বেগম সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১ – ২০ নভেম্বর ১৯৯৯) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
জন্ম:
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মাতার নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। তার বাবা কুমিল্লার বাসিন্দা ছিলেন। যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলিম নারীদের গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হত। স্কুল-কলেজে পড়ার কোন সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধ ছিলো। সেই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায়নি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন।
প্রাথমিক জীবন:
সুফিয়া কামাল তার স্বামী কামালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে (১৯৩৯)
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়ার যখন ৭বছর বয়স তখন তার বাবা সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। ফলে তাকে তার মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। এই কারণে তার শৈশব কেটে ছিল নানা বাড়িতে।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনী – Manik Bandopadhyay Biography in Bengali
যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারী-শিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। তার মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিলো উর্দু। এই কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানা বাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিলো। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিলো তার।
১৯২৪ সনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে দেয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করে ছিলেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়ে ছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তার দেখা হয়ে ছিল। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়ে ছিল বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।
সাহিত্যচর্চার সূচনা এবং কলকাতার জীবন:
সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করে ছিলেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা হয়। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সাথে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে।
নিজের সাহিত্য প্রয়াসের সূচনা প্রসঙ্গে তিনি এ ভাবে স্মৃতিচারণ করে ছিলেন, “এমনি কোন বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা `হেনা` পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে ? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। তারপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হল ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হল লেখা লেখির খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনো যে মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই লজ্জায় সংকুচিত হয়ে উঠি।”
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যচর্চা চলাতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তাঁর গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায় যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৩২ সালে তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় নিপতিত করে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিন আহমেদের সাঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। দেশ বিভাগের আগে কিছু কাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন।
ঢাকার জীবন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড:
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী তুলে ধরেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলো। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ গ্রহন করেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতঃপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানী বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলো, আর ঐ সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন ।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারী জাগরণ এবং সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল নক্ষেত রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়ে ছিলেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করে ছিলো। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
মৃত্যু:
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্মরণ করা হয়।
২০ জুন, ২০১৯ তারিখে তার ১০৮তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গুগোল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে।
রচনা:
কাব্যগ্রন্থ
সাঁঝের মায়া (১৯৩৮)
মায়া কাজল (১৯৫১)
মন ও জীবন (১৯৫৭)
প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮)
উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪)
দিওয়ান (১৯৬৬)
অভিযাত্রিক (১৯৬৯)
মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০)
মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)
গল্প:
কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)
ভ্রমনকাহিনী;
সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮)
স্মৃতিকথা:
একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)
আত্মজীবনীমূলক রচনা
একালে আমাদের কাল (১৯৮৮)
শিশুতোষ:
ইতল বিতল (১৯৬৫)
নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮১)
অনুবাদ:
সাঁঝের মায়া – বলশেভনী সুমের্কী (রুশ) (১৯৮৪)
পুরস্কার:
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মাঝে কয়েকটি:
পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১) (প্রত্যাখান করেন ১৯৬৯)
বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২)
সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০)
একুশে পদক (১৯৭৬)
নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭)
সংগ্রামী নারী পুরস্কার, চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৮১)
মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২)
বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬)
জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫)
দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬)
স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭)