(৫টি রচনা) বই পড়ার আনন্দ রচনা

বই পড়ার আনন্দ রচনা

মুক্তিযুদ্ধের কষ্টগাথা নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলো’ প্রবন্ধ পড়ে চোখ ছলছল করছিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নওশিন জাহানের। প্রবন্ধটি নবম শ্রেণিতে পাঠ্য। বাংলা বইয়ের ১১৩ থেকে ১১৭ পৃষ্ঠার লেখাটি নওশিন পড়েছে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বই পড়া উৎসবে এসে।
নওশিন জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে দুবার পড়েছে। প্রথমবার পড়ার পর মনে হয়েছে আবার পড়া উচিত। দ্বিতীয়বার পড়া শেষ করার আগে কখন কীভাবে চোখের কোণে পানি জমেছে, বুঝে উঠতে পারেনি। উৎসব একদিকে চোখ থেকে পানি ঝরিয়েছে, আবার সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো ঘটনাও এটি বলে মন্তব্য নওশিনের। পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বই পড়ার উৎসবটি হয় পৌর শহরের নাজিম উদ্দিন ভূইয়া মাঠে।

এই খোলা মাঠ গতকাল শনিবার শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার হয়। বছরের যেকোনো একটি দিনকে বই পড়া উৎসব ঘোষণার দাবিতে ব্যতিক্রমী এই উৎসবের আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন।
বেলা ১১টার দিকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদ। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ্বাসের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ নেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছারওয়ার আলম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাস্কর দেবনাথ ও মেয়র আনোয়ার আশরাফ।
বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে বই পড়া শুরু হয়ে শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। সকাল ১০টার আগে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়। পৌর শহরের সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। মাঠে রাখা ১ হাজার ৫০০ বেঞ্চে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কয়েক শ শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে বই পড়া কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
একসঙ্গে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বই পড়ার ভাবনাটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাস্কর দেবনাথের। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা বইপড়া থেকে সরে যাচ্ছে। অথচ গুণনির্ভর জাতি গঠনে জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, বছরের একটি দিনকে বই পড়া উৎসব ঘোষণার দাবির ভাবনা থেকে আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়।
বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, একসঙ্গে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর বই পড়ার ঘটনা বিরল। বই পড়া উৎসব দাবির বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

Read more: (৫টি রচনা) আমার চারপাশের প্রকৃতি রচনা

বই পড়ার আনন্দ রচনা ২

সৃষ্টির সেই উষালগ্ন থেকেই মানুষ নিজেকে ব্যক্ত ও ব্যাপ্ত করতে চেয়েছে; চেয়েছে তার মহৎ ও বিচিত্র সৃষ্টিশীল উপলব্ধিকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে। সীমিত জীবনের মধ্যে অনন্ত জীবনের স্বরূপ অনুভবের আকাক্ষা মানুষের সহজাত প্রবণতা। সেই অনুভবের অন্তর্গত সাড়া নিয়ে যুগে যুগে শিল্পীরা রূপে, রঙে, ভাষায়, ছন্দে, ইঙ্গিতে, চিত্রে, সংগীতে, চিত্রকল্পে, উপমা, অলংকরণে মূর্ত করে তােলেন তাদের বিচিত্র সৃষ্টি। পুস্তক হলাে এসব সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু । কেননা, বইয়ের অভ্যন্তরে আছে আলােয় ভরা কালাে বর্ণের আনন্দলােক। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি নিজের বুকে নিয়ে অনাগত পাঠকের জন্য চির অপেক্ষমাণ হয়ে আছে বই। বইয়ের পাতায় জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শােনা যায়। মানুষ তার আত্মার আত্মীয়ের তথা বিশ্বমানবের সাহচর্য ও সঙ্গ লাভ করে গ্রন্থের মাধ্যমে। অনাদিকাল থেকেই গ্রন্থ পাঠে মানুষ অনাবিল শান্তি লাভ করে আসছে। প্রাজ্ঞ মনীষী ও সাহিত্য স্রষ্টাগণ যুগে যুগে পাঠকের হাতে সৃষ্টির অমৃত পাত্র তুলে দেন । পাঠক নির্বিকল্প রসানন্দে আবিষ্ট হন। আর সমুদয় পাঠকের রসাস্বাদনেই পুস্তক প্রণেতার সম্পূর্ণ সার্থকতা।

পুস্তক পাঠের উপকারিতা : বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেছেন- ‘Three things are essential for life and these are books books and books। বই জ্ঞানের ভান্ডার, বােধের আধার, আনন্দের আনন্দলােক, মানবিক শুদ্ধতার শান্তিনিকেতন । পুস্তক পাঠে মানুষের মনে জাগে আনন্দ-বেদনার দার্শনিক সত্যবােধ। পুস্তক পাঠের প্রভাবেই মানবজীবন সুন্দর ও মহৎ হয়ে ওঠে। মানুষের মনে। এনে দেয় নম্রভাব, সহানুভূতি, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতির ভাব । যুগে যুগে গ্রন্থ দিয়েছে ত্যাগের দীক্ষা, করতে শিখিয়েছে সত্য ও সুন্দরের সাধনা। প্রকৃতপক্ষে মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে সহজ পন্থাই হলাে পুস্তক পাঠ। পুস্তক পাঠ মানুষের দৃষ্টিকে উদার করে, মনকে করে উন্নত। দুঃখ-কষ্ট, শােক-তাপ, হতাশা, অবসাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে পুস্তক পাঠেই মানুষ স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করতে পারে । তাই অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন- ‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ-কষ্টের বােঝা তার অনেকখানি কমে যায় ।

পুস্তক পাঠের আনন্দ : মানুষের আনন্দ লাভের বিচিত্র পথ রয়েছে। তার মধ্যে গ্রন্থ পাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ হিসেবে বিবেচিত। ভিনসেন্ট স্টারেন্ট বলেছেন- “When we buy a book we buy pleasure.’ পুস্তক পাঠ মানুষের কর্মক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা ও হানাহানির মধ্যে ক্লিষ্ট-পীড়িত চিত্তের ক্লান্তি দূর করে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি । গ্রন্থ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু । জীবনের নানাবিধ। অভিঘাত আমাদের যখন উন্মত্ত করে তােলে তখন আমরা সান্ত্বনা, সহানুভূতি ও আনন্দের জন্য ছুটে চলি গ্রন্থাগারের দিকে। পুস্তকের পেয়ালা হতে তৃষ্ণার্ত চোখে পান করি আনন্দলােকের অমৃত; শান্ত-শীতল করি অশান্ত-উত্তপ্ত অন্তর । নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায়, তখন সেই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে, হতাশা থেকে মুক্তি দিতে পারে। একটি ভালাে বই। মানুষের উচ্চতর বৃত্তিগুলাে চায় সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলাে। আর বই সত্য ও জ্ঞানের সন্ধান দিতে, আনন্দলােক সৃষ্টি করতে সর্বাধিক সাহায্য করে থাকে। বই সত্য ও আলাের পথ দেখিয়ে ব্যক্তিকে বিশুদ্ধ করে গড়ে তােলে। পুস্তক পাঠের আনন্দ প্রসঙ্গে মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন- ‘সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হলাে মনের ভেতর আপন ভুবন। সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার। ততই বেশি হয়।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় বই : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম-অগ্রগতির পথে । আমাদের বৃহত্তর জীবনের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড়াে সঙ্গী এবং শক্তিশালী সম্পদ হলাে বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই । এসব বই পড়েই আমরা তাদের মহৎ চিন্তাচেতনা ও বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি ।

বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগের উত্তম উপায় বই : সমগ্র বিশ্বকে জানতে হলে গ্রন্থ পাঠের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বাকায়। এই পাঠের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি । মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিশ্বের অজস্র গ্রন্থ। গ্রন্থপাঠ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তােলে। অতীতের ঐতিহ্য নানা সৎ-অসৎ চিন্তার অনুশীলন ও বিচিত্র ভাবধারা নিহিত রয়েছে গ্রন্থরাজিতে । তাই বিচিত্র জাতি, দেশ ও সমাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য গ্রন্থের সাহায্য ছাড়া গত্যন্তর নেই ।

See also  (৫টি রচনা) বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার রচনা

মনের স্বাস্থ্যবিকাশে পুস্তক পাঠ : দেহ আর মন নিয়েই মানুষ । দেহের পুষ্টির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়ােজন, তেমিন মনের স্বাস্থ্যের জন্য মানসিক খাদ্য অপরিহার্য। মনের খাদ্য আহরণ করতে হয় রূপ-রসের আনন্দ-বাজার থেকে । মনের ঐশ্বর্যের গুণেই মানুষ মহৎ হয়, হয় মৃত্যুঞ্জয়ী। পুস্তক হলাে সেই আনন্দ-ঐশ্বর্যের খনি । মনের খাদ্য তাই প্রত্যক্ষ নয়, তা অনুভবের বিষয়, উপলাকার ব্যাপার । সেই ভাব-উপলব্ধির সৌন্দর্য সমগ্র জীবনেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। মহৎ বইয়ের প্রভাবে, তাতে অভিব্যক্ত ব্যঞ্জনার অনুরণনে, সত্যের দ্বার। মুক্ত হওয়ায় আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যােগ অনুভব করি । পুস্তক যুগে যুগে মানুষকে দিয়েছে মহৎ ও উন্নত জাবনের দক্ষিা । পুস্তক পাঠে মানুষের মানসিক রুচির পরিবর্তন ঘটে এবং তা নিম থেকে ঊর্ধপানে ধারিত হয়। মানুষ তার ভেতরের সাড়া শুনতে পায় এবং নিজেকে চিনতে শেখে, বুঝতে শেখে অবাধের অবগুণ্ঠনে ঢাকা জীবনের সার-সত্যকে। পুস্তক মানবজীবনের মহিমাকে করেছে গৌরবদীপ্ত । অধর্ম-অন্যায়কে আশ্রয় করলে পরাজয় যে তার অনিবার্য, শক্তির দম্ভস্ফীত মানুষও যে নেপথ্য নিয়তির নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অমিত আকাঙ্ক্ষার অসংযমে, হিংসার পরিণামে, দ্বিধা-দ্বন্দের দোলাচল মনােভাবে জীবন যেখানে সর্বনাশ কবলিত, সেখানে ভােগ নয় ত্যাগ, মােহ নয় কল্যাণ- এই চিরন্তন সত্যই পুস্তকে নিত্য উদ্ভাসিত। পুস্তক পাঠ আমাদের মনের সংকীণতা দূর করে; উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বভ্রাতৃত্ববােধে । তাই মনের স্বাস্থ্য বিকাশে এবং রুচির উন্নতি সাধনে পুস্তক পাঠের গুরুত্ব অনির্বচনীয়।

পাঠকচিত্তে গ্রন্থপাঠের প্রভাব : মহাকবি গেটে পুস্তক পাঠের মাধ্যমেই আনন্দ খুঁজে পেতেন । পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম নিভৃতে বৃক্ষতলে স্বর্গ রচনার জন্য উপকরণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে একখানি কাব্যেরও স্থান ছিল। তিনি বলেছেন- ‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালাে চোখ ঘােলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়। আবার কোনাে একজন মনীষী বলেছেন, সাহিত্য অমৃতায়মান শক্তির উৎস । শক্তির কল্পফলের রস। তাই এ চির আধি-ব্যাধি বিজড়িত, কর্ম তাপতপ্ত নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন সংসারে যে জাতি জ্ঞানামৃত পান করে, সে জাতি মরণ তন্দ্রার মধ্যেও বেঁচে ওঠে, অবসাদের মধ্যেও আনন্দ পায় । আনাতােল ফ্রাস্ পুস্তক পাঠের আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলেছেন, নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একটা একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে। বস্তুত মাতৃদুগ্ধের অমৃতধারা মাতৃভাষার মধ্যে সঞ্চারিত আছে। তাই মাতৃভাষার সাহিত্যে যে ভাব প্রবাহ ছােটে তা জাতির প্রাণের মধ্যে স্পন্দন জাগায় । সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা বলে। প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছােটায় । তাই বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গাের্কি বলেছেন, আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছেই ঋণী।’ সত্যি বলতে, বই ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অপূর্ণ ।

Read more: (৫টি রচনা) ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা

উপসংহার : পুস্তক পাঠে মানুষ আনন্দ লাভ করে থাকে সত্য, তবে আনন্দ উপলব্ধির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। আর তার জন্য অধ্যবসায়ী হওয়া বাঞ্ছনীয় । উৎকৃষ্ট গ্রন্থই মানুষকে প্রকৃত সুখ ও আনন্দ দান করতে পারে । মহৎ বই পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব ও সার্থক ব্যক্তিত্ব বিকাশে জোরালাে ভূমিকা পালন করে। একমাত্র সাহিত্যই দেশে দেশে, কালে কালে, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে। সাহিত্য মানুষের মনের রুদ্ধ দ্বার খুলে মানুষকে কল্যাশ্বতে অনুপ্রাণিত করে তােলে । মােটকথা, পুস্তক পাঠে মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটে । যে জাগরণ গােপনে গােপনে, অলক্ষ্যে বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে; ক্ষণকাল থেকে চিরকালের দিকে। তাই ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামিসহ সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে সকলেরই বেশি বেশি বই পড়া উচিত।

বই পড়ার আনন্দ রচনা ৩

ভূমিকা:

বই মানুষের চিরন্তন বিশ্বস্ত সঙ্গী। জন্মগতভাবেই মানুষ অন্যের সাহচর্য প্রত্যাশা করে। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগ
থেকেই মানুষ পারস্পরিক সহযােগিতায় জীবনের অর্থ খুঁজেছে। মানুষের পাশাপাশি একসময় এ সাহচর্যের অংশীদার হয়েছে বই । মানবজীবন প্রবাহের যাবতীয় ভাব-অনুভূতি জানার প্রবল আগ্রহ মানুষকে বইমুখী করেছে। কেননা যুগ যুগ ধরে মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার অনুভূতি বুকে ধারণ করে অনাগত কালের মানুষের জন্যে চির অপেক্ষমাণ হয়ে আছে বই । অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতের যােগসূত্র রচনা করে বই । তাই বই পড়ে মানবমন লাভ করে অনাবিল প্রশান্তি।

বইয়ের বিকাশ:

বই মূলত জ্ঞানীর জ্ঞানসাধনার ফসল । জ্ঞানসাধক তার অভিজ্ঞতালব্ধ ভাব-অনুভূতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে
জানানাের তাগিদ থেকে বই লেখেন। সভ্যতার বিকাশের একপর্যায়ে মানুষ তার চিন্তাভাবনা, হৃদয়ানুভূতি, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ভবিষ্যতের মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্যে গ্রন্থ রচনার আশ্রয় নিল । ক্ৰমে ছাপাখানার আবিষ্কার বইয়ের প্রচারকে বিস্তৃত করল । ফলে ঘরে বসেই মানুষ যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা শুরু করল। শুধু অতীতের ঘটনাবলি নয়, বর্তমানের বিশ্বব্যাপী জ্ঞান আহরণের দ্বার উন্মুক্ত হলাে। এ যেন ক্ষুদ্র আসনে বসে বিশ্বমানবের সাহচর্য লাভ করা। জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শােনা যায় বইয়ের পাতায়। যে মহাসমুদ্র যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞান বিতরণের মহান ব্রত নিয়ে সদা প্রবহমান ।

বই পড়ার প্রয়ােজনীয়তা:

বই বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডার, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সাধনার ফল বিধৃত আছে বইয়ে। নানান কালের মানুষ
তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানােপলদ্ধি অনাগত কালের মানুষের আনন্দ জোগানাের জন্যে লিপিবদ্ধ করে যান বইয়ে। ফলে বর্তমানের মানুষ নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্বল্পায়ু জীবনে মানুষে পক্ষে বিস্তৃত পৃথিবীর বহুবিধ জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বইই পারে তার জ্ঞানভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করতে। এ উপলব্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐকতান ‘ কবিতায় বলেছেন –

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি !
বিশাল বিশ্বের আয়ােজন ;
মন মাের জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এক কোণ
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে–

বিশ্বের মহামূল্য গ্রন্থগুলাে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সাধনার নির্বাক সাক্ষী, এগুলাের মধ্য দিয়েই মানুষ লাভ করেছে তার আপন অন্তরতম সত্তার পরিচয়। বই হলাে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন, তাই যুগে যুগে বই মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছে।

বই মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী:

মানুষের নিঃসঙ্গতা ঘুচানাের অনুপম সঙ্গী বই। মানবজীবন নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। এ সংঘাতময় জীবনে বই পারে সকল ক্লান্তি মুছে দিয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে বই। জীবনের নানাবিধ অভিঘাতে মানুষ যখন অস্থির হয়ে ওঠে তখন গ্রন্থ পাঠেই মেলে সান্ত্বনা। বাইরের যান্ত্রিকতায় আমরা যখন মনের গহীনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি তখন গ্রন্থ পাঠেই পাওয়া যায় পরম বন্ধুর সাক্ষাৎ | বইয়ের সঙ্গের উপযােগিতা সম্বন্ধে চার্লস ল্যাম্ব বলেছেন, ‘বই পড়তে যে ভালােবাসে তার শত্রু কম। বই মানুষের আত্মাকে সৌন্দর্য। দান করে। আর আত্মার সৌন্দর্য মানুষকে দান করে পরিপূর্ণতা । গ্রন্থ পাঠেই খুঁজে পাওয়া যায় সামনে চলার আলাের পথ, আত্মার পরিশুদ্ধি ! তাই বইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু অকল্পনীয়।

বই পড়া এবং আনন্দলাভ:

উৎকৃষ্ট বই মানব হৃদয়ের অনাবিল আনন্দের অফুরন্ত উৎস। কর্মব্যস্ত মানুষ হাজার ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় করে নিয়ে বইয়ের মাধ্যমে পেতে চায় অনাবিল আনন্দ। জাগতিক জীবনের নানাবিধ সংঘাত এবং সমস্যার উর্ধ্বে বই মানুষকে আনন্দ দান করে । জীবন সংগ্রামের যান্ত্রিকতা থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের ভেতর সৃষ্টি করে একান্ত নিজস্ব একটি ভুবন। সে ভুবনে সবচেয়ে বেশি সাহচর্য দান করে গ্রন্থ পাঠ, মানুষকে দেয় নতুন প্রেরণা, উৎসাহ ও মানসিক প্রশান্তি। সত্য, সুন্দর এবং জ্ঞানের আলােয় গ্রন্থ পাঠ মনের বিকাশ ঘটায়। সকল অকল্যাণ, অসত্য, সংকীর্ণতা থেকে মানবমনকে মুক্তি দেয় বই । এজন্যই ভিনসেন্ট স্টারেট বলেছেন, ‘When we buy a book we buy pleasure.’ বইয়ের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির এবং সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবার আনন্দ লাভ করি। হেনরি ভনডিকের মতে, হৃদয়ের স্পর্শ যেখানে আছে, সেটাই গ্রন্থ। আমরা এক যুগে বসে আরেক যুগের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের হৃদয়ানুভূতির সাথে মিলিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করি গ্রন্থ পাঠে, এভাবেই দুঃখ-বেদনার মুহূর্তে, মানসিক অশান্তিতে, হতাশাগ্রস্ত মনে বই নানাভাবে আমাদের আনন্দের সঞ্চার করে।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বই:

বই শুধু ব্যক্তিমনের নিঃসঙ্গতা দূর করে না, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশেও রাখে। অসাধারণ ভূমিকা। গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয়ে চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম অগ্রযাত্রার পথে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে উৎকৃষ্ট বইগুলাের মাধ্যমে। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতা-সংস্কৃতি যে ধারায় বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা অক্ষরের ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে গ্রন্থে, যা পাঠ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুরাতন ও নতুনের তুলনা করে পাবে সৃজনের উন্মাদনা। এ সৃজনশীল অনুপ্রেরণাই সভ্যতা বিকাশের মূল নিয়ামক। যুগে যুগে যে সকল মনীষী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রেখেছেন তাদের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারি গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে । হােমার, দান্তে, ভার্জিল, মাদাম কুরি, জগদীশচন্দ্র বসু, প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা মার্কসকে আজ আমরা পাব, কিন্তু তাদের লেখা বইয়ের মাধ্যমেই আমরা তাদের সান্নিধ্য লাভ করব এবং তাদের কর্মপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে সভ্যতা
সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার মানসিক জোর পাব। সরােজ আচার্যের ভাষায়-

জীবনটা বই দিয়ে ঘেরা নয় ঠিকই, তবে জীবনকে বুঝতে হলে, অভ্যাসের সংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে
বই চাই।’
এভাবেউ সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে বই সভ্যতার বিকাশ ঘটায় যুগের পর যুগ।

ব্যক্তিত্ব বিকাশে বই:

বই মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফলে মনের দিগন্ত হয় উন্মােচিত ও প্রসারিত। কবি শেলীর মতে, ‘যতই আমরা অধ্যয়ন করি, ততই আমাদের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করি।’ যতই মানুষ তার নিজের অজ্ঞতাকে চিহ্নিত করতে পারে ততই তার মন মহৎ সাধনায় ব্যাপ্ত হতে শেখে। উৎকৃষ্ট বই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে শুদ্ধ করে, মানুষ খুঁজে পায় যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার পথের সন্ধান। বই হলাে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন। তাই গ্রন্থ পাঠে আমরা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়ে নিজ ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথ খুঁজে পাই । আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটিয়ে পরিপূর্ণতা অর্জনের অনুপ্রেরণা জোগায় বই । বিদ্যাসাগর, রাজা রামমােহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দস্তয়ভস্কি, মাক্সিম গাের্কি প্রমুখ মনীষীর মহৎ চিন্তাচেতনা, মহৎ কর্মকাণ্ডের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারি গ্রন্থ পাঠে। গ্রন্থ পাঠে মনের জানালা খুলে যায়, উঁকি দেয় মুক্তচিন্তা, গড়ে ওঠে মূল্যবােধ।

বই নির্বাচনে সতর্কতা:

যুগ যুগ ধরে মানুষ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার সবই বিধৃত হয়েছে
বইয়ের পাতায় । ফলে মানুষ প্রয়ােজনীয় দিকনির্দেশনা পেতে পারে বইয়ের সাহায্যে। উৎকৃষ্ট বই মানুষের আত্মার পরিশােধন করে তাকে আনন্দ ও প্রকৃত সুখ দান করে। অন্যদিকে, সাহিত্যিক মানসিকতা নিয়ে নয় বরং ব্যবসায়ী মানসিকতা নিয়ে কিছু বই ছাপা হয়, যা মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। এসব বই মনকে পরিশুদ্ধ না করে বিষাক্ত করে। যা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। তাই গ্রন্থ পাঠের ক্ষেত্রে গ্রন্থ নির্বাচনে দিতে হবে সতর্ক দৃষ্টি। মনের বিকাশে যে বই সহায়ক তাকেই পাঠের জন্যে নির্বাচিত করতে হবে।

উপসংহার:

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেছেন, জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়ােজন, তা হচ্ছে ‘বই, বই এবং বই।
বই মানুষের আনন্দের সঙ্গী । মানুষের মনকে জাগিয়ে তােলে বই। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ যতবার তার অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করে ততবার একটি করে মনের চোখ ফুটে ওঠে। গ্রন্থ পাঠে আনন্দলাভ এবং আনন্দোপলব্ধির জন্যে মানুষকে হতে হবে অধ্যবসায়ী। ভালােবাসতে হবে বইকে। অন্যথায়, গ্রন্থের জগৎ থেকে আনন্দ আহরণে সে হবে ব্যর্থ।

বই পড়ার আনন্দ রচনা, আমার প্রিয় বই রচনা. বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা রচনা. বই পড়া নিয়ে কিছু কথা. সাহিত্য পাঠের আনন্দ ও বেদনা. বই আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু রচনা. গল্প বই পড়া. রচনা কি ধরনের বই পড়তে আমার ভালো লাগে. গল্প পড়ার আনন্দ অনুচ্ছেদ,
আমার পড়া একটি বইয়ের গল্প রচনা class 6, আমার প্রিয় গল্পের বই, আমার প্রিয় বই পথের পাঁচালী, আমার পড়া একটি গল্প, আমার প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান রচনা, প্রিয় লেখক প্রিয় বই, রচনা কি ধরনের বই পড়তে আমার ভালো লাগে, বই আমাদের প্রিয় বন্ধু রচনা,

Leave a Reply