‘ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী’ মর্যাদার সুযোগ্য দাবিদার গৌড়ীয় নৃত্যের উৎস, বিকাশ, ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায়

সুজলা–সুফলা–শস্য–শ্যামলা বাংলা মা তাঁর শস্যের পাশাপাশি সমৃদ্ধ তাঁর সংস্কৃতিরই একটি শাখা ‘গৌড়ীয় নৃত্য’। নৃত্যকলা ভারতবর্ষের এক অমূল্য সম্পদ। যা বিবর্তনের পথ ধরে বর্তমানে পুনরায় পুনর্গঠিত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতি পরিচিত আধুনিক ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি। বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ একই ভাবে বিবর্তনের পথ ধরে আধুনিক ভারতের পাদপ্রদীপে এসে দাঁড়িয়েছে তার বিগত দিনের বহু ঐশ্বর্য সম্ভারে পুনর্গঠিত রূপে। শাশ্বত তার এই পথ পরিক্রমা।

এর সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা অনুসন্ধান করতে গেলে ঘাঁটতে হবে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাংলার সংগীত শাস্ত্রগ্রন্থ সমূহ, সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ঘাঁটতে হবে ভাস্কর্য–চিত্রকলা–লেখমালা–মুদ্রা, বাংলার গুরুমুখী লোকায়ত সজীব নৃত্যধারা সমূহ। উদাহরণস্বরূপ অত্যন্ত প্রচলিত একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য – ভরতনাট্যম–এর কথাই ধরা যাক, যা বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত, এই নৃত্যটি যে যে লোকায়ত গ্রামীণ নৃত্যধারা গুলিকে ভিত্তি করে পুনর্গঠিত সেগুলি হল – সাদির বা দাসী, কুচিপুড়ী, ভগবতমেলানাটক ও কুরুভাঞ্জি মূল এই চারটি মুখ্য উপাদান। এছাড়াও আছে – হরিকথা, তেরুকুথু ইত্যাদি গৌণ উপাদান সমূহ। গৌড়ীয় নৃত্যও গ্রামীণ গুরুপরম্পরা ধারার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

Read More: Is point Who are You নামে খ্যাত রাসেল এখন ঢাকা কাপাচ্ছে Rasel chuyadang damurhuda

শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা মূলতঃ চারটি অভিনয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে – আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক ও আহার্য। প্রত্যেকটিই অত্য়ন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রীয় নৃত্যের পুরো কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে বাচিক অর্থাৎ সাহিত্য ও বোলবাণীর ওপর। শাস্ত্রীয় নৃত্যে বাচিক অভিনয় তথা সাহিত্যের অবদান অপরিসীম। তাই বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা গৌড়ীয় নৃত্যের চারটি স্তম্ভই অত্যন্ত শক্তিশালী –

১। সাহিত্য ও ইতিহাস

২। সংগীত শাস্ত্র

৩। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প,ও লেখমালা।

৪। গুরুপরম্পরা লোকায়ত নৃত্যধারা।

১। সাহিত্য ও ইতিহাস

খ্রীস্টীয় পঞ্চম শতকে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ – এ গৌড়দেশবাসিনী মেয়েদের বর্ণনা আছে –

‘ মৃদুভাষিণ্যোহনুরাগবত্যো মৃদঙ্গশ্চগৌড্যঃ। 

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের মতে খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ– দশম শতকে বাংলার মন্দিরে নৃত্যানুষ্ঠান প্রচলিত ছিল এবং তা ছিল নাট্যশাস্ত্রনুসারী। এর উল্লেখ আমরা পাই কাশ্মীরের কবি কলহন রচিত ’রাজতরঙ্গিনী’ থেকে।

মণ্ডলেষু নরেন্দ্রানাং পয়োদানামিবার্যমা।

গৌড়রাজাশ্রয়ং গুপ্তং জয়ন্তাখ্যেন ভূভূজা।।

প্রবিবেশ ক্রমেনাথ নগরং পৌণ্ড্রবর্ধনম্।

……………………………………………………………………

লাস্যং সদ্রষ্টুম্ বিশৎ কার্তিকেয় নিকেতনম্।

ভরতানুগমালক্ষ্যনৃত্যগীতাদিশাস্ত্রবিৎ।

………………………………………………………………………

নর্তকী কমলা নাম কান্তিমন্তং দদর্শতম্।।

কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড় যখন ছদ্মবেশে গৌড়বঙ্গের পৌণ্ড্রবর্ধন নগরে প্রবেশ করেন। তখন দেখতে পান কার্তিকের মন্দিরে কমলা নামে দেবদাসী গীত ও বাদ্যের সঙ্গে ভরত নাট্যশাস্ত্রকে অনুসরণ করে নৃত্য পরিবেশন করছেন। সাহিত্য থেকেই বোঝা যায় বাংলার শাস্ত্রানুসারী নৃত্যের কথা।

সাহিত্যের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে যুগযুগ ধরে ভারতের সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করে তুলতো বাংলার গীত–নৃত্য–বাদ্য তথা সংগীত শাস্ত্রজ্ঞরা। চান্দ্রব্যাকরণ প্রণেতা চন্দ্রগোমিন্ (আনুঃ ৫ম–৬ঠ শতক), তিনি ‘তারা ও মঞ্জুশ্রী স্তোত্র ‘ ও ‘লোকানন্দ নাটক’ রচনা করেন। চর্যাপদ ও নাথ সাহিত্যে বৌদ্ধ সাধকদের(সাবেরি–পা, কানু–পা, লুই–পা, হাঁড়ী– পা প্রভৃতিদের দ্বারা রচিত) সাধন সংগীত অর্থাৎ উক্ত গ্রন্থগুলিতে তৎকালীন বাঙ্গালীর নাট্যভিনয়ের সংকেত পাওয়া যায়। বজ্রাচার্য ও দেবী দুজনে মিলিত হয়ে বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনী নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে অভিনয় করেছেন–

সম্রাট হাজরা

‘নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী

বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই ।‘ চর্যাপদ সং।১৭। ৪

সেযুগের সিদ্ধাচার্যদের সাধনসঙ্গিনী ডোম রমণীগণ নৃত্য ও গীতে পটীয়সী ছিলেন। চর্যাপদে আছে ডোমরমণী একটি চৌষট্টি দলযুক্ত পদ্মের ওপর অতি লঘু পদক্ষেপে নৃত্য করছেন–

‘একসো পদুমা চৌষঠ্ঠী পাখুড়ী

তহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।‘ চর্যাপদ সং।১০।

নাথগীতিকার মধ্যে দেখা যায়, গোরক্ষনাথ তাঁর গুরু মীননাথকে উদ্ধার করতে এসে নেচেছিলেন এবং সেখানে বেশভূষা অর্থাৎ আহার্য অভিনয়ের বর্ণনা আছে –

‘ অলঙ্কার পাইয়া নাথ করিল ভূষণ,

একে একে পরিলেক যথ আভরণ।

গলাতে দিলেন নাথ সাতছড়ি হার,

করেতে কঙ্কণ দিল অতি শোভাকর।

কপালে তিলক দিল নয়ানে কাজল,

করণেতে দিল নাথ সুবর্ণ কুণ্ডল।

পায়েতে নূপুর দিল কনক উঝটি,

গায়েতে কাঞ্চলি দিল কোমর কাছটি।

এমত করিল সাজ ভুবনমোহন,

আছৌক আনের সাজ– টলে মুনির মন।

রূপসজ্জার পর নৃত্য গীতের বর্ণনা –

‘নাচন্তি যে গোরখনাথ মাদলে করি ভর

মাটিতে না লাগে পদ আলগ উপর

নাচন্তি যে গোরখনাথ ঘাগরের রোলে,

কায়া সাধ কায়া সাধ মাদলেতে বলে।‘

বাংলার সাহিত্য ও শিল্পের ইতিহাসে ধারাবাহিকতার সূত্রপাত পালরাজাদের সময় থেকে। সাহিত্যে তার সাক্ষ্য রয়েছে বহু প্রাচীন প্রকীর্ণ শ্লোকে। রাজা রামপালের সময়ে সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত কাব্য’ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। সেযুগের কবিরা বাংলার মন্দিরের দেবদাসীদের রূপ যৌবনের বর্ণনায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।

পালযুগের পর সেনযুগ। সেনযুগ সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের সুবর্ণযুগ। সেই যুগে নৃত্যগীত চর্চায় কবি পণ্ডিতরা বিমুখ ছিলেন না। যারা ‘নট’ বৃত্তি অবলম্বন করতেন সমাজে তাঁদের সম্মানীয় আসন ছিল। বাংলায় ‘নট’ উপাধিতে তাঁরা ভূষিত হতেন। যেমন – নট গঙ্গোক, জয় নট প্রমুখ। ‘নট গঙ্গো’ রচিত কয়েকটি শ্লোক শ্রীধরদাস সংকলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ – এ রক্ষিত আছে। গোবর্ধন আচার্য রচিত ‘আর্যাসপ্তশতী’ গ্রন্থে বাংলার সংগীত তথা গীত–বাদ্য–নৃত্যের সংবাদ পাওয়া যায়। আর্যায় অনেক বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায় যেমন– ঢাক, বাঁশী, শঙ্খ, বীণা ইত্যাদি।

স্বয়ং জয়দেব সংগীত বিশারদ ছিলেন। ‘গীতগোবিন্দ’ গাইবার ও নাচবার জন্য জয়দেবের দল ছিল। শোনা যায় পদ্মাবতী সেই দলে নাচতেন এবং জয়দেব মৃদঙ্গ বাজাতেন। গীতগোবিন্দের পদগুলিতে সেকালের নৃত্য গীত বা নাটযাত্রা পালার নিদর্শন পাওয়া যায়।১০ গীতগোবিন্দের প্রথম সর্গের শ্লোকে রাসনৃত্যের উল্লেখ আছে।

সেনযুগের পর অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ১২০০ অব্দ শেষ হতে না হতেই বাংলার তুর্কী আক্রমণের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্মণ সেন অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী নবদ্বীপ ত্যাগ করেন। তুর্কী বিজয়ের প্রথম দিকটা ছিল ধ্বংসের পর্ব। মোটামুটি খ্রিঃ ১২০০ – ১৩৫০ এই দেড়শ বছরের বাংলার কোন সাংস্কৃতিক বা সামাজিক চিত্র আমরা পাই না, সার্ধ শতাব্দী জোড়া এই নিস্তব্ধতাই তুর্কী বিজয়ের ভয়াবহতার প্রমাণ।১১ দেড়শ শতাব্দীকাল যাবৎ ধীরে ধীরে তাঁরা ইরাণ, তুরাণ যেখান থেকেই আসুন না কেন, এদেশে এসে সম্পূর্ণরূপে বাঙালী হয়ে পড়লেন। মহরম, ঈদ, সবেবরাৎ প্রভৃতির পাশাপাশি দুর্গোৎসব, রাস, দোল ইত্যাদি চলতে লাগলো। গৌড়ের সম্রাটগণের প্রেরণায় হিন্দুশাস্ত্র অনুবাদ শুরু হল। গৌড়ীয় যুগে বাংলা সাহিত্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে অনুবাদ শাখা, লৌকিক শাখা ও পদাবলী শাখা প্রধান।

১২ বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ থেকে জানা যায় যে সেই যুগে রাত জেগে লোকে মনসার গান শুনতো, চণ্ডীবাশুলী গাইতো, যোগীপাল– ভোগীপালের গীত শুনতো, শিবের গান গাইতো, কৃষ্ণলীলা খুবই জনপ্রিয় ছিল। এগুলির প্রধান রূপ ছিল গীত ও পাঁচালী। পাঁচালী ছিল এক ধরনের গান – মৃদঙ্গ, মন্দিরা, চামর হাতে নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হতো।

মূল গায়েন গাইতো এবং নাচতো, অন্যেরা দোহার হিসেবে হতো তার সহযোগী। উত্তর প্রত্যুত্তরে কৃষ্ণলীলা অভিনীত হতো – তাকে বলা হতো নাট্যগীত বা নাটগীত। ১১ অভিজাত সমাজে নাটগীত এবং অনাভিজাত সমাজে লোকনাট্য প্রচলিত ছিল।১৩ বড়ুচণ্ডীদাসের ‘কৃষ্ণকীর্তন’ অভিনীত হতো।১৪ মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়য়’ (১৪৭৩ খ্রিঃ) কৃষ্ণলীলার প্রথম কাব্য। এখানেও বাদ্যযন্ত্র, গান ও নৃত্যের কথা পাই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে এই যুগে নৃত্য গীতের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেই সময়কার নর্তকীর বেশভূষা, অঙ্গরাগ, অলঙ্কারের বর্ণনা পাই।১৫

বাংলাসাহিত্যের আরেকটি শাখা মঙ্গলকাব্য নৃত্যগীতের বর্ণনায় ভরপুর। মনসা মঙ্গলকাব্যের নায়িকা বেহুলা নৃত্যগীতে পারঙ্গম। আমরা প্রাচীনবাংলা সাহিত্যে তিনজন বধূর নাম পাই যারা নৃত্যগীতে পারদর্শী, বিখ্যাত ছিলেন এবং লোকসমক্ষে সম্মানের সঙ্গে নৃত্যগীত প্রদর্শন করতেন –

১) কবি জয়দেবের পত্নী ‘পদ্মাবতী’।

২) মনসামঙ্গলকাব্যের নায়িকা চাঁদসদাগরের পুত্রবধূ ‘বেহুলা’।

৩) গঙ্গোনটের পুত্রবধূ জয়নটের বধূ ‘বিদ্যুৎপ্রভা’।

মনসামঙ্গলকাব্যে শিবের নৃত্যের বর্ণনা আছে –

‘পদ্মারে লইয়া কাঁখে নাচে শিব ঘন পাকে’

‘পাক’ অর্থাৎ ‘ভ্রমরী’ বা ‘ঘোরা’।

মনসামঙ্গল কাব্যে নৃত্য, গীত ও বাদ্যযন্ত্রের বর্ণনা আছে। একজোড়া মৃদঙ্গ সঙ্গত এবং বসন্তবাহার রাগের সঙ্গে বেহুলার নৃত্য উপযোগী বেশভূষা করে নৃত্য করেছেন। মৃদঙ্গ বাদকদ্বয়ের নাম বিশ্বাবসু – চিত্রসেন।

‘ সেই সজ্জা দিয়া বেউলা করিলেক সাজ।

বিশ্বাবসু চিত্রসেন দুই বাইন রাজ।।

তাল টংকারিয়া কৈল মৃদঙ্গে আঘাত।

ধ্যান ভাঙ্গি ফিরিয়া বসিলা ভোলানাথ।।

আলাপেয়ে পঞ্চমেতে বসন্ত–বাহার।

তার শেষে নৃত্য করে তালে করি ভর।।১৬

মুকুন্দ চক্রবর্ত্তী রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যেও নর্তকীর বেশভূষা প্রসাধনের বর্ণনা পাই –

সুরঙ্গ পাটের জাদে বিচিত্র কবরী বাঁধে

মালতী মল্লিকা চাঁপা গাভা।

কপালে সিন্দুর ফোটা প্রভাতে ভানুর ছটা,

চৌদিকে চন্দন বিন্দু শোভা।।

পরি দিব্য পাট শাড়ী কনক রচিত চুড়ি,

দুই করে কুলুপিয়া শঙ্খ।

হীরা নীলা মোতি পলা কলধৌত কণ্ঠমালা

কলেবর মলয়জ পঙ্ক।।

পীত তড়িত বর্ণে হেম মুকুলিকা কর্ণে

কেশমেঘে পড়িছে বিজুলী।

রতন পাসলি ছটি পরে দিব্য তুলাকোটি

বাহু ভূষণ ঝলমলি।।১৭

নৃত্য–গীত–বাদ্য এদেশের সাধনার বিষয়বস্তু ছিল। নৃত্যকালীন তাল ভঙ্গ সে যুগের সমাজের কাছে এক কঠিন অপরাধ বলে গণ্য করা হতো। যার উদাহরণ বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যে বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যগুলিতে দেখতে পাই। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে স্বর্গনর্তকী রত্নমালার তালভঙ্গ এবং অভিশপ্ত হওয়ার উদাহরণ প্রদত্ত হল –

‘ তালভঙ্গ হইল রামা লাজে হেঁটমুখী।

যতেক দেবতা সভে হইলা বিমুখী।।

তালভঙ্গ দেখি তারে বলেন ভবানী।

যৌবন গরবে নাচ হয়ে অভিমানী।।

সুধর্ম সভায় নাচ হয়ে খলমতি।

মানব হইয়া ঝাট চল বসুমতী।।‘১৮

দেবতা সভায় বেহুলার নৃত্য বর্ণনায় খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের রচনাটি সার্থক। এতে পুরোপুরি শাস্ত্রানুসারী নৃত্যের বিশদ বর্ণনা পাই –

“দেবতা সভায় গিয়া খোল করতাল লয়্যা

নাচে কন্যা বেহুলা নাচনী।।

যতেক দেবতা দেখি ফিরে যেন নৃত্যশিখী

গায় যেন কুকিলের ধ্বনি।।

ঘন ঘন তাল রাখে অঞ্চলে বয়ান ঢাকে

হাসি হাসি দশন দেখায়।

মুখে গায় মিষ্ট বোল খয়ের কাষ্ঠের খোল

তাথৈ তাথৈ দ্রিমিকি বায়।।

আগু পাছুয়ান গিয়া নাচে কন্যা পাক দিয়া

পায়ে বাজে রতন নূপুর।

নবীন কুকিল যেন রহি রহি ঘন ঘন

মুখে গায় বচন মধুর।।

…………………………………।

নাচে কন্যা বেহুলা নাচনী

মুখে মন্দমন্দ হাসি ক্ষণে রহি উঠি বসি

যেন নাচে ইন্দ্রের নটিনী।।

করে কাংস্য করতাল বলে ধনি ভাল ভাল

কটিতে কিঙ্কিণী ঘন বাজে।

আসিয়া হরের কাছে বেহুলা সন্ধানে নাচে

প্রাণপতি জীয়াবার কাজে।।

রহি রহিা পাক মেলে মরাল গমনে চলে

মুখ যেন পূর্ণিমার শশী।

……………………………………………………………………

নাহি হয় তাল ভঙ্গ মনে বড় বাঢ়ে রঙ

মত্ত ময়ূর যেন ফিরে।।

রঙ্গে ভঙ্গে হস্ত নাড়ে ত্রিভঙ্গ হইয়া পড়ে

অই রীতে গায় মিষ্ট বানী।

নৃত্যগীতে মন মোহে যতেক দেবতা কহে

ভাল নাচে বেহুলা নাচনী।। ” ১৯

এই সাহিত্যের বর্ণনা অনুযায়ী বেহুলা শাস্ত্রে বর্ণিত শৃঙ্গার রসযুক্ত হয়ে ময়ূরী গতি, মরালী গতি, ত্রিভঙ্গিমা ও ভ্রমরী সহকারে ঘন আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্র করতাল– মৃদঙ্গের সঙ্গে নৃত্য করছেন।

এই সাহিত্যগুলির পাশাপাশি শ্রীচৈতন্যদেবও গৌড়ীয় নৃত্যের মধ্যযুগের একজন প্রধান নর্তক হিসেবে সুচিহ্নিত করা যায়। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ( ১৪৮৬ – ১৫৩৩ খ্রিঃ) আকস্মিক নয়। তার পূর্বে তুর্কী আক্রমণের ঝড়ের পর বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে। পঞ্চদশ শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে নৃত্য, গীত, বাদ্য জগতে বিরাট আন্দোলন হয় এবং তার ফলে চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্য সমূহ নৃত্য ও গীতের তথ্যে সমৃদ্ধ। সুরে তালে করতাল ও মৃদঙ্গের সহযোগে ভগবানের নাম অর্থাৎ কীর্তিগান আবৃত্তি অর্থে কীর্তন প্রচলিত প্রাচীন কাল থেকেই কিন্তু চৈতন্যদেবের সময় থেকে ব্যাপক ও জনপ্রিয় ভাবে কীর্তন শব্দের প্রচলন হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেব সংকীর্তনের সঙ্গে নাচতেন– নাচের প্রকার ছিল দুই রকমের – উচ্চণ্ড অর্থাৎ তাণ্ডব এবং মধুর অর্থাৎ লাস্য। তিনি নিজে যে সংকীর্তনের ব্যবস্থা করতেন তাকে বলা হত ‘নৃত্যসংকীর্তন’। চৈতন্যদেব যেমন নিজে অত্যন্ত দক্ষ নৃত্য শিল্পী ছিলেন এবং সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। মধ্যযুগের গৌড়ীয় নৃত্যের প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী শ্রীচৈতন্যদেব।

চৈতন্যদেবের সমকালীন এবং চৈতন্যোত্তর সাহিত্যে বাংলার নৃত্যকলার বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।

(ক্রমশঃ)

Read More: প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী সম্রাট হাজরা এর কিছু কথা কোটালীপাড়া গোপালগঞ্জ

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

প্রয়াত অধ্যাপক ডঃ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রয়াত অধ্যাপক ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত, পণ্ডিত অমিতাভ মুখোপাধ্যায় (গৌড়ীয় সংগীত গবেষক), অধ্যাপক ডঃ গৌতম সেনগুপ্ত।

 

তথ্যসূত্র

১) শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ (সম্পাদনা),বাৎসায়নের কামসূত্র, মূল সংস্কৃত ও বাংলা অনুবাদ ৬/৫/৩৩ – ওরিয়েন্টাল এজেন্সী, কলকাতা।

২) Stein, M. A. Kalhana’s Rajatarangini, Motilal Banarsidass, Delhi, 4th Taranga, Vol III, Sloka 420 – 424.

৩) মজুমদার, ডঃ রমেশচন্দ্র, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৩৬৪, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, পৃঃ ১২২।

৪) দাস, ডঃ আশা ও ভট্টাচার্য, আশুতোষ, বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ১৯৬৯, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলকাতা, পৃঃ ৫৩১।

৫) গোস্বামী, নিত্যানন্দ বিনোদ, বাংলা সাহিত্যের কথা, ১৩৫৯, লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা, বিশ্বভারতী প্রকাশন, পৃঃ ৫১–৫৬।

৬) সেন, সুকুমার, বৈষ্ণবীয় নিবন্ধ, ১৯৭০, রূপা, পৃঃ ১২।

৭) মজুমদার, ডঃ রমেশচন্দ্র, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৩৬৪, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, পৃঃ ১৯৩–১৯৫।

৮) সেন, সুকুমার, প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী, ১৩৫৩, বিশ্বভারতী প্রকাশন।

৯) চক্রবর্ত্তী, জাহ্নবীকুমার (সম্পাদনা ও অনুবাদ), আর্যাসপ্তশতী ও গৌড়বঙ্গ (গোবর্ধন আচার্য রচিত), ১৩৭৮, স্যানাল এন্ড কোং, পৃঃ ৯৫–৯৮।

১০) মুখোপাধ্যায়, হরেকৃষ্ণও, শ্রী শ্রী গীতগোবিন্দম, ১৩৬২, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, কলকাতা, পৃঃ ২৯।

১১) হালদার, গোপাল, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা, ১৯৮৬, মুক্তধারা, কলকাতা, পৃঃ ৩১।

১২) সেন, দীনেশচন্দ্র, বাংলাভাষা ও সাহিত্য, ১ম খণ্ড, সম্পাদনা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮৬, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ, পৃঃ ১২৮ – ২৯১।

১৩) বন্দ্যোপাধ্যায়, ডঃ রবীন্দ্রনাথ, বাংলাসাহিত্যের পৌরাণিক নাটক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পৃঃ ২১ – ২৯।

১৪) ঘোষ, ডঃ মনমোহন, বাংলাসাহিত্য, ইন্ডিয়ান পাবলিসিটি সোসাইটি, পৃঃ ৪৯ – ৫০।

১৫) মজুমদার, ডঃ রমেশচন্দ্র, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ১৩৮০, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, পৃঃ ৩০৮ – ৩০৯।

১৬) চক্রবর্ত্তী, শ্রীরমানাথ ও চক্রবর্ত্তী, দ্বারকানাথ (সম্পাদনা), বংশীদাস পদ্মপুরাণ, ১৩১৮, ভট্টাচার্য এন্ড সন্স, কলকাতা, পৃঃ ৫৯৭।

১৭) চক্রবর্ত্তী, মুকুন্দরাম, কবিকঙ্কণচণ্ডী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, পৃঃ ৯০ – ৯১।

১৮) ভট্টাচার্য, আশুতোষ, বাংলার লোকনৃত্যঃ বিবিধ, ২য় খণ্ড, ১৯৮২, এ. মুখার্জী এন্ড কোং প্রা. লি., পৃঃ ১৫ – ২৩।

১৯) ঐ।

Rabindranath Thakur বাংলা কবিতা সমগ্র Bangla Kobita of Robindronath Thakur

লেখিকা পরিচিতি

ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায় একজন অগ্রণী গবেষক যিনি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী গৌড়ীয় নৃত্যকে বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগের বর্ষীয়ান অধ্যাপক এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন ডীন। স্বামী অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি ১৯৮০-র দশক থেকে তাঁর সমগ্র কেরিয়ার জুড়ে গৌড়ীয় নৃত্য শৈলীটির পুনরুদ্ধার ঘটিয়ে চলেছেন। ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে বক্তৃতা দিয়েছেন, নৃত্য পরিবেশনও করেছেন। দু’বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেগোর চেয়ার অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শশী মাহাতো (নাচনী), নরোত্তম সান্যাল (কীর্তন), পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুধা (ছৌ), পদ্মভূষণ কলানিধি নারায়ণন (অভিনয়), গুরু মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (শাস্ত্র) প্রমুখ বিভিন্ন গুরুর কাছ থেকে নৃত্য বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছেন। ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায় নৃত্য প্রতিষ্ঠান ‘গৌড়ীয় নৃত্যভারতী’র প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক এবং ‘মিত্রায়ন’ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন পরিচালক। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় এমএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। নাইজিরিয়ান লেখক তানুরে ওজাইদের “দ্য বিউটি আই হ্যাভ সীন : আ ট্রিলজি” সংকলনে প্রকাশিত একটি কবিতার বিষয়বস্তুও থেকেছেন তিনি। বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রেও তাঁকে দেখা গিয়েছে, যেমন – ‘ডান্স অফ গড’ (১৯৯৭), ভারত সরকারের ফিল্ম বিভাগ দ্বারা নির্মিত ‘গীতময় তন্ময় – ট্রান্স ইন মোশন’ (২০১২), রেজারেকশন (রাজ্যসভা টিভি চ্যানেল ২০১৩), গৌড়ীয় নৃত্য – গোল্ডেন গ্লোরি : এ ক্লাসিকাল ডান্স অফ বেঙ্গল (সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ২০১৭) এবং আরও অনেক। তাঁর লেখা প্রায় কুড়িটি বই এবং ১৮০টিরও বেশি নিবন্ধ রয়েছে। তাঁর কাছে তালিমপ্রাপ্ত পঞ্চাশেরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভারত সরকারের জুনিয়র এবং সিনিয়র স্কলারশিপ ও ফেলোশিপ পেয়েছে।

Source Of : bangodesh

ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।

নৃত্য কাকে বলে, শাস্ত্রীয় নৃত্য কাকে বলে, সৃজনশীল নৃত্য কি, বাংলার নৃত্য, বাংলাদেশের নৃত্য, আধুনিক নৃত্য, নৃত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, লাস্য নৃত্য কাকে বলে

Leave a Reply