বাজারে সবজি বিক্রি করেন। সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে শুধু খেয়ে-পরে দিন কাটাতে রাজি নন ৬১ বছরের বৃদ্ধা। তার জীবনের দর্শনই হলো, কাজ করো, টাকা জমাও আর দুনিয়া দেখো।
আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬১ বছর বয়সী মলি, থাকেন কেরালার এর্নাকুলামে। পেশা সবজি বিক্রি। তবে শুধু এই পরিচয়ে বন্দি হতে চান না মলি। জীবনে আরও বেশি কিছু চাওয়ার আছে তার। তাই কয়েক মাস পর পরই ‘উধাও’ হয়ে যান তিনি। আবার দোকান খোলেন। ক্রেতাদের কাছে অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বর্ণনা করেন দেশ ভ্রমণের গল্প।
স্থানীয়রা এই ভোরবেলা দেখছেন সবজি বিক্রি করছেন বৃদ্ধা পরের দিন এসে দেখলেন দোকান বন্ধ। মলি তত ক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন না দেখা কোনও জায়গার উদ্দেশে। এ কারণে এখন দোকান বন্ধ থাকলে ক্রেতাদেরও বুঝে কষ্ট হয় না যে বেড়াতে গেছেন বৃদ্ধা।
সবজি বিক্রি করে যা আয় হয় তাতে নিজের ভালোভাবে খেয়ে-পরে চলে যায় মলির। তবে প্রতি দিনের আয় থেকে একটা অংশ জমিয়ে রাখেন তিনি। উদ্দেশ্য, নতুন কোনও দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।
এই ভাবে গত ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গা তো ঘুরেছেনই, ১১টি দেশও ভ্রমণে গেছেন এই সবজি বিক্রেতা।
প্রায় ২৬ বছর আগে সবজির দোকান করেছিলেন মলির স্বামী। ১৮ বছর আগে তিনি মারা যান। স্বামী ছিলেন শ্রমিক। স্ত্রী চালাতেন সবজির দোকান।
স্বামীর মৃত্যুর পর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন মলি। একার উপার্জনে কীভাবে দুই সন্তানকে বড় করবেন! কিন্তু হাল ছাড়েননি শান্ত প্রকৃতির এই নারী।
সবজির ব্যবসা করে দুই সন্তানকে মানুষ করেছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেও চাকরি করেন। এখন যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত।
আর চিন্তা কী। বৃদ্ধা জানান, ছেলে এবং মেয়ে বড় হয়েছেে। তিনি নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছেন। এখন কিছুটা সময় দিচ্ছেন নিজের জন্য। শুরু হলও মলির ভ্রমণ।
দোকান খোলা, রান্না-খাওয়া, দোকান বন্ধ; রোজ এই দিনযাপন করতে চান না মলি। একাকীত্বকে কোনোভাবে চেপে বসতে দিতে রাজি নন তিনি।
বেড়ানোর পরিকল্পনার শুরু কীভাবে? বছর ১১ আগে এক প্রতিবেশী উটি বেড়াতে যাচ্ছিলেন। খানিক সৌজন্যের খাতিরেই মলির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘একা মানুষ কোথাও বেরোও না। যাবে?’’ এক কথায় রাজি হয়ে যান মলি। সেই তার প্রথম বেড়াতে যাওয়া।
প্রথম বার বেড়িয়ে এসে পেয়ে বসে ভ্রমণের নেশা। মলি ঠিক করলেন, এবার নিয়ম করে বেড়াতে যাবেন।
এ ভাবে টুকটাক কাছেপিঠে বেড়াতে যেতেন। এ ভাবেই বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছে মাথাচাড়া দেয় মলির।
যেই ভাবা সেই কাজ। কাজ করে টাকা জমাচ্ছিলেন। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ করলেন ২০১২ সালে। ২০১০ সালেই পাসপোর্ট বানিয়ে নিয়েছিলেন। প্রথম বারেই ইউরোপ-ভ্রমণ। ১০ দিনের সফর ছিল।
কেরালার সবজি বিক্রেতা মলি একে একে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইটালি, আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বেড়াতে যাওয়ার তালিকা এখনও বাকি। কিন্তু এতগুলো দেশ ঘুরে জমানো টাকা শেষ।
মলি জানান, আমেরিকা ভ্রমণের পরই প্রায় সব জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। সেই বার ১০ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন তিনি! কিন্তু মলি থামতে চান না। এই বয়সে রোজ দোকান খোলেন। ব্যবসা করেন। আর কাজের ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নেন ভ্রমণ পত্রিকায়। সেখান থেকেই ঠিক করেন, পরের বার কোথায় বেড়াতে যাবেন।
মলি আরও জানান, বেড়ানোর জন্য তিনি যে কোনও ‘ট্রাভেল এজেন্সি’র উপর নির্ভর করেন। এতে খরচও কম হয়। আর এই বয়সে একা বেড়ানোটাও এড়ানো যায়।
সবজি বিক্রেতা এও জানান, ভ্রমণের শখ পূরণ করতে কখনো কারও কাছে ধার করেননি। যতগুলো দেশ ঘুরেছেন, সব নিজের জমানো টাকায়। সবজির দোকানটাই তার একমাত্র আয়ের উৎস। কখনও কখনও অবশ্য নিজের গহনা বন্ধক দিয়ে বেড়াতে গেছেন। তবে ফিরে এসে জমিয়ে ব্যবসা করে সেই গহনা ছাড়িয়ে এনেছেন।
মলি বলেন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তার পর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। শখ বলতে তো কিছুই ছিল না। জীবনে কোনও আক্ষেপও নেই। তবে মনের গোপনে লালন করতেন বেড়ানোর ইচ্ছা। ভেবে রেখেছিলেন একদিন শখপূরণ করবেনই করবেন।
দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। কোন শহর সবচেয়ে ভাল লেগেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই বৃদ্ধার বলেন, লন্ডন। ব্রিটেন সফরে গিয়েছিলেন ১৫ দিনের জন্য। লন্ডন খুব ভালো লেগেছে তার। এছাড়া আমস্টারডাম, রোমের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও দুর্দান্ত। কিন্তু এক কথায় যদি কেউ জানতে চান বেড়ানোর সেরা মুহূর্ত কোনটি, মলির জবাব, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নায়গ্রা জলপ্রপাত দেখা।