Biography Of Chanakya In Bangla.প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ চাণক্য এর জীবনী | Biography Of Chanakya In Bangla.

ইতিহাসে যে কজন প্রাচীন পণ্ডিত অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন চাণক্য। এই উপমহাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বে তাকে অন্যতম প্রাচীন এবং বাস্তববাদী মহাপণ্ডিত মনে করা হয়। মহাকবি কালিদাস যুগেরও অনেক আগে আবির্ভূত এই পণ্ডিত তার সময়ে থেকেই ভবিষ্যৎ দেখতে পেরেছিলেন। লিখে গেছেন অমর সব তত্ত্বগাথা।

যিনি চাণক্য তিনিই কৌটিল্য

চাণক্য [খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ থেকে ২৮৩ অব্দ] ছিলেন প্রাচীন ভারতের পণ্ডিত, দার্শনিক ও রাজ উপদেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ছিলেন। মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজক্ষমতা অর্জন ও মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষটির জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়, যেখানে উপমহাদেশে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপীঠ অবস্থিত ছিল। রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তব চর্চা ও রাষ্ট্রীয় কৌশলের প্রয়োগপদ্ধতির নির্দেশনা দানে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে তার অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। মহাজ্ঞানী চাণক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল বিষ্ণুগুপ্ত। এ ছাড়া তার বিখ্যাত ছদ্মনাম ‘কৌটিল্য’।

আবার কারও কাছে তার নামই বিষ্ণুগুপ্ত। কৌটিল্য নামেই তিনি সংস্কৃত ভাষার অমরগ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ লিখে গেছেন। রাষ্ট্রশাসন ও কূটনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা শাস্ত্র মানা হয়। যেহেতু তিনি ‘কুটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভূত ছিলেন তাই সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। অন্যদিকে তার সবচেয়ে পরিচিত ও প্রিয় নাম ‘চাণক্য’ এর উদ্ভব ‘চানকা’ থেকে। চানকা হচ্ছে তার গ্রামের নাম। এই গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মতান্তরে তার পিতার নাম ‘চানক’ থেকে ‘চাণক্য পণ্ডিত’ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত হয়ে ওঠেন চাণক্য। তাকে বিষ্ণুগুপ্ত নামেও ডাকা হয়।

চূড়ান্ত পাণ্ডিত্য

চাণক্য কী পরিমাণ জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন তার শাস্ত্র পড়লেই সে সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, লেখক, দার্শনিক, শাসক এবং কূটনীতিবিদ ছিলেন। তার সমাজ ও জীবন সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো আজকের আধুনিক জীবনেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা। তার ‘অর্থশাস্ত্র’ (Arthashastra) গ্রন্থে তিনি চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন একটি রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে ওঠে এবং পরিণতি লাভ করে। তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে একজন শাসককে নিজস্ব ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে আরও ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হয়। একইভাবে সম্পদ ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নত করার জন্য কী কী কাজ করা যেতে পারে, সেসব বিষয়ও পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করেন চাণক্য। তার অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি নামে অর্থশাস্ত্র হলেও এটি মূলত শাসকের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতিবিষয়ক কৌশলের পরামর্শ। আর তৎকালীন সময়ের রাজা-মহারাজারা তাদের রাজদরবারে এরকম একজন দুজন পণ্ডিতকে সব সময়ই প্রাধান্য দিতেন।

কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রে এসব পণ্ডিতের দারুণ ভূমিকা ছিল। সেই অর্থে বলা যেতেই পারে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পরবর্তীকালের রাজাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনকল্যাণমূলক রাজ্য গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিতে সমর্থ হয়েছিল। এর প্রমাণ পরবর্তী সময়ের প্রজাবৎসল শাসকদের রাজ্যশাসন ও রাজ্য পরিচালনা নীতি। স্পষ্টতই তাদের সেই সময়ের শাসনে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বড় একটি ছাপ পড়েছে। চাণক্য-সহায়তায় মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ২৪ বছর শাসনকাল যেমন বর্ণিল ছিল, তেমনি দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারার সমৃদ্ধিময় জনপ্রিয়তার পেছনেও ছিল চাণক্যের অবদান।

আরও পড়ুন:গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল কোথায় অবস্থিত গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ডাক্তারদের তালিকা লিস্ট

চাণক্যের ভালো থাকার ৪ সূত্র

সার্বিক প্রয়োজনে অনেক বিষয় নিয়েই লিখেছেন চাণক্য। কিন্তু মানুষ মাত্রই ভালো থাকতে চায়। ভালো থাকার জন্য চাণক্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন।

১) টাকা-পয়সার নিদারুণ সংকট থাকলে কাউকে কখনো বলতে নেই। কারণ এ সময় কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না, আবার কপট সাহায্যের আশ্বাস দেয়। কারণ তার মতে দরিদ্ররা সমাজে তেমন মর্যাদা পায় না। তাই তাদের নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রাখা উচিত।

২) মহামতি চাণক্যর মতে ব্যক্তিগত সমস্যা কখনো কাউকে বলতে নেই। যারা বলে তারা অন্যের কাছে নীচু ও বিরক্তিকর হিসেবে গৃহীত হয়, আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে নেই। এসব বললে মানুষ মনে করে কিছু একটা অভিপ্রায় নিয়ে তা বলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর ফল নিয়ে আসতে পারে। জ্ঞানী ব্যক্তির মতো মৃত্যু পর্যন্ত তা নিজের কাছে রেখে দেওয়া উচিত।

৩) যদি কখনো নীচপদস্থ ব্যক্তি দ্বারা অপমানের স্বীকার হওয়া যায়, তাহলে তা অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করাটাই ভালো। তাহলে মানুষ বক্তার সামনেই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারে। ফলে তা মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে।

৪) আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ। তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়। পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, ১০ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ১৬ বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে। পুত্রকে যারা পড়ান না, সেই পিতা-মাতা তার শত্রু। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না। তেমনি একটি গুণী পুত্র একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে ভালো।

 

2.

নীতির দর্পণ সারাংশ

চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী হওয়ার পর প্রাসাদের জীবন ছেড়ে কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসী জীবন বেছে নিয়েছিলেন চাণক্য। সেখানে শিষ্যদের নানা বিষয়ে  নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তার অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহীত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। চলুন দেখে নেওয়া যাক চাণক্যের নীতির  দর্পণ সারাংশ।

১) যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন না এবং শুধু অভিযোগ করেন যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।

২) সব উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সে জন্য সবচেয়ে  বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তছরুপ বা অর্থ আত্মসাতের ৪০টি পদ্ধতি আছে। জিহবার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোনো রাজকর্মচারীর পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজকর্মচারীর তহবিল তছরুপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।

৩) বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নীচ কারও থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী এসব গ্রহণ করা সংগত।

৪) মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।

৫) যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনো কিছুই জয় করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তির জন্য কোনো দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোনো শত্রু নেই।

৬) বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সব সময় তাকেই অনুসরণ করে।

৭) মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।

Gender কাকে বলে ? কত প্রকার ও কি কি?

মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা

চাণক্যের উত্থান কিংবদন্তি গল্প হলেও ঐতিহাসিক সত্যতা আছে বলেই মানেন অধিকাংশ ঐতিহাসিক। সে সময় মগধ রাজ্যের পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধনানন্দ। তিনি ন্যায়বিচারক ছিলেন না। তার অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাদের কাছে দারুণ অপ্রিয় ছিলেন। এই ধনানন্দ একবার চাণক্যকে অপমান করেন। ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়লে ধনানন্দের মন্ত্রী শকটা ব্রাহ্মণ খোঁজার দায়িত্ব নেন।

তিনি চাণক্যকে ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধের পুরোহিত হওয়ার অনুরোধ জানান। সে অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা তেমন ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ গেলেন রেগে। অযথাই চাণক্যকে তিরস্কার করে বের হয়ে যেতে বলেন।

চাণক্য প্রথমে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কিছু না শুনে উল্টো অন্যদের দিয়েও চাণক্যকে অপমান করেন। এবার ক্রুদ্ধ হলেন চাণক্য। সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ  নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। অন্যদিকে রাজা ধনানন্দের সত্ভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাত) পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করছিলেন। কারণ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর রাজা ধনানন্দ দাসীমাতা মুরা ও সত্ভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই  ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। তখনই  ঘটনাচক্রে চাণক্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎ যে ইতিহাসের বাঁক বদলে দেবে কে জানত?

চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের প্রতিশোধপরায়ণতা আর সিংহাসনের বাসনাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্তও চাণক্যের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। ফলে চন্দ্রগুপ্ত তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে স্বীকার করেন। এরপর চাণক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে পরিকল্পনাকে আরও বেশি নিখুঁত করে তোলেন চাণক্য। চাণক্যের পাণ্ডিত্য আর চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে শেষ পর্যন্ত সিংহাসনচ্যুত হলেন নন্দরাজা। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা  করেন। এই বংশই পরবর্তীতে ভারতীয় ইতিহাসে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। আর এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক। তিনিও ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।

 

বৈচিত্র্যময় জীবন

চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করার পর পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। এই পাটালিপুত্র বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্ত রাজ্য শাসন করেন। তার সময়কালে রাজ্যজুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্রগুপ্তের দরবারে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। চাণক্য তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পণ্ডিত হিসেবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় একটি অবস্থান ধরে রেখেছেন। টিকে আছেন তার কর্মবহুল জীবনের কর্ম ও সৃষ্টির মাধ্যমে। কর্মজীবনের শুরুতেই  তিনি পাঞ্জাবকে বিদেশি শাসনমুক্ত করতে রাজাকে সাহায্য করেন। এরপর অযোগ্য শাসক নন্দ রাজাকে উত্খাত করে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সঙ্গে আরও রাজ্য যুক্ত করেন এবং সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার ভূমিকা পালন করেন। কেবল চন্দ্রগুপ্তের আমলই নয়, পরবর্তীকালের ভারতীয় সম্রাটদের শাসন কৌশলে দারুণভাবে প্রভাব পড়ে চাণক্য নীতির। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের শাসন। এই সময়টি এতটাই পরিশীলিত ছিল যে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামেও প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের উপস্থিতি রয়ে গেছে।

এমনকি এরও পরে বিক্রমাদিত্যের শাসনকালের কিংবদন্তীয় উপকথাগুলোর জনপ্রিয় লোকভাষ্য থেকেও তা ধারণা করা যায় হয়তো। এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন দার্শনিক ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন। চাণক্যের কথাগুলো আধুনিক যুগের পরিশীলিত কথাবার্তা থেকে ভিন্ন হলেও আজকের দিনেও ঠিক একই তাৎপর্য বহন করে।

এরকম জ্ঞানী একটা মানুষ কিন্তু শারীরিকভাবে খুব একটা সবল ছিলেন না। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তবে সব ছাপিয়ে এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতের সমাজ, সংসার, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কিত নীতি কথাগুলো হাজার বছর পরেও গুরুত্ব হারায়নি।

প্রাসাদ ছেড়ে শ্মশানের জীবন

মগধের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্ত আরোহণের পর যথারীতি চাণক্যের সম্মান-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেল অনেকগুণ। গুরু এবং নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে  জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবনযাপনের অবারিত সুযোগ পেলেন চাণক্য। কিন্তু ওসবে কী আর পণ্ডিতের মন ভরে? কথিত আছে, এমন বিলাসী জীবনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাণক্য শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সঙ্গে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালন করতেন। পাশাপাশি সেখানেই নিজের শিষ্যদের রাজ্য পরিচালনা ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন। চাণক্যের সেই নীতি আর দর্শন হাজার বছর পরও আধুনিক। এর বাইরে অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চাণক্যের খ্যাতি অসাধারণ। সিদ্ধান্তে অটলস্বভাবী চাণক্যের কাছে আবেগের কোনো মূল্য ছিল না। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।

 স্ত্রী নাকি টাকা? জেনে নিন চাণক্য নীতি

স্ত্রী নাকি টাকা? যদি যেকোনো একটি বাছাই করতে বলা হয়; তাহলে আপনি কোনটি বাছাই করবেন? চাণক্য নীতির দর্পণের প্রথম অধ্যায়েই এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। টাকা-পয়সা সঞ্চয়ের পরামর্শ দিয়েছেন চাণক্য। কারণ, বিপদে অর্থই কাজে আসে।

কিন্তু স্ত্রী ও টাকার মধ্যে কাকে বাছাই করবেন? চাণক্য বলেছেন, স্ত্রীকে বাছাই কারই বুদ্ধির পরিচয়। ধর্ম ও সংস্কার স্ত্রীর মধ্যে থাকে। তিনিই পরিবারের রক্ষা করেন। স্ত্রী ছাড়া ধর্ম ও কর্ম অসম্পূর্ণ। স্ত্রী ছাড়া গৃহস্থ আশ্রমও সম্পূর্ণ হয় না।

তবে যখন নিজের আত্মাকে বাঁচানোর প্রশ্ন আসবে তখন স্ত্রী ও টাকার মায়া ছাড়তে হবে। অর্থাত্ মায়া-মোহ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিকতার পথ বেছে নিতে হলে স্ত্রী ও অর্থ ত্যাগ করতে হবে। তখনই আত্ম্যার সঙ্গে সংযোগ ঘটবে পরমাত্মার।

Read More:অবশেষে মুখ খুললেন যশ অন্তঃসত্ত্বা নুসরাতের বিষয়ে

 

চাণক্য শ্লোক

বাস্তববাদী চাণক্যের অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন ইত্যাদি নিয়ে বলা কথাগুলো ‘চাণক্য শ্লোক’ নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ আড়াই বছর পরেও কথাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। কথিত হয় যে, এখনো ভারতের রাজনীতি অনেকাংশে চাণক্যনীতি অনুযায়ী চলমান। চাণক্যের নীতি পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে বহু দেশে। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও তার নীতি এখনো সমানভাবে কার্যকর। সেখান থেকেই কয়েকটি শ্লোক দেখে নেওয়া যাক।

 

♦ দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।

♦ দুষ্ট স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ বিষয়ে সংশয় নেই।

♦ পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।

♦ আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।

♦ অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।

♦ অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।

♦ অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।

♦ অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।

♦ আপদের নিশ্চিত পথ হলো ইন্দ্রিয়গুলোর অসংযম, তাদের জয় করা হলো সম্পদের পথ, যার যেটি ঈঙ্গিত সে সে পথেই যায়।

♦ আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভালো কথা, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।

♦ গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।

♦ অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাঞ্চায় সম্মান নাশ হয়, দারিদ্র্য বুদ্ধিনাশ হয়।

♦ অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্নে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপণ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।

♦ ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।

♦ বিনয়ই সবার ভূষণ।

♦ বষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।

♦ ভাগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।

♦ মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।

♦ ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।

♦ উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।

♦ ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।

♦ একটি মাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুলধন্য হয়।

♦ একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণীপুত্র বরং ভালো। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না।

♦ একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।

♦ একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।

♦ উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।

♦ কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

♦ খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।

♦ গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।

♦ গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।

♦ অহংকারের মতো শত্রু নেই।

♦ তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয় : নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনো সন্তোষ না থাকে।

♦ দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ-সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।

♦ দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।


 

ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।

চানক্য নীতি, Chanakya Niti, chanyaka Neeti, Chanakya Niti Bangla, chanakya neeti, Chanakya, Quotes, বাংলায়, chanakya, Niti, bangla,  jibon somossar somadhanপ্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ চার্ণক্য এর জীবনী, Biography Of Chanakya In Bangla, প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ চার্ণক্য, চার্ণক্য এর জীবনী, দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ চার্ণক্য এর জীবনী, দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ চার্ণক্য, Biography Of Chanakya, Indian teacher, philosopher, economist, jurist and royal advisor, Vishnugupta, indian philosopher, chanakya mini bio, chanakya short life story, চাণক্য এর জীবনী चाणक्य निति:ये 2-काम कर दो लोग आप के तलवे चाटेंगे|Chanakya Niti Best Motivational Video|Psychology, chanakya niti full in hindi, fundoo programming, fundoo boy, psychology in hindi, chanakya niti motivation in hindi, chanakya niti in telugu for students, अपमान का बदला कैसे ले, chanakya niti in hindi for success, chanakya niti in hindi for love, chanakya niti for success in life in hindi, chankya niti motivation in telugu, how to become successful in life in hindi, Chanakya Hindi

প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক  অর্থনীতিবিদ চাণক্য এর জীবনী | Biography Of Chanakya In Bangla.

Leave a Reply