হিজড়া সংবাদ | পাকিস্তানের প্রথম হিজড়া সংবাদ পাঠিকা | বাংলাদেশে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী সংবাদ পাঠিকা তাসনুভা নবজাতককে ঘিরে বেপরোয়া হিজড়ারা

নাম তার মারভিয়া মালিক। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম হিজড়া সংবাদ পাঠিকা। দেশটির একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রথমবারের মতো খবর পাঠ করেছেন মারভিয়া।

তৃতীয় লিঙ্গের এই সংবাদ পাঠিকা সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতক পাশ করেছেন।

হিজড়াদের Transgender hijra (6)

তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন  চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়, আমি আনন্দে চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন স্বপ্ন পূরণের পথে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েছি।’

মারভিয়া বলেন, ‘আমার পরিবার আমাকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু আমার দেশ দুই হাত খুলে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে।’

জানা গেছে, মারভিয়া পাকিস্তানি ফ্যাশন জগতে একজন মডেল হিসেবে পরিচিত। শুক্রবার দেশটির ব্যক্তিমালিকানাধীন নিউজ চ্যানেল কোহিনূর-এ সংবাদ পাঠ করেন তিনি।

 

কোহিনূরের মালিক জুনাইদ আনসারি জানান, তারা মারভিয়াকে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত করেছেন। এখানে লিঙ্গ কোনো বিষয় ছিল না।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তানে হিজড়াদের নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। চাকরি যোগাড় করতেও তাদের অনেক লড়াই করতে হয়।পাকিস্তান সিনেট গত মাসে হিজড়াদের পক্ষে একটি বিল অনুমোদন করেছে। সেই বিলে হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষার পাশপাশি তাদের নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

সূত্র: ভিওএ নিউজ

হিজড়াদের Transgender hijra (6)

বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে দুই ট্রান্সজেন্ডার

‘‘সমাজ, পরিবার সবকিছু উলটো পথে হাঁটছিল৷ সব প্রতিবন্ধকতা ভেদ করেই আজকের জায়গা তৈরি করতে হয়েছে৷’’ ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তাসনুভা আনান শিশির, বাংলাদেশে প্রথম টেলিভিশনে সংবাদ পাঠের সুযোগ পাওয়া ট্রান্সজেন্ডার নারী৷

বেসরকারি চ্যানেল বৈশাখী টেলিভিশনে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সংবাদ পাঠ করবেন তিনি৷

একই দিন চ্যানেলটির একটি নাটকে দেখা যাবে আরেক ট্রান্সজেন্ডার নারী নুসরাত মৌ-কে৷ শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বৈশাখী টেলিভিশন এই ঘোষণা দিয়েছে৷ চ্যানেলটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক টিপু আলম মিলন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বৈশাখী টেলিভিশন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছর, স্বাধীনতার মাস মার্চে নারী দিবস উদযাপনের আগে সংবাদ বিভাগ ও নাটকে দুই জন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে যুক্ত করেছে৷ দেশের মানুষ এই প্রথম একজন ট্রান্সজেন্ডারকে পেশাদার সংবাদ বুলেটিনে পাঠ করতে দেখবেন৷’’

দৃষ্টান্ত স্থাপনের সেই মুহূর্তের জন্য দুইজনই এখন ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন৷ তার মধ্যেই ডয়চে ভেলের কাছে জানিয়েছেন তাদের বাধার পাহাড় ডিঙানোর গল্প৷

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার অব পাবলিক হেলথের শিক্ষার্থী তাসনুভা আনান শিশির৷ তার শৈশব-কৈশোর অন্য শিশুদের মতো ছিল না৷ আশেপাশের মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেনস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন৷ সেই অতীত স্মৃতি বরাবরই তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক৷ শিশির বলেন, একটা ছেলের শরীর নিয়ে কারো আচরণ যদি মেয়েলি হয়, তাহলে, ‘‘সেই আচরণে কেউ সমর্থন দেয় না, বরং অনবরত বুলিং, হেনস্থার শিকার হতে হয়, যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়৷ সেরকম প্রতিবন্ধকতা ভেদ করেই আজকের জায়গা তৈরি করতে হয়েছে৷’’

নুসরাত মৌ-এর সংগ্রামটা একটু অন্যরকম৷ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি৷ চতুর্থ শ্রেণি পেরুতেই বাধ্য হয়েছেন স্কুল ছাড়তে৷ ‘‘আমি যখন স্কুলে যেতাম, তখন আমাকে অন্য শিক্ষার্থীরা খ্যাপাতো, হিজড়া হিজড়া বলতো, টিজ করতো, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতো, এক সাথে বসতে গেলে বেঞ্চ ফেলে দিতো, নানাভাবে হেনস্থা করতো৷ এ কারণে স্কুলে যাওয়ার ম- মানসিকতাটা আর হয়নি৷ একটা পর্যায়ে মনে হলো, সবাই এমন অপমান করে, আর স্কুলেই যাবো না৷’’

এখানে কেউ আমাকে আঙ্গুল দিয়ে বলছে না আমি অন্য কেউ: তাসনুভা আনান

শুধু স্কুল নয়, পরিবারও ছাড়তে হয়েছে তাকে৷ মাত্র আট-নয় বছর বয়সেই চলে আসেন ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটিতে৷ উত্তরায় এক গুরু মায়ের কাছেই বড় হয়েছেন তিনি৷ ‘‘আমাদের সামাজিকভাবে স্বাভাবিক চোখে কেউ দেখে না৷ আমাদের মতো মানুষ এই পর্যায়ে আসতে পারে সেটিই কেউ ভাবতে পারে না৷’’ অবশ্য নুসরাত তার কমিউনিটির সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞ৷ তাদের সমর্থনই এতদূর আসার পেছনে তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে৷

যেভাবে গণমাধ্যমে

টেলিভিশনের পর্দায় একই সময়ে অভিষেক হবে দুজনের, যদিও তাদের চলার পথটি ছিল একেবারেই ভিন্ন৷ তবে মিল এক জায়গায়৷ দুজনই বলছেন, তাদের কারো জন্যই এতদূর আসা হঠাৎ পাওয়া কোনো সুযোগ নয়৷

টেলিভিশনে সংবাদ পাঠিকা হতে চললেও শিশির চেয়েছিল নাটকে অভিনয় করতে৷ বৈশাখী টেলিভিশনে গিয়েছিলেন অডিশন দিতে৷

‘‘চয়নিকা দি (চয়নিকা চৌধুরী) একটি নাটকে কাজ করার জন্য কথা বলছিলেন৷ সেখান থেকে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল, তখন ওনাদের নিউজে অডিশন দিতে বললেন৷ আমার উচ্চারণ ভালো দেখে বললেন নিউজে কাজ করতে চাই কিনা৷ আমারও ভালো লাগা ছিল, আগ্রহের জায়গা ছিল৷ সেখান থেকে অডিশন দিয়ে পুরো যোগ্যতা প্রমাণ করেই আমাকে আসতে হয়েছে, দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে৷ যেহেতু আগের কোনো কোর্স করা নেই সেহেতু টেকনিক্যাল জায়গাগুলো বুঝতে হয়েছে৷’’

তবে এই বোঝাপড়ার জায়গায় সহকর্মীদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছেন সেটি তার জন্যে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা৷ ‘‘এটা আমার আরেকটা পরিবার, এখানে কেউ হয়রানি করে না৷ এখানে কেউ আমাকে আঙুল দিয়ে বলছে না আমি অন্য কেউ,’’ বলেন শিশির৷

গণমাধ্যমেই কাজ চালিয়ে যাবেন কিনা কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী- এমন প্রশ্নে জানালেন, খুব বেশিদূর তাকাতে চান না তিনি৷ ‘‘আপাতত পড়োশোনা করছি, পোড়াশোনাটাই করতে চাই৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে ঐ পরিমান ভাবতে পারিনি এখনও৷ পড়াশোনা শেষ করে হয়ত বুঝতে পারবো কী করা উচিত,’’ বলেন তিনি৷

আমাদের মতো মানুষ এই পর্যায়ে আসতে পারে কেউ ভাবতে পারে না: নুসরাত মৌ

নুসরাত মৌ অবশ্য গণমাধ্যমেই কাজ চালিয়ে যেতে চান৷ কেননা, শৈশব থেকে এমন স্বপ্নই দেখেছেন তিনি৷ শখ ছিল অভিনয়ের৷ সেই সুযোগ আসে আ ক ম নাসিরুল্লাহ নামে একজনের মাধ্যমে৷ তিনিই তাকে নিয়ে আসেন মঞ্চ নাটকে৷ ‘‘উনি আমাকে মেয়ের মতো দেখেন, ভালোবাসেন৷ উনি আমাকে মঞ্চ নাটকে নেন৷ সেখান থেকে আমার অভিনয় দেখে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়৷ তার মাধ্যমে মনির হোসেন জীবন ভাইয়েরসঙ্গে পরিচয় হয়৷ এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরে আসলে এই কাজের সুযোগ পাওয়া,’’ বলেন মৌ৷

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য

ভবিষ্যৎ যেখানেই নিয়ে যাক না কেন দুইজনই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কাজ করতে চান৷ নুসরাতের ভাবনা নতুন প্রজন্মকে ঘিরে৷ ট্রান্সজেন্ডার হলেও তার মতো যেন কাউকে পড়াশোনা ছাড়তে না হয়৷ সবাই সমান ভাবে যাতে স্কুল কলেজে পড়ার অধিকার পায়৷ তার ভাবনা, ‘‘ভবিষ্যতেও তো হিজড়াদের জন্ম হবে৷ তারা কীভাবে বড় হবে? আমি চাই সরকার, সমাজ এমন কিছু একটা করুক যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবারের সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করে বড় হতে পারে৷ আমাদের কমিউনিটিতে যেন তাদের আসতে না হয়৷’’

শিশিরের স্বপ্ন তৃতীয় লিঙ্গের কমিউনিটির সদস্যদের ভাগ্য পরিবর্তন করা৷ তাদের জন্য একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা৷ ‘‘তাদের দক্ষতা উন্নয়নে এবং প্রতিটি মানুষকে সাপোর্ট দেওয়া দরকার৷ আমি শুরু থেকেই তাদের জন্য কাজ করেছি, সেটা সামনেও করবো৷ যে যেই সেক্টরে কাজ করতে চায় তাদের সহযোগিতা করবো,’’ এমনটাই শিশিরের সংকল্প৷

বৈশাখী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডারদের ধারাবাহিক ও স্থায়ী উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে সবার মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি৷ সে-কারণেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে নারী দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে তারা সংবাদে ও নাটকে দুইজন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে যুক্ত করছেন৷

এদিন চ্যানেলটির ধারাবাহিক নাটক ‘চাপাবাজ’-এর একটি পর্বে দেখা যাবে নুসরাত মৌকে, যা প্রচারিত হবে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে৷ অন্যদিকে শিশিরকে দেখা যাবে বৈশাখীর নিয়মিত সংবাদের উপস্থাপনায়৷

হিজড়াদের মাদ্রাসা আরও বিস্তৃত হচ্ছে

  • ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া, নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, বাংলাদেশ, প্রথম, তাসনুভা আনান শিশির, নুসরাত মৌ, বৈশাখী টেলিভিশন

Leave a Reply