ছোটদের গল্প :
রাজার ভূত জামাই
লেখক : সবুজ চৌধুরী
রাজা গৌরচন্দ্রের রাজসভা। মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন – রাজামশাই, আপনি অভয় দিলে একটা কথা বলতে পারি? রাজা সম্মতি দিলেন। মন্ত্রী বললেন – আমাদের রাজকুমারী তো বড় হয়েছে। তাকে বিয়ে দেয়া দরকার। রাণীমা খুব দুঃখ করেই বললেন মেয়ের দিকে আপনার নাকি কোনো খেয়ালই নেই। রাজা গৌরচন্দ্র খুব চিন্তিত স্বরেই বললেন – ঠিকই বলেছ মন্ত্রী কিন্তু আমার যোগ্য জামাই কোথায় পাই বলো তো? তখন বিদুষক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন – রাজামশাই আপনি যদি প্রাণ খুলে বলেন বিস্তারিয়া কেমন জামাই চান আপনি কহেন খুলিয়া। রাজামশাই বললেন – জামাই হবে বীর, শক্তি ও সাহসে অপরাজেয়, কর্মে দক্ষ আর ধীর, একবারে খাবে একটা গোটা খাসি, হাতের উপর আশি মণ তুলে করবে নাচানাচি। রাজার শর্ত শুনে তো সবার চোখ চড়কগাছ। এ আবার কেমন কথা! মানুষ কখনো আশি মণ হাতের উপর তুলে নাচতে পারে। মন্ত্রী বললেন, রাজামশাই এমন মানুষ তো আমাদের গোটা রাজ্যে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কেমন শর্ত আপনার? রাজা গম্ভীর কন্ঠে বললেন – রাজার কথা আর বেদের বাক্য কখনো নড়চড় হবে না। এমন ছেলে খুঁজে বের কর তার সাথেই আমি আমার কন্যার বিবাহ দিব। আর বর খুঁজে না পেলে তোমাদের সবার গর্দান কেটে নেব। রাজসভার সকলেই তখন ভয়ে ভীত হয়ে গেল। বিদূষক বললেন – তাই হবে রাজামশাই। আমরা আজ থেকে সবাই ‘আশি মণী’ বর খোঁজা শুরু করব। রাজসভা সমাপ্ত হলো।
সমস্ত রাজ্যময় ঢেরা পিটিয়ে ঘোষণা দেয়া হলো রাজকন্যার বিয়ের জন্য রাজামশাই ছেলে খুঁজছেন। তাকে বীর, সাহসী হতে হবে। একবারে একটা গোটা খাসি খেতে হবে। আর আশি মণ ওজন হাতের ওপর তুলতে হবে। হাটে বাজারে, বন্দরে সর্বত্র এ ঘোষণা ছড়িয়ে দেয়া হলো। মাসের পর মাস কেটে যায়। রাজা তার যোগ্য জামাই পায় না। কোনো মানুষের পক্ষে এ শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। সবাই খুব চিন্তিত। সভাসদ গর্দান কাটা যাবার ভয়ে রাজসভায় যায় না।
রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল বিশাল আকৃতির এক বটগাছ। গাছটির বয়স কম করে হলেও হাজার বছর। গাছটির চারপাশে কোনো জনমানব বাস করত না। বছরখানেক আগে সেখানে আস্তানা গেড়েছে একদল ভূত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে চালাক ছিল ভিঙ্গি ভূত। ভিঙ্গি ভূতের ছিল তিন তিনটে বউ আর প্রায় এক ডজন ছেলে পুলে। সংসার চালাতে তার বেশ হিমশিম খেতে হতো। ভিঙ্গি ভূত রাজার এমন ঘোষণা শুনে ভাবল রাজার জামাই হয়ে থাকতে পারলে তো মন্দ হয় না। সে সুন্দর এক রাজপুত্রের বেশ নিল। তারপর চলল রাজ বাড়ির দিকে। রাজসভায় গিয়ে নিজকে রাজার যোগ্য জামাই প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষা দিতে চাইল। সবাই ভাবল একজন তো আসল অন্তত। যদি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায় তবে তারা প্রাণে বেঁচে যাবে। তাই সকলে আগ্রহ ভরে তার সাহসের পরীক্ষা নিতে চাইল। প্রথমে তাকে সাহসের পরীক্ষা দেয়ার জন্য একটা অন্ধকার ঘরে এক রাত বন্দি থাকতে হবে। সে ঘরে থাকবে ক্ষুধার্ত একটি সিংহ। রাজপুত্রকে সে ঘরে প্রবেশ করানো হলো তারপর বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। ভিঙ্গি ভূত ঘরের মধ্যে ঢুকেই মন্ত্র পড়ে অদৃশ্য হয়ে রইল। সিংহ মহারাজ তাকে দেখতেই পেল না। পরের দিন যখন সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে ঘরের দরজা খুলল হাই তুলতে তুলতে রাজপুত্র বের হয়ে আসল। সবাইতো বেশ খুশি। ক্ষুধার্ত সিংহের কবল থেকে বেঁচে ফিরে সে সাহসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। পরের দিন তাকে একটা আস্ত খাসি রান্না করে খেতে দেয়া হলো।
এমন ভালো খাবার অনেকদিন ভিঙ্গি ভূত খায় নি। তাই সে গাপুস গুপুস করে পাঁচ মিনিটেই পুরো খাসিটি হাড়-গোড়সহ খেয়ে ফেলল। সবার চোখ তো ছানাবড়া! এ কী করে সম্ভব? যাইহোক সকলের গর্দান বাঁচবে এই আশায় সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। বাকি রইল পরের পরীক্ষাটি। আশি মণ ওজনের পাথর হাতের ওপর তুলে নাচতে হবে। সবাই আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল। এবার নিশ্চিত রাজপুত্র পাথরের তলায় চাপা পড়ে মারা যাবে। আর সাথে সাথে আমাদেরও গর্দান যাবে। পরের দিন সকলে মহা আগ্রহ নিয়ে ময়দানে হাজির হলো দশটা হাতি দিয়ে টেনে আশি মণ ওজনের একটা বিশাল পাথর আনা হলো। ময়দানে রাজপুত্র প্রবেশ করল। কী হয়, কী হয় – সবাই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। রাজপুত্র পাথরটির কাছে এসে পাথরের গায়ে হাত বুলাল। ভিঙ্গি ভূত জানে কীভাবে ওজন হালকা করা যায়। সে মন্ত্র পড়ে পাথরের ওজন তুলার মতো হালকা করে ফেলল। তারপর এক ঝটকায় পাথরটিকে এক হাতের তালুতে তুলে ধরল। সকলে হাত তালি দিয়ে উঠল। ভিঙ্গি ভূত পাথরটিকে কখনো আঙুলের ঢগায় কখনো নখের ঢগায় তুলে ধরে নৃত্য করতে শুরু করল। রাজামশাই তখন আবেগে দৌড়ে এসে ভিঙি ভূতকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সসম্মানে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। সকলে জয়জয়কার করতে লাগল। পরদিন মহা ধুমধামে রাজকন্যার সাথে ভিঙ্গি ভূতের বিবাহ হলো। বিয়েতে রাজামশাই ভিঙ্গি ভূতকে এ রাজ্যে ভাবি রাজা ঘোষণা করে দিলেন। এমন জামাই পেয়ে রাজা গৌরচন্দ্রের আনন্দ আর দেখে কে।
রাজ্যময় আনন্দের বন্যা বয়ে চলল। বিবাহের রাতে রাজ্যের নিয়ম অনুসারে বর আর কন্যাকে আলাদা আলাদা ঘরে থাকতে হয়। রাজকুমার ভিঙ্গি ভূতের জন্য রাজ্যের অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা হলো। রাতে ভিঙ্গি ভূত অদৃশ্য হয়ে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেল সেই বটগাছে। তারপর তিন স্ত্রী আর ছেলে-পুলেদের নিয়ে এলো রাজপ্রাসাদে। তাদের আনন্দ আর দেখে কে! রাজবাড়িতে এসে তারা তো মহা খুশি। চারদিকে খাবার ছড়িয়ে রয়েছে। ভিঙ্গি সকলকে সাবধান করে দিল কেউ যেন দৃশ্যমান না হয়। খাবার দাবার খাওয়ার সময় সকলে যেন অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র পড়ে খায়। এদিকে রাতের ভোজ সবার জন্য রাজকুমারের ডাক আসল।
ভিঙ্গি ভূত তখন সকলে সাথে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। টেবিলে কত কত সুস্বাদু খাবার! কোনটা রেখে কোনটা খাবে সে বুঝতে পারছিল না। সে যেন ভুলেই গেল যে সে রাজকুমারের বেশ ধরে আছে। গপ্ গপ্ করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই টেবিলে রাখা প্রায় একশ জনের খাবার একাই সাবার করে ফেলল। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইল। সবাই ভাবল এ কেমন জামাই রে বাবা!
পরদিন মহারাজ গৌরচন্দ্র রাজসভায় বসে রয়েছেন এমন সময় রক্ষী এসে খবর দিল – মহারাজ, একটা দঃসংবাদ আছে। আমাদের ঘোড়াশালে একটি ঘোড়াও নেই। গো-শালার গরুগুলোও উধাও হয়ে গেছে।
– বলো কী? এ কী করে সম্ভব? তোমরা কী রাতে নাক ডাকছিলে?
– নাহ্ মহারাজ আমরা সবাই জেগেই ছিলাম। পাহাড়া দিচ্ছিলাম।
– তবে চোর এসে আমার এক সহস্র গরু-ঘোড়া নিল কী করে?
এমন সময় সেনাপতি বেশ হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে। রাজা উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –
– কী হয়েছে, সেনাপতি?
– মহারাজ একটা ভয়ংকর সংবাদ আছে।
– অত ভণিতানা করে বলো কী হয়েছে?
– মহারাজ, আমাদের প্রাসাদের পিছনে কতগুলো গরু-ঘোড়ার হাড়গোড় পড়ে আছে।
– মানে?
মহারাজ বেশ আশ্চর্য হয়ে যায়। এ তো চোর নয়! নিশ্চয়ই অন্য কিছু। কিন্তু কোন সে প্রাণী যে কিনা সহস্র গরু-ঘোড়া একসাথে খেয়ে ফেলেছে। জরুরি রাজসভা ডাকা হলো। সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে করেই হোক এই মাংসখেকো প্রাণীটাকে জব্দ করতেই হবে। এক দল সৈন্যকে নিয়োজিত করা হলো এ কাজে। পরের রাতে রাজবাড়ির সমস্ত পশুগুলোকে একত্র করে পাহারার ব্যবস্থা করা হলো।
গভীর রাতে ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। সৈন্যরা দেখল, ভেড়াগুলো শূণ্যে ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ভেড়াগুলোকে ধরে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা দেখ সবার যেন চোখ কপালে উঠল। কী হচ্ছে এসব? ঘটনাটা বোঝার জন্য কেউ কেউ উড়ন্ত ভেড়াগুলো পিছু নিল। দেখল ভেড়াগুলোর গায়ের কাঁচা মাংস কে যেন শূন্যে বসেই খেয়ে নিচ্ছে। হাড়-গোড়গুলো ফেলে দিচ্ছে রাজ প্রাসাদের পিছনে। ঘটনাটি দেখার জন্য সৈন্যরা রাজামশাইকে ডেকে নিয়ে আসল। রাজা তো দেখ থ হয়ে গেল। রাজ তান্ত্রিককে ডাকা হলো। তান্ত্রিক আগুন জ্বেলে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন। তারপর একটা সুতোর পুটলি আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে আগুন থেকে কতগুলো সুতা বের হয়ে আসল। সুতাগুলো লম্বা হতে থাকল। লম্বা হতে হতে গিয়ে রাজজামাইকে বেঁধে ফেলল। তারপর সুতাগুলো আরো লম্বা হয়ে গিয়ে ভিঙ্গি ভূতের স্ত্রীদের ও ছেলে-পুলেদের বেঁধে ফেলল। তান্ত্রিকের কাছে ধরা পড়ে রাজজামাই তার বেশ ত্যাগ করে আসল ভিঙ্গি ভূতের রূপ নিল। সকলে দেখল এ যে রাজকুমার নয়, এ যে ভয়ংকর ভূত! তান্ত্রিক তখন ভূতগুলোকে আবার তাদের বটগাছে ফেরৎ পাঠালো।