প্রিন্স অব কলকাতা সৌরভ গাঙ্গুলির জীবনী | Sourav Ganguly Biography in Bengali | কেমন ছিল ক্রিকেটের দাদার জীবন?

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়  

জন্ম: ৮ জুলাই, ১৯৭২

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ৮ই জুলাই, ১৯৭২ সালে, কলকাতার বেহালায় একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারে। তিনি বিসিসিআই এর বর্তমান সভাপতি এবং উইসডেন ইন্ডিয়ার সভাপতি। তার বাবার নাম চণ্ডীদাস গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতার নাম নিরুপা গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভ মূলত তার দাদার সাহায্যে ক্রিকেট জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা “সৌরভ গাঙ্গুলী” একজন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার এবং ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক। বাঁহাতি ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক বলে বিবেচিত হন; তার অধিনায়কত্বে ভারত ৪৯টি টেস্ট ম্যাচের মধ্যে ২১টি ম্যাচে জয়লাভ করে। ২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে তাঁর অধিনায়কত্বেই ভারত ফাইনালে পৌঁছে যায়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কেবলমাত্র একজন আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন অধিনায়কই ছিলেন না, তাঁর অধীনে যে সকল তরুণ ক্রিকেটারেরা খেলতেন, তাঁদের কেরিয়ারের উন্নতিকল্পেও তিনি প্রভূত সহায়তা করতেন।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেটার। একদিনের ক্রিকেটে তাঁর মোট রানসংখ্যা এগারো হাজারেরও বেশি। ২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর সৌরভ ঘোষণা করেন যে সেই মাসে শুরু হতে চলা টেস্ট সিরিজটিই হবে তাঁর জীবনের সর্বশেষ টেস্ট সিরিজ। ২০০৮ সালের ২১ অক্টোবর সৌরভ তাঁর সর্বশেষ প্রথম-সারির ক্রিকেট ম্যাচটি খেলেন।


সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার ও প্রাক্তন অধিনায়ক।

তিনি প্রথম জীবনে স্কুল ও রাজ্যের হয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ক্রিকেট জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে থাকেন তিনি। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম একদিনের আন্তজার্তিক ম্যাচ খেলেন ১১ই জানুয়ারী, ১৯৯২ সালে। কিন্তু তিনি সেই অভিষেক ম্যাচে মাত্র তিন (৩) রান করেন, যার ফলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে বাদ পড়েন। তার পরে ১৯৯৩-১৯৯৪ এবং ১৯৯৪-১৯৯৫ সালের রঞ্জি ট্রফিতে চমৎকার সাফল্য লাভ করেন যার ফলে তিনি আবার ১৯৯৬-এর ইংল্যান্ড সফরের জন্য খেলার সুযোগ পান। এরপরে সেই সফরেই তিনি তার জীবনের প্রথম টেষ্ট খেলেন ২০ই জুন, ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তিনি সেই সফরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন।

সৌরভ গাঙ্গুলীর সফলতার কাহিনী

 

 

সৌরভ গাঙ্গুলীর সফলতার কাহিনী

Sourav Ganguly Biography in Bengali

 

 

পুরো নাম                                                      সৌরভ চণ্ডীদাস গাঙ্গুলী /Sourav Ganguly

ডাকনাম                                                        দাদা,প্রিন্স অফ ক্যালকাটা, বেঙ্গল টাইগার, গড অফ অফসাইড

জন্ম                                                               জুলাই, ১৯৭২

বাবার নাম                                                    চণ্ডীদাস গাঙ্গুলী

মায়ের নাম                                                   নিরুপা গাঙ্গুলী

ক্রিকেট খেলায় মুখ্য ভুমিকা                     প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক

ব্যাটিংয়ের ধরন                                           বাঁহাতি ব্যাটসম্যান

জাতীয়তা                                                     ভারতীয়

টেস্ট অভিষেক                                           ২০ জুন ১৯৯৬ বনাম ইংল্যান্ড

.ডি.আই অভিষেক                                  ১১ জানুয়ারি, ১৯৯২ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ

শেষ টেস্ট ম্যাচ                                           ৬ই নভেম্বর ২০০৮, নাগপুর বনাম অস্ট্রেলিয়া

শেষ .ডি.আই ম্যাচ                                   ১৫ই নভেম্বর ২০০৭, গোয়ালিয়র বনাম পাকিস্তান

আরো পড়ুনশচীন টেন্ডুলকারের জীবন পরিচয় | Sachin Tendulkar Life Story in Bengali | শচীন তেন্ডুলকারের জীবনী

Early Life of Sourav Ganguly:


ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীকে আমরা তো সবাই চিনি | বাঙালীর গর্ব, সৌরভ গাঙ্গুলীর জন্ম হয় ৮ই জুলাই ১৯৭২ সালে, দক্ষিন কোলকাতার বেহালা অঞ্চলের একটা সু-প্রতিষ্ঠিত পরিবারে |

তাঁর বাবর নাম চন্ডীদাস গাঙ্গুলী এবং মায়ের নাম নিরুপা গাঙ্গুলী | ছোটবেলা থেকেই সৌরভ ফুটবল খেলতে ভীষন ভালোবাসতেন | পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল খেলাতেই তাঁর আগ্রহ ছিলো বেশি |

 

তিনি ও তাঁর দাদা স্নেহাশীষ গাঙ্গুলী একই সাথে বড় হয়ে ওঠেন চন্ডীদাস পরিবারে | তাঁর দাদাই আসলে ক্রিকেট খেলতেন কিন্তু পরে সৌরভকেও তাঁর বাবা চন্ডীদাস গাঙ্গুলী দশ বছর বয়সে, কোলকাতার একটা নামী ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দেন |

সৌরভ গাঙ্গুলী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা নেন, কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল থেকে এবং সেই স্কুলেরই ক্রিকেট একাডেমিতে তিনি যোগদান করেন একজন ক্রিকেট প্লেয়ার হিসাবে |

Cricket Career of Sourav Ganguly:

তিনি তাঁর জীবনের প্রথম ক্রিকেট সেঞ্চুরি করেন ওড়িশার আন্ডার-১৫ দলের বিরুদ্ধে | সেই খেলায় তাঁর অসাধারণ পারফর্মেন্স, তাঁকে করে দেয় সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক |  এরপর ধীরে ধীরে সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেট খেলা সকলকে মুগ্ধ করতে থাকে এবং দিকে দিকে তাঁর খেলার চর্চা ছড়িয়ে পরতেও শুরু করে খুব তাড়াতাড়ি |

অবশেষে তাঁর সব প্রতীক্ষার অবসান হয় ১৯৮৯ সালে, যখন তাঁকে বেঙ্গল ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার জন্য নির্বাচন করা হয় | কিন্তু অন্যদিকে, ঠিক সেই বছরই তাঁর দাদা স্নেহাশীষ গাঙ্গুলীকে বেঙ্গল ক্রিকেট দল থেকে অপসারিতও করা হয় |

১৯৯০ ও ১৯৯১ এই দুই বছর, রঞ্জি ট্রফিতে দারুন পারফর্মেন্স করার ফলে তাঁকে প্রথমবারের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়, ১৯৯২ সালে | সেই বছর ভারতের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের একটা ও.ডি.আই সিরিজ অনুষ্ঠিত হয় |

কিন্তু ডেবিউ ম্যাচে সৌরভ মাত্র ৩ রানে আউট হয়ে যান | যারফলে তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে অপসারিত করা হয় | দল থেকে বাদ পরার পর আবার সৌরভ গাঙ্গুলী রঞ্জি ট্রফি খেলতে শুরু করেন |

১৯৯৩-১৯৯৪ ও ১৯৯৪-১৯৯৫ এই দুই সিজিনে, তিনি Domestic Cricket-এ ব্যাপক পরিমান রান করেন ধারাবাহিক ভাবে | তাছাড়া দলীপ ট্রফিতেও তিনি ১৭১ রানের একটি সুন্দর ইনিংস খেলেন, যারফলে পুণরায় তাঁকে ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে টেস্ট সিরিজে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়  |

 

প্রথম টেস্টে সৌরভ কিন্তু মোটেই খেলার সুযোগ পাননি, তিনি মাঠের বাইরে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবেই বসে ছিলেন গোটা প্রথম টেস্ট ম্যাচ |

দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচেও তিনি প্রায় অনিশ্চিতই ছিলেন কিন্তু শেষ মূহুর্তে নভজৎ সিং সিধুর শারীরিক অসুস্থতা, তাঁকে দলে খেলার সুযোগ করে দেয় |  সেই টেস্ট ম্যাচেই আবার রাহুল দ্রাবিড়ও সুযোগ পান, প্রথমবারের জন্য ভারতের হয়ে খেলার |

আরো পড়ুন : বিরাট কোহলির জীবনী

তাঁরা দুজনেই তাঁদের প্রথম ডেবিউ ম্যাচে, সুন্দর দুটো সেঞ্চুরি করেন, ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট ময়দানে | সেই সিরিজের শেষ টেস্টেও সৌরভ সুযোগ পান | এরপর ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেস্ট খেলা অনুষ্ঠিত হয় ট্রেন্ট ব্রিজে, যেখানে তিনি আবারও একটা সেঞ্চুরি করেন (১৩৬রান) |

Personal Life of Sourav Ganguly:

বিদেশের মাটিতে পরপর দুটো ঝড়ো ইনিংস খেলার পর, সৌরভের জায়গা পাকাপাকি ভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দলে হয়ে যায় | ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে চরম সাফল্য নিয়ে ফিরে আসার পর সৌরভ গাঙ্গুলী ঠিক কিছু সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর ছোটবেলার প্রেমিকা ডোনা রায়কে নিয়ে পালিয়ে যান বিয়ে করার উদ্দেশ্যে |

তাদের এই বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারেরই ভীষন অমত ছিলো প্রথমে, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলায় এবং সবাই তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নেন অবশেষে |

১৯৯৭ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে, দুই পরিবারের মত মতো সৌরভ ও ডোনা গাঙ্গুলীকে; হিন্দু প্রথা মেনে পুণরায় ভালোভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় | বিয়ের ঠিক সেই বছরেই সৌরভ শ্রীলঙ্কার মাটিতে ১১৩ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন আর সেইসাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাহারা কাপে পর পর ৪টে ম্যাচে ম্যান অফ ম্যাচ হিসাবে সম্মানিত হন |

এছাড়াও ১৯৯৯ সালে সৌরভ গাঙ্গুলী শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৮৩ রান করেন এবং ২০০৭ সালে ভারতের চির প্রতিদ্বন্ধি পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও তিনি ২৩৯ রান করেন |

Team India & Captain Sourav Ganguly:

২০০০ সালে ভারতের অধিনায়ক হওয়ার পর, তিনি ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ভবিষ্যতই বদলে দেন | তাঁর অধিনায়কত্বের সময়কে আমরা ভারতীয় ক্রিকেটর স্বর্ণযুগ হিসাবে ধরতে পারি | বিদেশের মাটিতে কীভাবে জিততে হয়, সেটা হয়তো গাঙ্গুলী ছাড়া এত ভালোভাবে কেউই এর আগে শেখাতে পারেনি আর বর্তমানেও পারবেনা |

আগে বিদেশী খেলোয়াড়দের চোখ রাঙানী দেখে অনেক ভারতীয় ক্রিকেটাররাই জবাবে কিছু বলতে পারতো না | কিন্তু এখানেও সৌরভ গাঙ্গুলীই প্রথম শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে বিদেশী খেলোয়াড়দের চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে তাদের পাল্টা জবাব দিতে হয় |

তাঁর দৌলতেই ভারতীয় ক্রিকেট দল পেয়েছিলো কিছু অভাবনীয় প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের; যার মধ্যে বীরেন্দ্র সেহওয়াগ, আশিস নেহেরা, জাহির খান, যুবরাজ সিং, হরভজন সিং ও ভিভিএস লক্ষণ  ছিলো অন্যতম |

তুমি হয়তো এটা বিশ্বাস করবেনা যে, ভারতের আরো এক সফলতম খেলোয়াড় তথা মহান অধিনায়ককেও দলে সুযোগ করে দেওয়ার নেপথ্যে স্বয়ং আমাদের মহারাজই ছিলেন | আমি যার কথা বলছি তিনি কিন্তু আমাদের সবার প্রিয় ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, যার ক্রিকেটিও কর্মকান্ড আজ গোটা বিশ্বে বিখ্যাত |

সত্যি, আজ যদি সৌরভ গাঙ্গুলী ভারতীয় ক্রিকেট জগতে না আসতেন; তাহলে আজ আমরা হয়তো এইসব প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খেলা দেখার সুযোগই পেতাম না |

আমার মতে, তিনি সত্যিই একজন মহান ক্রিকেটিও ব্যক্তিত্ব, যার থেকে আমরা প্রত্যেকটা দেশবাসী অনেক কিছু শিখেছি | তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য  যা করেছেন, তা  সত্যিই কোনদিন ভোলার নয় |

অবশেষে ভারতের এই মহান ক্রিকেটার তথা অধিনায়ক, ৬ই নভেম্বর ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ টেস্ট খেলেন নাগপুরে | সেই ম্যাচে তিনি প্রথম ইনিংসে ৮৫ রান আর দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রান করেন এবং তাঁকে দুবারই আউট করেন অস্ট্রেলিয়ার এক অনুভবি বোলার জেসন ক্রেজা |

আরো পড়ুনইলন মাস্ক | বিশ্বের সেরা ধনীর যত কথা | এলন মাস্ক এর জীবনী- Elon Musk Biography

Records and Achievements: 

1. পৃথিবীর একমাত্র ক্রিকেটার যিনি পরপর ৪টে ম্যাচে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হন |

2. দক্ষিন আফ্রিকার ক্রিকেটার এবি ডিভিলিয়ার্স পর তিনিই পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান, যিনি দ্রুততম ৯০০০ ও.ডি.আই রানের অধিকারী |

3. তিনি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ক্রিকেটের ইতিহাসে, প্রথম একজন ব্যাটসম্যান যিনি ৩টে সেঞ্চুরি করেন |

4. চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনালে তাঁর রানের রেকর্ড এখনো অবধি কোনো ক্রিকেটার ভাঙ্গতে পারেনি (১১৭ রান) |

5. তিনি পৃথিবীর সেই ৫জন ক্রিকেটারের মধ্যে একজন, যার নিজের ১০০০০ রান, ১০০টা উইকেট আর ১০০টা ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড আছে |

6.  ২৬শে মে, ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বকাপে তিনি  শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৮৩ রান করেন |

7. তিনি তাঁর জীবনের প্রথম ডেবিউ টেস্টে ভারতের হয়ে সেঞ্চুরি করেন এবং শেষ টেস্টে করেন শূন্য রান |

আরো পড়ুন : ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর জীবনী

Awards: 
*১৯৯৭ সাল – অর্জুন পুরস্কার
*১৯৯৮ সাল – Sports Person of the Year পুরস্কার
*২০০৪ সাল – পদ্মশ্রী পুরস্কার
*২০০৪ সাল – রামমোহন রায় পুরস্কার

প্রিন্স অব কলকাতা এবং ভারতীয় ক্রিকেটের দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি

কেমন ছিল ক্রিকেটের দাদার জীবন?

২০০২ সালের ১৩ জুলাই। ইংল্যান্ড, ভারত আর শ্রীলংকার মধ্যে চলমান ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনালটা ইংল্যান্ড খেললো ফাইনালের মতোই। মার্কাস ট্রেসকোথিক এবং অধিনায়ক ভনের জোড়া সেঞ্চুরিতে ৫ উইকেট হারিয়ে ৩২৫ রানের পাহাড় গড়লো ইংল্যান্ড। ৩২৫ রান যদি পাহাড় মনে না হয়, তাহলে আরো একবার উল্লেখ করছি, ম্যাচটা ২০০২ সালের। সে সময় ৩০০ রানই পাহাড়সম স্কোর বলে গণ্য হতো। তার উপর উপমহাদেশের একটি দলের জন্য ইংল্যান্ডের মাঠে সে পাহাড় পেরোনো তো আরো কঠিন।

কিন্তু গল্পটা যে অন্যরকম হতে চলেছে, তা উদ্বোধনী জুটিতে শেবাগের সাথে ১৪ ওভারে ১০৬ রানের জুটি করে বুঝিয়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক। ইংল্যান্ডের সাথেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া এই ব্যাটসম্যান, আউট হবার আগে খেলেন ৪৩ বলে ৬০ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস। পরে মিডল অর্ডারের ধ্বস নামলেও মোহাম্মদ কাইফের দৃঢ় এক ইনিংসে ২ উইকেটের নাটকীয় জয় পায় ভারত। কিন্তু এই ম্যাচটি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে অন্য কারণে। ম্যাচের জয় ছাপিয়ে সবার নজর কাড়ে ভারতীয় অধিনায়কের উদযাপন! মনে পড়ে পাঠক? শেষ ওভারে ফ্লিনটফের করা তৃতীয় বলটিতে কাইফের দ্বিতীয় রান তোলার সাথে সাথে, লর্ডসের ব্যালকনিতে দেখা যায় ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়কের স্বভাববিরুদ্ধ এক উদযাপন। গায়ের জার্সি খুলে উন্মত্তভাবে হাওয়ায় দুলিয়ে তার সেই বুনো উল্লাস আজও শিহরণ জাগায় অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে। ব্যক্তিটি কে, তা বুঝেছেন নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কথাই বলছি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেকটা হয় খুবই বাজেভাবে। ১৯৯২ সালে ২০ বছর বয়সে, ভারতের ওয়ানডে দলে ডাক পান গাঙ্গুলি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুঃস্বপ্নের অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৩ রানই করতে পেরেছিলেন তিনি! তবে আসল দুঃস্বপ্ন শুরু হয় সে ম্যাচের পরই। ২য় ম্যাচে মূল একাদশে না থাকলেও অন্তত দলে ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচেই তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি করে দেশে পাঠিয়ে দেয় বিসিসিআই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি অতিমাত্রায় ‘অহংকারী’ ছিলেন! সিনিয়রদের সাথে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া যায়। গাঙ্গুলি যদিও সেগুলো অস্বীকার করেছিলেন, তথাপি ভারতীয় ক্রিকেট দলের দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সে দরজা খুলতে তাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে পরবর্তী চারটি বছর। ১৯৯৩-৯৪ এবং ১৯৯৪-৯৫, টানা দুই রঞ্জি ট্রফি মৌসুমে রানের বন্যা বইয়ে পুনর্বার নির্বাচকদের মন জয় করতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে তাই দলে ডাক পেয়ে যান। তিন টেস্টের প্রথমটিতে খেলতে না পারলেও, দ্বিতীয়টিতে মূল একাদশে জায়গা করে নেন গাঙ্গুলি। তার সাথে সে ম্যাচে অভিষেক হয় আরেক ভারতীয় কিংবদন্তী রাহুল দ্রাবিড়েরও। তবে গাঙ্গুলির জন্য সে ম্যাচটি ছিল রূপকথার মতো!

ইংল্যান্ডকে সৌরভ গাঙ্গুলির ‘প্রিয় প্রতিপক্ষ’ বললে ভুল বলা হবে না। যখনই ইংল্যান্ডকে সামনে পেয়েছেন, খেলেছেন নজরকাড়া সব ইনিংস। তবে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার স্বপ্নের মতো টেস্ট ডেব্যু ম্যাচটিই। ‘ক্রিকেটের মক্কা’ খ্যাত ইংল্যান্ডের লর্ডসে সেঞ্চুরি করে ‘অনার্স বোর্ড’ এ নাম লেখানোর স্বপ্ন থাকে প্রত্যেক ক্রিকেটারের। এই স্বপ্ন যেখানে শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা আর রিকি পন্টিংয়ের মতো রথী-মহারথীরা পূরণ করতে পারেননি, সেখানে অভিষেক টেস্টেই লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান গাঙ্গুলি। তার ১৩১ রানের ঝলমলে ইনিংসে ভর করেই ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয় ভারত। এমন স্বপ্নীল অভিষেকের পরের ম্যাচেই, ট্রেন্ট ব্রিজে খেললেন ১৩৬ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস। পেয়ে গেলেন টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার। এই ম্যাচটিও ড্র হয়। তবে সিরিজের প্রথম ম্যাচ জেতার সুবাদে ১-০ তে সিরিজ জেতে ইংল্যান্ডই।

একদিনের ক্রিকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখলেও, একদিনের ক্রিকেটে একটা ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলা হচ্ছিল না গাঙ্গুলির। ১৯৯৭ সালে শ্রীলংকা সফরে ২য় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তুলে নেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। তবে ১১৩ রানের ইনিংস খেলেও সে ম্যাচে দলকে জেতাতে পারেননি তিনি। এই হতাশা দূর করলেন বছরের শেষদিকে পাকিস্তানের সাথে সাহারা কাপে। সিরিজে টানা চার ম্যাচে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এর পুরস্কার ওঠে তার হাতে। এর মধ্যে একটি ম্যাচে তো ব্যাটসম্যান গাঙ্গুলি ম্যাচসেরা হয়েছিলেন বোলার হয়ে! ১০ ওভারে মাত্র ১৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে! এই ‘বোলার’ গাঙ্গুলি পরের সিরিজেই শ্রীলংকার বিরুদ্ধে চার টেস্টে করলেন ৩ সেঞ্চুরি। এই সিরিজ দিয়েই তিনি তার জাত চেনান, বুঝিয়ে দেন যে তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।

তখনও অনেকেই গাঙ্গুলিকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য অধিক উপযোগী মনে করতেন। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে, ১৯৯৮ সালে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে একদিনের ক্রিকেটের গাঙ্গুলি। ঢাকায় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ’ এর একটি ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ৩১৫ রানের বিশাল লক্ষ্যের নীচে সেদিন চাপা পড়তে পারতো ভারত, যদি না গাঙ্গুলি তার জীবনের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেলতেন! পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তার দায়িত্বশীল ১২৪ রানের ইনিংসটি সেদিন ভারতের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি দলে তার অবস্থান পাকাপোক্ত করেছিল। পরের বছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপটা ভারতের জন্য ভুলে যাবার মতো হলেও, গাঙ্গুলির জন্য অবশ্যই স্মরণীয়। গ্রুপ পর্বে শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচে, রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১৮ রানের জুটি গড়ার পথে গাঙ্গুলী তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস খেলেন। ১৮৩ রানের সে ইনিংস বিশ্বকাপের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস।

২০০০ সালে ভারতের অধিনায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন সৌরভ গাঙ্গুলি। অধিনায়ক হয়ে যেন তিনি বড় ম্যাচের খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। দ্বিপাক্ষিক কিংবা ত্রিদেশীয় সিরিজগুলোতে তার খেলা ঠিক গাঙ্গুলিসুলভ না হলেও, আইসিসির টুর্নামেন্টগুলোতে দেখা যেত বিধ্বংসী আর ভয়ানক গাঙ্গুলিকে। তার ব্যাটে চড়েই ২০০০ সালে ‘নকআউট ট্রফি’র ফাইনালে পৌঁছে যায় ভারত। ২ সেঞ্চুরিসহ টুর্নাম্যান্টের সর্বোচ্চ ৩৪৮ রান করেও দলকে শিরোপা এনে দিতে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপেও তার ব্যাটে রানের ফোয়ারা সৃষ্টি হয়। তার অসাধারণ নেতৃত্ব এবং ৫৮.১২ গড়ে ৪৬৫ রানে ভর করেই ১৯৮৩ সালের ২০ বছর পর, আরো একবার এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছে ভারত। তবে এবারো তার ব্যক্তিগত সাফল্য দলের চূড়ান্ত সাফল্যে এনে দিতে ব্যর্থ হয়। এ সময় একদিনের ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্যের পুরস্কার স্বরূপ র‍্যাংকিংয়ে এক নম্বরে উঠে আসেন গাঙ্গুলি। কিন্তু টেস্টে তার রানখরা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো।

শ্রীলংকার বিপক্ষে ১৮৩ রানের ইনিংস খেলার পথে স্ট্রোক খেলছেন গাঙ্গুলি;

অধিনায়ক হবার পর থেকেই বিতর্কের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন গাঙ্গুলি। প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে বোর্ডের উপর প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিল। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে তো অভূতপূর্ব এক কাণ্ড করে বসেন। একই সিরিজে চারটি ম্যাচে তিনি বিলম্বে টসে যোগ দেন। এই ঘটনা তার ক্রিকেটীয় নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের দিকেই আঙুল তোলে। তবে সম্ভবত যে বিষয়টি দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন গাঙ্গুলি, তা হচ্ছে লর্ডসে তার নগ্নগাত্রে উদ্দাম উদযাপন। লর্ডসের প্রোটোকল ভাঙার জন্য জরিমানা গুণতে হয়েছিল তাকে। সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন অনেক স্বদেশী এবং বিদেশী ক্রিকেট কিংবদন্তী। কিন্তু গাঙ্গুলি এসব থোড়াই পরোয়া করতেন! বহুমুখী সমালোচনার জবাবে তিনি শুধু বলেন, “আমি তো কেবল ইংল্যান্ডের ভারত সফরে ফ্লিন্টফের করা উদযাপনের অনুকরণ করেছিলাম মাত্র!”

২০০৪ সাল থেকে দীর্ঘ ফর্মহীনতায় ভুগতে শুরু করেন গাঙ্গুলি। দল থেকেই বাদ পড়েন ২০০৫ সালে। তার অনুপস্থিতিতে অধিনায়ক করা হয় ডেপুটি অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়কে। সে বছরই ভারতের কোচ হন অস্ট্রেলীয় কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। চ্যাপেলের সাথে গাঙ্গুলির সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা কে না জানে? চ্যাপেল-গাঙ্গুলি মনোমালিন্য লিখতে গেলে একটি আলাদা ফিচারই লিখে ফেলা সম্ভব! যা-ই হোক, সব মিলিয়ে তখন গাঙ্গুলির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে সময় চলছে। দল থেকে বাদ পড়ার পর তাকে অব্যহতি দেয়া হলো অধিনায়কত্ব থেকেও। এবার দলে ফিরতে তাকে অপেক্ষা করতে হলো ১০টি মাস। তবে প্রত্যাবর্তনটা রাঙিয়ে নিলেন দুর্দান্ত সব স্ট্রোকের তুবড়ি ছুটিয়ে ৯৮ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার এই রাজকীয় প্রত্যাবর্তনে ক্যারিয়ার যেন দ্বিতীয় জীবন পায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শ্রীলংকা সফরে ৭০ গড়ে রান তুলে উভয় সিরিজে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ জিতে দলে আবারও আসন পাকাপোক্ত করেন তিনি। ফলে ২০০৬ সালের নকআউট ট্রফিতেও দলে জায়গা করে নেন তিনি, যে টুর্নামেন্টটি ভারতের জন্য ছিল নিছক হতাশার। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচের মধ্যে দুই ম্যাচ হেরে প্রথম রাউন্ডে বাদ পড়ে ভারত। এর পরই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ৪ ম্যাচের ওডিআই সিরিজ ৪-০ তে হারে। কিন্তু এতসবের মাঝে গাঙ্গুলি ছিলেন স্বীয় পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল। ভারতের ক্রমাগত ব্যর্থতার মাঝে ৫০ এর অধিক গড়ে রান তুলে নিজের ক্যারিয়ারের পুনর্জন্ম ঘটান তিনি। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টেস্ট ম্যাচ জেতে ভারত, যে ম্যাচে গাঙ্গুলির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ভারত সিরিজ হেরেছিল, তথাপি গাঙ্গুলিই হন সে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

দলের ব্যর্থতার মাঝে উজ্জ্বল ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি

ক্যারিয়ারের শেষ বছরটা টেস্ট এবং ওডিআই, উভয় ফরম্যাটেই দুর্দান্ত কাটে তার। ২০০৭ সালে টেস্টে ৩ সেঞ্চুরিতে ৬১ গড়ে ১,১০৬ রান এবং ওয়ানডেতে ২ সেঞ্চুরিতে ৪৪ গড়ে, ,১২৪৬ রান করেন। অথচ এমন দুর্দান্ত ফর্মে থেকেও ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের পর, আর কোনোদিন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি তার। বোর্ডের সাথে সম্পর্ক এবং বয়স, কোনোটাই তার পক্ষে কথা বলেনি। টেস্ট ক্রিকেটকেও বিদায় জানিয়ে দেন ২০০৮ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে। এই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারের শেষ শতকটি হাঁকিয়েছিলেন তিনি। সিরিজের চতুর্থ এবং শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসেও খেলেন ৮৫ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস। কিন্তু দ্বিতীয় তথা নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে ০ রানেই প্যাভিলিয়নে ফেরেন এই ব্যাটিং গ্রেট। এই টেস্টের শেষদিকে, যখন জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন মাত্র ১ উইকেট, তখন অধিনায়ক ধনী, গাঙ্গুলিকে শেষবারের মতো অধিনায়কত্ব করবার আমন্ত্রণ জানান। ফলে অধিনায়ক হয়েই ক্যারিয়ার শেষ করেন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বছর ব্রাত্য হয়ে পড়েন, সে বছরই বলিউড তারকা শাহরুখ খানের আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) অধিনায়ক হিসেবে আইপিএলে খেলা শুরু করেন গাঙ্গুলি। আইপিলে তিনি খুব একটা সফল যে ছিলেন, তা বলা যাবে না। বরং অধিনায়ক এবং ব্যাটসম্যান, উভয় ক্ষেত্রেই তার ব্যর্থতার পাল্লা ছিল ভারি। আইপিএলের চতুর্থ আসরে কলকাতা তাকে ছেড়ে দিলে তিনি পুনে ওয়ারিয়র্সে যোগ দেন। ২০১২ আইপিএলই ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ আইপিএল। পুরো ক্যারিয়ারে ৫৯ ম্যাচে ৭টি অর্ধশতকসহ ১০৬ স্ট্রাইক রেটে ১,৩৪৯ রান করেন তিনি। আহামরি তো নয়ই, বরং স্ট্রাইক রেটের জন্য গড়পড়তার চেয়েও কম হয়ে যায়!

কলকাতার জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে;

টিভি রিয়েলিটি শো ‘দাদাগিরি’তে হোস্ট হবার জন্য নয়, বরং ক্রিকেট মাঠে তার দাদাগিরির জন্যই তাকে ভক্তরা ‘দাদা’ বলে ডাকে। মহেন্দ্র সিং ধোনি অধিনায়ক হবার আগপর্যন্ত, দাদাই ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম অধিনায়ক। তার কিছু রেকর্ড একনজরে দেখে নিই চলুন।

  • ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি টানা চার ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়েছেন।
  • একদিনের ক্রিকেটে অষ্টম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৩১১ ম্যাচে, ৪১ গড়ে ১১,৩৬৩ রান করেন তিনি।
  • ২০১৭ সাল পর্যন্ত গাঙ্গুলিই ছিলেন দ্রুততম ৯ হাজার রান করা ব্যাটসম্যান। সে বছর ভিলিয়ার্স তার রেকর্ড ভাঙেন।
  • একদিনের ক্রিকেটে ১০ হাজার রান, ১০০ উইকেট এবং ১০০ ক্যাচ ধরা ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি একজন।
  • ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই টেস্ট কিংবা ওডিআই, কোনো ফরম্যাটেই গাঙ্গুলির ব্যাটিং গড় ৪০ এর নিচে নামেনি।
  • ৩০০ ওডিআই এবং ১০০ টেস্ট খেলা ১৪ জন ক্রিকেটারের ছোট্ট তালিকায় গাঙ্গুলিও একজন।
  • বিদেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের সফলতম অধিনায়ক গাঙ্গুলি। তার নেতৃত্বে বিদেশের মাটিতে খেলা ২৮ টেস্টের ১১টিতে জয় তুলে নেয় ভারত, ড্র হয় ৭টি।
  • তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে, টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি এবং শেষ ইনিংসে প্রথম বলেই ০ রানে সাজঘরে ফেরার অদ্ভুত রেকর্ড করেন!

১৯৭২ সালের ৮ জুলাই কলকাতার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তখন কলকাতার আনাচে কানাচে মানুষ কেবলই ফুটবল খেলতো। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা সেখানে খুবই কম ছিল। বাবা চণ্ডিদাসও খুব করে চাইতেন, ছেলেকে ফুটবল খেলোয়াড় বানাবেন। কিন্তু ক্রিকেটকে এমন একজন কিংবদন্তীর সৌরভ থেকে হয়তো সৃষ্টিকর্তারও বঞ্চিত করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই তো বড় ভাই স্নেহাশীষের হাত ধরে ঠিকই ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ার গড়া শুরু করেন গাঙ্গুলি। তবে যে ব্যাপারে অধিকাংশই অবগত নয় তা হচ্ছে, গাঙ্গুলি কিন্তু আদতে ডানহাতি ছিলেন! কেবল পাড়ার ক্রিকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের কদর ছিল বলে তিনি বাঁহাতে ব্যাটিং রপ্ত করেন!

সৌরভ-ডোনার বিয়ে;

বর্ণাঢ্য ক্রিকেট জীবনে অনেক নাটকীয়তার সাক্ষী যেমন হয়েছেন, তেমনি ব্যাক্তিগত জীবনও তার কম নাটকীয় ছিল না। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের সাথে স্বপ্নময় অভিষেকের পর দেশে ফিরেই এক কাণ্ড করে বসেন গাঙ্গুলি। উদীয়মান ক্রিকেট তারকা হিসেবে সারা ভারতে জনপ্রিয় গাঙ্গুলি তার কৈশোরের ভালোবাসা ডোনা রয়ের সাথে পালিয়ে যান! তার এই পালিয়ে বিয়ে করাকে ঘিরে ভারতে হৈ হৈ রৈ রৈ ডাক পড়ে যায়। বর-কনের দুই পরিবারের সম্পর্কও বেশ শীতল হয়ে যায়। অবশ্য তাদের যৌথ চেষ্টায় বরফ গলতে বিলম্ব হয়নি। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ডোনার সাথে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এই দম্পতির ঘরে ২০০১ সালে তাদের একমাত্র সন্তান সানা গাঙ্গুলির জন্ম হয়।

একটা সময় ছিল, যখন তিনি একইসাথে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রিয় এবং অপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন! বর্তমানে বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন ভারতীয় ক্রিকেটের দাদা। ভালোবেসে কেউ তাকে ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ ডাকতেন। কেউ আবার অফসাইডে তার বিস্ময়কর দক্ষতার জন্য ‘অফসাইডের ঈশ্বর’ বলেও ডাকতেন! ক্রমাগত ব্যর্থতা, স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি এবং হারের চক্রে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দল যখন ওডিআই র‍্যাংকিংয়ে আট নম্বরে অবস্থান করছে, তখন দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন দাদা। এরপর শুধুই ইতিহাস রচনা করেছেন নিজের খেয়ালখুশি মতো! আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বে বদলে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের খোলনলচে। তার হাত ধরেই ভারত উঠে আসে ওডিআই র‍্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে, টেস্টে তিনে। “দেশে বাঘ, বাইরে বিড়াল”, টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের এই অপবাদ তিনিই ঘুচাতে সক্ষম হন। তখনকার সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে কেবল গাঙ্গুলির ভারতই প্রতিযোগিতা করতে পারতো। টেস্ট ক্রিকেটে হয়তো নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তেমনভাবে, তবে অধিনায়ক হিসেবে তার তুলনা তিনি নিজেই। আর একদিনের ক্রিকেট তো নিঃসন্দেহে সৌরভ গাঙ্গুলি সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকার একজন। একটা যুগ, বাইশ গজের পিচে তার সৌরভে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাতোয়ারা হয়ে ছিল ক্রিকেট বিশ্ব, সে মুগ্ধতা আজও কমেনি, কমবে না কখনো!

সৌরভ গাঙ্গুলী জীবনী, বাংলা সৌরভ গাঙ্গুলির স্ত্রী, সৌরভ গাঙ্গুলী কত টাকার মালিক, সৌরভ গাঙ্গুলীর মেয়ের নাম কি, সৌরভ অর্থ সৌরভ, গাঙ্গুলির পরিবার আন্তর্জাতিক স্তরে সুনাম অর্জন করেছেন, এমন একজন বাঙালি ক্রীড়াবিদের কৃতিত্বের পরিচয় দাও, সৌরভ গাঙ্গুলীর বাড়ি কোথায়,সৌরভ গাঙ্গুলীর সফলতার কাহিনী , Sourav Ganguly Biography in Bengali,সৌরভ গাঙ্গুলির জীবনী , কেমন ছিল ক্রিকেটের দাদার জীবন?,প্রিন্স অব কলকাতা এবং ভারতীয় ক্রিকেটের দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি

0 thoughts on “প্রিন্স অব কলকাতা সৌরভ গাঙ্গুলির জীবনী | Sourav Ganguly Biography in Bengali | কেমন ছিল ক্রিকেটের দাদার জীবন?

Leave a Reply