আপনার উৎকর্ষের জন্য কণ্ঠের সুস্থতা সংরক্ষণ করুন অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু

কণ্ঠ মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যমই শুধু নয়, এর উপরে অনেক মানুষের পেশাগত জীবন নির্ভরশীল। এছাড়া কণ্ঠ এবং বাচনভঙ্গি মানুষের ব্যক্তিত্বের অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কণ্ঠের যথাযথ ব্যবহার ব্যক্তির সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। সম্প্রতি আমেরিকায় একটি জরিপে দেখা যায়, যে সব শিক্ষক সারাক্ষণ কথা বলছেন কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে তাদের ১১% কণ্ঠের সমস্যায় ভুগছে। শিক্ষক ছাড়া অন্য পেশার জন্য এটা ৬.২%, তাই যারা মনে করেন শিক্ষকতা কণ্ঠ প্রয়োগের তেমন কোনো পেশা নয়, তাদের এই ধারণা ভুল। আরেকটি জরিপে দেখা যায় ২০% শিক্ষক তাদের চাকরি হারিছেন কণ্ঠের বিভিন্ন সমস্যার জন্য, যেখানে অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে এই হার ৪%। কণ্ঠের সুস্থতা এবং এর বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেই ১৯৯৯ সালের ১৬ এপ্রিল ব্রাজিলে প্রথম বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হয়েছে।

পরবর্তীতে জনসাধারণের মাঝে কণ্ঠ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১৬ এপ্রিল বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘আপনার উৎকর্ষের জন্য কণ্ঠের সুস্থতা সংরক্ষণ করুন’। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী তথা শিক্ষক, গায়ক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ধারাভাষ্যকার, বিক্রয় প্রতিনিধি ও অভিনেতাদের মতো পেশার মানুষ নিজের কণ্ঠের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় তারা তাদের কণ্ঠের সুস্থতার ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সব মানুষের জীবনে কণ্ঠের সুস্থতার গুরুত্ব রয়েছে যে বিষয়ে আমরা সচেতন নই। কণ্ঠনালীর বিভিন্ন রোগ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয় আমাদের কণ্ঠনালীকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে কণ্ঠনালি ও স্বরযন্ত্র তাদের স্বাভাবিক গঠনগত ও গুণগত বৈশিষ্ট্য হারাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিরামহীনভাবে কণ্ঠের ব্যবহার, অতি উচ্চস্বরে কথা বলা, বারবার গলা পরিষ্কার করা, ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত গরম/ঠাণ্ডা পানীয় গ্রহণ করা ইত্যাদি কণ্ঠস্বরের জন্য ক্ষতিকর। কণ্ঠনালী, নাক, গলা ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণে ও স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে কণ্ঠের পরিবর্তন ঘটতে পারে যেমন শ্বাসনালীর সংক্রমণ, নাক ও সাইনাসের সংক্রমণ, এলার্জি, স্বরযন্ত্রের পলিপ, টিউমার ও ক্যান্সার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বরযন্ত্রের জন্মগত রোগ নিয়েও শিশুর জন্ম হতে পারে যার ফলশ্রুতিতে জন্মের পর পরই শিশুর শ্বাসকষ্ট, দুধ পানে সমস্যা এবং কান্নার সময় অস্বাভাবিক আওয়াজ পরিলক্ষিত হতে পারে।

কণ্ঠের যত্নে করণীয় :

১. উচ্চস্বরে কথা বলা পরিহার করতে হবে।
২. দীর্ঘসময় কথা বলার ক্ষেত্রে (যেমন শিক্ষক) কিছুক্ষণ পর পর বিরতি নিতে হবে।
৩. শ্রেণিকক্ষে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪. অতিরিক্ত চা, কফি ও কোমল পানীয় পান করবেন না।
৫. মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
৬. ধূমপান পরিহার করুন।
৭. অতিরিক্ত খাওয়া দাওয়া এবং খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাতে যাওয়া পরিহার করতে হবে।
৮. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
৯. বায়ু দূষণরোধ করুন এবং দূষিত পরিবেশে মাস্ক ব্যবহার করুন।
১০. অতিরিক্ত গরম/ঠান্ডা পানীয় পান থেকে বিরত থাকুন।
১১. কণ্ঠনালি, নাক, কান ও শ্বাসনালীর বিভিন্ন রোগে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
১২. কণ্ঠের পরিবর্তন তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
নিন।
১৩. শুষ্ক আবহাওয়া আমাদের কণ্ঠনালীর জন্য ক্ষতিকর। শীততাপ যন্ত্র, যে বায়ুতে
জলীয়বাষ্প কম এসব স্থানে থাকলে কণ্ঠের আর্দ্রতা কমে যায়। রাতে আর্দ্রতাকরণ যন্ত্র
ব্যবহারে সমস্যা দূর করা যায়।
১৪. উড়োজাহাজেও বাতাস অনেক শুকনো থাকে। তাই আকাশ ভ্রমণে ক্যাফেইন জাতীয়
খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। কমপক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ৮ আউন্স পানি পান করা উচিত।
১৫. গলায় গারগিল করা যেতে পারে। আধা টেবিল চামচ লবণ, আধা টেবিল চামচ বেকিং সোডা ও ৬ আউন্স গরম পানি সহকারে।
১৬. অনেক সময় গলা শুকনো থাকলে বা ঠাণ্ডায় মিউকাস জমলে আমরা জোরে কাশি
দিই এবং গলা পরিষ্কারের চেষ্টা করি, যা খুব ক্ষতিকর। এই মিউকাস বের করার জন্য যা করবেন
বুক ভরে শ্বাস নিন (যতখানি সম্ভব)। শ্বাস ধরে রাখুন। শ্বাস ছাড়ার সময় আস্তে শব্দ করুন।
আপনি কি ভাবতে পারেন, একজন ডাক্তার জটিল কোনো রোগের কথা তার রোগীকে বলছেন অথচ শব্দ ছাড়া! একজন ব্যবসায়ী একটি সমাবেশ পরিচালনা করছেন কিন্তু কথা ছাড়া! একজন শিক্ষক পাঠদান করছেন কোনো শিক্ষার্থীদের কলকাকলী ছাড়া! একজন গায়ক গান গাচ্ছেন আওয়াজ ছাড়া! কণ্ঠহীন পৃথিবী নৈঃশব্দের পৃথিবী। তাই আসুন, আপনার উৎকর্ষের জন্য কণ্ঠের সুস্থতা সংরক্ষণ করুন।
লেখক : নাক, কান ও গলারোগ বিশেষজ্ঞ।
Source of : Bangladesh Protidin

Leave a Reply