দে’খে

নিমিত্ত ————————– জন্য

প্রত্যহ ————————— প্রতিদিন

বল-পূর্বক ————– গায়ের জোরে/জোর করে

বলিয়া ————————– ব’লে

মদীয় ————————— আমার

যথা —————————– যেমন

যথায় ————————— যেখানে

যদ্যপি ————————– যদিও

হ‌ইতে ————————— থেকে

More Reading : What is Tense? Write how many types of tense and what are the examples, what is tense?

* সাধারণ বর্তমান কালে সাধু ও চলিত ভাষায় সমাপিকা ক্রিয়ার ক্রিয়াবিভক্তির বদল ঘটে না। ক্রিয়ার ধাতুটির বদল করা গেলে তা করতে হবে। যেমন: ‘গমন করি’ থাকলে চলিতে ‘যাই’ হবে, ‘ভোজন করি’ থাকলে ‘খাই’ হবে, কিন্তু ‘দেখি’, ‘বলি’, ‘শুনি’ ইত্যাদি ক্রিয়া সাধু ও চলিত, উভয় ভাষাতে এক রূপেই ব্যবহৃত হতে পারে।

সাধু থেকে চলিতে রূপান্তরের উদাহরণ

সাধু:

তৎকালে আমাদিগের পরিধেয় বস্ত্র বলিতে ছিল একখানা পাঁচ হাতের মলিন ধুতি। বলিলে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করিবে না যে, দশম-বর্ষীয় বালকেরাও ধুতি পরিয়াই বিদ্যালয়ে যাইত। গ্রামের স্ত্রীলোকগণ নদীতে জল ভরিতে যাইত। অধিকাংশ গৃহের বালিকারা পড়াশোনা কাহাকে বলে তাহাই জানিত না।

চলিত:

সে সময় আমাদের পরনের পোশাক বলতে ছিলো একখানা পাঁচ হাতের ময়লা ধুতি। বললে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না যে, দশ বছরের ছেলেরাও ধুতি পরেই ইস্কুলে যেতো। গ্রামের মহিলারা নদীতে জল ভরতে যেত। বেশিরভাগ বাড়ির মেয়েরা পড়াশোনা কাকে বলে তা-ই জানতো না।

চলিত থেকে সাধুতে রূপান্তরের উদাহরণ

চলিত:

“এ কেমন করে সম্ভব?” নিখিল একেবারে রেগে আগুন হয়ে প্রশ্ন করল। তার চেহারা দেখেই সদানন্দ রায় বুঝতে পারলেন, তিনি একটা অন্যায় প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছেন। হতে পারে নিখিলের টাকার জোর তার বাবার মতো নেই, তবুও যে আভিজাত্যের ভিতর সে ছোটোবেলা থেকে লালিত হয়েছে, বাবার মৃত্যুর পর এই পনেরো বছরে তার গায়ে সে দাগ লাগতে দেয়নি।

সাধু:

“ইহা কেমন করিয়া সম্ভব?” নিখিল রাগিয়া একেবারে অগ্নিশর্মা হ‌ইয়া প্রশ্ন করিল। তাহার মূর্তি দেখিয়াই সদানন্দ রায় বুঝিতে পারিলেন, তিনি একটা অন্যায় প্রস্তাব দিয়া ফেলিয়াছেন। হ‌ইতে পারে নিখিলের টাকার জোর তাহার বাবার মতো নাই, তথাপি যে আভিজাত্যের ভিতর সে শৈশবাবধি লালিত হ‌ইয়াছে, পিতার মৃত্যুর পর এই পঞ্চদশ বৎসরে তাহার গায়ে সে দাগ লাগিতে দেয় নাই।

সাধু ও চলিত ভাষার মৌলিক পার্থক্য

সাধু ভাষায় সর্বনাম পদ, অনুসর্গ ও ক্রিয়াপদের পূর্ণ রূপ ব্যবহার করা হয়। চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদ, অনুসর্গ ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। — এটুকুই সাধু ও চলিত ভাষার মৌলিক পার্থক্য। অন্য পার্থক্যগুলি সব সময় নাও থাকতে পারে, কিন্তু মৌলিক পার্থক্যগুলি সব সময়ই লক্ষ করা যায়।

গুরুচণ্ডালী দোষ কাকে বলে

সাধু ও চলিত ভাষা একসাথে মিশিয়ে লিখতে নেই। এই ধরনের মিশ্রণকে বলা হয় গুরুচণ্ডালী দোষ। এই পরিভাষাতে সাধু ভাষাকে গুরু ও চলিতকে চণ্ডালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এমন তুলনা করা উচিত কিনা সেই তর্কে যাওয়া আমাদের কাজ নয়, তাই ওই প্রসঙ্গে কিছু বলছি না। সাধু ও চলিত ভাষা মিশিয়ে ফেললে রচনাটি পড়তে সমস্যা হয়। বর্তমান সময়ে সাধু ভাষার ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না। ছাত্র-ছাত্রীদের এবং অন্য সকলের‌ই যে কোনো লেখা চলিতেই লেখা উচিত। সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র অনেক সময় সাধুতে লেখার রেওয়াজ রয়েছে। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রতিবেদন এখনও সাধু ভাষায় লেখা হয়।

Leave a Reply