বিয়ের সময় বরকে আমরা কাঁদতে তো দেখিই না, বিষণ্নও হতে দেখি না। বর পণের টাকা পাচ্ছে, বিনে পয়সার দাসি পাচ্ছে। বিনে পয়সার দাসি মানে বিনে পয়সার রাঁধুনি, বিনে পয়সার কাজের লোক, বিনে পয়সার মালি, নার্স, কেয়ারটেকার, যৌনদাসি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, সবই পাচ্ছে। একের ভেতর অনেক। সুতরাং বরের আনন্দের সীমা নেই। সমাজের নিয়মগুলো মেয়েবিরোধী, তারপরও মেয়েরা এই নিয়মগুলোই মেনে নেয়, কারণ মেনে না নিলে কেউ তাদের ‘ভালো মেয়ে’ বলে না। ভালো মেয়ে না হলেই সে মন্দ মেয়ে। মন্দ মেয়েদের নরক যাপন করতে হয়। নরক যাপন কে চায়?
বিয়ের সময় পণ দিতে হয়, এই ভয়ে বাবা মা কন্যা সন্তান চান না। গরিবদের জন্য কন্যা সন্তান তাই অনেকটা অভিশাপের মতো। পণপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও এখনও এই প্রথাটি এত জনপ্রিয় যে এটির আজও বিলুপ্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। মেয়েরা কেন কাঁদে বিয়ের সময়? শুধু কি আত্মীয় স্বজন ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট? অনিশ্চিত জীবনের ভয় নেই? সংসারে বধূ হত্যা, বধূ নির্যাতন ঘটেই চলেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না মেয়েরা অচেনা অপরিচিত লোকের হাতে নয়, সবচেয়ে বেশি খুন হয় স্বামী বা ঘনিষ্ঠ লোকের হাতে, খুন বাইরের চেয়ে বেশি হয় ঘরে। ঘরের মতো অনিরাপদ আর কোনও জায়গা নেই মেয়েদের জন্য। যে নতুন ঘরে মেয়েটি বিয়ে হওয়ার কারণে যায় বা যেতে বাধ্য হয়, সেই ঘরটি তার জন্য আদৌ নিরাপদ হবে কি না, মেয়েটি জানে না। মেয়েটি হয়তো অনিশ্চিত জীবনটির জন্যই নিজের অজান্তেই কাঁদে।
বিয়ে মেয়েদের নিরাপত্তা দেয় না। নিরাপত্তা দেয় আর্থিক স্বনির্ভরতা। পরনির্ভর মেয়েদের জীবন জড়িয়ে থাকে অনিরাপত্তায়, হীনমন্যতায়। পুরুষতন্ত্র সমাজকে শিখিয়েছে, শৈশব কৈশোরে মেয়েদের নির্ভর করতে হবে পিতার ওপর, যৌবনে স্বামীর ওপর, বৃদ্ধাকালে পুত্রের ওপর। পুরুষতন্ত্র মেয়েদের পরাধীন রাখার পক্ষপাতি। দীপিকা আর প্রিয়াংকা কেউই আর্থিকভাবে পরনির্ভর নয়। কে তাদের স্বামী হবে, তা পরিবার ঠিক করে দেয়নি, তারা নিজেরাই ঠিক করেছে। দীপিকা রনভীরের সঙ্গে কয়েক বছর মিশেছে, প্রেম করেছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করার। প্রিয়াংকাও নিক জোনাসের সঙ্গে বিস্তর ঘুরে বেরিয়েছে, নিককে কাছ থেকে দেখেছে, জেনেছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করার। রনভীর এবং নিক যেমন শ্বশুরবাড়িতে বাস করবে না, প্রিয়াংকা বা দীপিকাও তেমন তাদের শ্বশুরবাড়িকে নিজের ঠিকানা করবে না। তারা নিজেদের বাড়িতেই বাস করবে। তারা কোনও বধূ নির্যাতন মেনে নেবে না, তারা কোনও অসম্মান, অপমান সহ্য করবে না। স্বনির্ভর মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ পরনির্ভর মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য সেই স্বনির্ভর মেয়েরা সত্যিকার স্বনির্ভর নয়, যারা টাকা পয়সা রোজগার করে পুরো টাকাটা স্বামীর হাতে তুলে দেয়, কারণ স্বামীদের মতো তারাও বিশ্বাস করে টাকা পয়সা রোজগার করতে জানলেও মেয়েরা টাকা কী খাতে খরচ করতে হবে তা জানে না, বা হিসেব নিকেষ মেয়েরা ভালো বোঝে না। অধিকাংশ নারী পুরুষ দুজনেরই ধারণা টাকা জিনিসটা পুরুষের, টাকা সে যে-ই রোজগার করুক না কেন। টাকা পয়সায়, ধন দৌলতে, সম্পদে, প্রাচুর্যে তারা তাই পুরুষালি গন্ধ পায়।
দীপিকা আর প্রিয়াংকা তাদের বিয়েতে প্রাণখুলে অট্টহাসি হেসেছে। তারা আনন্দ করেছে। এ ছিল তাদের আনন্দের দিন। বিয়ে মানে বাবা মা ভাই বোনকে জন্মের মতো ছেড়ে যাওয়া নয়। যে কোনও সময় দীপিকা বা প্রিয়াংকা নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারে, ঠিক যেমন রণভীর আর নিকও তাদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। দীপিকা বা প্রিয়াংকা কাউকে স্বামীদের দাসি হতে হবে না। যদি স্বামীরা অত্যাচার শুরু করে, নির্দ্বিধায় তারা তাদের স্বামীদের তালাক দেবে। তালাক দিলে কে তাদের ভরণপোষণ করবে, কার কাছে তারা সাহায্যের হাত পাতবে, সন্তান সন্ততি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে কি না, এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। নিজের উপার্জনে নিজেই চলতে পারে স্বাবলম্বী মেয়েরা। প্রিয়াংকা আর দীপিকার মতো অঢেল টাকা দুনিয়ার অধিকাংশ মেয়ের নেই। আত্মবিশ্বাস থাকতে হলে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে গেলে প্রচুর টাকা থাকতে হবে, তা না হলে কিচ্ছু হবে না, এ ঠিক নয়। নিজের মতো করে সসম্মানে বাঁচতে হলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার দরকার হয় না।
মেয়েদের কিছু জিনিসকে ‘না’ বলার সময় এসেছে। বিয়ের দিন কান্নাকাটি নয়, হাসতে হবে। দীপিকা আর প্রিয়াংকার মতো প্রাণ খুলে হাসতে হবে। সম্বন্ধ করা বিয়ে, অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, পণপ্রথা, গার্হস্থ্য নির্যাতন, স্বামীর ধর্ষণ, পুরুষতন্ত্র, নারী বিদ্বেষ সব কিছুকে বড় সড় ‘না’ বলে দিতে হবে। মেয়েদের না বলতে শেখায়নি সমাজ। মেনে নেওয়া, আপোস করা, হজম করা, সহ্য করা, এসব মেয়েদের জন্যই। পিতৃতন্ত্র মেয়েদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে, স্বামীর সুখেই স্ত্রীর সুখ। কোনও সচেতন মেয়েই এ কথা মানবে না। সচেতন মেয়েরা স্বামীর সুখকে স্বামীর সুখ বলেই ভাবে, নিজের সুখকে ভাবে নিজের সুখ বলে। নিজের পৃথক অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করে না। নিজের সুখের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করে না। নিজের সুখ নিজেই আহরণ করে নেয়।
মেয়েরা যেন কখনও নিজের নাম বিসর্জন দিয়ে স্বামীর নাম গ্রহণ না করে। রণভীর সিং যেমন রনভীর পাডুকোন হবে না, দীপিকাও যেন দীপিকা সিং না হয়। প্রিয়াংকাও যেন রয়ে যায় প্রিয়াংকা চোপড়া হয়ে, যেমন নিক রয়ে যাবে নিক জোনাস হয়ে। মেয়েরা যেন নিজের পরিচয় বা স্বকীয়তা বিয়ের কারণে বিসর্জন না দেয়। সমাজ মেয়েদের চায় বশ্য হতে, তাই বলে মেয়েদের বশ্য হতে হবে কেন! সমাজের নারীবিরোধী নিয়মগুলো যদি এখন বিলুপ্ত না হয়, কবে হবে?
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
আরও পড়ুন: ১০টি বাংলাদেশের সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল
ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।