ছবির বইয়ে আলতামিরা গুহার বিখ্যাত বাইসনের চিত্র দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল সাত্যকির ছোট্ দাদুর। তখন তিনি কিশোর। নিজের সামান্য জমানো টাকা এবং ঠাকুরমার দেওয়া কিছু গিনি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ছুটতে শুরু করেছিলেনসেই ছোট্ দাদু। তারপর আর বাংলার দিকে ফিরেও তাকাননি। সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছেন। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য করেছেন স্ট্রাগল। সুসভ্য পাঁচতারা হোটেল থেকে তথাকথিত অসভ্য আদিবাসীদের সঙ্গেও দিন কাটিয়েছেন। মোট কথা কূপমণ্ডুক হয়ে খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ারের ছোট্টো পৃথিবীতে আটকে থাকতে নারাজ ছিলেন তিনি। তিনি মানে মনমোহন মিত্র ওরফে সাত্যকির ছোট্ দাদু ওরফে উৎপল দত্ত। নিজের শেষ ছবি আগন্তুকের প্রধান চরিত্রে মনমোহন মিত্র চরিত্রটির এরকমই বিবরণ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের।
আলতামিরার গুহা দেখে কতজন ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোনোর স্বপ্ন বাস্তবে কতজন দেখেছেন তা জানা নেই, তবে মনমোহন মিত্রের চরিত্রটি যে কম বেশি অনেক বাঙালির মধ্যেই রয়েছে তা বাঙালি মাত্রেই জানে। শুধু বাঙালি কেন বিশ্বের অনেক জাতির মধ্যেই এই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে দুনিয়া দেখার প্রবণতা রয়েছে ব্যাপক হারে। না হলে কেউ চাকরি বাকরি ছেড়ে শুধু ঘোরার নেশায় স্বপরিবারে ঘরছাড়া হন?
ফ্যামিলি মুন
কথা হচ্ছে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা রস এবং সারা ব্যারেটকে নিয়ে। লিভ ইন সম্পর্কে থাকার পর ২০১৯ সাল নাগাদ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ছেলে রিলির বয়স যখন মাত্র দুই। আর ছেলেকে নিয়েই হানিমুনে যাওয়ার কথা ভাবেন তাঁরা। ঠিক হানিমুন নয় বরং তাকে ফ্যামিনিমুন বলা যেতে পারে অনায়াসে। কারণ ছেলে রিলি ছাড়াও রস এবং সারার সঙ্গে ছিল তাঁদের কালো রঙের ল্যাব্রেডর মাউই। বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছে ছিল তাঁদের। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াতে গেলে প্রয়োজন অনেক টাকা আর ছুটি। সঙ্গে নির্দিষ্ট বাজেটও।
ছুটির ফাঁদে
বিশ্বভ্রমণ করতে গেলে প্রয়োজন অনেক ছুটির। তাই নিজেদের চাকরি ছেড়ে দেন ব্যারেট দম্পতি। নিজেদের কটেজটি দুবছরের জন্য ভাড়া দেন। তা থেকে মাসে ৮০০ পাউন্ড পাচ্ছিলেন তাঁরা। মোটামুটি সেই টাকাতেই বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। প্লেন, গাড়ি, হোটেল কোনও কিছুর বুকিং করে অর্থ নষ্ট করেননি তাঁরা। ২০১৪ সালে একটি ক্যাম্পার ভ্যান কিনেছিলেন তাঁরা। সেই কালো রঙের ভ্যানটি চড়েই বেড়িয়ে পড়েন ফ্যামিলিমুনে। তাঁদের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড, ইটালি, স্পেন, টার্কি এবং বুলগেরিয়া ঘোরেন তাঁরা।
এই বিশ্ব আমার পাঠশালা
মোটামুটি এই বোহেমিয়ান জীবন দারুণ উপভোগ করেছেন তাঁরা। রস এবং সারার ছেলে রিলির বয়স এখন পাঁচ। বিশ্বভ্রমণের মধ্য দিয়ে সে তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে ফেলেছে। স্কুলের চার দেওয়ালের গণ্ডি নয়। রিলির কাছে এই পৃথিবীটাই একটা পাঠশালা।
আমি যাযাবর
ক্যাম্পারভ্যান চড়ে দুনিয়া ঘোরা মানে অসাধারণ এক অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা। প্রতিদিনই প্রায় ঘুম ভাঙত নতুন নতুন অচেনা জায়গায়। ক্যাম্পারভ্যানের দরজা খুলে মাটিতে পা রাখলেই নতুন স্থান। জামা কাপড়, বিছানা বালিস, থালা বাটি সব ভ্যানেই থাকত। ভোজনং যত্র তত্র আর শয়নং ক্যাম্পারভ্যানের ভিতর। কিংবা কখনও খোলা আকাশের নীচে। রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া কিংবা স্নান ক্যাম্পারভ্যানের বাইরেই সারতে হত। চিন্তা ভাবনা সবকিছু ইংল্যান্ডেই ফেলে এসেছিলেন ব্যারট দম্পতি। আর মা বাবার সঙ্গে সঙ্গে যে কোনও পরিস্থিতিতে সাবলীল হয়ে উঠেছিল ছোট্টো রিলিও।
হলিউডি স্টাইল
রস এবং সারার এই অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণকে অনেকেই হলিউডের সুপারহিট ফিল্ম সিরিজ ইন্দিয়ানা জোনস্-এর সঙ্গে তুলনা কতরছেন। অথচ চাকরি, বাড়ি, সুখের জীবন ছেড়ে জীবনের একরকম ঝুঁকি নিয়েই বিশ্বভ্রমণের সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছিলেন তখন অনেকেই তার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু হলিউডি স্টাইলের এই পর্যটন বাস্তব রূপ পাওয়ায় সবাই দারুণ খুশি।
তবে মহামারির সময় এভাবে ঘুরতে খানিকটা অসুবিধা হয়েছিল বটে। যদিও সারার মতে মহামারিতে বাড়িতে গুমোট হয়ে বসে থাকার চেয়ে এভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ ছিল আলাদা। ভূমধ্যসাগরের তীরে বসে রান্না করা, সানবাথ নেওয়া বা সমুদ্রভ্রমণ করার আনন্দ তো ঘরে বসে পাওয়া যাবে না।
ইটালিতে লক ডাউন শুরু হওয়ার খবর পেতে না পেতেই তাঁরা ক্যাম্পারভ্যান চালিয়ে পারি দেন বুলগেরিয়াতে। সেখান থেকে সাইবেরিয়া, ক্রোশিয়া, স্লোভানিয়া হয়ে ফের ইটালিতে ফেরেন। সেখান থেকে যান ফ্রান্সে। বিবাহবার্ষিকী পালন করেন লেক অ্যানেসি-তে।
বাড়ি ফেরা
চলতি বছরের জুন মাসে ইংল্যান্ডে নিজেদের বাড়ি ফেরেন রস এবং সারা। সেপ্টেম্বরে ফের বেরাতে বেরোনোর কথা তাঁদের। পুরোনো গতে ধরা জীবনে আর ফিরতে চান না তাঁরা। ছেলেকে নিজেরাই পড়াশোনা করাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো এভাবেই চলবে।
এর আগেও হয়েছে
চাকরি ছেড়ে বিশ্বভ্রমণের সিদ্ধান্ত কিন্তু রস এবং সারাই প্রথম নেননি। এর আগে এক ভারতীয় দম্পতিও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেটা বেশ কয়েক বছর আগে। মুম্বইয়ের দম্পতি সন্দীপা এবং চেতন নিজেদের চাকরি ছেড়ে, বসত বাড়ি বিক্রি করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন ২০১৩ সাল নাগাদ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের ১১টি রাজ্য এবং ৮টি দেশ ঘুরেছিলেন তাঁরা।
বলা যায় না, হয়তো ভারতের সন্দীপা এবং চেতনের বিশ্ব নাগরিক হওয়ার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ঘর ছেড়েছিলেন ইংল্যান্ডের রস এবং সারা ব্যারট। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।